short-story-gontobyo

গন্তব্য
বীথি চট্টোপাধ্যায়


মানুষ বিশ্বাসই করতে চায়না মৃত্যুতে সব শেষ৷ এত কথা, এত সংগ্রাম, আনন্দ দুঃখ সবকিছুই শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এটা আমরা সহজে মেনে নিতে পারি না। মেনে নেওয়া সত্যি সহজও নয় বিষয়টা। তথাগতবাবু বাকিদের দিকে একটু তাকালেন, তাই না?

তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, মানুষ তার জীবনকে বড়ো ভালবাসে৷ এই পৃথিবীকেও সে তার শরীরের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করে। তাই এই জীবন একদিন একেবারে শেষ হয়ে যাবে। কোথাও আর আমি থাকব না এই ভাবনাটাকে মানুষ খুব ভয় পায়। এমনকি যে মানুষ আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে সেও ভাবে তার চলে যাবার পরে এই পৃথিবীর চেনা পরিচিতরা কে কী ভাববে? সে জীবনে পৃথিবীকে যা বলতে পারল না, নিজের হাতে নিজের জীবন শেষ করে সেটা বলে যেতে চায় অনেক সময়। তাহলে তার লক্ষ্য কী? লক্ষ্য হল সেই পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষ। যেন সে দেখতে পাবে সে মারা গেল বলে কারা কাঁদছে, কারা অনুতপ্ত এইসব অনেক সময় মানুষ ভাবে আত্মহত্যা করবার আগে।

অপালা হাত তুলল, তথাগত বাবু বললেন বলো…

কিন্তু স্যার অনেকে ধরুন ধার শোধ করতে না পেরে বা কোনও ভয় থেকেও আত্মহত্যা করে। তাদের কী মনে হয়?

তথাগতবাবু বললেন, হ্যাঁ। এইসব কেসগুলো খুব প্যাথেটিক। তারা শেষ হবার আগে কী চিন্তা করে সেই নিয়ে মতবিরোধ আছে অনেক। তবে ভয় থেকে জীবনে যারা ইতি টানেন তাঁদের মধ্যে একটা ঘৃণা কাজ করে এই পরিমন্ডলের ওপর। তাঁরা ভাবেন তাঁদের বাঁচতে দেওয়া হল না। ধারে জর্জরিত হয়ে যাঁরা আত্মহত্যা করেন, তাঁরা অনেকেই অভিশাপ দিয়ে সুইসাইড নোট লেখেন; এদের সুইসাইড নোটের সঙ্গে ফাঁসির আসামীদের শেষ জবানবন্দির খুব মিল পাওয়া যায়। ফাঁসির আসামীরা প্রায় সকলেই দেখা গেছে বিচারপতিকে অভিশাপ দিয়েছেন শেষমুহূর্তে।

অদ্ভুত একটা ঘটনা এ বিষয়ে পড়েছিলাম। একজন আসামীর বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। ফাঁসির আদেশ স্থির হয়েছে। শুধু বিচারকের সই-এর অপেক্ষা। আসামী বলল, আমার ফাঁসির আদেশে সই করতে পারবে না বিচারক। বিচারক বললেন লাঞ্চের পর অর্ডারে সই করবেন। লাঞ্চ চলছে, বিচারকের মাথায় আকস্মিক ভেঙে পড়ল বিরাট ঝাড়বাতি। বিচারক মারা গেলেন। বছর খানেক পরে আবার সেই আসামীর ফাঁসি হবার দিন, আবার বিচারক মারা গেলেন এবারে আদালতে আাসবার পথে গাড়ি উল্টে। তারপর সেই আসমাীর ফাঁসি খারিজ হয়ে যায়। ঘটনাটি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ঘটেছিল।

শিমুল বলল, এটাও তো হতে পারে সেই সাংঘাতিক অপরাধী ইচ্ছে করে লোক লাগিয়ে ঝাড়টা ফেলে দিয়েছিল ওপর থেকে অথবা গাড়িটা উল্টে দিয়েছিল, গাড়ির কলকব্জা খুলিয়ে।

তথাগত বাবু বললেন চান্স খুব কম। কারণ লোকটি ছিল খুবই গরীব। একটি বাড়িতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে এসে বাড়ির সকলকে একে একে খুন করেছিল। শিশুদেরও নৃশংশভাবে মেরেছিল আরও নানা অত্যাচার করেছিল, ওরা তিনজন ছিল বাকি দুজনকে ঘটনাস্থলেই মার্কিন পুলিশ গুলি করে মেরে ফ্যালে, বাকি ছিল আমাদের এই কয়েদি জোসেফ। বহুবছর কেস চালিয়ে জোসেফের অবস্থা ছিল কপর্দকহীন। সে কী করে টাকা দিয়ে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ঝাড় জজের মাথায় ফেলবে বা দামি গাড়ি জেলে বসে উল্টে দেবে?

সৈকতে সমুদ্রের উদার হাওয়া। স্বর্গদ্বারে মেলার পরিবেশ। ওদের দলের কয়েকজন মেয়ে ঝিনুকের মালা কিনছে৷ কয়েকজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গরম জিলিপি ভাজিয়ে নিচ্ছে। প্রফেসার তথাগত মিত্র একটা চেয়ারে বসে সমুদ্র দেখছেন। তাঁর অধীনে এই ছেলে-মেয়েরা পি এইচ ডি করছে। সকলেই মনস্তত্ত্ব নিয়ে এম এস সি করেছে। এখন এরা মানুষের মনজগতে ভূত আর ভূতের ভয়ের ইতিহাস নিয়ে পি এইড ডি করছে। দিল্লি থেকে বিরাট গ্রান্ট এসেছে। দেশের বিভিন্ন হান্ডেট জায়গাগুলো ঘুরে দেখে খুঁটিয়ে লিখতে হবে কীভাবে জায়গাগুলো ভৌতিক বলে রটল। স্থানীয় মিথ কী, তার উৎসই বা কী? এরপর ভ্রমণপিয়াসু বাঙালির মন বলে কথা৷ ওরা ঠিক করে ফেলল পুরীকে কেন্দ্র করে ওরা ওদের রিসার্চের ফিল্ড ওয়ার্ক করবে।

ওড়িশার বিভিন্ন জায়গায় এমনিতেও ইতিহাস আর ভৌতিক উপকথা মিলেমিশে রয়েছে। ফলে পুরী বেড়াতে বেড়াতে ফিল্ড ওয়ার্ক ভালই করা যেতে পারে।

ওরা একটা বড়ো বাড়ি ভাড়া নিয়েছে সমুদ্রের ওপরে। আজ সকাল দশটার মধ্যে স্নান আর ব্রেকফাস্ট সেরে ওদের সাতজনের দল একেবারে প্রস্তুত৷ এখান থেকে ওরা যাবে মঙ্গলাজোড়ি গ্রামে, সেখানে এক ভুতুড়ে গাছের কাহিনি জানতে। ফেরবার পথে ওদের লক্ষ্য চাঁদপুরের বহু পুরোনো এক হানাবাড়ি দেখে ফেরা। চাঁদপুরে একটা রাত ওরা থেকেও যেতে পারে, সেটা অবস্থা বুঝে ওরা ঠিক করবে। দুপুরে মঙ্গলাজোড়ি গ্রামের মোড়লের বাড়িতে ওদের খাবার ব্যবস্থা হয়েছে।

তোমরা সকলে তৈরি, তাহলে বেরোনো যাক, তথাগত বাবু ঘড়ি দেখলেন৷ মৈনাক বলল, আমাদের তো সেই কখন হয়ে গেছে, মেয়েরা সাজতে গুজতে যা সময় নিল, বাপরে। বাসবদত্তা তীব্র প্রতিবাদ করল, আমরা সাজছিলাম, তোরাই তো সারাক্ষণ চুল ঠিক করছিস, কী জামা কাপড় ম্যাচ করতে বাছাবাছি করছিস যেন মঙ্গলাজোড়ির পেত্নী তোদের প্রোপোজ করবে বলে হাতে মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ কথায় কথায় সূর্য প্রায় মাথার ওপর চলে এসেছে। গন্তব্যে পৌঁছাতে আর বেশি দেরিও নেই। শীতকালের রৌদ্রস্নাত দুপুর৷ অপলা বলল, স্যার এই গাছটা কতদিনের পুরোনো ছিল এটা একটা পয়েন্ট। ছবি দেখে তো মনে হল কম করে চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের পুরোনো গাছ।

উৎকল টুডের কপিটা এনেছিস তো? অদ্রীশ সামনের সিট থেকে জিজ্ঞেস করল। আমার কাছে নেই। অপালা ঘাড় নাড়ে। তাহলে কার কাছে কাগজটা? কালই তো পড়া হল। তথাগতবাবু বললেন, ওটা আমি রেখেছি, কয়েকটা জায়গা আন্ডারলাইন করবার ছিল। গ্রামটি চোখ জুড়ানো বললে কম বলা হয়। মঙ্গলাজোড়িকে উড়িষ্যায় লোকে বলে পাখির গ্রাম বা বার্ডস ভিলেজ, টিঁয়াপাখি, বদ্রু পাখি নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোকিল ডাকছে এই শীতকালেও। বড়ো বড়ো পরিষ্কার জলাশয়, তাতে কতরকমের হাঁস, বক, দেখা যাচ্ছে মাছরাঙাকেও। জলাশয়ের ধারে গোলাপ বাগান। হাজার গোলাপ ফুল ফুটেছে। তার মৃদু গন্ধ বাতাসে। গোলাপ বাগানের পাশে মোড়লের তিনতলা বাড়ি। সাদা বাংলোর ধাঁচে একেবারে আধুনিক বাড়ি বলা যায়। বাড়ির সামনে খাচ্ছে একপাল বেড়াল, কুকুর, দশাশই চেহারা তাদের। বাড়ির বৈঠকখানায় কাজের লোকেরা কফি, দইয়ের ঘোল, নিমকি দিয়ে গেল ওদের।

বেশ কিছুক্ষণ ওরা বসে রইল। চারপাশে পাখিদের অবিশ্রান্ত কলরব৷ একটু পরে একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি ঘরে ঢুকলেন। মোড়ল বলতে যেরকম প্রাচীন গ্রামবৃদ্ধর ছবি ফুটে ওঠে এই লোকটির সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। সপ্রতিভ ইংরেজিতে লোকটি ওদের আপ্যায়ন করলেন৷ বোঝা যাচ্ছে, নিশীথ মোহান্তি বলে এই গ্রাম-প্রধান যথেষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তি। নিশীথবাবু জানালেন, তাঁর তিন মেয়ে, তাদের একজন কৃষি নিয়ে পড়াশোনা করছে যাতে গ্রামে তাদের চাষাবাদের পরম্পরাকে ধরে রাখতে পারে। আর একজন ডাক্তার। আর সবচেয়ে ছোট মেয়ে সে অনুসূয়া নৃত্যশিল্পী, তার অনেক ছবি রয়েছে নাচের পোশাকে। নিশীথ বাবু বললেন আজ একাদশী, আপনাদের মাছ খাওয়াতে পারব না দুপুরে। পোলাও, ডাল, ছানার ডালনা, এঁচোড়ের কোপ্তাকারি, পায়েস, মালপো, আর উড়িষ্যার বিখ্যাত ছানাপোড়া দিয়ে সামান্য খাবার আয়োজন করা হয়েছে। আগে আপনারা ফ্রেশ হয়ে খাবার ঘরে গিয়ে একটু খেয়ে নিন। ইকো ট্যুরিজমের জন্য বেশ নাম রয়েছে গ্রামটির। আসবার পথে অনেক কটেজ চোখে পড়েছে যেগুলো ভাড়া দিয়ে এদের ভাল রোজগার হয়। খাবার ঘরে একটা ধপধপে সাদা প্যাঁচা আলমারির মাথায় বসে রয়েছে চোখ বুজে। আর ডাইনিং টেবিলের নিচে পাপোশে গোটা দুই মোটা বেড়াল গুটিশুটি মেরে শুয়ে। খাবার ঘরে কর্মচারীরা পরিবেশন করছিল। তথাগতবাবু একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আপনাদের গ্রামে যে এত বেড়াল, কুকুর তারা পাখি ধরে না? এখানে এই প্যাঁচাটাকে কিছু বলে না বেড়ালেরা? প্রবীন কর্মচারীটি বললেন, না না এরা পাখিদের বন্ধু হয়ে গেছে। এই গ্রামের জীবজন্তুরা একেবারেই দুষ্টু নয় কারণ আমরা ওদের খেতে দিই, কেউ ওদের মারে না। ওরাও তাই খুব মিশুকে আর শান্ত। মৈনাক বলল, খুব সুন্দর আপনাদের এই গ্রাম, একেবারে আদর্শ মডেল যাকে বলে।

খাওয়া দাওয়া শেষে বাড়ির পিছনদিকের নিঃস্তব্ধ দাওয়ায় বসে নিশীথ মোহান্তি বললেন, এটাই মর্ডান ইন্ডিয়া। সত্যি আমরা আমাদের গ্রামটাকে খুব যত্নে গড়ে তুলেছি। এখানে হাসপাতাল বানিয়েছি, চারটে স্কুল, দুটো কলেজ বানিয়েছি। আমরা পুরোপুরি স্বনির্ভর। সুধাংশু বলল, মালপোগুলো তো অপূর্ব ছিল। এত ভাল মালপো জীবনে খাইনি, এত ভাল নিরামিষ খাবারও বহুদিন পরে খেলাম। মিস্টার মোহান্তি বললেন, আমাদের নিজেদের ডেয়ারি দুধের এইসব মিষ্টি। আর আমাদের ডেয়ারি কিন্তু ক্রুয়েল্টি ফ্রি, ইকো ফ্রেন্ডলি ডেয়ারি। অপালা বলল, যত দেখছি ততই অবাক লাগছে। আচ্ছা ওই গাছটা যেখানে ছিল সেই জায়গাটায় আমরা একবার যাব, আসলে কয়েকটা বিষয় নিজের চোখে দেখতে চাইছি।

মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেলেন মিস্টার মোহান্তি। চুপ করে কঠিন মুখে বললেন। দ্যাটস সাউন্ড গুড বাট নট পসিবল। পারমিশন কান্ট বি গ্রান্টেড ফর ইট।

অপালা বলল, কিছু যদি মনে না করেন, আপনি তো একজন এনলাইটেড পারসন৷ ভারতবর্ষের একটা জায়গায় যাবার জন্য আমরা আপনার অনুমতি কেন নেব? আপনি এই গ্রামের মোড়ল তাই?

মিস্টার মোহান্তি বললেন, গুড কোশ্চেন। আমি আপনাদের অনুমতি দেবার কেউ নই। কিন্তু যেখানে বেশ কয়েকটা মৃত্যু হয়ে গেছে, সেই জায়গাটা পুলিশ দড়ি দিয়ে সিল করে রেখেছে; ফলে আপনারা তো পুলিশ পারমিশন ছাড়া ওখানে যেতে পারবেন না। আশা করি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন।

শিমুল করুণ সুরে তথাগতবাবুকে বলল, স্যার যাওয়া হবে না তাহলে? মৌসুমী বলল, আমার কেমন একটা মন চাইছিল না যেতে, ভালই হল। এখানে এদের মুখে শুনেই তো সব জেনে যাব। সেগুলো লিখলে কি পেপার অশুদ্ধ হয়ে যাবে নাকি? কী দরকার বাবা ওই ভূতের জঙ্গলে যাবার!

মিস্টার মোহান্তি বললেন, এই মেয়েটি তো ঠিকই বলছে, শুধু পেপার তৈরি করার জন্যে ওই জায়গায় কাছে না গেলেও চলবে। তার থেকে ঘটনাগুলো আমাদের মুখ থেকে শুনে নেওয়া মাচ বেটার৷

মাটির দাওয়ার ওপর অল্প ধুলোর আস্তরণ, অথচ এদের গ্রাম খুব পরিচ্ছন্ন। দাওয়ার পাশে দীঘির জলে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। তথাগতবাবু বললেন, আসলে আমারা তো একটা ফিল্ড ওয়ার্কে এসেছি। গাছটার বয়স আনুমানিক কত ছিল?

মিস্টার মোহান্তি বললেন, জিওজিকাল সার্ভের রিপোর্টের হিসেবে গাছটার গায়ে একশো বছরের পুরোনো মাটি পাওয়া গিয়েছিল। সেই রিপোর্ট আপনাদের মেল করে দেব৷ আপনাদের থিসিসে অ্যাড করে দেবেন৷ একবার এখানে খুব ঝড় হয়, সেটা বছর কুড়ি আগের ঘটনা। তখন গাছটার ওপর খুব জোরে বাজ পড়ে। সেই থেকে গাছটা মরে শুকনো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পাতা ছিল না। পাখির বাসা ছিল না। এরপর সরকার উদ্যোগ নেয় মরা গাছটা কেটে জায়গাটা পরিষ্কার করবার। কারণ মৃত গাছের ডাল নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল কারুর মাথায় বটগাছের ভারি ডাল পড়ে বিপদ হতে পারত। মিস্টার মোহান্তি থামলেন।

তথাগতবাবু বললেন তারপর মরা গাছটা সরাতে যেতেই তো শুরু হল যত বিপত্তি।

মিস্টার মোহান্তি বললেন, যারা গাছটা কাটতে এসেছিল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে তিনটি ছেলেই মারা যায়। অথচ ওদের কারুরই কোনও অসুখ ছিল না। তারপর আবার তিনজন ঠিকে শ্রমিক গাছে ওঠে ডালগুলো কাটবে বলে। দুজন গাছ থেকে পড়ে যায় আর সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আর একটি ছেলে খুব ভয় পায়। গ্রাম থেকে সে পালিয়ে যাবে ঠিক করে। একটা ভ্যানে চড়ে বসে, যেটা কটক যাচ্ছিল। হাইওয়েতে ভ্যানটা উল্টে যায়। অন্য যাত্রীরা বেঁচে গেলেও রামু বলে ওই ছেলেটি মারা যায়। এরপর সকলে রটিয়ে দেয় ওই গাছে একটি মেয়ের প্রেতাত্মা বাস করে। জায়গাটা টেরর হয়ে ওঠে। পুলিশও আর গাছটা সরাতে সাহস পায় না। আমি সেন্ট্রাল গভমেন্ট আর আমাদের স্টেট গভমেন্ট দু-জায়গাতে অনুরোধ করি যাতে মরা গাছটা সরিয়ে নেওয়া হয় কারণ একটা মরা গাছ বড় জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে জায়গাটা অন্ধকার করে রাখছিল। মানুষের মধ্যে অদ্ভুত আতঙ্ক আর গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল। আমি এই প্যানিকটা বন্ধ করতে চেয়েছিলাম।

তখন আমার একটা গাড়ির ড্রাইভার ভবানী বেহারা নামে একটা ছোট ছেলে বলে সে একাই দলবল নিয়ে গাছটা কেটে জায়গাটা পরিষ্কার করে দেবে। কথামতো ভবানী তার দল নিয়ে সাতদিন ধরে গাছের ডাল, কান্ড সব কেটে জায়গাটা একেবারে সাফ করে দেয়। কাজ শেষে করে ভবানী দু-তিনদিন ভালই ছিল। ভূত টুত সব রটনা একথা গ্রামের অনেকে ভাবতেও শুরু করেছিল। কিন্তু গাছটা সরানোর তিনদিন পর নিজের বোনের ওড়নায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ভবানীর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়। পোস্টমর্টমে আত্মহত্যাই প্রমাণিত হয়েছিল। সুইসাইড নোটে ভবানি লিখেছিল সাদা ওড়না জড়ানো এক প্রেতিনী তাকে বাঁচতে দিল না। এরপর থেকে জায়গাটায় দিনের বেলাতেও আর কেউ যায় না। পুলিশ জায়গাটা সিল করে দিয়েছে যাতে প্যানিক ছড়িয়ে কোনও অঘটন না ঘটে। তাই আপনাদেরও ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়।

মৈনাক বলল, আসলে এত কাছে এসে একবার দেখব না জায়গাটা? আপনি চাইলে পুলিশ পারমিশন কোন ব্যাপারই নয় মিস্টার মোহান্তি।

মিস্টার মোহান্তি একটু হাসলেন৷ সামনে পঞ্চায়েত ইলেকশন। ওইখানে কেউ যাক এটা গ্রামবাসীরা চায় না। আপনারা তো দেখছি আমাকে ইলেকশনে হারিয়ে দেবেন।

বাসবদত্তা বলল, ওই যে মেয়েটার আত্মা গাছে থাকে বলে মিথ রটেছে। সেই মেয়েটার নাম কী? মেয়েটা কি এই গ্রামেরই কেউ ছিল? মিস্টার মোহান্তি বললেন, হুঁ আমি তাই শুনেছি। মেয়েটার নামটা ঠিক বলতে পারব না।

তথাগতবাবু আর তাঁর ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করল মোড়লের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তারা এই জেলার এসপির সাহায্য চাইবে যদি গাছটা যেখানে ছিল সেই জায়গাটা একবার দেখা যায়।

নিশীথ মোহান্তির বাড়ি থেকে বেরোবার জন্যে ওরা প্রস্তুত। দু-একজন কাজের লোক-কে বাড়ির এদিকে ওদিকে দেখা যাচ্ছিল। তথাগতবাবু তাঁদের একজনকে অনুরোধ করলেন, মিস্টার মোহান্তির সঙ্গে একবার দেখা করে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে যাব৷ একবার যদি মিস্টার মোহান্তিকে ডাকতেন। কাজের লোকটি বলল উনি এখন বাড়ি নেই৷ একটু পরে ফিরবেন। মৌসুমী বলল, এইতো একটু আগেই বাড়ি ছিলেন, তারপরেই বেরিয়ে গেলেন নাকি? অদ্ভুত!

ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল, গেটে ওদের কেউ এগিয়েও দিতে এল না। এদিকে এত এলাহি আথিথেয়তা করলেন এতক্ষণ! ওরা বেরোবার মুহূর্তে বাড়ির গেটের বাইরে হঠাৎ একটা বড়ো জিপ গাড়ি এসে থামল। সেই গাড়ি থেকে নামলেন সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক। অনেকটা নিশীথ মোহান্তির মতো দেখতে। হয়তো তাঁর ভাই হতে পারেন৷ তথাগতবাবুদের দলটাকে দেখে ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন একি আপনারা চলে যাচ্ছেন? আমি প্রদীপ মোহান্তি৷ খুব জরুরি কাজ ছিল বলে আপনাদের লাঞ্চের সময় থাকতে পারলাম না। আপনারা ওই গাছের জায়গাটা দেখবেন বলেছিলেন আমি ওসিকে বলে রেখেছি৷ চলুন আপনাদের ঘুরিয়ে আনি৷ কিন্তু আপনাদের এই গাড়িতে গেলে ওইদিকে কাদায় এই গাড়ির চাকা বসে যেতে পারে৷ রাস্তা তো ভালো নয়। আমার জিপে করে আপনাদের ঘুরিয়ে আনি চলুন। জিপ প্রদীপ মোহান্তি নিজেই চালাচ্ছেন। তথাগতবাবু ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তো যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। অথচ নিশীথ মোহান্তি এক কথায় ওদের যাওয়া নাকচ করে দিয়েছিলেন! তথাগতবাবু বললেন আপনি কি মিস্টার নিশীথ মোহান্তির কেউ হন?

প্রদীপ মোহান্তি সজোরে গাড়িটা ঘোরালেন। বললেন, আমার দাদা। দাদাই তো প্রায় একার চেষ্টায় এই গ্রামটাকে এতটা আধুনিক করে তুলেছিলেন। এই গ্রাম ছিল দাদার প্রাণ। সকলে এখানে এখনও আমার দাদাকে দেবতা মনে করে। তারপর আমার ছোট ভাইঝি অনুসূয়া সুইসাইড করল। যে গাছটার কাছে আপনারা যাচ্ছেন সেই গাছের সঙ্গে নিজের সাদা ওড়না জড়িয়ে ঝুলে রইল সারারাত। নানা রটনা রটল। দাদা প্রায় পাগল হয়ে গেলেন। শেষদিকে তো দাদাকে ঘরে আটকে রাখতে হত। তারপর একদিন সব যন্ত্রণা থেকে দাদা মুক্তি পেলেন৷ একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, সব শেষ। আপনারা বাড়িতে ঠিকমতো লাঞ্চ করেছেন তো? এখন কিন্তু অনেকদূর যেতে হবে। অনেকটা রাস্তা আমার সঙ্গে থাকতে হবে…দুপুরের রোদ পড়ে এসেছে গাড়ি ছুটছে পড়ন্ত রৌদ্রের পথ ধরে। ছ-জন ছাত্রছাত্রী আর তথাগত বাবু হাত নেড়ে হয়তো গাড়ি থামাতে বলছেন প্রদীপ মোহান্তিকে৷ কিন্তু গাড়িটা থামছে না। গাড়িটা নিঃসীম পথ ধরে ছুটেই চলেছে।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *