micro-story-safe-chip

সেফ চিপ
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়


সুবিমল দাঁড়িয়েছিল স্কুলের সামনে। দারোয়ান বিরক্ত মুখে বলল স্কুল ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এত দেরীতে কেউ বাচ্চা নিতে আসে?

হাতের ফাইলটা দেখাল সুবিমল – হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

কী ব্যাপারে?

কী ব্যাপারে সেটা একে বললে কি বুঝবে?

কি হল? বলুন! নয়ত সরুন, গেট বন্ধ করব।

বাচ্চা মেয়েদের জন্য সেফটি গ্যাজেটের কোম্পানি থেকে এসেছি ভাই। বড়দিদিমণির সঙ্গে দেখা করতে চাই।

“বড়দিদিমণি যার তার সঙ্গে দেখা করে না। ব্যাস্ত মানুষ। এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে অফিস থেকে। ওই যে ওদিকে অফিসঘর”

অফিসরুমে তিনজন কর্মচারী। শিঙাড়া মুড়ি খাওয়া চলছে। একজন বললেন বলুন, কী ব্যাপার? হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

ওই বোর্ডে ইমেল আইডি দেওয়া আছে। মেল করবেন। দিন তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে।

একজন মহিলা ঝাঁটা নিয়ে ঢুকল ঘরে। তিনজনের একজন বললেন আরে ঝর্ণাদি, এখন মুড়ি খাচ্ছি আর তুমি ঝাঁট দিতে এলে? অন্য পুরুষটি চোখের ভঙ্গি করল, আরে দিতে দিন না। দাও দাও, ঝাঁট দাও, টেবিলের নিচেটিচেও দিও। নিচটা বড্ড নোংরা।

সুবিনয় ইচ্ছা করেই ওই লোকটির সামনের টেবিলে নিজের ফোনটা রেখে ব্যাগ থেকে ছোট একটা খাতা বার করল।

“মেল আইডিটা লিখে নি”

ফ্যান বন্ধ কিন্তু দু চারটে মুড়ি মাটিতে পড়ছেই। কাজের মহিলাটি কোমর বেঁকিয়ে ঝাঁটা ঢোকাচ্ছে টেবিলের নিচে। টেবিলের ওপাশের লোকটার চোখ মহিলার বুকের ওপর। কাঁপছে ফোনটা, একটা সিঁ সিঁ আওয়াজ আসছে, যেন কেউ ফোঁপাচ্ছে।

আপনার ফোন আসছে মশাই- লোকটা বলল।

সুবিনয় ফোনটা তুলে নিয়ে পিছনে লাগানো চাকতিটায় চাপ দিল একবার। আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

অ্যাপয়েনমেন্ট পাওয়া গেল সপ্তাহখানেক পরের। হেডমিস্ট্রেস কিছুটা শুনেই বিরক্ত মুখে থামিয়ে দিলেন।

“এটা আমার কাজের আওতার বাইরে। প্রশাসনিক ডিসিশন আমি নিই না। মাফ করবেন।

এর আগে চারটে স্কুল থেকেও সুবিমল এইই শুনেছে। মাফ করবেন।

“কিন্তু ম্যাডাম, মেয়েদের সুরক্ষার জন্যও এটা জরুরী”

“সুরক্ষার নাম করে সারাক্ষন সঙ্গে ফোন রাখাটাও ছাত্রীদের জন্য ভাল না।”

“কিন্তু কোভিডের পর থেকে স্টুডেন্টদের হাতে ফোন তো সবসময়েই।

“শুনুন ভাই, আমার স্কুল গার্লস অনলি স্কুল। এখানে স্কুলের মধ্যে ওসব ভয় নেই। বাইরে কার কী হচ্ছে সেটা আমার দায়িত্ব নয়। মা বাবারা মেয়েদের পোশাক আশাক ঠিকঠাক কিনে দিক, রাতের বাড়ি ফেরার টাইম বেঁধে দিক, এসব ওদের কাজ” ভদ্রমহিলার গলায় ঘাড়ধাক্কার ইঙ্গিত। সুবিনয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ইচ্ছে করে এই মহিলাকে নিয়ে গিয়ে দেখায় ওর অফিসঘরেই কী চলে। মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে। দারোয়ানটা জিজ্ঞেস করে কাজ হল?

নাহ।

মুখে এটুকুই বলে কিন্তু মনে মনে ঠিক করে হাল ছাড়বে না ও।

দরকার নেই স্কুল অ্যাপ্রুভা্লের। সুবিমল স্কুলের সামনে গার্জেনদের ধরে বোঝাতে শুরু করল এবার। কিন্তু লোকে বুঝতে চায় কই। কেউ বলছে আমার স্বামী রাগ করেন অ্যাপস ডাউনলোড করলে। কেউ পাশ থেকে বলছে ফোনে অ্যাপস লাগালে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা কেটে নেবে, খবরদার। “দেখুন, এটা তেমন কোনো অ্যাপ নয়। টাকা পয়সার কোনো ব্যাপার নেই এতে। শুধু এই চাকতিটা কাজ করানোর জন্য অ্যাপটা ফোনে রাখতে হবে। সুবিনয় নিজের ফোনটা দেখায়। ফোনের পিছনে ছোট একটা গোল ব্যাটারির মত চাকতি লাগানো”

“কী হবে এতে?”

“এটা একটা অ্যালার্ম সিস্টেম। এটাই অ্যাপটার সঙ্গে কানেক্টেড থাকবে। অ্যাপটা অন রাখবেন বাচ্চারা যখন একা থাকছে বা এমন কোথাও যাচ্ছে যেখানে বড়রা সঙ্গে নেই। ধারে কাছে যদি এমন কেউ আসে যার উদ্দেশ্য অসৎ তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ফোনে লাগানো চাকতিটা থেকেই একটা শব্দ ছড়িয়ে পড়বে যেটা খুব মৃদু থেকে বাড়তে বাড়তে চড়া হয়ে উঠবে। যদি কেউ বাচ্চাকে অ্যাটাকও করে, অ্যালার্ম বাজবে নিজে নিজেই এবং গার্জেনদের ফোনে অ্যাপটা থাকলে সেখানেও বাজতে থাকবে। তাছাড়া আশেপাশে যদি আরও কারুর কাছে এই চিপ থাকে তো এই ভাইব্রেশনটা কানেক্ট করবে সেগুলোকেও। ফলে মেয়েটি যে বিপদে পড়েছে তা তখুনি ছড়িয়ে পড়বে অনেকগুলো ফোনের মাধ্যমে।”

“মানে যেমন একটা কুকুর ডাকলে পাড়ার সব কুকুর ডাকতে থাকে?” বলে অসভ্যের মত হাসল একজন। তারপর বলল নতুন ভাঁওতাবাজি শুরু হয়েছে বোধহয়।

সুবিনয় মরীয়া হয়ে ওঠে। জোর গলায় বলে একবার ভেবেই দেখুন না, আপনি ভিক্টিম হওয়া ভালো না আপনার মেয়ে? যদি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উধাও হয়ে যায় তো আপনি ভিক্টিম হলেন। কিন্তু আপনার সন্তানকে যদি কেউ…” আর বলতে পারে না সুবিনয়।

খুব যে কাজ হল তা নয়। আবার কাল অন্য কোনো স্কুলের সামনে যাবে।

চার্জার নিতে ভুলে গেছে আজ। বাড়ির কাছাকাছিই আছে। টুক করে একবার ঘুরে এলেই হয়। ওর গলা পেয়েই ঘর থেকে তিতাই দৌড়ে আসে। সুবিমল আর শ্রেয়সী দুজনেই সারাদিন বাইরে। মেয়েটা একা একা কাজের লোকের কাছে থাকে। অসময়ে বাবাকে ফিরতে দেখে খুব খুশি হয়েছে। বাবা, তোমাকে একটা জিনিস দেখাব এসো। শিগগির এসো।

কোথায় যাব?

টমটমদের বাড়ি। আজ খুব মজা হয়েছে জান?

কী হয়েছে? সুবিমল অবাক হয়।

আমি একটু আগে টমটমদের বাড়ি গেছিলাম খেলতে। মাসিকে বলেই গেছিলাম। মাসি বলল ফোনটা নিয়ে যাও। যখন আসতে ইচ্ছে করবে আমাকে ডেকে নেবে নিয়ে আসব। আমি তাই ফোনটা নিয়ে গেছিলাম।

আচ্ছা… সুবিমল এক গ্লাস জল ঢালতে ঢালতে শুনছে মেয়ের কথা।

আজ তোমার ছুটি নেই কেন বাবা? ওদের বাড়িতে কাকুর তো ছুটি আছে।

এটাই তোর মজা? টমটমের বাবার ছুটি আছে?

না না বাবা, আমি আর টমটম খেলছিলাম। আর যেই কাকু ঘরে ঢুকেছে আমাদের সঙ্গে একটু খেলতে বসেছে, অমনি ফোনটা কান্না করতে শুরু করল জান? সিঁ সিঁ পিঁ পিঁ আওয়াজে কেঁদেই যাচ্ছে! কিন্তু কাকু বেরিয়ে গেলে আর বাজল না। আবার ঢুকল, অমনি বাজল। চলো ওদের বাড়ি, তোমাকে দেখাব। কী মজা না?

চমকে ওঠে সুবিমল। হাতের খালি গ্লাসটাও অসম্ভব ভারি মনে হয়। তার ছ বছরের বাচ্চা মেয়ে, এখনও ওকে সেফ চিপের কিছুই বোঝানো হয়নি, শুধু জিনিসটা ইন্সটল করেছে সুবিমল। বোঝাতে চেয়েছিল। শ্রেয়সী বাধা দিয়েছে। বলেছে শিশু মনে জটিলতা ঢুকিও না। পৃথিবীটা এতটাও খারাপ না। ও আমাদের সঙ্গে ছাড়া কোথায় যায় যে এসব করতে হবে?

কিছুই বোঝানো হয়নি তার ছোট্ট মেয়েটাকে। সে এখনও দুলে দুলে হাসছে আর বলছে কী মজা না বাবা! কাকু সামনে এলেই ফোনটা কেমন কাঁদতে শুরু করে! কী মজার না বাবা?



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *