সৌমী গুপ্ত
চকচকে রোদ্দুরের মতোই ভবতোষবাবুর মনটা আজ ফুরফুরে। সকালে বাজারে গিয়ে এমন একটা খবর কানে এসে পৌঁছেছে যা জীবনে এই প্রথম শোনা! সেই থেকে চিন্তাটা ঘাই মারছে মাথায়। একটু অদ্ভূত কিন্তু বেশ অন্যরকম। মালা শুনলে চমকে যাবে।
পরিতোষ বলে ছেলেটি মাছ কেনার সময় ফোনে কাউকে প্যাকেজ নিয়ে বোঝাচ্ছিল, ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু কথা কানে আসতেই পাড়ার নেড়ি কুকুরের মত কানটা আপনাআপনি খাড়া হয়ে গিয়েছিল ভবতোষবাবুর। কাছ ঘেঁষে কথাটা যাচাই করতে কিন্তু কিন্তু বোধ করছিলেন অবশ্য। পরিতোষই খোলসা করে দিল পুরোটা। প্রথমটা একটু লজ্জা লাগছিল তাঁর। তবে আলাপ, কথোপকথন একটু এগোতেই ভবতোষবাবু লজ্জার মাথা খেয়ে কথাটা পেড়েই ফেললেন, “ইয়ে বলছি এগুলো তো সব প্রি প্যাকেজের কথা বলছ! বলি পোষ্ট প্যাকেজ বলে কিছু নেই?”
পরিতোষ ব্যবসাদার চোখ নিয়ে যেন মেপে নিচ্ছিল ভবতোষবাবুকে। আমতা আমতা করে সাফাই গাইলেন ভবতোষবাবু, “ইয়ে মানে জীবনে তো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। চাল, ডাল, চচ্চরিতেই জীবন কেটে গেল। যদি এই বয়সে এসে একটু যৌবনের আনন্দ ফিরে পাই…!”
কথাটা একপ্রকার ছিনে জোঁকের মতো লুফে নিয়েছিল পরিতোষ, “কাকু বয়স তো একটা সংখ্যা মাত্র! আপনি কীই বা করছেন! আপনি জানেন আপনার মতো কতজন এখনও লেকের ধারে বসে মেয়ের বয়সী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু…!”
তড়িঘড়ি কানে আঙুল দিয়েছিলেন ভবতোষবাবু। মা কালীর মতো একহাত জিভ বের করে মুখে চুকচুক আওয়াজ করেছিলেন লজ্জায়। উল্টোদিকে এককেজি ওজনের ইলিশের ঘষামাজা রূপোলী গায়ের দিকে অন্যমনস্ক হয়ে বিড়বিড় করছিলেন,”লোক হাসানো হবে না তো পরিতোষ! মেয়ে জামাইয়ের কানে গেলে কী হবে! পিছনে হাসাহাসি করলে!”
বরাভয় মুদ্রা দেখিয়েছিল পরিতোষ। ভবতোবাবুর সাক্ষাৎ নারায়ণের মুখটা মনে পড়ছিল। বাঁ হাতে খৈনি ডলতে ডলতে বলছিল, “চাপ নেবেন না কাকু। সব রেডি করে যখন মার্কেটে ছাড়বেন না দেখবেন এই পরিতোষকেই সবাই খুঁজছে!”
বেশ কিছুক্ষণ টালবাহানার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন ভবতোষবাবু। মন্টুকে বলেছিলেন, “এই তোল তো ইলিশটা! দেখ তো ওজন কত দাঁড়ায়!”
এমন একটা দিনে জম্পেশ করে খাওয়া দাওয়া করতে হবে বৈকি! মালার মুখটা মনে পড়ে গেল। আহা বেচারা সারাজীবন খেটেই পার করে দিল। এমন একটা খবর কতক্ষণে যে মালার কানে পৌঁছতে পারবেন! রিটায়ার্ড করে বেশ কিছু টাকা পেয়েছেন তিনি। পরিতোষ বলে গেল সাত হাজারের মতো পড়বে। জামাকাপড় ভবতোষবাবুকেই কিনতে হবে।
পেটের ভিতর কেমন বুড়বুড়ি কাটছে তাঁর। যেন নতুন করে প্রেমে পড়েছেন। বাজারের থলিটা রেখেই মালাকে ডাকলেন ঘরে। একদম নতুন বৌয়ের মতো। বেশ রসিয়ে রসিয়ে কথাটা পাড়তেই একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে গেল মালা, “যাহ এই বয়সে!”
ভবতোষবাবু কায়দা করে বললেন, “তবে চিরকাল আমাকে আনরোম্যান্টিক বলে গাল দিয়েছ!”
একটু চিন্তা করে মালা বলল,’কিন্তু নতুন জামাকাপড় কই?”
ভবতোষবাবু নিজে এবার নারায়ণের ভূমিকায়, “পরিতোষ বলেছে একদম সাদামাটা জামাকাপড়, ছাদে হবে সব কাজকর্ম। নতুন জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করে ফেলব, জলখাবারটা সেরে ফেলি!”
খুশিতে ডগমগ অবস্থা দুই শিবিরের। ভবতোষবাবু বহুদিন পর গুনগুন করতে করতে বাজার গেলেন আর ফিরে এলেন দ্বিগুণ উৎসাহে।
মালার কাছে ব্যাগটা ধরিয়ে দিতেই শুরু হল আসল খেল। ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে আনতেই মুখটা গনগনে আগুনের মতো ঝলসে উঠল মালার। টান মেরে সবকটা ফেলে দিয়ে বলল, “বুড়ো ভাম, এগুলো কী! লুঙ্গি, নাইটি? ইয়ার্কি? এগুলো দিয়ে পোষ্ট ওয়েডিং ফটোশ্যুট করবে তুমি?”
ঢোঁক গিলে ভবতোষবাবু বললেন, “পরিতোষ যে বলল এই বয়সে সাদামাটা জামাকাপড় দিয়েই ম্যানেজ হয়ে যাবে!”
মালা দপ করে জ্বলে উঠল, “সব কটাকে বিদেয় করব আমি! মিনসে কোথাকার!”
বুকের ভিতরটা সাহারা মরুভূমি লাগছে ভবতোষবাবুর। গনগনে রোদটা টাকের উপর এসে বলছে, “পুনর্মূষিকভব!”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন