short-story-buer-chhobi

বুয়ের ছবি
রম্যাণী গোস্বামী


বু আজ ভোররাতে মারা গেল।

বু মানে আমার ছোটমাসি। ডাকনাম ‘কুটি’ হলেও ছোটমাসিকে ভালোবেসে আমরা ভাইবোনেরা সবাই ‘বু’ বলেই ডাকতাম। বুয়ের বয়স এখনও তেমন কিছু হয়নি, অন্তত আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো তো নয়ই। সে ছিল ভীষণ প্রাণবন্ত, হাসিখুশি একটা মানুষ। রান্নায়, সাংসারিক কাজে, অতিথিপরায়ণতায়, সেলাই ফোঁড়াইতে চূড়ান্ত পারদর্শী। গায়ের রং শ্যামলা। হাসলে দুই গালে টোল পড়ে আর সেই সঙ্গে ঠোঁটের দু’প্রান্তে দুটো গজ দাঁত দেখা যায়।

ছোটবেলায় আমি নাকি মাত্রাছাড়া রকমের বু ন্যাওটা ছিলাম। কোল ছেড়ে কিছুতেই নামতে চাইছিলাম না বলে বিএ পরীক্ষায় বাংলা অনার্স পেপারের দিন সেন্টারে পৌঁছতে ছোটমাসির পনেরো মিনিট লেট হয়। সেই সময় অনার্স পেপারগুলো চার ঘণ্টার ছিল। শুনেছি যে সেই চারটে ঘণ্টা হেঁচকি তুলতে তুলতে একনাগাড়ে আমি এত কেঁদেছিলাম যে বিকেলের দিকটায় গায়ে হাই টেম্পারেচার এসে গেছিল। কোনওমতে পরীক্ষার খাতা জমা করে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরেই বু আমাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল মায়ের কোল থেকে। সেসব অনেক ছোটবেলার কথা। আমার অত ভালো মনেও নেই।

তবে আজ খুব ভোরে যখন মেসোর ফোন থেকে মায়ের কাছে ওই ভয়ঙ্কর খবরটা এসে পৌঁছল তখন ছেলেবেলায় দেখা একটা দৃশ্য যেন জীবন্ত হয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে ছোটমাসির। তরুণী বু মেসোদের হেলাপাকড়ির বাড়ির রান্নাঘরে গ্যাসের উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য চিতল মাছের মুইঠা রান্না করছে। সেই সঙ্গে অনবরত কথা ও হাসির দমকে ওর হাতের বালা আর কানের সোনার ঝুমকো দুটো টুংটাং টুংটাং নড়ে উঠছে। আমি এক হাতে টেনিস ব্যাট অথবা লাট্টু নিয়ে দাঁড়ানো। তখন আমি হাফ প্যান্ট। ক্লাস সেভেন।

তারপর বহুকাল ছোটমাসির সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। যা যোগাযোগ তা ওই ল্যান্ডফোনেই। একেবারে দেখা হল যখন আমি একজন ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট। সেই সময়ের ঘটনাগুলো বলার আগে তারও আগেকার কিছু কথা এইবেলা বলে নেওয়া দরকার। যা পুরোপুরি আমার ক্যামেরা সম্পর্কিত।

আমার ছবি তোলার শখ স্কুল লাইফ থেকেই। বাবার কাছে সেকালের পুরনো এক ফিল্ম ক্যামেরা ছিল। সেটাতেই প্রথমে ছবি তুলে আমার হাত মকশো করা। তবে প্যাশন থাকলে কী হবে? ফিল্মে ছবি তোলা, প্রিন্টিং, এসব কাজে ঝক্কি অজস্র। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে বাড়ি থেকে উপহার পেলাম একটা দামী ডিএসএলআর। যাকে আমার ড্রিম ক্যামেরাই বলা যায়। সেটা গলায় ঝুলিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিজেই জাস্ট মুগ্ধ! এই লুকের সামনে কোথায় লাগে শাহরুখ, ঋত্বিকদের? বুকের কাছে লেপটে থাকা কালো মডেলের ভারি জিনিসটা যেন আমার চরিত্রে অন্যরকম একটা ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছে। নিখুঁতভাবে সেভ করা গালে হাত বুলিয়ে আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে মনে হল এই দিয়েই এবার আমি রাজ্য জয় করব।

প্রবল উৎসাহে কালবিলম্ব না করে প্রথমেই চলে গেলাম আমাদের বাড়ির কাছেই গঙ্গার ঘাটে। ক্যামেরা বডিতে প্রাইম লেন্সটা সেট করলাম ল্যান্ডস্কেপ তুলব বলে। তারপর শুরু হল আমার ছবি তোলা। এ তো আর কিপটের মতো চেপে চেপে ফিল্ম খরচ করার গল্প নয়, তাই আনাড়ির মতো যা দেখছি তাই তুলে চলেছি। ফেরীঘাটে অপেক্ষা করা মানুষজনের হালকা জটলা। চলন্ত লঞ্চ। দূরে নোঙর করা জাহাজ। ঘাটের সিঁড়িতে কিংবা গাছতলায় নির্জনতার খোঁজে বসে থাকা প্রেমিক প্রেমিকার জুটি। নদীর কিনারে সার বেঁধে রাখা রঙিন নৌকোগুলো আর এসবের ব্যাকগ্রাউন্ডে দ্বিতীয় বিদ্যাসাগর সেতু। এই হল আমার সাবজেক্ট।

মিড মার্চ। বাতাসে রোদের তেজ প্রবল না হলেও কিছুটা গরম আছে। এই দুপুরে লোকজনের ভিড় তেমন নেই। ইতিমধ্যেই বেশ ক’বার চা খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিয়েছি। ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে যাওয়ার পর আমার ছবি তোলার প্রাথমিক উৎসাহ থিতিয়ে পড়ল অনেকটাই। একা একা গলায় ভারি ক্যামেরা আর পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে কাঁহাতক ঘুরে বেরানো যায়। নিশ্চয়ই খুব হাস্যকর দেখতে লাগছে আমাকে।

ধুস, এর চাইতে বিকেলের দিকটায় কোনও বন্ধুকে সঙ্গে করে নিয়ে আসলেই ভালো হত। তখন এই এলাকাটা জমজমাট থাকে। নদীর বুকে সানসেটের বেশ কয়েকটা ছবিও পাওয়া যেত আর সঙ্গে আড্ডাটা হত ফাউ। কিন্তু আনবটা কাকে? বাসব গেছে মেদিনীপুরে, ওর দেশের বাড়ি। তন্ময়রা তখন কফি হাউজে বসে কাব্য কপচাবে। লিটিল ম্যাগাজিন করবে। রাজা উজির মারবে। শালারা ওই সময় হাজার ডাকলেও আর যাই হোক গঙ্গার ঘাটে আড্ডা মারতে আসবে না।

চতুর্থবার দুধ চায়ের অর্ডার করে পাকুড়তলাটার নিরিবিলি বেঞ্চে বসে এক এক করে ডিসপ্লেতে এতক্ষণ ধরে তোলা ছবিগুলো দেখলাম। মাইরি বলছি, একটা ছবিও পছন্দ হল না। রোদের জন্যই কি ছবিগুলো এমনি জ্বলে গেছে? শাটার স্পিড বাড়াতে হত? আইএসও খানিক কমাতে হত কি? কী জানি। এইসব খানদানি ক্যামেরার সেটিং টেটিংগুলো এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না। ক্যামেরার সঙ্গে দেওয়া ম্যানুয়ালটা ভালো করে পড়ে দেখতে হবে। বেজার মুখে বেঞ্চের পাশে রাখা কাপে চুমুক মেরে দেখলাম যে চায়ের স্বাদটাও ভারি পানসে।

চা’টা কিন্তু ফাটাফাটি ছিল। ওটা আসলে ছিল আমার ব্যর্থতার স্বাদ। তিতকুটে আর কষাটে।

এরপর তোড়জোড়ের সঙ্গে ইউনিভার্সিটির ক্লাস আরম্ভ হয়ে গেল। আর আমার সাধের ক্যামেরা বাক্সবন্দী হয়ে সেঁধিয়ে গেল মায়ের আলমারির একদম নীচের তাকে। ইন ফ্যাক্ট যেন ভুলেই গেলাম ওটার কথা। আবার ওকে মনে পড়ল যখন পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি।

পরীক্ষার পর আমি একা একাই বেড়াতে চলে গেলাম হেলাপাকড়ি। ছোটমাসির কাছে। এবং সঙ্গে গেল আমার ক্যামেরা।




বু এতদিন পর আমাকে দেখে কী যে খুশি হল তা আর বলবার নয়।

কত বড় হয়ে গেছিস তুই টুটুল! এইটুকু দেখেছিলাম তোকে। আর তোর হাতে ওটা কী রে? কড়াইতে আমার জন্য মালপোয়া ভাজতে ভাজতে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল বু।

আমি কোনও জবাব না দিয়ে সোজা বুয়ের দিকে ক্যামেরা তাক করে খচাত করে শাটার টিপে দিলাম। এই পোর্ট্রেট লেন্সটা নতুন কিনেছি। এতদিন আমি ছবি তুলিনি বটে। কিন্তু কলেজের এক সিনিয়র পেশায় ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার বাসবদার পাল্লায় পড়ে বিস্তর বইপত্র ঘেঁটে এবং নানা এগজিবিশনে ঘুরে ঘুরে বিখ্যাত ফটোগ্রাফারদের তোলা ছবি দেখে ফটোগ্রাফির বেসিক নলেজ নেওয়া হয়ে গেছে। হাত স্টেডি ছিল। তা দেখলাম ছবিটা মন্দ ওঠেনি।

শান্ত মফস্বলগুলোর একটা নিজস্ব টিউন, একটা রিদম আছে। হেলাপাকড়ি জায়গাটা আমার বেশ ভালো লেগে গেল। সকালে যখন গোটা বাড়ি ঘুমে কাদা, আমি ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তালগাছ ঘেরা নিথর দিঘি পেরিয়ে, লাল রঙের শিবমন্দিরটাকে ডান হাতে রেখে, ছোট্ট সাঁকো পার করে সমস্ত রকমের নির্জনতাকে টপকে আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই সেই দিকটায়, যেখানে লোকালয়ের ছোঁয়া পাই। হাট বসেছে অথবা মেলা লোকজনের ভিড়ে উপচে পড়ছে বাজার।

ইদানীং খুব টের পাই যে প্রাকৃতিক দৃশ্যেরা আমাকে আর টানছে না সেভাবে। বরং টিনের চালাঘরের ছাউনির তলায় পুড়ে চারপাশ কালো হয়ে যাওয়া বিরাট ডেকচিতে দুধ-চা ফোটাতে ব্যস্ত লোকটি, খবরের কাগজ হাতে কাঠের বেঞ্চে অপেক্ষা করা তার রেগুলার খদ্দেররা, একটিমাত্র সেলুনে রোজ কাঁচি হাতে অখণ্ড মনোযোগে চুল কাটে যে, সেই নাপিত, হাটে বিভিন্ন পসরা নিয়ে আসা খেটে খাওয়া মানুষজন, প্রাইমারি স্কুলের পথে ছেঁড়া ব্যাগ পিঠে মলিন পোশাকের বাচ্চাগুলো, এরাই আমাকে আকর্ষণ করছে বেশি। ওদের প্রত্যেকের নিজের নিজের গল্পগুলোকে আমি যেন আমার লেন্স দিয়ে ধরতে চাইছি। ছোটমাসিদের এখানে বেড়াতে না এলে আমি কখনও জানতেও পারতাম না যে আমার ছবি তোলার আসল ইন্টারেস্টের জায়গাটা ঠিক কী। হ্যাঁ। ক্যান্ডিড আর স্ট্রীট ফটোগ্রাফি।

এদিকে সকাল সকাল আমার সাড়া পেলেই বু ঘুমচোখে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে আমার জন্য চা বানিয়ে আনে। সুদৃশ্য ডাইনিং টেবিলে বসে টি পট থেকে কাপে চা ঢেলে দুজনে মিলে একসঙ্গে গল্প করি। সঙ্গে থাকে বুয়ের হাতে তৈরি হোমমেড বিস্কিট।

আহ্‌, বু! তুমি আবার উঠলে কেন শুনি? আমি তো বাজারে গিয়েই চা-টা খেতে পারি। শুধুশুধু…

আমার ধমককে বু কোনও পাত্তাই দেয় না। হেসে উঠে বলে, ইস, ভারি তো শাসনের বহর দেখছি। বল না? কেউ জুটেছে নাকি? এখন তো ইউনিভার্সিটি। কলকাতায় তোর কোনও মেয়ে বন্ধু নেই?

ধ্যাত। বন্ধু থাকবে না কেন? কিন্তু তুমি যেমন ভাবছ তেমন কেউ নেই। বুয়ের দিকে তাকাতে আমি লজ্জা পাই। চায়ের কাপে মনোযোগী হয়ে পড়ি।

বাপরে! এখনও যে ছোটবেলার সেই লাজুক টুটুল? কথায় কথায় লজ্জা? আচ্ছা আচ্ছা, দেখবখন। কতদিন এমন লাজুক হয়ে থাকা হয় বাবুর। কাউকে যখন মনে ধরবে, তখন দেখবি মনের সব আড় ভেঙে গেছে।

মেসোর এখানে ফার্নিচারের দোকান আছে। বাড়ির সমস্ত আসবাবপত্র তার নিজের ডিজাইনে সেরা কারিগরের হাতে তৈরি। টিক উডের পালিশ করা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকা দুই বেণী করা ছোটমাসিকে ভোরের নরম আলোয় দেখাচ্ছে ঠিক একজন কিশোরীর মতো। মুখে দুষ্টু হাসি। দুই গালের টোল আর গজ দাঁতদুটো ঝলসে উঠছে জানলার সাদা রেশমের পর্দা ভেদ করে আসা স্নিগ্ধ আলোয়। ভরাট হাতের আঙুলগুলো আলগোছে ধরে আছে ফিনফিনে বোন চায়নার লেবু রঙা চায়ের কাপের হাতল। শাড়ির আঁচলটা ভারি নান্দনিকভাবে লুটিয়ে পড়েছে মেঝে অবধি।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা খণ্ড দৃশ্যের জন্ম হয় আর আমার হাত আপনা থেকেই চলে যায় ক্যামেরায়। আমি প্রায় সাত আটখানা ছবি তুললাম বুয়ের। যেন কোনও ঘোরের মধ্যে থেকে। তারপর সেই ঘোরকে সঙ্গী করেই ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম রোজকার মতো।




হেলাপাকড়ি থেকে কলকাতায় ফিরে আসার সপ্তাহ দুয়েক পর রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে মা আমাকে জিগ্যেস করল, হ্যাঁ রে? তুই কি কুটি’র কোনও ছবি তুলেছিলি এবার ওদের ওখানে গিয়ে? দুপুরে ও ফোনে বলছিল। দারুণ তুলেছিস নাকি ছবিগুলো? আবার বলেও এসেছিস যে ফিরে এসেই বাছাই করা সেরা ছবিটা প্রিন্ট নিয়ে ফ্রেমে বাঁধিয়ে ওকে পাঠাবি? সেজন্যই খোঁজ নিচ্ছিল। বলল, কই? কিছু তো এলো না? টুটুল কি তাহলে পাঠাতে ভুলে গেল? কোন ছবিটা রে? আমাকে দেখাস তো একবার।

বুয়ের ছবি? ওহ্‌ হ্যাঁ। কয়েকটা তুলেছিলাম তো। আমার মনে পড়ল ছবিগুলোর কথা। মনে পড়ে গেল সেই সকালটার কথাও।

আচ্ছা দেখাব, দেখাব। অন্যমনস্ক হয়ে রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে মায়ের কথার জবাব দিলাম। আমার চোখ আঠার মতো সেঁটে ছিল টিভির পর্দায়। সেখানে ধোনি হাঁকিয়ে একখানা ছয় মারল। নয় বলে আর চব্বিশটা রান করতে পারলেই আমরা জিতে যাব। উফ্‌, এমন এক্সাইটিং মুহূর্তে মা কী এত বকবক করছে?

মা আবার বলল, কুটি তোকে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেই ফোন করতে বলেছিল। খাওয়া হয়ে গেলে মনে করে একবার করিস বাবা।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, করব। নিশ্চয়ই করব।

টিভির দিকে তাকিয়ে এবার আমি হাহাকার করে উঠলাম। যাহ্‌! ধোনি আউট! সে রাতে যথারীতি আমি ছোটমাসিকে ফোন করতে বেমালুম ভুলে গেলাম। পরদিনও ভুললাম। তার পরদিনও। তাছাড়া পার্ট টুর ক্লাস আরম্ভ হয়ে গেছে। অনেকটা সময় চলে যাচ্ছে ক্লাসরুমে আর লাইব্রেরিতে। হেলাপাকড়ির ওই ছবিগুলো ক্যামেরার মেমোরি কার্ডেই মধ্যেই রয়ে গেছে। যাচ্ছি যাব ভেবেও বাসবদার বাড়িতে গিয়ে ওর ডেস্কটপে ছবিগুলো ট্রান্সফার করে একটা ফোল্ডারে স্টোর অবধি করা হয়নি। এমন আলসেমি।

এর মাসখানেকের মধ্যেই একটা দারুণ সুযোগ এল। আমি রিসেন্টলি যে নর্থ কলকাতা ফটোগ্রাফিক অ্যাসোশিয়েশনে জয়েন করেছি সেখানে আনকোরা ফটোগ্রাফারদের বেশ কিছু ছবি নিয়ে বড় করে একটা এগজিবিশন হবে। সেই উদ্দেশ্যে ছবি চাওয়া হয়েছে বিভিন্ন থিমের উপর। কম্পিটিশনে একজন মোট আটখানা ছবি পাঠাতে পারবে, তার মধ্যে থেকে তিনটে ছবি সিলেক্ট করবেন বিশিষ্ট মেন্টররা।

বাসবদার সঙ্গে আলোচনা করে আমি তৎক্ষণাৎ বেছে নিলাম স্ট্রীট ফটোগ্রাফিকে। বন্ধুরাও দারুণ উৎসাহ দিল। শনি আর রবিবার নাওয়া খাওয়া ভুলে আমরা কজন শখের ফটোগ্রাফার উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ালাম আর ছবি তুলে গেলাম পাগলের মতো। ক্যামেরার মেমোরি কার্ডে পুরনো ছবির উপরে আরও প্রায় হাজারখানেক নতুন ছবি এসে ভিড় জমাল। তারপর একদিন সব ঢালাও ট্রান্সফার করা হল বাসবদার ডেস্কটপে, পোস্ট প্রসেসিংয়ের জন্য। আমার বাড়িতে তখন কম্পিউটার নেই।

বাসবদার ঘরে বসেই এক রবিবার গোটাদিন ধরে প্রচণ্ড খেটেখুটে নর্থ কলকাতার আটটা বাছাই ছবি প্রসেস করার পর ই-মেইলে পাঠিয়ে দিলাম কম্পিটিশনের মেইল আইডিতে। তিনদিন পরেই রেজাল্ট। ওই তিনটে রাত ভালো করে ঘুমোতে পারিনি আমি।

মেসোর কাছ থেকে আজ সকালে ফোনটা আসার পর থেকেই মা পাগলের মতো কান্নাকাটি করছে। সুস্থ মানুষটা। রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমোতে গেল। ঘুমের মধ্যেই কার্ডিয়াক অ্যাটাক। এও সম্ভব?

হয়। হয় এমন। এগুলো সব ওই পোস্ট কোভিড সিম্পটম। তোমার বোনের তো কোভিড হয়েছিল, মনে নেই? বাবা বলল।

হ্যাঁ। কিন্তু সে তো কতদিন আগেকার কথা। তার জন্য? না না। আমি এটা মানতেই পারছি না। মা উত্তর দিল ধরা গলায়।

আমিও ঠিক এমনিভাবেই সেদিন মেনে নিতে পারিনি নিজের চোখকে। কম্পিটিশনের ফাইনাল প্যানেল লিস্টে আমার নাম নেই! এ যে ইম্পসিবল! ওদিকে কত এলেবেলে ফটোগ্রাফার, ক্যামেরাটা যারা ঠিকমতো ধরতেও জানে না, তাদের নামগুলো সব লিস্টে একের পর এক জ্বলজ্বল করছে।

রেজাল্ট দেখা ইস্তক রাগে আমার ব্রহ্মতালু পুড়ছিল। বন্ধুরা ভয়ে কাছে ঘেঁষতে পারেনি আমার ওই খিচড়ে যাওয়া মেজাজ দেখে। লুজার। আমি একজন লুজার। দুপুরের দিকেই বাড়ি ফিরে এলাম এই প্রথমবার ক্লাস বাংক করে। বাবা এই সময়টা অফিসে থাকে। মা’ও বাড়িতে ছিল না। হয়তো বাজারে টাজারে গেছে। নিজের ঘরের দিকে এগোচ্ছি, শুনতে পেলাম ডাইনিং হলে আমাদের ল্যান্ডফোনটা বাজছে।

হ্যালো – বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো বুয়ের উচ্ছ্বসিত স্বর, টুটুল তুই? বাব্বা, কতদিন তোকে ফোন করতে বলেছি, করিস নি। এত ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে? হ্যাঁ রে? আমার সেই ছবিটা আর পাঠালি না তো?

কোন ছবি?

আরে মনে নেই? সেই যে তুলেছিলি…

ওহ্‌, ওগুলো তো সব ডিলিট হয়ে গেছে। রুক্ষস্বরে ছোটমাসিকে মাঝখানে থামিয়ে দিলাম আমি।

সেকী! ডিলিট হয়ে গেছে মানে? তোর ক্যামেরায় ছিল তো ছবিগুলো! আমায় দেখালি!

হ্যাঁ। কিন্তু কম্পিউটারে ট্র্যান্সফারের সময় অ্যাক্সিডেন্টালি সব মুছে গেছে। বু, আমি এখন রাখি? একটু বেরব। কাঠ কাঠ স্বরে কথাটা বলে দুম করে ছোটমাসির মুখের উপরে ফোনটা নামিয়ে রেখে ঝড়ের বেগে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমার মাথাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। যত রাগ গিয়ে পড়ল প্রাণের চাইতে প্রিয় ক্যামেরাটার উপরে।

ছুঁড়ে ভেঙেই ফেলব ওটা আজ। বেকার বেকার বাজে কাজে সময় নষ্ট!




আজ এতদিন পর আমার ল্যাপটপ খুলে পাগলের মতো ফোল্ডারগুলোর মধ্যে খুঁজে যাচ্ছি বুয়ের সেদিনের সেই ছবিগুলো। এই ল্যাপটপটা কেনা হয়েছিল মাস্টার্স করতে করতেই। মনে আছে এটা কেনার পর একদিন বাসবদার মেশিন থেকে আমার ডিএসএলআরে তোলা যাবতীয় ছবিগুলোর র-ফাইল পেন ড্রাইভে ভর্তি করে এনে ঢুকিয়েছিলাম এতে। প্রায় পাঁচ হাজার ছবির ভিতরে ছোটমাসির সেদিনের ছবিগুলোর একটাও নেই? এও কি সম্ভব? অ্যাট লিস্ট একটা দুটো তো থাকবে?

এখন অফিসের কাজকর্ম সব স্মার্টফোনেই সারা হয়ে যায়। খুব প্রয়োজন ছাড়া ল্যাপটপটায় হাত দেওয়া হয় না। ক্যামেরার মতো এটাও ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকে ধুলো মেখে। এবার আমার অন্যরকম সন্দেহ হল। সত্যিই কি সেদিন ছবিগুলো এনে এখানে রেখেছিলাম? নাহ্‌, কিচ্ছু মনে পড়ছে না। তা কমসে কম সাত আট বছর আগেকার কথা তো বটেই। বু তো আচমকা না ফেরার দেশে চলে গেল। অন্তত সেদিনের ওই ছবিগুলোর একখানা আমার কাছে রয়ে যাক। নাকি নিজের দোষে সেটাও হারিয়ে ফেলেছি আমি?

অসহায় আঙুলের ক্লিকে আমি তন্নতন্ন করে খুঁজছিলাম। অজস্র পিক্সেলের ভিড়ে আমার প্রিয় মানুষটাকে।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

4 thoughts on “short-story-buer-chhobi

  1. চমৎকার গল্প। ভাল লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *