পার্থ দে
ছুটিছাটায় নাতি ঋক বাড়ি এলে গৌরীর একাকিত্ব খানিকটা কমে। ছেলে গৌরবের সরকারি চাকরি, উত্তরবঙ্গে পোস্টেড। নাতির ইস্কুলের গরমের ছুটি পড়লে বউমা নাতিকে নিয়ে কলকাতা চলে আসে। ছেলে সাধারণত আসে পুজোর ছুটিতে, এবারে অবিশ্যি গরমেই এসেছিল, প্রণবেশের বাৎসরিক কাজ সেরে গত হপ্তাতেই ফিরে গেছে। ছেলের প্রতি গৌরীর ইদানীং অতটা টান নেই, যতটা না নাতির জন্য। নাতিকে দেখলেই তাঁর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আসলের চেয়ে সুদের দর যে চিরকালই বেশি!
ক্লাস থ্রি-এর ঋকও দাদু-ঠাকুমা বলতে অজ্ঞান। কিন্তু গত একবছর ধরে সে দাদুকে খুব মিস করছে। দাদুর মৃত্যুর প্রথম বাৎসরিক কাজের দিন থেকেই দেখেছে ঠাকুমার মনটা খারাপ। রাতেরবেলা বিছানায় ঠাকুমার পাশে শুয়ে বলে, “গিগি, তুমি এবার আমাদের সঙ্গে শিলিগুড়ি যাবে? দুজনে খুব মজা করব, কত খেলা খেলব। বাবাকে বলব তোমাকে দার্জিলিং ঘুরিয়ে আনতে। তুমি দার্জিলিং গেছ কখনও?”
ঋক ছোটবেলা থেকেই তার ঠাকুমাকে গিগি বলে ডাকে। গৌরী সিলিংয়ের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “সে অনেকদিন আগে গিয়েছিলাম, তোমার ঠাকুরদার সঙ্গে। কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে আমার যে আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই দাদুভাই, কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে। তবে কথা দিচ্ছি, কালকে আমি তোমার সঙ্গে একটা খেলা খেলব।”
“কী খেলা গিগি?” ঋক উৎসুক হয়ে ওঠে।
“সে একটা খেলা আছে, একদম নতুন খেলা।”
“নামটা বলো না?”
“কালকে বলব’খন, এখন নয়। এখন ঘুমিয়ে পড়ো।”
“না না গিগি, এখন বলো, অন্তত খেলার নামটা বলো প্লিজ।”
“বেশ, বলছি, দুষ্টু ছেলের তর সয় না যেন। খেলাটার নাম ‘লস্ট এন্ড ফাউন্ড’, সে খুব মজার খেলা।”
“যাহ্, এমন কোনো খেলা হয় নাকি!” ভুরু কুঁচকে ঋক তাকায়।
গৌরী নাইটল্যাম্পের আলোয় নাতির জোড়া ভুরুর দিকে তাকান। ওই জোড়াভুরু, অমন করে তাকানো দেখলে ওঁর বুকটা মুচড়ে ওঠে। “হয় গো। কাল সকাল হলেই দেখতে পাবে, এখন ঘুমোও” বলে চোখ থেকে চশমাটা খুলে গৌরী পাশ ফিরে শুলেন।
পরদিন সকাল থেকেই ঋক তার গিগিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে—”ও গিগি, চলো না, লস্ট এন্ড ফাউন্ড খেলাটা খেলবে।”
গৌরী বলেন, “দাঁড়াও দাদুভাই, সকালে কত কাজ থাকে, তারপরে রান্নাবান্না সারতে হবে, সেগুলো সেরে তোমার সঙ্গে খেলব।”
“না গিগি, দিস ইজ নট ফেয়ার। তুমি বলেছিলে সকালে উঠেই খেলবে, এখন খেলতে চাইছ না কেন?” ঋকের মুখে ছটফটানির চিহ্ন।
“আচ্ছা বেশ, খেলছি,” গৌরী চোখ থেকে নিজের কার্বন ফ্রেমের চশমাটা খুলে বলেন, “এই নাও আমার চশমাটা, তুমি এটা নিয়ে বাড়ির যে কোনো জায়গায় লুকিয়ে ফেলো, আমি ঠিক খুঁজে বের করব।”
“উঁহু, আমি এমন জায়গায় লুকোব, তুমি খুঁজেই পাবে না।”
“চ্যালেঞ্জ?”
“ইয়েস, চ্যালেঞ্জ।”
“তাহলে কিন্তু তুমি হারবে দাদুভাই।”
এরপর সারাদিন ধরে চলে ঠাকুমা আর নাতির খেলা। দোতলা বাড়িটায় পাঁচখানা ঘর, দুটো বাথরুম। ড্রইংরুম, রান্নাঘর, বারান্দা, ছাদ মিলিয়ে আরও অনেক জায়গা। ঘরের দুরূহ কোণে এবং অদ্ভুত সমস্ত জায়গায় ঋক তার গিগির চশমা লুকিয়ে রাখে। কিন্তু পাঁচ মিনিট, বড়জোর দশ মিনিটের মধ্যে গৌরী তা ঠিক খুঁজে বের করে দেন। কখনও প্রণবেশের বইয়ের তাক, কখনও ছাদের চিলেকোঠা ঘর, কখনও আবার বাথরুমের তাক থেকে অবলীলায় উদ্ধার করে আনেন তাঁর চশমাখানি। একবারের জন্যও ভুল হয় না গৌরীর!
সন্ধে নাগাদ দশমবারের খেলা শেষে ঋক হার মেনে বলে, “এই খেলাটা মোটেই ভাল নয়, তুমি বারবার জিতে যাচ্ছ, গিগি।”
গৌরী নাতির কথায় চুপ করে থাকেন কিন্তু চশমা খোঁজার খেলায় তাঁর পারদর্শিতার কারণটা আর বলতে পারেন না।
বেঁচে থাকতে রোজ প্রণবেশ তাঁকে কম জ্বালিয়েছেন! নিজের চশমাটা বাড়ির কোথাও না কোথাও ভুল করে ফেলে এসে কাঁচুমাচু মুখে বলতেন, “চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না, জানো। আচ্ছা, চশমার কেন রিংটোন থাকে না বলো তো! একটা ফোন করলেই খুঁজে পাওয়া যেত!”
প্রতিবার গৌরীই প্রণবেশের চশমা উদ্ধার করতেন। এভাবেই চশমা খোঁজার খেলায় তিনি পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। এক বছর হয়ে গেছে প্রণবেশ চলে গেছেন। পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও খেলাটা কিন্তু গৌরীর আজও খেলতে ইচ্ছে করে। অবিশ্যি করবে নাই বা কেন, নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীও তো সেই জোড়াভুরু, সেই এক চাহনি…
ডিএনএ-র ছাপ যে হারায় না, ফিরে ফিরে আসে!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন