ফিচার
অভীক মুখোপাধ্যায়
‘এটা প্রথম বই। এ হল সেই সময়ের কথা, যখন কিচ্ছু ছিল না। না মানুষ, না পশু, না পাখি, না মাছ, না কাঁকড়া, না গাছপালা, না পাথর, না গুহা। পৃথিবীর তল তখনও উন্নত হয়নি। চারিদিকে শুধু সমুদ্র আর সমুদ্র।
আকাশ ছিল, কিন্তু ধ্বনির জন্ম হয়নি। যখন কিছুই ছিল না, তখন শুধু ছিলেন দুই স্রষ্টা – গুকুমাজ আর তেপু। তাঁরা স্বর্গে বাস করতেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে সৃষ্টিকার্যে হাত দিলেন। প্রথমেই তৈরি করলেন পৃথিবীর ধরাতল। পাহাড় এল, ঝর্না, নদী সব জন্ম নিল। সৃষ্টি হল পশুপাখির দল। সব শেষে সৃষ্টি হল মানুষের।
প্রথমে মাটি দিয়ে, তারপরে কাঠ দিয়ে এবং মাংস দিয়ে। কিন্তু মানবের কুটিলতার কারণে পৃথিবীতে প্রলয় এল, আবার জলের তলায় চলে গেল সমগ্র বিশ্ব। সকল মানুষের সলিল সমাধি ঘটল।
ঈশ্বর আবার ভুট্টার আটা দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের গড়লেন।’
–মায়া সভ্যতার আদিগ্রন্থ ‘পোপোল বুহ’ থেকে উদ্ধৃত।
***
আমেরিকা মহাদ্বীপে প্রথম মানুষ কবে এসেছে এই নিয়ে হাজার তর্ক রয়েছে। মনে করা হয় আমেরিকা হল নতুন দুনিয়া, মানুষের পায়ের ছাপ সেখানে অনেক পরে পড়েছে। প্রায় চোদ্দ হাজার বছর আগে এক হাজার মাইল চওড়া বেরিং সেতু পেরিয়ে মানুষ সাইবেরিয়ার পথে প্রথম যে জায়গাতে পা রেখেছিল সেটাই আজকের কানাডা। কাল এবং জলের স্রোতে সেই সেতু পরে জলনিমগ্ন হয়ে যায়, বাকি পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের শেষ সম্পর্কটুকু তখন ছিন্ন হয়ে পড়ে। এটা গেল একটা থিওরি। আবার নতুন গবেষণা ইঙ্গিত করছে যে, এই ঘটনার আগে থেকেই আমেরিকা মহাদ্বীপে মানুষ উপস্থিত ছিল। অনুমান করা হয় যে, নৌকাতে করে আফ্রিকা, ইউরোপীয় ভূখণ্ড কিংবা দক্ষিণ এশিয়া থেকে গিয়েছিল মানবদল।
সে যেখান থেকেই গিয়ে থাকুক না কেন, অধুনা কানাডা কিংবা উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ অংশই কিন্তু সেভাবে বাসযোগ্য ছিল না। তাহলে তারা করল কী? একটু নেমে এল। মধ্য কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার জমিতে, যেখানে আবহাওয়া, জলস্রোত, অরণ্য মোটামুটি অনুকূলের কাছাকাছিই।
২০০৭ সাল। ডুবুরিদের একটি দল সাগরতল থেকে মেক্সিকোতে একটি করোটি উদ্ধার করল। কত পুরোনো? না ১১,০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের কোনও এক মানবীর করোটি। মনে করা হয় সেই মানবী ছিল আমেরিকা মহাদ্বীপের প্রথম মানবদলের সদস্যা। অবশ্য এটা অনুমান মাত্র। কারণ তার থেকেও প্রাচীন পাথরের অস্ত্রের সন্ধান মিলেছে। তবে মানব রূপে উপস্থিতির একটি অকাট্য প্রমাণ হল ওই সুকুমারীর করোটি।
করোটি দেখে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন মেয়েটি হয়তো দক্ষিণ এশিয়া থেকে গিয়েছিল। তবে তা প্রামাণ্য সত্য বলে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এখন এশিয়া থেকে নৌকা করে অত দূরে গিয়েছিল কিনা কে জানে? হতে পারে এশিয়া থেকে সাইবেরিয়ার পথ ধরে বেরিং সেতু পেরিয়েই গিয়েছিল। তবে এশিয়ান কন্যে ছিল জানতে পেরে গর্ব যে একটু আধটু হয়নি তা আর বলি কী করে?
বিখ্যাত লেখক নন্দিতা বাগচি আমেরিকাকে বলেছেন ‘কলম্বাসের নতুন পৃথিবী।’ আমি সেখান থেকে ধার নিলাম ‘নতুন পৃথিবী’টুকু। সেই নতুন পৃথিবীটাও কিন্তু পুরোনো জগত হিসেবে খুব মন্দ ছিল না। মানুষ পাথরে পাথরে ঘষাঘষি করে আগুন জ্বালছিল, পাথর কিংবা ধাতব অস্ত্র নির্মাণ করছিল। গহন অরণ্যে বিশাল হস্তিবৎ গোম্ফোথর আর শ্লথদের সঙ্গে লড়াই করার জন্যে হাতিয়ার তৈরি করছিল তারা। মন কৃষিকাজ শিখছিল। নির্মিত হচ্ছিল নতুন সভ্যতা এবং সংস্কৃতি। খ্রিষ্ট জন্মের ১৫০০ বছর আগে যখন সিন্ধু উপত্যকার বুকে, মেসোপটেমিয়াতে কিংবা মিশরে সভ্যতা বিকশিত হচ্ছিল, তখন আমেরিকাতেও লকলক করছিল ভুট্টার খেত। পাথর দিয়ে ত্রিকোণাকার মন্দির বানিয়ে নিজেদের ইষ্ট দেবতাকে সেখানে প্রতিষ্ঠা করছিল মানুষেরা। বসতি, নগরী স্থাপিত হচ্ছিল। বিকাশ ঘটছিল ভাষার।
হয়তো বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের সভ্যতাগুলির মতনই তাদের সভ্যতাকেও উন্নতই বলা হতো, কিন্তু হল না। হল না কেন? দেবতাদের উদ্দেশে মানব বলি প্রদানকারী জংলি, নির্দয় জনজাতি রূপে তাদের দাগিয়ে দেওয়া হল। কারা দাগালো? সেই সকল ‘সভ্য’ মানব, যারা আমেরিকার প্রাচীনতম সভ্যতাকে এবং ভূমিপুত্রদের অত্যন্ত সুচারু পদ্ধতিতে প্রায় শেষই করে দিয়েছিল। তবে সংস্কৃতি শেষ হয়েও হয় না, রেশ রয়ে যায়। ইতিউতি পড়ে থাকে। ইট – কাঠ –পাথরের খাঁজ থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। নিজের গল্প শোনায়। হাজার ফুট গর্ত করে, সমুদ্রতলে ডাইভ দিয়ে সভ্যতা সংস্কৃতিকে খুঁজে পাওয়া যায় বলে আমি বিশ্বাস করি না। সংস্কৃতি রয়ে যায় আমাদের অভ্যেসে, রঙ, রূপ, জীবনযাত্রায়, আমাদের ব্যক্তিত্বে, আচরণে, আমাদের ডি.এন.এ –এর মধ্যে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পুরাতত্ত্ববিদের দল শিলালেখ, পাষাণ যুগের অস্ত্র ইত্যাদির মধ্যে সংস্কৃতিকে না খুঁজে জেনেটিক সিগনেচারের মধ্যে সংস্কৃতিকে খোঁজেন। কিন্তু যারা আমার মতন মানুষ, মূঢ়সম, যারা জেনেটিক সিগনেচার খোঁজাতে দক্ষ নন, ইতিহাসের পুঁথিগত বিদ্যে যাদের অতীব কম, পুরাতত্ত্ববিদ হতে পারা যাদের দূরতম স্বপ্ন হিসেবে অধরাই রয়ে গেছে, তারা কীভাবে খুঁজবে?
***
আমার এক বন্ধু ইলিনয়েস ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। ওদের একটা বাস্কেটবল টিম ছিল। নাম ছিল ফাইটিং ইলিনাহ। বাস্কেটবল আর আমেরিকান ফুটবল (রাগবি) আমেরিকানদের শিরায় – উপশিরায় বইছে। ভারতে নাহয় আইপিএল এই এক দশকের একটু বেশি সময় ধরে চলছে। কিন্তু ওখানে স্পোর্টস লিগের প্রচলন আজকের নয়। পুরো লিগটাই কিন্তু নিজেদের মধ্যে চলে, বাইরের দেশের কাউকে নেওয়া হয় না। দুটো ভাগ। প্রফেশনাল লিগ আর অ্যামেচার লিগ। ইউনিভার্সিটি টিম অ্যামেচার লিগে পড়ে, প্রফেশনাল লিগের জেল্লাই আলাদা, সেখানে কোটি কোটি ডলারের ইনভেস্টমেন্ট থাকে।
তা হঠাৎ এত কথা বলছি কেন? মানে বাস্কেটবল নিয়ে এত কথা তোলার কারণ কী? কারণ, বাস্কেটবলের ইতিহাসের অন্দরমহলে একটু খোঁজ করে দেখলাম এটাই একমাত্র এমন খেলা যার জন্ম আমেরিকার মাটিতে হয়েছিল। জনক কে? জেমস নেস্মিথ। তিনিই গোড়ার দিকের যাবতীয় নিয়ম বানিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি তার আগে বাস্কেটবলের অস্তিত্ব ছিল না? একটু খুঁজে দেখতেই অন্যরকম উত্তর মিলল। দেখলাম এ তো হাজার – হাজার বছর ধরে খেলা হয়ে আসছে। এমন একটা সময়ও ছিল যখন যুদ্ধের বদলে রাজারা এই খেলার হারজিতের মাধ্যমে নিজেদের জয় – পরাজয়ের সিদ্ধান্ত নিতেন। পরাজিত দলের কাপ্তেনের মাথাটা কেটে বাঁশের আগায় কুমড়ো গাঁথার মতন করে গেঁথে রাখা হতো। আগেই মায়ান সভ্যতার আদিগ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছিলাম। মনে পড়ছে কি? পোপোল বূহ। সেখানে লেখা আছে—
‘একবার হুন হুনাপু পাতালে জিবাল্পার কাছে গোলক নিয়ে খেলা করছিলেন। পাতালবাসীরা তাঁকে আমন্ত্রণ করেছিল খেলার জন্যে। ছলনার মাধ্যমে তাঁকে পরাজিত করার পরে তাঁর মাথা কেটে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সেই সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন এক দেবী। কাটা মাথা থেকে থুতু গিয়ে পড়ল দেবীর গায়ে। দেবী জন্ম দিলেন দুই যমজ ভাইয়ের — হুনাপু এবং জবালাঙ্ক। দুই ভাই গিয়ে পাতালের রাজাকে ওই খেলায় হারিয়ে দিলেন।’
আমি যা লিখলাম, তা কিংবদন্তী হলেও প্রাক – আমেরিকান শিলালেখতে এই ধরণের খেলার বিবরণ এবং ছবির সন্ধান মেলে। সোজা ভাষায় আমি সেই খেলা নিয়ে দুটো কথা বলি। দুটো দল থাকত। গোলক বা বল নিয়ে ছোটাছুটির খেলা হতো। তবে স্পষ্ট করে এই উল্লেখ পাওয়া যায় না যে বল নিয়ে গিয়ে এখনকার মতন কোনও জালে ফেলতে হতো নাকি একে অন্যের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই জয় হতো। এমনও হত ড্রপ খাইয়ে পাথরে মেরে খেলা হতো। তবে এই খেলাতে হার বা জিত রাজ্যশক্তির মাপকাঠি ছিল। এর প্রথম প্রমাণ কোথায় পাওয়া গিয়েছিল সেটাও একটা প্রশ্ন।
কোথায়?
আমেরিকা মহাদেশের প্রাচীনতম রাজধানীতে।
কোন জায়গা সেটা?
সান লোরেঞ্জো।
নিয়ে যাব সেখানেও। কিন্তু যেটা এতক্ষণ ধরে বলতে চাইছিলাম, সেটাই খোলসা করে বলি। পুরাতত্ত্ব তো ইলিনয়েসের খেলার মাঠেও উপস্থিত ছিল বা আছে। বাস্কেটবলের ইতিহাসবিদেরা মায়া সভ্যতাকে তার এতটুকু ক্রেডিট পর্যন্ত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।
***
‘কৃষি বিপ্লব ঘন জনবসতি সম্পন্ন শহর এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্য নির্মাণের সুযোগ তৈরি করেছে। জনগণ মহান দেবতাদের নিয়ে এবং নিজেদের মাতৃভূমির সম্পর্কে কিংবদন্তী সৃষ্টি করেছে…’
যুবাল নোয়া হারারি, স্যাপিয়েন্স।
কখনও ভেবে দেখেছেন কি, আমরা ‘সভ্যতা’ বলতে ঠিক কোন ব্যাপারটাকে বোঝাই? শহরকে। গ্রামের জীবনযাত্রাকে সভ্যতার অঙ্গ বলে কখনও স্বীকার করা হয় কি?
সিন্ধু সভ্যতা হোক বা ব্যাবিলনের সভ্যতা, সবই কিন্তু নাগরিক ছবি তুলে ধরে। সেখানে নগর – ব্যবস্থাই ছিল। নইলে কুঁড়েঘর, খাওয়াদাওয়া, সমাজরীতি তো আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। যেখানেই মানুষ বসবাস করেছে, সেখানেই গোষ্ঠী বানিয়েছে। খেয়েছে, পান করেছে। পাষাণ যুগেও এসব ছিল, কিন্তু পাষাণ যুগের সেই স্মৃতিকে সভ্যতা বলা হয়েছে কি? বিড়ম্বনা কিনা জানি না, আজ অব্ধি কোথাও কোনও গ্রামের মানুষকে ‘সভ্যতার দিশারী’ তকমা পেতে দেখিনি। অথচ যেখানে মানব গাছ কেটে সমতল করেছে, রাস্তা বানিয়েছে, নর্দমা বানিয়েছে, বস্ত্র – অলঙ্কার ধারণ করেছে, রাজনৈতিক ব্যূহ রচনা করেছে, কিংবদন্তী গড়েছে, ভাষা শিখেছে, লিখতে জেনেছে, সেখানেই অবতীর্ণ হয়েছে সভ্যতার বিজয়রথ। যারা জঙ্গলে কোলে থেকে প্রকৃতির পূজা করেছে, প্রকৃতির ধ্বনিতে কথা বলা বজায় রেখেছে, তারা রয়ে গেছে অসভ্য হয়েই।
কিন্তু… এই নাগরিক তথা সভ্য লোকেরা এল কোথা থেকে?
যখন আমেরিকা মহাদ্বীপে মানুষজন কুটির তৈরি করতে শিখল, তখন তাদের সামনে বিপদ রূপে এসে পড়ত হিংস্র সব শ্বাপদ। মানুষগুলো কী করল? বন ছেড়ে পাহাড়ের দিকে এগোল। তাতে লাভ? প্রথমত, ভারী শরীরের পশুগুলোর পাহাড়ে উঠতে কষ্ট হবে, তারা পাহাড়ে উঠে আক্রমণ কম করবে। দ্বিতীয়ত, পাহাড়ের উচ্চতর অবস্থানে বসে নিজেদের শিকারের জন্যে পশুদের রেকি করতে সুবিধে হবে। তাই আমেরিকার প্রাচীনতম জনবসতিগুলি খোলা ময়দানে না হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার পাহাড়ি এলাকাতে গড়ে উঠেছিল। পাহাড় থেকে ময়দানে নেমে এসে শিকার টিকার সেরে আবার নিজ নিকেতনে ফিরে যেত তারা। এসবের মাঝে তারা ভুট্টার বীজও সংগ্রহ করে নিয়েছিল। তাদের মুখের বুলি ক্রমশ ভাষার রূপ নিল। এখনকার আফ্রিকান পিগমিদের ভাষা যেমন, অনেকটা তেমনি ছিল সেই ভাষার তদানীন্তন রূপ।
এরই মধ্যে থেকে কিছু প্রগতিশীল মানসিকতার মানুষেরা ভাবল যে, যে বুনো ভুট্টার বীজগুলো জোগাড় করা হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে যেখানে বাস করছি সেখানে চাষ করা যাক, তাহলে আর রোজ অমন পাহাড় থেকে নীচে যেতে হয় না। বন কেটে সুরক্ষার জন্যে পাথরের দেওয়াল তৈরি করা যেতে পারে এমন প্রস্তাবও উঠল। নিজেদের প্রকৃতি – দেবতা যেমন, বর্ষা, অগ্নি, আকাশের দেবতাদের মন্দির প্রতিষ্ঠা করা শুরু হল। পথঘাট তৈরি হল। তখনকার দিনের হিসেবে একেবারে স্মার্ট সিটি। এই প্রগতিশীলদের দলটার নাম হল ‘ওল্মেক’। ওল্মেক মানে কী? রাবারের মতন পদার্থের মানুষ। এমন নামকরণের পিছনের কারণ কী? তারা গোলক বা বল নিয়ে ময়দানে খেলা করত।
তো কী বলছিলাম?
ওল্মেকদের কথা। ওল্মেক মানে রাবারের মতন পদার্থের মানুষ, যারা অধুনা মেক্সিকোর ময়দানগুলোতে একটা নাগরিক সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটাল। ওই নগরের এখনকার নাম সান লোরেঞ্জো। এসব কতদিন আগের কথা? খ্রিষ্ট জন্মের ১৪০০ বছর আগের কালখণ্ডে আমরা ভ্রমণ করছি এখন। প্রায় ১২৩৫ একর জমির ওপরের বনজঙ্গল সাফ করে নগরী তৈরি হল। ভুট্টার সঙ্গে গড়নে মিল আছে এমন পাথরের মূর্তির দেবতা জন্ম নিল। ভুট্টাই তখন তাদের অন্ন, অন্নদাতার সাথে তাই অন্নের মিল থাকাটা স্বাভাবিক। দেবতার কাছে প্রার্থনা হতে থাকল — আসছে বছর ভালো ফসল দিও, ঠাকুর! যখন মানুষ বনচারী হয়ে কাটিয়েছে, তখন প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলাটাও রপ্ত করে ফেলেছিল। পশুদের সঙ্গে কথা বলতে পারত তারা। সেই সংস্কৃতি আজকের মূলনিবাসীদের মধ্যেও অনেকাংশে উপস্থিত। এর জন্যে ইংরেজরা একটা বেশ গোবদা শব্দ ঠিক করে রেখেছে। Animism… যার বাংলা হতে পারে সর্বাত্মবাদ। একটু ভেঙে বলি। যে পশুর শিকার করা হবে, তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলা হবে যে, নিজের পরিবারের ভরণ পোষণের জন্যে তোমাকে বধ করতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু সেই শিকারী মানুষগুলোই যখন চাষ করতে লাগল, নগরের পত্তন করল, তখন সর্বাত্মবাদের প্রকৃতি বদলে গেল। জন্ম নিতে লাগল সংকর দেবতারা। হাইব্রিড গডস্।
যেমন ধরুন, একটা বনবেড়াল আর মানুষের শরীরকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেবতার রূপ দেওয়া হল। আমি সহজ করে বনবেড়াল বলে চালালাম বটে, ওটাকে জাগুয়ার পড়তে হবে কিন্তু। সম্ভবত বনের জীবন ছেড়ে চলে এলেও অরণ্যের ছায়া তাদের পিছু ছাড়ছিল না। শুধুমাত্র মানবের রূপকে শক্তিশালী দেবতার ছাঁচে ফেলার মতন ঔদ্ধত্য তখনও তারা দেখাতে পারছিল না। এভাবেই ভুট্টার দেবতা প্রকট হলেন, যাকে মানব এবং ভুট্টার সংকর রূপ বলা যেতে পারে। বৃষ্টির দেবতার কথা তারা বনে থাকাকালীনই বলত, কিন্তু নগরে আসার পর তার সম্মান আরও বেড়ে গেল। কেন বাড়ল? আগে ভুট্টা না পেলেও শিকার করে পেট চালিয়ে দেওয়া যেত। নগরে আসার পরে শিকার সেকেন্ডারি অপশন, ভুট্টার চাষের ওপরেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল উন্নততর মানব। আর ভুট্টার চাষটা ছিল পুরোপুরি বর্ষা – নির্ভর। উলটো দিকে আবার অগ্নিদেবের পদমর্যাদা একটু কমে গেল। কারণ বনে দাবানলের ভয় ছিল বেশি, নগরে সেই প্রমাদ অনেকটাই কম।
বনে পশুর আতঙ্ক থাকে। আর নগরে?
মানুষের ভয়।
একদিন সেই নগরীর সমস্ত ঘরবাড়ি, ভবন, মন্দির ভেঙে দেওয়া হল। আমেরিকার প্রথম নগর, প্রথম রাজধানী ধ্বংস করে দিল। কিন্তু কারা করল এসব? ওল্মেক ছাড়া অপর কোন শক্তির উপস্থিতি ছিল সেখানে?
সান লোরেঞ্জো প্রায় চার দশকের বেশি সময় ধরে ওল্মেকদের রাজধানী রূপে টিকেছিল। কে বা কারা সান লোরেঞ্জোকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে দিয়েছিল তা কারো জানা নেই। তবে মানুষের হাতেই যে নগরটি নষ্ট হয়েছিল তার প্রমাণ স্পষ্ট। যেহেতু ওই সময়ে ওল্মেক ব্যতীত অপর কোনও সভ্যতার অস্তিত্ব মেলে না, তাই হতেই পারে নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলেই ধ্বংস হয়েছিল সান লোরেঞ্জো নগরী। মুষলপর্ব আর কি। কী নিয়ে লড়াই হয়েছিল? হয়তো চাষের জমি। কিংবা চাষের ফসল। আচ্ছা, এমনটা হওয়া কি সম্ভব যে তখনও যারা বনে বাস করত, তাদের সঙ্গে কোনও বিবাদের ফলে আক্রমণ ঘটেছিল? হতেই পারে। বলা মুশকিল।
সান লোরেঞ্জো নাহয় ধ্বংস হয়ে গেল। ওল্মেকরা কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়নি। আরও বেশি উন্নত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠল তারা। অপর একটা জনপদ গড়ে উঠল। নতুন সেই রাজধানী আরও বিশাল। নাম হল — লা বেন্টা। হাতের কাছে নিশ্চয়ই স্মার্ট ফোনটা রয়েছে। একবার গুগল ম্যাপে সার্চ করে দেখুন না, উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যিখানের যে ময়দানি সেতু, যাকে আমরা মধ্য আমেরিকা বলে জানি, তারই একটা মাথা কিউবার দিকে এগিয়ে গেছে, সেদিকটাকে ইউকাটান পেনিনসুলা। তারই একটা অংশে তৈরি হল ওল্মেকদের নতুন রাজধানী। এখন সেই জায়গাটার কী নাম? তাবাস্কো। দেশটার অধুনা নাম? মেক্সিকো।
***
জীবনকে সহজ করে তোলার জন্যে ওল্মেকরা আবিষ্কারের নেশায় মাতছিল। খাবার খাওয়ার জন্যে নকশাকাটা চিনেমাটির থালা বাসন বানাল। চাষের জন্যে আর পশুদের বাঁধার জন্যে এল নতুন উপকরণ। নিজেদের ভাষাকে খোদাই করা শুরু করে দিল তারা। ভিন্ন – ভিন্ন চিহ্ন জন্ম নিল। ছবি এল। সেসব অবশ্যই বুনো ভাষার প্রতীক, তবে পুরোনো ক্লিক – ক্লক মার্কা ধ্বনি দিয়ে পশু – পক্ষীদের সঙ্গে কথা বলার আর কোনও দরকার ছিল না। সেই ধরণের শব্দ ত্যাগ করে নতুন শব্দ মানুষের জীবনচর্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল। অবসর বিনোদনের জন্যে জন্মাল খেলা। তবে সমগ্র সমাজ এবং জীবনশৈলীকে নতুন রূপ দেওয়ার জন্যে আরও দুটি বিষয়ের প্রয়োজন ছিল।
দরকার ছিল একটি রাজনৈতিক কাঠামোর, যা সমাজের নিয়মকানুন নির্ধারণ করবে। আর দরকার ছিল দেবতার, যার বা যাদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা থাকবে। শুধু দেবতার জন্ম হলেই চলবে না, দেবতাদের নিয়ে গল্পগাথা থাকতে হবে, এমন গল্প হতে হবে যার মাধ্যমে মানুষের বনচারী থেকে নগরবাসী হওয়ার যাত্রার বিবরণ ধরা পড়ে। যেমন পোপোল বূহ বইতে বলা আছে প্রথমে মাটি আর কাঠ দিয়ে মানুষ তৈরি হয়েছিল, পরে সেখানেই ভুট্টা দিয়ে মানুষ তৈরি করার কথা লেখা আছে। অরণ্য থেকে কৃষি – নির্ভর জনজীবনের পরিবর্তনের চালচিত্র ধরা পড়ে এর মাধ্যমে।
গুয়াটেমালা দেশের কমিনলজ্যুতে খ্রিষ্ট জন্মের ১১০০ বছর আগে গড়ে ওঠা একটা অদ্ভুত জায়গার সন্ধান মেলে। সেখানে পঙক্তিবদ্ধ পিরামিডের সারি। একটা দুটো নয়, শত – শত পিরামিড। পিরামিড আর টিলায় ভর্তি জায়গাটা। ওল্মেক সভ্যতার মন্দির সেগুলো। যেন কোনও দুর্দান্ত তীর্থস্থল, যেখানে ভুট্টা ফলার আগে এবং পরে মানুষেরা সমবেত হয়ে প্রার্থনা করত। অগুনতি মূর্তিগুলিতে মানব, পশু এবং প্রকৃতির সমাহার বিদ্যমান।
প্রথমে তিন দেবতার জন্ম হয়। এক, যিনি সমুদ্রে শয়ন করে থাকেন, শঙ্খের মতন কান। দুই, যিনি আকাশ ফাটানো বাজ দিয়ে বৃষ্টি নামান। তিন, অগ্নি এবং বিনাশের দেবতা। দেবতাদের নাম তখনকার লোকে কী রেখেছিল সে জানার উপায় হয়নি বলে কোনও বিজ্ঞানমনস্ক তথা নীরস ব্যক্তি তাদের নামকরণ করেছিলেন। প্রথম দেবতার নাম G1, দ্বিতীয় জনে নাম G2, এবং তৃতীয় জনের নাম G3. আমি তিনজনের কথা বললাম বটে, সর্বসাকুল্যে অমন ন’জন দেবতার কথা মেলে। G1 থেকে G9 পর্যন্ত। আমি যতবার পড়েছি, ততবার ভেবেছি এমন নাম কেউ রাখে? যেন ঠাকুরদেবতাদের রোল কল করা হচ্ছে!
যদি ইলিনয়েস থেকে নিউইয়র্ক গাড়িতে করে যান, তাহলে পথে একটা জায়গা পড়ে, হার্শে।
হার্শে?
কিছু মনে পড়ল কি?
পৃথিবীর সবথেকে বড় চকোলেট শিল্পের জন্যে বিখ্যাত স্থান। হার্শে শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে স্ট্রিট লাইট পর্যন্ত সর্বত্র চকোলেটের ছাপ। বিশ্বের বহু কোটি মানুষের শরীরে বদ ক্যালোরি বৃদ্ধি এবং দাঁত খারাপ করার দায় এই হার্শে নামক স্থানের। না চকোলেট তৈরি করা হতো, না বাচ্চারা তা খাওয়ার জন্যে ঘ্যানঘ্যান করত। অবশ্য চকোলেট তৈরি হওয়ার ইতিহাসটা এই শহরের থেকে অনেক বেশি পুরোনো। সেই নিয়ে বিস্তারে অন্যত্র লিখব’খন।
পুরাতত্ত্ববিদেরা প্রাচীন আমেরিকান সভ্যতার সন্ধানে যখন রত ছিলেন, তখন তাঁরা বেশ কয়েক জায়গাতে কেটলি খুঁজে পান। আজ্ঞে হ্যাঁ, কেটলি। যেমন কেটলি আমাদের দেশের রেল স্টেশনের চা – ওয়ালারা নিয়ে ঘোরেন। লম্বা নলওয়ালা কেটলি। ওল্মেক সভ্যতার লোকেরা এই ধরণের কেটলির ব্যবহার কোনও পেয় পানের জন্যে ব্যবহার করত। না, সুধী পাঠক, এই কথা বলব না যে খ্রিষ্ট জন্মের হাজার বছর আগে মেক্সিকোর কোনও স্থানে চায়ের দোকান ছিল। তার জন্যে চায়ের আবিষ্কার প্রাথমিক বিষয় হতে হয়। অন্য কিছুই পান করত সেই সভ্যতার লোকজন।
শেষ ওইসব কেটলিকে পরীক্ষার জন্যে ফিলাডেলফিয়ার হার্শেতে পাঠানো হয়, যেখানে চকোলেট তৈরি করা হয়। এক বৈজ্ঞানিক জেফ হার্স্ট নিজের গবেষণায় পেলেন যে কেটলির মধ্যে নিয়োব্রোমিন নামক একপ্রকারের রসায়নের উপস্থিতি রয়েছে। এই নিয়োব্রোমিন চকোলেটেও থাকে। দীর্ঘ নলযুক্ত কেটলির মাধ্যমে চকোলেট কোনও পাত্রে ফেললে বেশ ফেনা ফেনা হতো। সেই ফেনাময় চকোলেট পান করত ওল্মেকরা। চকোলেট শব্দটার ব্যুৎপত্তি অনুসন্ধান করতে বসলে প্রাচীন অ্যাজটেক সভ্যতার একটা শব্দ মেলে। ‘শাকোলাট’। শাকোলাট মানে কী? তিতকুটে জল।
কিংবদন্তী অনুসারে এই দ্রবণ দেবতাদের প্রিয় ছিল। কিন্তু মনুষ্যের জন্যে এর পান ছিল বর্জিত। ঐতিহাসিকদের মতে অভিজাত বর্গের মানুষেরা নিজেদের চকোলেট পানের ব্যাপারটা আইনসম্মত করে নিয়েছিল। নিম্ন বর্গের মানুষের অবশ্য সেই অধিকার ছিল না। পরে এক কেট জলকোটাল চকোলেট পানের অধিকার মানুষের হাতে তুলে দেন। কোকো বীজ দেবলোক থেকে এনে মনুষ্যলোকে ফেলেন। দেবতারা আবার এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে তাঁকে দণ্ডিত করেন। কিন্তু মানুষ? মানুষদের কাছে তিনি হয়ে উঠলেন চকোলেটের দেবতা। শুরু হল কোকোর চাষ। এই কোকো প্রথমে স্প্যানিশরা নিয়ে গেল ইউরোপে, সেখান থেকে ইংল্যান্ড ঘুরে আবার তা গিয়ে উঠল আমেরিকাতে। তবে একটাই কথা বলব, বিশ্বের প্রথম চকোলেট ওল্মেকরা কেটলিতে করে পান করত, তাই সব কৃতিত্ব তাদেরই। অবশ্য ক্রেডিট দেওয়া হবে কাকে? ওল্মেক সভ্যতা আছে কই?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন