মৌমন মিত্র
কাচে বড় বড় জলের ঝাপটা। ফোঁটাগুলো জ্বলজ্বল করছে অন্ধকারে। হাওয়ার শন শন শব্দ ভারী কাচ ভেদ করে ঢুকছে কানে। রাত ন’টা। ইমিগ্রেশন শেষ। কাপাচিনো হাতে ডালা খুলে বসেছি ল্যাপটপের। দু’একটা কল, মিটিং আপডেট শেষ করেই দেব ফেসবুক পোস্ট।
আজ পাঁচ বছর পর বইমেলায় কলকাতা ট্র্যাভেল করছি আমি। এই ট্র্যাভেল ডিটেলস একটা পোস্ট, কিছু মন্তব্য, কিছু অর্থহীন সংলাপ, অকারণ ছবি সাঁটানো, মানে মোটের ওপর জনমানসে চর্চা ডিজার্ভ করে না? বলুন আপনারাই।
আর্লি থার্টিজেই যা কাজের চাপ, ফাস্ট লাইফস্টাইল আর জটিল জীবন, সোশ্যাল মিডিয়ার সামান্য অ্যাটেনশন না-পেলে মনটা খচখচ করে বৈকি! কিন্তু,তাই বলে, আমাকে আবার সমাজমাধ্যম-প্রো ভেবে বসবেন না। আমি ইন্সটা, টুইটার কিছুই মেনটেন করতে পারি না তেমন। সময় নেই। ফেসবুকে লগ-ইন করে দু’এক কথার মিষ্টি মিষ্টি ক্যাপশন দিয়ে ছবি পোস্ট করি মাঝেমধ্যে।
”পাঁচ বছর পর কলকাতা বইমেলায় থাকব এইবার। আমার চতুর্থ উপন্যাস ‘ভেজা সাঁঝ’ এর রিলিজ অনুষ্ঠান ফেব্রুয়ারি ১৩ তারিখ। আপনাদের সাদর আমন্ত্রণ রইল। স্টল নম্বর ১৫৬ ।” এয়ারপোর্টের ভেজা কাচ আর কফি কাপের পোট্রেট মোড ছবিও পোস্ট করলাম লেখাটার সঙ্গে। কয়েক মিনিটের মধ্যে শত শত লাইক। অভিনন্দন বার্তা। এঁরা কেউ বইটা কিনবে কি? জানি না। আমি মেলায় যাই না। আন্দাজ করব কীভাবে?
দূরে একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে খুব কাঁদছে। খিদে কিংবা ঘুম পেয়েছে হয়তো। আমার কাছে ছোটদের কান্না বড় বিস্ময়ের। কখন যে ওরা খিদে বা ঘুম পেলে কাঁদে, কখন জেদ, কখন বিরক্তি কে জানে! মায়েরাই বোঝে।
মেয়েটির কান্নায় ফোনের রিং টোন শুনতে পাইনি আমি। পার্স থেকে ফোনটা বের করে দেখি, তিনবার বেজে গিয়েছে। উড়ান। এক্সপেক্টেড কল। আমারই ফোনটা হাতে রাখা উচিত ছিল। হোয়াটস্যাপে ভিডিও কল করলাম। দু’বার রিং হতেই ওপারে উড়ানের হাসি মুখ।
”কোথায় এখন?”
”আর মিনিট দশ পরই বোর্ডিং শুরু।” উড়ান মনের উত্তেজনা চেপে রাখতে পারে না আমার মতো। ব্লাশ করছে। মাথার কাঁচাপাকা ধূসর চুলে আঙুল চালিয়ে বলল, ”এয়ারপোর্টে যাব?” আমি মাথা নাড়লাম। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে মেঘ ঘনিয়ে এল।
কত বছর হয়ে গেছে, মা, বাবা, ছোটন আমাকে আর এয়ারপোর্ট থেকে পিক আপ করে না। আমি একাই উবার ধরে আমার ফ্ল্যাটে চলে যাই। উড়ান ফের ঘুরিয়ে বলল কথাটা, ”আমি একটা অ্যাসাইনমেন্টের জন্য দমদমের দিকটা যাব আগামীকাল।” আমি ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললাম, ”দ্যাটস রিয়ালি নাইস অফ ইউ টু থিংক। আমি চলে যাব। ডোন্ট ওয়ারি। বোর্ডিং এর সময় হয়ে গিয়েছে।”
”হ্যাপি জার্নি, ডার্লিং।” উড়ো চুমু পাঠিয়ে ফোনটা রেখে দিল ও।
শেরিল উডসের মন ভাল করা উপন্যাস পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ব ভেবেছিলাম। চোখে ঘুম এল না। চশমাটা কপালে তুলে আকাশের দিকে তাকালাম। কালো, ঘন অন্ধকার। ফ্লাইটের ডানা ছাড়া কিছুই সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। ভাগ্যিস উইনডো সিট পেয়েছিলাম। দমচাপা লাগছে। মায়ের কথা মনে পড়ছে বার বার।
ড্যারিয়ানের সঙ্গে লিভ-ইন করাটা আমার জীবনের এমন একখানা অপরাধ হয়ে গেল, মা? তা ছাড়া..অ্যাবরশন আমি চাইনি। ভেবেছিলাম বাচ্চাটা নষ্ট করলে ড্যারিয়ান আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না।
মা সতর্ক করেছিল, ”সব খোয়াবি, রুনু। তিন মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এখন আর কলকাতায় আসিস না, মা। চাকরি আগে, না বাচ্চাটা? তা ছাড়া, বাবা তোকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। তুই তো জানিস বাবার কেমন জেদ।”
আমার জেদটাও মা জানত। বুঝেছিল, অফিসের জন্য ট্র্যাভেল আমি করবই, আর অ্যাবরশনটাও হবে। একবার ভালবাসলে আমি সবটা উপুড় করে ঢেলে দিই উল্টোদিকের মানুষটাকে।
কলকাতা থেকে ফেরার পরই আমি প্রজেক্ট ম্যানেজার পোস্টে প্রমোশন পেলাম সেইবার। পেটের ভিতরের ওইটুকু মাংসপিণ্ডও ধুয়েমুছে শেষ। ড্যারিয়ান খুশি হবেই হবে!
শুক্রবার ছিল। প্রমোশনের খবর পেয়ে একটা কাট গ্লাসের হুইস্কি সেট কিনে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরেছি। দামি মদ আর কুচো মুর্গি ফ্রাই সহ সেলিব্রেট করব আজকের দিনটা। ভালবাসব আজীবন। অনেক, অনেক টাকা জমিয়ে ফ্যামিলি প্ল্যান করব। ধীরেসুস্থে।
এইবারটা বড্ড হুড়োহুড়ি হয়ে গিয়েছে। জীবনে আবেগই কি সব? প্রপার প্ল্যানিং করতে হয়। রিয়েলিটি চেক। ড্যারিয়ান শেখাত।
অপেক্ষা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কাউচে। সন্ধে সাড়ে আটটা নাগাদ ফোন বেজে উঠল কয়েকবার। চারটে মিসড কল। ধরফর করে উঠি আমি। চোখ ডলে দেখি, স্ক্রিনে ড্যারিয়ানের নম্বর।
এত দেরি করে না ও। এতবার কল-ই-বা করছে কেন? ভয়ে ভয়ে ওর নম্বর ডায়াল করতেই ড্যারিয়ান চেঁচিয়ে উঠল, ”ফোন ধরছিলে না কেন? আমি আজ যেতে পারব না। ইনফ্যাক্ট, আর কোনওদিনই আমি তোমার কাছে যাব না। আই অ্যাম ইন্টু আ ডিফারেন্ট রিলেশনশিপ। …ক্যান ইউ, ক্যান ইউ প্লিজ লিভ মি অ্যালোন?” আমি হাঁ করে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কী বলব, কী বলা উচিত, কীভাবে ফোনটা কেটে দেব, কিছুই সেই মুহূর্তে মাথায় এল না।
জীবন তো কত কিছুর জন্য প্রস্তুত করে আমাদের। ভাঙনের সময় কীভাবে রিঅ্যাক্ট করব? ঠিক এইখানে এসেই আমরা দিশেহারা হই, ভাবি, এমনটাও হতে পারে? এমনটাই হয়, হওয়ার কথা ছিল, সেটা বুঝেও মনের ভিতর অনুভূতিগুলো প্রসেস করার মতো কঠিন কিংবা এক ধরণের সতর্ক ভাবনা দরকার।
তখন আমি অত বুঝতাম না। কেঁদেছিলাম বালিশে মুখ গুঁজে সারাটারাত। শুধু যে ব্যর্থ প্রেমিকা আমি, তা নয়। মা বাবার কাছেও মনে হচ্ছিল রাতারাতি হেরে গেলাম।
সেই রাতে ফোনটা কেটেছিলাম কিনা, মনে নেই। এটুকু মনে আছে, বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল খুব। সঙ্গে সে কী ঝড়! বার বার ফোনে হারিকেন ওয়ার্নিং দেখাচ্ছিল। সতেরোবার শুনেছিলাম গানটা। শোভা মুদ্গালের গলায়, ‘পিয়া তোরা কেয়সা অভিমান।’
শরীরে নাভির তলার অংশটা আচমকা ফাঁকা মনে হচ্ছিল। একটা শূন্যতা, একটা হেরে যাওয়া, একটা না-পারা। কে যেন গলা চেপে দম বন্ধ করে দিচ্ছিল আমার! সত্যিই, বাচ্চার কান্না, হাসি, রাগ, অভিমান কিছুই বুঝি না আমি। আমি শুধু আমার চাকরি, আমার প্রেম, আমার শরীরটাই…
” ম্যাম, ডু ইউ নিড সামথিং?” হঠাৎ আমার কাঁধে আলতো হাত রেখে প্রশ্ন করল ক্যাবিন ক্রিউ। আমি মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম। ছেলেটা বলল, ” আপনি শিভার করছেন খুব। আর ইউ ওকে?” কাঁপছি আমি? কই না তো! কিংবা হয়তো এমন সময়গুলো কাঁপি আমি। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। চোখে পড়ে না আর।
চাউনিতে স্বাভাবিক হাসি এনে বললাম, ”আই ডু শিভার সামটাইমস। ডোন্ট ওরি। আই উইল বি ফাইন।” ছেলেটা ঘাড় কাত করে অবুঝ চোখেমুখে চলে গেল।
অনিতা বাড়ি পরিষ্কার করে রেখেছে সকালবেলা। মেয়েটা আমি না-থাকলেও যত্নে রাখে ফ্ল্যাটটা। তবে, বদ্ধ ঘরের একটা সোঁদা গন্ধ আছে। নিমাইল, সাবান, নিম স্প্রে, কোনওকিছুই সেই গন্ধকে উড়িয়ে দিতে পারে না। এই স্ট্রং স্মেলটা আমি পাই আমার শাড়ির পরতে পরতেও। বিদেশে ফেরা পর্যন্ত নাকে গন্ধটা লেগে থাকে। যেই সে চলে যাব, চলে যাব করে, অমনি আমার চলে যাওয়ার দিনটাও ঘনিয়ে আসে।
ঘরের মাটিতে পা দিলে যে কী আরাম লাগে! বুক ভরে নিঃশ্বাস নিই। ফুসফুসে গন্ধ আর শ্বাস ভরতে হবে না? একটা সেলফি তুলব?
ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক নেই। ঘরের নেটওয়ার্কের সঙ্গে কানেক্ট করতে হবে। চালের ড্রামে চাল বাড়ন্ত। কৌটোয় ডাল নেই। ইস! অনিতাকে বললে এনে রেখে দিত। আমারই মাথায় আসেনি কথাটা যে, পৌঁছে খাব কী?
নেটওয়ার্ক কানেক্ট করে উড়ানকে কল করলাম। ”কী ব্যাপার? পৌঁছনোর পর কথাবার্তা বন্ধ যে? লাঞ্চ করবে বাইরে?”
উড়ান একটু থমকে উত্তর দিল, ”আরে না না। আমি সময়টা বুঝতে পারিনি তুমি কখন এসে পৌঁছবে দমদমে। এদিকে আর-এক কাণ্ড! ”
”কী কাণ্ড আবার?” আমার ভুরু কুঁচকে যায়।
”উর্বশীর একটা কবিতার বই বেরোবে। তার ব্লার্ব লিখেছে অরিত্র। আরে, এইসব লেখা আমার বাঁ-হাতের খেলা! ও যদি আমাকে একবার বলত… তবে মেয়ের সাহস আছে বলতে হবে। তুমি তো লোক লজ্জায় লাস্ট ইয়ার আমার লেখা ব্লার্বটা অ্যাকসেপ্টই করলে না!”
আমার মাথাটা গরম হতে শুরু করল। আমি চব্বিশ ঘণ্টা সমুদ্রে ভেসে এলাম একমাত্র উড়ানের জন্য। লাস্ট ছ’টা বই রিলিজে আমি কলকাতা শহরে পা রাখিনি। মা বাবাকে ইগনোর করব বলে। এই বছরটা উড়ান এমনভাবে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমাকে ডাকল! আর এখানে আসার পর একবার জানতে চাইবে না যে, কেমন আছি? বাড়িটার কী অবস্থা? কোনও হেল্প লাগবে কিনা…সোজা উর্বশীর প্রসঙ্গে চলে গেল লোকটা?
এই উর্বশীর সঙ্গে গত বছর বইমেলায় ও একটা ঘোঁট পাকিয়েছিল, আমি অত দূর থেকেও বুঝতে পারি। জানান দিইনি উড়ানকে। তার পর উর্বশীর হাজবেন্ড, বয়ফ্রেন্ড খুব চালাকি করে মেয়েটিকে উড়ানের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়। মেয়েটি বোকা। এক কলম লিখতে পারে না। যেই পুরুষ যখন শুতে বলে, শুয়ে লেখা ছাপায়। উড়ানের পত্রিকায় এন্ট্রি নেবে ভেবেই এগিয়েছিল সে।
উড়ানটাও আর-এক গর্ধব! কোনটা প্রেম, কোনটা স্বার্থ আলাদা করতে পারে না। অবশ্য প্রেমে আমরা সবাই গর্ধব। কে যে মন নিয়ে কাছে আসে, কে যে শরীর চায়, কেই-বা এই দুটির সংমিশ্রণ, কে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য পা বাড়ায় টেরই পাই না আমরা। ফার্স্ট ফ্লাশের মতো পারফেক্ট ব্লেন্ড কোথায় পাবেন, বলুন? তাই একটা প্রেম ভুলতে পরের প্রেম, সেটা ভুলতে আর-একটা… এভাবেই নদীর জলের মতো গড়িয়ে যায় সম্পর্কগুলো। কখনও স্রোত, কখনও শান্ত, কখনও জোয়ার ভাঁটার খেলা।
” কিছু বললে না তুমি?” উড়ানের প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরল আমার।
বললাম, ”কী বলব বলো? প্রথমত ইউ ডিডেন্ট ইভেন বদার টু আস্ক, রূপমিতা, ঠিক আছ? খেয়েছ? দ্বিতীয়ত, আমার প্রথম উপন্যাস আমেরিকার বাঙালি কমিউনিটিতে ঘটে যাওয়া একটা মলেস্টেশন কেস। যার কোনও লিগ্যাল প্রতিবাদ হয়নি। আমার লেখাটাই ছিল প্রথম পাবলিক প্ল্যাটফর্ম যেখানে একটা মেয়ে আর-একটা মেয়ের জন্য লড়াই করেছিল। তোমার উর্বশী জীবনে পারবে এ সব লিখতে? লেখে তো ওই ছাতার মাথা আকাশ, নদী, ঝুপুসঝাপুস প্রেম। আগে সাহসের সংজ্ঞাটা বোঝো। এত স্থূল হয়ে গেছ না তুমি ! রাখছি।”
”রাখবে কেন?”
”কেন মানে? কুইনস ম্যানসন যেতে হবে এখন।” আলমারি থেকে একটা পিচ-ইশ প্রিন্টেড সিল্ক শাড়ি বের করে বিছানার উপর রাখলাম। শাড়িটার আঁচলটার কোইয়েজ ব্লু আর মভ পেজলি প্রিন্ট। ভুলেই গিয়েছিলাম শাড়িটা! আমি আবার অন্যমনস্ক।
” রাসেল স্ট্রিট কেন?”
”শুটিং।”
”উফফ! লেখায় মন দাও। হাজারটা করে লাভ নেই, রূপমিতা।”
ঝাঁঝিয়ে উঠি আমি, ”তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আই ক্যান ম্যানেজ। বুক, কোমর, চিবুক, এক পিঠ ঘন চুল, যৌবন। কোনটা নেই আমার? জানি, তুমি মডেলিং করতে বারণ করো কেন। অভ্র তোমার চেয়েও হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, ইন্টিলিজেন্ট। বাড়িতে ছেলে, স্ত্রী রেখে দিনরাত ছুকছুক করবে কচি মেয়েদের পিছনে। অথচ আমি পুরুষবন্ধু করলেই দোষ, না?” টকাস করে ফোনটা কেটে বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিলাম। নরম গদি। ফোনটা অক্ষত রইল। কিন্তু, একটা প্রশ্ন। ও উর্বশীকে সাহসী বলতে আমিই-বা এত রিঅ্যাক্ট করছি কেন?
ও আমাদের শহরে একটা কবিতার অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিল কয়েক বছর আগে। আমি ছিলাম অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। সেইখানেই আলাপ, তার পর উড়ো প্রেম। দু’চার বার চুমু খেয়েছি, ঠিকই। দাগ কাটার মতো তেমন কিছু হয়নি আমাদের মধ্যে।
এমনিতেও বুড়োটে প্রেম আমার অসহ্য লাগে। উড়ান আমার চেয়ে আঠেরো বছরের বড়। মাকে ছোটবেলায় বলতাম, বুড়ো হলেও চলবে না, কচির সঙ্গও সম্ভব নয়, আই নিড আ পারফেক্ট এজ গ্যাপ! ”
” ঘর করার জন্যে অত ভাবলে চলে না…” ধমক দিত মা। তখন মাকে জড়িয়ে বলতাম, “দূর! দূর! ঘর কে করবে? একসঙ্গে বিড়ি টানব, ছাদে এক আকাশের নীচে জড়িয়ে শুয়ে থাকব।” অমনি মা কাপড় মেলা থামিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসত। পরে শান্ত হলে জানতে চাইত মা, ”তুই তখন ইয়ার্কি করলি, না রে?” মা মন থেকে কী শুনতে চায় আমিও ঠিক বুঝতাম না। শুধু মায়ের প্রশ্নের সুরে ভেসে যেতাম, দূরে, অনেক দূরে!
পরের দিন উড়ান অফিসের কাজে মুম্বাই চলে গেল। বলল, ”তুমি প্রথমদিন আমার সঙ্গে বইমেলা যাবে কিন্তু। ফিরছি পরশুই।” তাই হল। বইমেলা শুরু হওয়ার পর তিন চার দিন মেলায় গেলাম না আমি। দুটো কারণ ছিল, এক আমার বইটা স্টলে ঢোকেনি তখনও। দুই, কথা দিয়েছি উড়ানকে। মেলায় ঘুরব এক সঙ্গে।
রবিবার দুপুরে ফিরল উড়ান। বিকেলেই দু’জন ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলাম মেলায়। আমি তো হাঁ! মেলা এত বদলে গেছে এই কয়েক বছরে? বাবার হাত ধরে কত এসেছি। তবে, আজ অন্যরকম। আজ আমি লেখিকা। অনেক পরিণত। সে অনেক ভাবনা চিন্তা করে পা ফেলে। বাবার হাত ধরতে হয় না আর।
ঠিক তার পরের দিন দুপুরে উড়ানের ফোন, ”আজ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে আমার। অফিসেও ছুটি নিলাম। তুমি এত দূর থেকে এসেছ, তুমি দিনগুলো নষ্ট করবে কেন? মেলায় ঘুরে এসো।”
জোর করিনি আমি। বয়স হয়েছে লোকটার। ক্লান্ত লাগতেই পারে। বললাম, ”নো প্রবলেম। আমি চলে যাব। তোমার কিছু লাগলে জানিও, ফেরার পথে…” আমার কথা কেটে ও বলল, “না না। লাগবে না…” হঠাৎ কথা শেষ না-করেই আচমকা রেখে দিল ফোনটা। কে জানে! বাড়ির লোকজন এসে গিয়েছে হয়তো। তারও মিনিট দশেক পর আবার ফোন করল উড়ান।
”তোমাকে অঙ্কিতার কথা বলেছিলাম মনে পড়ে? প্রচ্ছদ এঁকেছিল তোমার-আমার বইয়ের?”
”খুব ভাল করে মনে আছে। তোমার সঙ্গে লটঘট ছিল।” বলে আমি থেমে গেলাম। এইবারও উড়ানের প্রচ্ছদ করেছে ও। আমাকে অ্যাপ্রচ করেছিল। আমি পাত্তা দিইনি। ওর থেকে দশ গুণ বেটার আঁকে আমার আমেরিকার বান্ধবীরা। তারা আমার পরিণত থট প্রসেস বোঝে। ও আমার হাঁটুর বয়সি মেয়ে। আমার লেখার ও কী বুঝবে? হাতই পাকেনি এখনও।
ওপারে উড়ান চুপ। আমিই জিজ্ঞেস করলাম, ”কী হয়েছে তার?”
”আসবে মেলায়। দেখা করতে চায় তোমার-আমার সঙ্গে।”
আমি অবাক হলাম খানিকটা। আমি ওকে পাত্তাই দিই না। হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা করবে কোন স্বার্থে?
”স্ট্রেঞ্জ! বেশ তো! দেখা হবে।” উড়ান কিছু না-বলে ফোনটা রেখে দিল। দিক গে। আমার কী? কথায় কথায় মুখে অন্য মেয়ের নাম। এদিকে রাতে স্কচের বোতল হাতে ফোনে ওই এক গান। কখনও রূপ ডাকবে কখনও মিতা। বলবে, ” তুমিই আমার সব মিতা! আই কান্ট থিংক অফ…।” ন্যাকা! আমি যেন বুঝি না…
ট্র্যাডিশনাল তসর পরলাম আজ। চকোলেট ব্রাউন পাড়। করসেট ব্লাউজ আর বিডসের গয়না। এই ধরণের কনটেম্পোরারি ক্লাসি লুক উড়ান বোঝে? চুলটা টপ নট করছি এমন সময় উড়ানের নম্বর ছলকে উঠল ফোন স্ক্রিনে।
”আমি যাব, বুঝলে। তুমি যাওয়ার পথে আমাকে তুলে নেবে, প্লিজ? ” উড়ানের বাড়ি আমি চিনি। বললাম ”বেশ”। ছবিটা ক্লিয়ার হচ্ছে ধীরে ধীরে। ও শরীর খারাপ নিয়ে আমার সঙ্গে মেলায় যাচ্ছে না। ও যাবে দেখা করতে অঙ্কিতার সঙ্গে। হি কান্ট স্টপ।
মেলায় ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যে অঙ্কিতা চলে এল। আলাপের পরই অঙ্কিতার প্রথম প্রশ্ন, ”তুমি তো কাঁপাও বাংলা বাজার রুপমিতাদি। অর্ক নাকি তোমার প্রেমে পাগল! ওর স্টল আঁকছি, তখনই বলল তুমি কলকাতায় এসেছ। তোমাকে দেখতে উদগ্রীব, অর্কদা।” অর্কর সঙ্গে উড়ানের একটা প্রতিযোগিতা আছে। চাপা টানাপোড়েন। কেন, আমার আইডিয়া নেই। সে সব জেনেই কি মেয়েটা অর্কর প্রসঙ্গ তুলল?
”যত জনই কাঁপাই, তোমার কী? সবে তো আলাপ হল। তুমি আমার পার্সোনাল জীবন সম্পর্কে কথা বলছ কেন?” আমি প্রশ্নটা অঙ্কিতাকে ছুঁড়ে উড়ানের দিকে কটমটিয়ে তাকালাম। ওর হুস নেই। অঙ্কিতার খুব কাছে গিয়ে ও বলল, “তুমি অর্কদার স্টল আঁকছ বিনা পয়সায়? ভাল ভাল!” অঙ্কিতা হঠাৎ উড়ানের পেটে একখানা ঘুষি মেরে বলল, ”ভাল হবে না কিন্তু, উড়ানদা।”
”আমি আসছি ওইদিকটা ঘুরে,” বলে আমি সরে গেলাম। বুঝলাম, দে নিড স্পেস। তার পর মেলায় দূর থেকে দেখলাম ওরা ঘুরছে, চুড়মুড় খাচ্ছে, ছবি তুলছে এক সঙ্গে।
আমি সেদিন ফেরার পথে উড়ানকে বাড়িতে ড্রপ করলাম না। ফ্ল্যাটের অন্ধকার ঘরে সোফায় গা এলিয়ে টিভি অন করলাম দিনের শেষে। আবার কাঁপুনি দিচ্ছে ভিতরে। মাকে একটা কল করব? কী বলব? আমি কলকাতায় এসেছি?
এক বার দু’বার রিং হতেই মায়ের গলা, “কবে এলি, রুনু? ” কাঁদলাম অনেকক্ষণ। মা চুপ করে শুনল আমাকে। বলল, ”কাল দুপুরে কই মাছ রাঁধব? খাবি?” আমি ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম, ”বাবা?” বাবার সাড়াশব্দ পেলাম না। পাশ থেকে ছোটন বলল, ”এত প্রশ্ন করিস না তো। চলে আয়।”
“এমন দিনে…” আবার বৃষ্টি। এমনই রাত এল আবার। আমি সারাটা রাত উড়ানের কথা ভেবে বালিশে মুখচাপা দিয়ে কাঁদলাম সেই একইভাবে। আর কাঁপুনি! কী করে পারল ও? আমি উড়ানের কাছে কোনওদিন শরীর চেয়েছি? এত দূর এসেছিলাম শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে, আর আজ ও আমারই সামনে অঙ্কিতার সঙ্গে… অঙ্কিতা তো কলকাতায় থাকবে, উড়ান! আমি তো কয়েকটা দিন পর চলেই যাব। তখন যা-খুশি করো। অন্তত এই ক’টা দিন অ্যাবসলিউটলি আমাকে দিতে পারলে না?
কখনও কখনও মনে হয় শরীর চাইলে পুরুষদের পক্ষে সুবিধে। মন চাইলেই এরা কেমন মাঝপথে নির্বোধ, বলদ হয়ে যায়!
ফায়ারডোরিং শুরু। কালো মসলিন পরেছি আজ। ব্রাস রঙা বাহারে ব্লক প্যাটার্ন। বুকের ক্লিভেজ, ঝাপসা পেট, কোমরের প্রত্যেকটা ভাঁজে চিরন্তনী মসলিন বিউটি! শাড়িটার ট্রান্সপারেন্সি বাবা খেয়াল করেনি হয়তো, কিংবা করেছে খেয়াল জেনেবুঝে কিছু বলল না। হতেও তো পারে। আজ যা যা ঘটল মায়ের বাড়িতে তার পর আর বাবার কিছু বলার মুখ রইল?
কী কী ঘটল, শুনুন তা হলে। ছোটন ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা চাকরি পেয়ে গেছে। চাকরিটার কথা ছোটন আমাকে বলেছিল আগেই। তা ছাড়া, ছোটনের প্রোফাইলে কেউ কলকাতায় বসে থাকবে না সে কথা বাবা একগুঁয়েমিপনায় স্বীকার না করলেও, মা ঠিক বুঝত মনে মনে।
মাস দুই পর আমারই মতো কলকাতাকে টা টা বাই বাই করে চলে যাবে ভাই। মা বাবা একা থাকবে কীভাবে? এ সব ভেবে বছর দুই আগেই বাবা মায়ের গ্রিনকার্ড করে রেখেছিলাম আমি। বাবা জিজ্ঞেস করল, “তোমার সঙ্গে যেতে হবে? ”
” উপায় নেই বাবা। তোমরা লেট প্যারেন্ট। ভাইকে ক্যারিয়ারে মন দিতে হবে। আমিই একমাত্র অপশন।” আমার গলায় আচমকা আত্মবিশ্বাস। বাবা মাথা নিচু করে বসে রইল। রইল তো রইল।
আমি সন্ধেবেলা বাবা মায়ের টিকিট কেটে সোজা চলে গেলাম মেলায়। ঢুকতেই উড়ানের ফোন, “রানাদা ডিনারে ডাকছে আমাদের আজ। যাবে?” দূরের একটা স্টল থেকে উড়ান দেখেছে আমাকে। আমি লক্ষ করেও বুঝি না বুঝি না ভান করে মুখ ঘুরিয়ে রইলাম অন্যদিকে। শরীরের কোন অংশগুলো পুরুষ হাঁ করে গিলবে আমি জানি। প্রচণ্ড প্রেডিক্টেবেল।
”যাব ডিনারে।” উত্তর দিলাম নরম গলায়।
”কাল থেকে কথা বলছ না কেন, মিতা? একটু যাই তোমার কাছে?”
” আজ অভ্র আসবে। মেলায় শুট করবে আমার কয়েকটা ছবি।”
চেঁচিয়ে উড়ান বলল, ”অভ্র, অভ্র! সস্তার একটা ফটোগ্রাফার। ফ্যাশন ফটোগ্রাফি কারা করে জানো?”
” আমার কাছে বেশ্যার পেশাটাও মূল্যবান। পারব আমি বেশ্যার মতো শরীরকে পুজো করতে? তুমি পারবে প্রতি রাতে বেশ্যাদের অনলাইন ছবি না-দেখে ঘুমোতে?”
” ছি!” বলে উড়ান ফোন কেটে দিল। দিক গে। বয়েই গেল আমার ! সেই সন্ধে থেকেই শুরু।
উড়ান প্রতিটি দিন বইমেলায় আমার জন্য অপেক্ষা করেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখনও আমি অভ্রর সঙ্গে। কখনও অন্য বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম-প্রেম আড্ডা দিয়েছি। হ্যাংলার মতো আমার বুকের দিকে তাকিয়ে রয়েছিল ডিনারে। রানাদা প্রশ্ন করেই বসেছিল, “কী হে, উড়ান? তোমার চোখ যে রূপমিতা থেকে সরছেই না।” কী অস্বস্তিকর বলুন! ডিনারের পর আমার ফ্ল্যাটে যাওয়ার প্রস্তাব পাড়ল ও। জানতাম। এই শাড়িটার সেক্সি লুক, বিচ ওয়েভ হেয়ারস্টাইল, ব্রোঞ্জ রঙের ডিপ কাট ব্লাউজ, ও এড়াতে পারবে না। আমি বলেছিলাম, ”মা এসেছে ফ্ল্যাটে।” মুখ চুন করে চলে গিয়েছিল ও। জানত, ওটা ঢপ।
আমেরিকায় ফেরার পর একদিন টেক্সট এল উড়ানের, ” জ্বালিয়ে গেলে কলকাতায়। কাছে এলে না, তবুও। এতটা ফায়ারডোর কি আমার প্রাপ্য ছিল মিতা?” স্মাইলির সঙ্গে কী লিখি? ভাবতে ভাবতে একটা ফোন এল।
”টেক কেয়ার, ডিয়ার। ইট উইল হিল ওভার টাইম।” বলেই পিছন ঘুরে দেখি, আমার কাঁধে হাত রেখেছে মা।
”কিছু বলবে?” জিজ্ঞেস করলাম।
”ড্যারিয়ান, না?”
মা যেন কীভাবে বুঝে যায় সবটা। বললাম, ”হ্যাঁ।”
”মিটমাট হল তোমাদের?”
”দূর! জুস খাবে এক গ্লাস?” ফ্রিজের হাতল টেনে বললাম, “একবার ভাঙলে জোড়া লাগে, মা? জানো, ইভ্যানজিলিন ওকে ছেড়ে চলে গেছে।”
”নাম নিস না মেয়েটার! ওর জন্য…”
মায়ের কথা থামিয়ে বললাম, ”কারও জন্য কিছু হয় না মা, তৃতীয় ব্যক্তি এসে সম্পর্ক ভেঙে দিলে বুঝতে হয়, সম্পর্কটা কোনওকালেই মজবুত ছিল না।”
”ঠিকই। তা…কী চায় এখন ও?” মায়ের চোখেমুখে মেয়ের সংসার গড়ার ঘোলাটে স্বপ্ন।
”কিছু না। নর্মাল কথাবার্তা। একসময় আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে, ড্যারিয়ান। ও চাইলেও আমি আর সেই জায়গায় নেই।”
” তা হলে কথা বলছিস কেন?”
” ড্যারিয়ানের একটা অপারেশন হয়েছে পরশুদিন। কথা বললে ভাল লাগছে ওর। অতীতের ভুলগুলোও মনের ভিতর ঘুরপাক খাবে। সেটাই আমার প্রতিশোধ। প্রতিদিন ওর গালে আমার একটা করে চড়!”
মুখে কয়েক টুকরো আঙুর ছুঁড়ে আমি কিচেন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, মা ডাকল, “শোন। আমি আর তোর বাবাও তোকে কষ্ট দিয়েছি। অনর্থক। তুই আমাদের শেষ বয়সে এখানে কি নিয়ে এসেছিস একই কারণে? প্রতিদিন একটা করে চড় মারতে আমাদের গালে?”
খানিকটা এগিয়ে পিছনে ফিরলাম আমি, ”বাবা কাল প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি দেখতে যাবে তো? আমার বাড়ি থেকে এক ঘণ্টার বেশি ড্রাইভ। শুয়ে পড়ো। সকাল সকাল বেরোলেই ভাল। ট্র্যাফিক কম থাকবে।”
” উত্তর দিবি না আমার প্রশ্নটার, রুনু?”
”লেখাপড়া শিখিয়ে কর্পোরেট চাকরি করতে বললে তুমি আর বাবা। অনেক টাকা! তাই না, মা? সেই কর্পোরেট দুনিয়ার প্রথম শিক্ষাটাই হল, সত্যিকে সত্যি স্বীকার না করে, গিভ ইট আ ডাউট।” মায়ের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে দোতলায় উঠে গেলাম আমি। সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ স্মাইলির সঙ্গে উড়ানকে লিখলাম, “ঢং!”
শোবার ঘরের আলোটা ডিম করা ছিল। শুয়ে পড়লাম। আজ বালিশে মুখ গুঁজে কান্না নয়।
সহ্য আর সময় জীবনের নৌকার গঠন, পাটাতন বুঝিয়েছে। নাবিক-মাঝিমাল্লা, বাতিঘর, বাতাস, জলের স্রোতের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে লড়তে শিখিয়েছে আমাকে।
কত সহজে চোখে ঘুমে চলে এল সেই রাতে। এত সহজে সহজ হওয়া কী কম কথা! কখনও ফায়ারডোর, কখনও অদেখা চড়। ঝড়ের রাতে আমার শক্ত মাস্তুল! কাঁপে না..
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন