সুরশ্রী ঘোষ সাহা
পাহাড় জানে না সে কোন্ দেশের। নদী জানে না, তার কী নাম। মানুষই পাহাড়কে দিয়েছে দেশ আর নদীকে দিয়েছে নাম। কখনো নদীকে দিয়েছে দুই দেশকে বিভক্ত করে বয়ে যাওয়ার দায়িত্ব।
আজ ভ্রমণকাহিনিতে লিখব এমনই এক দায়িত্ববান নদীর গল্প, পাহাড়ের গল্প, আর অজানা পাহাড়ি চিসাং গ্ৰামের গল্প।
কালিম্পংয়ের এক উঁচু পাহাড়ি গ্ৰাম হল চিসাং। যেখানে মানুষ বসবাস করে পঞ্চাশ ঘর। সবাই নেপালি। আগে কোন হোমস্টে ছিল না, তাই ভ্রমণপিপাসু পর্যটক এসে পৌঁছতে পারেনি কখনো। কোভিডের পরপর নতুন দু’টি হোমস্টে খুলেছে। নাম ‘ওয়াইল্ড উডস রিট্রিট’ আর ‘সিরিন অ্যাক্রস’।
যেহেতু ডুয়ার্স ট্যুরের শেষে জুড়ে নেওয়া হয়েছিল চিসাংকে, তাই এই ‘চিসাং’ গ্ৰামে পৌঁছতে আমাদের অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল। দুই দিন ও এক রাতের জন্য ‘ওয়াইল্ড উডস রিট্রিট’ হোমস্টে আগে থেকেই বুকিং করে রাখা ছিল। এখানে পর্যটকদের জন্য অনেকগুলো ঘর আছে। তারমধ্যে কিছু ঘর সিমেন্টের, শহুরে কায়দায় বানানো। আর একটা ঘর আছে, যেটা পাহাড়ের কোলে ঝুলছে। ঘরের উঠোনে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালেই বিরাট শৈলরাজি দেখতে পাওয়া যায়। ঘরটা সম্পূর্ণ কাঠের। চাটাইয়ের মায়াবী দেওয়াল। সবুজ ঘাসের মতন কার্পেটে মোড়া মেঝে। ছোট্ট ঘরটুকু সুন্দর কাঠের আসবাবপত্র দিয়ে অতি সুন্দর রূপে সাজানো। যদিও পাহাড়ের সৌন্দর্যের কাছে কি মানুষ নির্মিত কোনোকিছুই কাঁধ বরাবর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে? উঁহু পারে না। তাই ঐ ছোট্ট ঘরের পুবদিকের জানলা খুলে দিতে মন চায়। ব্যাস্, পাহাড় তার রং নিয়ে, আর সূর্য তার আলো নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে তৎক্ষণাৎ।
আমি এই ঘরটাই থাকার জন্য বেছেছিলাম।
‘ওয়াইল্ড উডস’ থেকে পায়ে হেঁটে যখন জিরো কিলোমিটার পর্যন্ত ঘুরতে গেলাম, দেখলাম অন্য হোমস্টে ‘সিরিন অ্যাক্রসে’র পজিশনও দারুণ সুন্দর জায়গয়। সামনে খোলা নীল পাহাড়ের ঢেউয়ের বিস্তৃতি আরো অনেক বেশি। কিন্তু মুশকিল একটা আছে। তা হল, সিরিনে পর্যটকদের জন্য থাকার ঘর কম। তাই বুকিং পাওয়া যায় না সবসময়।
‘ওয়াইল্ড উডস’ থেকে পায়ে পায়ে সিরিন অ্যাক্রস ও জিরো কিলোমিটার (প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার শেষ পিচের রাস্তা) পর্যন্ত যখন তখন হেঁটে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলাম। ভাগ্যিস অমন নেটওয়ার্ক বিহীন পাহাড়ি নির্জনতায় মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকার সুযোগ নেই। তাই কম করে দু’তিন বার আমি চক্কর মেরেছি ঐ পথে। সূর্যোদয় ও সূযাস্তটাও মন ভরে দেখেছি জিরো কিলোমিটারের উচ্চতায় উঠে।
‘ওয়াইল্ড উড্সে’ পৌঁছে দুপুরের মেনুতে কী কী খেলাম এবার সেই কথা লিখি। সরু চালের ভাতের সঙ্গে ডাল, আলু ভাজা, অরগ্যানিক রাই শাকের গুন্দ্রুক শ্যুপ। যা ওখানকার এক স্পেশাল ডিশ। আমাদের চেনা পূন্যলতা বা ঢেকি শাক আর ডিমও ছিল পাতে। সন্ধ্যায় প্রথমে সবজির ফ্রাইয়ের সঙ্গে চা, তারপরে বার্বিকিউ চিকেন। রাতের মেনুতে ভাত দিয়ে চিকেন, ডাল আর ফুলকপি – আলু – বিন্সের তরকারি। ভোজন রসিক মানুষের কাছে বেড়াতে গিয়ে খাওয়াটা যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। তাই সেদিকে ওঁরা পুরোপুরি নজর রেখেছিলেন।
চিসাং গ্ৰামের উচ্চতা সাড়ে চার হাজার ফুট। চারিদিকের অপরূপ পাহাড় সারির নিসর্গ সৌন্দর্যের কথা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কোনো দামী ক্যামেরাতেও ঠিকঠাক বন্দি করা যাবে না তার ভুবনমোহিনী রূপ। সবচেয়ে বেশি মেগা পিক্সেলের দুই মানব চক্ষু দিয়ে উপভোগ করতে ইচ্ছে জাগবে শুধু। ভারতের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে যে পাহাড়ের সারি পুবদিকে দেখা যায় তার সবটাই ভূটানের। সেখানে পাহাড় হঠাৎ হঠাৎই যেন আলাদা আলাদা সাজসজ্জা করে। কখনো সাদা তুলোর মতন মেঘের ওড়না পরে। কখনো কুয়াশা ঢাকা ধোঁয়া রঙের পোশাক। কখনো নীল শাড়ি। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশে দেখা যায় নাথুলা পাস রেঞ্জ ও চিনের ডোকালাম। দেখতে পাওয়া যায় ভূটানের মিলিটারি ক্যাম্পের ঘরগুলো আর দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ি নাম না জানা গ্ৰাম। সন্ধ্যার অন্ধকারে যে সব গ্ৰামের আলো জ্বলে উঠলে টিমটিম করতে থাকা তারা-ভরা-আকাশের মতন দেখায় যেন।
আভাকাডো, নাসপাতি, পাম, আখরোট, আরুচা এবং এমন বহু দামী ফলের গাছ আছে চিসাং গ্ৰাম জুড়ে। আছে বিভিন্ন ধরণের অর্কিড। পথের ধারে ধারে অযত্নে নিজের থেকেই ফুটে আছে নানা ফুল। নীল বলের মতন দেখতে একটা ফুল বড্ড দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। নাম জানতে চাইলে শুনলাম, ‘কমল’। নিজের থেকেই হয়ে থাকে সর্বত্র। অবাক হয়ে গেলাম, প্রকৃতির মনের খেয়াল দেখে। কোনো সার নেই, সময় মতন মালির দেওয়া জল নেই, অথচ এতটুকু অহঙ্কার নেই এইসব গাছেদের। বিরাট বড় বড় সুগন্ধি গোল্ডেন শাওয়ার ফুলও ওখানে প্রচুর দেখা গেল। প্লাম গাছে ছোট ছোট ফল ধরে আছে দেখলাম। হরেক রকম হিমালয়ার পাখি শিস দিয়ে সুস্বাগতম করে চলল সারাদিন ধরে। ওড়াউড়ি ও ঝটপটে ভাব দেখে মনে হল, খুব তাড়া ওদের। কেউ বেশিক্ষণ এক ডালে স্থির হয়ে বসার নয়। ওদের ছবি ক্যামেরায় ধরতে হলে আপনাকেই ধীর-স্থির হতে হবে অনেক বেশি।
এখানকার প্রধান ফসল বড় এলাচ। গ্ৰামের বেশিরভাগ সবাই বড় এলাচের ক্ষেতেই চাষ করে। নিজেদের খাবার জন্য অরগ্যানিক শাক সবজি সব চাষ করে নেয়। আর জীবনের বাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মালবাজার থেকে কিনে আনে। সেখানে তিনঘন্টা করে যেতে আসতে সময় লাগে। কাছাকাছি স্কুল আছে, তবে উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যায় ছেলেমেয়েরা। শুনলাম, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তারা কলকাতায় চলে আসে। তারপর ভালো চাকরি পেতে বিদেশ। পাহাড়ে শিক্ষিতদের জন্য যে বিরাট কিছু চাকরির সুযোগ নেই।
আমাদের হোমস্টের মালিক ছিলেন চিসাং হাইস্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক। দেখলাম, শিক্ষক মহাশয় নির্দ্বিধায় পর্যটকের ব্যাগ গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন ও নামাচ্ছেন। কিংবা এগিয়ে আসছেন ভাত – ডালের বাটি-হাতা নিয়ে। মুখে সর্বদাই হাসি মাখা। বললেন, ‘পাহাড়ের ওয়েদার আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। এখন গরম থাকা উচিত, অথচ দেখুন কত ঠান্ডা।’ মোবাইলে তাকিয়ে দেখলাম, ১৮ ডিগ্ৰী তখন। রাতের দিকে পাহাড়ের ১৮° তে ভালোই ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছিল। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ওখানে আর কারুর মোবাইলেই টাওয়ার ছিল না, সৌভাগ্যবশত শুধু আমার নেটওয়ার্কটাই ছিল। আরো একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ঘটেছিল। তা হল কারুর কারুর মোবাইলের টাইম ভূটানের ধরে নিয়েছিল। প্রায় পঁচিশ মিনিট এগিয়ে হাঁটছিল। শিক্ষক জানালেন, ‘এ’বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে প্রচুর স্নো-ফল হয়েছে চিসাং-এ, যা আগে কখনো হয়নি।’
দুপুরে খাওয়ার পরে একটু হাঁটতে বেরুলাম। দেখলাম, চিসাং গ্ৰামের এক পরিবার হেঁটে আসছে। তিনটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আর তাদের বাবা – মা। ভাঙা হিন্দিতে আলাপ জমালাম। শুনলাম জন্ম থেকেই ঐ গ্ৰামে আছে। জানতে চাইলাম, ‘ইস্ গাঁওকে বাহার কাভি ঘুমনে গয়ে?’ উত্তরে শুনলাম, শহর দেখেছেন জীবনে একটাই, তা হল, শিলিগুড়ি।
সন্ধ্যায় একটানা নানা পোকার নানা ধরণের গুনগুন শুনে মনে হচ্ছিল, আশাপাশে নানারকমের ইন্সট্রুমেন্ট বেজে চলেছে। প্রকৃতির স্টেজে বিরাট কনসার্ট চলছে বুঝি।
এবার বলি, নদীর কথা। সীমানা খোলা নদী এখানে ভারত – ভূটানের বর্ডার হয়ে বয়ে যাচ্ছে। এতবছর নদীর দুই দিকের দুই পাহাড়ে যাতায়াত ও সম্পর্ক স্থাপনে বাধা ছিল না। র্নির্দ্বিধায় ভূটানের মেয়ে বিবাহ করে ইন্ডিয়া আসত। ইন্ডিয়ার মানুষ গাড়ি করে ওপারে আত্মীয়ের বাড়িতে যেত। কোভিডের সময় থেকে সেই সবকিছুই বন্ধ। পুরোপুরি সিল করে দিয়েছে বর্ডার। পথে অনেক চেকপোস্ট বসিয়েছে। খুব প্রয়োজনে আইডি কার্ড দেখিয়ে তবেই যাতায়াত চলছে।
অজস্র পাখির ডাকে আর মোরগের ডাকে পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে দেখলাম, কাচের জানালার বাইরে আলো ফুটে আছে। ঘড়িতে সাড়ে চারটে। গা মাথা চাপা দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লাম। উড়ো মেঘের মধ্য দিয়ে হেঁটে পৌঁছলাম জিরো কিলোমিটার পয়েন্টে। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে ভেসে আসছিল ঝরণার শব্দ, পাখিদের কিচিরমিচির, পাহাড়ের গায়ের ঝোপ থেকে পোকার ডাক।
এমন পোকার ডাকও শুনতে পেলাম, মনে হল যেন আড়ালে বসে কেউ ‘ওম’ ধ্বনি উচ্চারণ করে চলেছে।।
এবার বলি, কীভাবে যাবেন চিসাং। কালিম্পং জেলার তোদে তাংতা পঞ্চায়েতের ভিতর অবস্থিত চিসাং গ্ৰাম যেতে হবে গাড়ি করে। এছাড়া কোনো উপায় নেই।
কবে যাবেন – সারা বছরই যাওয়া যেতে পারে। সারা বছর পাহাড়ের আলাদা রকমের সৌন্দর্য।
কোথায় থাকবেন: সিরিন অ্যাক্রস কিংবা ওয়াইল্ড উডস রিট্রিট। আগে থেকে বুকিং করে যেতে হবে। সিরিন অ্যাক্রসের ফোন নম্বর ও মেইল আইডি ইন্টারনেটে উপলব্ধ। ওয়াইল্ড উডস হোমস্টের ফোন নম্বর – +91 8900370801 / 825017511 / 0097577853328
www.chisanghomestay.com
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব সুন্দর লিখেছিস। দারুণ বর্ণনা সঙ্গে ইনফরমেশন।
খুব ভালো লাগলো।
ঝরঝরে লেখা, সাথে ছবিগুলো বাড়তি পাওনা।
আনন্দ পেলাম।
খুব সুন্দর বর্ণনা! মানস ভ্রমণ হলো আমার।ছবিগুলোও সুন্দর।
খুব আনন্দ পেলাম, মহুয়া দি।