জয়তী রায়
নাহ্। নেই।
খুঁজছে প্রমা। শুনতে নিরীহ খোঁজা শব্দটি কাজের সময় নির্মম হত্যাকারীর ভূমিকা নেয়! দরকারের সময় পাওয়া যাবে না তো যাবেই না! কিচেনের প্রতিটি সেলফ, বুক কেসের পিছন, ওষুধ রাখার তাক, বাসন রাখার ক্যাবিনেট, টুক করে গিয়ে বাথরুমের বেসিনের নিচের খোপ জায়গা… পার্টির জন্য দরকার। আজকে শনিবার। বাড়ির ছাদে মুনলাইট পার্টি। মোটামুটি একই বয়েসের দশজনের গ্রুপ। বাচ্চাগুলো সবকটার বয়স দশের ঘরে। জমে যায় ব্যাপারটা। — মদ্যপানের পরে ডায়ালগগুলি কি ঝাড়বে সেটাও জানা থাকায় হাসির হররা ওঠে। একটা ব্যাপার অবশ্য প্রমার সঙ্গে মেলে না। শাশুড়ি নিয়ে সমস্যা! স্মার্ট ড্যাশিং ট্রেন্ডি পোশাক, হাতে সিগারেট, রঙীন পানীয়, ইংরেজি ভাষায় ফুলঝুরি, বাংলা বলবে ত্যাড়া স্বরে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে — চরম আধুনিক যুবক – যুবতী মাঝে মাঝে বিষয় তুলে আনে দিদিমাদের মত। কাজের লোক এবং শ্বশুরবাড়ি। রতিন আর রূপা যেমন আলাদা হয়ে গেছে, ওদের শাশুড়ি একলা থাকে। তন্ময়ের কেস আলাদা। প্রচুর ট্রাভেল করে, ওদের মিষ্টি বাচ্চাটা কথা বলে না। স্পেশাল বাচ্চা। একদিন জানা গেল, তন্ময় নিজের মাকে রেখে এসেছে কেয়ার হোমে। ভদ্রমহিলা খুশি মনে মেনে নিয়েছেন। পরিষ্কার বলেছেন — সম্পর্ক ভালো রইল। বেশ আছি।
তন্ময়ের বৌ রিয়া মুখ ভেংচে বলে — বাড়ি থাকলে ঝামেলা বলে মহিলা পালিয়ে গেলেন। আয়া দিয়ে রেখে মাঝে মধ্যে সিনেমা যেতাম। সহ্য হল না।
নির্ঝর আর মাধবী সিরিয়াস টাইপ। জ্ঞান ঝাড়বে। লেকচার দেবে। এদিকে শ্বশুর – শাশুড়ি দুজনকে দিয়ে রাজ্যের কাজ করায়। শ্বশুর বেশ জাঁদরেল। প্রয়োজনমত কথা শুনিয়ে দেন। অশান্তি লেগেই থাকে। প্রমা আর অর্কর পরিবার নিয়ে সকলে বেশ তারিফ করে। ভালোবাসাবাসির বিয়ে। দুজনের পরিবার সম্পন্ন। অর্কের বাবা নেই। মায়ের নাম নীলা। চাকরি করেছেন। রিটায়ার করেছেন। পেনশন ভালোই। ঝামেলাহীন মহিলা। উল্টে রাজ্যের খরচ করবে। এই বাড়িটা শাশুড়ির। শহরের কেন্দ্রে এমন খোলামেলা বসতবাড়ি আজকাল আর কোথায়? একতলা দোতলা মিলিয়ে বাড়ি। নিচে কিচেন। বসার ঘর। লম্বা টানা বারান্দা। দোতলায় শোবার ঘর। চারটে ঘর। সেগুলোর সাইজ বেশ বড়। নীলার ঘর সবচেয়ে বড়। বিরাট পালঙ্ক। উঁচু সিলিং। খোলা জানালা দিয়ে অফুরন্ত বাতাস আর আলোর লুটোপুটি। একদিকে কাঠের আলমারি। টেবিল। চেয়ার। এই ঘরের সঙ্গে আছে বারান্দা। বেতের চেয়ার টেবিল। প্রমা শুনেছে, অর্কর দাদুর ঘর ছিল ওটা। সেইজন্যেই দেওয়ালের গায়ে দাদুর ছবি। অর্কর বাবার ছবি নিচের তলায় ঝুলে আছে। বাড়ির ছাদটা বিরাট। বন্ধুদের পার্টি এখানেই হয় বেশিরভাগ। নীলার কোনো আপত্তি নেই। নিজের ঘরে ঢুকে চুপচাপ থাকে। এইরকম সমস্যাহীন শাশুড়ি — দেখা যায় না। চেহারাটা বেশ শক্ত পোক্ত। সত্তরবছরের তুলনায় চৌকস। কুন্তী আছে। সবসময়ের কাজের লোক। নিচের তলায় ঘর আছে ওর। রামুদা আছে। বাজার – হাট করে টুকটাক ফরমাশ খেটে বাড়ি চলে যায়। শাশুড়ি লাগাতার সিঁড়ি ভেঙে উপর নিচ করেন। একাভোগা ব্যাপারটা নেই। থাকেন পরিপাটি। পরিষ্কার। সেলাই করেন। ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখেন। অল্প সময়ের জন্যে দেখেন। সিরিয়াল না দেখে বই পড়েন। সেই তুলনায় প্রমার বাপের বাড়ি গোলমেলে। মায়ের হাঁটুর ব্যথার নালিশের সঙ্গে আছে পারিবারিক অশান্তি। বাবা – মা মানিয়ে নিতে পারছে না দাদা বৌদির সঙ্গে। কার দোষ কে জানে? বাপের বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না। গেলে একগাদা নিন্দে শুনবে বৌদির নামে।
ভাবতে ভাবতে থুপ করে ঠোকর লাগল পায়ে। টুবাইয়ের বল। চেঁচিয়ে উঠল প্রমা — টুবাই? এটা কী হচ্ছে? গোটা বিরক্তি টেনশন ঢেলে দিল নরম বল আর ছেলের উপরে। খাঁচার চন্দনা পাখি দুলতে দুলতে বলে উঠল —- হারাল কী? কী হারাল?
প্রমার ফর্সা মুখ লালচে। নীলার পেয়ারের পাখি। অবিকল ওই ভাবেই জিজ্ঞেস করবে। রাতে পার্টি। আগে সব সাজিয়ে আরাম করবে তা নয় খুঁজে মরছে জিনিস। খাবার বাইরে থেকে আসবে কিন্তু ছোট ছোট অনেক কাজ থাকে। গ্লাস, পেপার প্লেট, চামচ — টুকিটাকি গুছিয়ে রাখতে হয়। বন্ধু সবাই আবার শত্রুও। মুখে হাজার তারিফ করলেও টুক করে দেখে নেয় কোনখানে ভুল আছে। গসিপের রসদ না হলে মনের আরাম কিসের? শিক্ষা চাকরি লাইফ স্টাইল নিয়ে আধুনিক চেহারার ভিতরে ঘুরে মরছে পল্লী সমাজ! অর্ক বিরক্ত হয়। প্রমা নাকি বাড়াবাড়ি করে। জীবনের মূল্যবোধ এখন একেবারে আলাদা। সময় থাকতে গুছিয়ে নিতে হবে!
উফ্! টুবাইয়ের খেলনায় আবার ঠোক্কর লেগেছে। ছেলেটা আজ বাড়িতে। ঘুরছে ফিরছে আর প্রশ্ন করছে। হাজার প্রশ্ন। — চোরাশিকার কাকে বলে? মা বলো? জঙ্গলে কী হয়? জঙ্গলে কারা চুরি করে? অর্ক ওমনি বলছে — প্রমা, বলো।
প্রমা রেগে যাচ্ছে মনে মনে। প্রেম করার সময় টের পায়নি, একসঙ্গে থাকছে আর বুঝেছে, অর্ক একটি স্বার্থপর জীব। টুবাই জন্ম থেকে রুগ্ন। চাকরি ছাড়তে চেয়েছিল প্রমা। অর্ক সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল —- অতগুলো টাকা! কুন্তী আছে। মা আছেন। চাকরি ছাড়বে না। এদিকে নিজে ছেড়ে দিয়েছে চাকরি। করছে ব্যবসা!
টুবাই ঘুরছে ফিরছে আর জিজ্ঞেস করেই চলেছে — মা, চোরাশিকারি কি গো? নীলা তাড়াতাড়ি বললেন — অর্ক, ফোন রাখ। ছেলেটাকে দেখ। প্রমা, কি খুঁজে পাচ্ছ না? — টিসু বক্স পাচ্ছি না। ভাজা ভুজি খাবে আর পেপার ন্যাপকিন না হলে তো হবে না। হাফ পালাজো টিশার্ট সামলে ছোট চুল ঝাপটে সোজা হয়ে দাঁড়াল প্রমা। অল্প গরম পড়েছে। চকচক ত্বকে ঘাম ফোঁটা ফোঁটা। নীলা বলে — আগে বলবি তো। গরু খোঁজা খুঁজিস কেন? এই তো। ওভেনের পিছনে।
মাইক্রোওভেনের পিছনে টিসুর প্যাকেট? প্রমা জানে এটা কার কাজ। টিসুর প্যাকেটের হাত পা গজিয়েছে যে ওখানে যাবে? নীলা করেছে। মাঝে মাঝে করেন। পার্টির সময়, অফিস যাওয়ার সময়, টুবাইয়ের স্কুল যাওয়ার সময় খুঁজে পাওয়া যায় না জরুরি কিছু। ঠিক তখনি মহান ত্রাতার ভূমিকায় উনি অবতীর্ণ হন — এই তো রে। এটা এখানেই তো আছে।
তুমুল লজ্জা। ছেলেটার অবাক চোখ। অর্কর গোমড়া মুখ। কাজের মেয়ের ফিক হাসি, খাঁচার চন্দনার পাখা ঝাপটানোর মধ্যে দিয়ে নীলা বিজয় গর্বে রাজকীয় ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যান। আজকেও তাই। কিল খেয়ে হজম করা ছাড়া উপায় নেই কিছু। হিসেব করে ভেবে চিন্তে নজর এড়িয়ে টুক করে লুকিয়ে ফেলবেন জিনিসটা। বারান্দার ফুলের টবের পাশে মোজা? হয় কখনো? ঝগড়া করার সুযোগ নেই আর ঝগড়া করতে পারে না প্রমা। ভালো লাগে না। তুচ্ছ ঘটনায় নিজেকে তুচ্ছ করতে মন চায় না। অর্ককে নালিশ করে লাভ নেই। পয়সা কড়ির হিসেবে চালাক ছেলে অর্ক জানে বাড়িটার বাজারদর। মা চটবে এমন কোনো কাজ করবে না। হজম করে প্রমা। সংসারে চলতে গেলে কত কিছুই হজম করতে হয়!
*********
পার্টি জমে গেল। পরদিন রবিবার। সকালে ওঠার চিন্তা নেই। বাচ্চা নিয়ে এসেছিল সবাই। দোতলা জুড়ে বাচ্চাদের হই হই সামলে নিয়েছে কাজের মেয়ে কুন্তী। নীলা যতক্ষণ পেরেছেন ওদের দেখে শুনে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন। বৈশাখী পূর্ণিমার জোছনা ছিল। টুনিলাইট ছিল জোনাকির মত। পানীয় আর বিরিয়ানি খেয়ে প্রাণ খুলে মস্তি। ঘুমন্ত বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সকলেই বলে গেল — মাসিমাকে থ্যাংকস জানিয়ে দিস। আসল ধকল উনি সামলে না দিলে এত মজা করতে পারতাম না।
তানিয়া চোখ টিপল — প্রমা, তুই এত সুন্দরী হচ্ছিস কেন জানিস? ওই নীলাদেবীর কল্যানে। নো টেনসন লাইফ। আর আমার দেখ, ডিভোর্স হতে চলল বরের মায়ের জন্যে।
তানিয়া একলা এসেছে। রাহুলের সঙ্গে থাকে না। থাকতে পারল না। বাড়িতে একটা টিকটিকি মরলেও রাহুলের মা আর দিদি বলবে, সেটা নাকি হয় তানিয়ার চাকরি করার জন্যে! অপয়া। অলক্ষ্মী। শেয়ার লোকসান থেকে বিহারের গ্রামের বাড়ির আগুন লাগা — যা কিছুই হোক দায়ী তানিয়া। ভিতরের গল্প সনাতনী লোভ। রাহুলের আবার বিয়ে দিতে চায়! খারাপ ব্যবহারের ঘাস জমির নিচে সুচতুর ফাঁদ। তানিয়া সেখানে পা ফেলেছে। চলে এসেছে ভাড়ার ছোট্ট এপার্টমেন্টে। দাদা বৌদির সংসারে ফিরে গিয়ে লাভ নেই। আজকের পার্টিতে রাহুল অফ। একলা ফিরে যাচ্ছে মেয়েটা! ইস্। বিয়ের দিন রানির মত লাগছিল। তছনছ হয়ে গেল স্বপ্নের বাগান। তানিয়া এখন সম্পর্ককে ভয় পায়। নীলরঙের গাউন পরা বিষন্ন সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে প্রমা হাত নাড়ল — তান্নি, ফ্ল্যাটে পৌঁছে ফোন করিস।
*********
মাঝে মাঝে কালো হয়ে আসে আকাশ। বৈশাখ মাস। কখন তান্ডব ধেয়ে আসে বলা বলা যায় না। নীলা এর মধ্যে একদিন পড়ে গেলেন বাথরুমে। অল্পের উপর দিয়ে গেল। তেমন কিছু না হলেও, অর্ক একেবারে হাঙ্গামা শুরু করে দিল — মা , শুয়ে থাকো। মা, অমুক করো। মা, আয়া রেখে দেব।
নীলা নিজেই ধমক দিলেন — কুন্তী আছে। রামু আছে। হাত ভাঙেনি পা ভাঙেনি। তুই চুপ করবি?
অর্ক দ্বিগুণ জোরে চেঁচায় — যে কোনো সময় হতে পারে। হঠাৎ করে কিছু হলে … আমি তো পথে বসে যাব।
নীলা অবাক — তুই কেন পথে বসবি? যা কিছু আছে সবই তো তোর।
হাত নেড়ে মুখ নেড়ে অর্ক বলে — উইল দিয়ে কী হবে? আজকাল গিফট্ ডিডের যুগ। তুমি বরং বাড়িটা গিফট্ ডিড করে দাও আমার নামে। ঝামেলা খতম।
নীলা বলেন — দেখা যাবে। এখন তুই যা। টুবাই পড়ছে না। জ্বালাচ্ছে।
অর্ক চেয়ার টেনে বসে। চশমা খুলে টেবিলে রেখে বলে — ধুর। ক্লাস ফাইভের আবার পড়া? ছাড়ো তো!
—- ওরে, কোথায় দেখেছে হাতি চোর শিকারির গল্প। কত মাস হয়ে গেল। ভুলে যায় না। জ্বালিয়ে খাচ্ছে একেবারে।
অর্ক চশমা খুলে টেবিলের উপর রেখে বলে —- আমি কেন? প্রমা বলেনি?
নীলা রাগত গলায় বলে —- তুই কেন বলবি না? প্রমা চাকরি করে। তুই কিসের ব্যবসা করিস ভগবান জানে। কেন ছাড়লি চাকরি?
অর্ক শব্দ করে চেয়ার সরিয়ে ওঠে —- কেন? ব্যবসা খারাপ নাকি? পয়সা লাগাতে হয় তবে পয়সা উঠে আসে।
নীলা সমান তেজে বলেন —- আমার কাছে চাইবি না আর। অনেক দিয়েছি।
অর্ক আমল দেয় না। হেসে বলে — তোমার পালঙ্ক বেচলে কত টাকা পাব ধারণা আছে? যাক গে, আমি বরং চা খেয়ে তোমার নাতিকে কেরালার হাতি চোরা শিকারিদের গল্পটা বলে ফেলি। —- গল্প কেন রে? ঘটনা তো সত্য। ঘটছে কত। পোচার না কি যেন?
হাই তুলে বলে অর্ক —- ঘটছে তো। কোটি কোটি টাকার জন্যে মারছে। হাতির দাঁত চাই। —– আহা। দেখ। লোভের জন্য মানুষ কি না করে।
অর্ক ছটফট গলায় বলে —- লোভ খারাপ নয় মা। একটা উদ্দীপক। লোভ না থাকলে লাভ হতে পারে কখনো?
—- তুই থাম। বড্ড বদলে যাচ্ছিস। যা এখান থেকে।
অর্ক সুর ভাঁজতে ভাঁজতে চলে যায়। নীলা নিজের ফোন থেকে প্রমাকে ফোন করতে যাবেন এইসময় নিচের তলায় বেল বাজে। কুন্তীর কলকল গলা পাওয়া যায় —- ভিজে কাক হয়েছ বৌদিমণি। এসো এসো। আদা চা করে দি।
*******
গিফট্ ডিড করে ক্ষান্ত দিল অর্ক। নীলাও আপত্তি করেননি। আইন জটিলতা কম হবে — কে জানে কিসের আইন? প্রমা বলেছিল, চট করে বিক্রি করতে সুবিধা হবে। টাকা তো লাগল অনেকগুলো। দরকার কি ছিল? বিক্রি করুক বা রাখুক — নীলার কোনো আপত্তি নেই। মরে গেলে কে আর দেখতে আসছে। তবে, বেঁচে থাকতে নয়। কিচ্ছু করতে দেবেন না। বাড়িটার প্রতি তীব্র আকর্ষণ আছে নীলার। শ্বশুরের আমলের বাড়ি। স্বামীর ছিল আরো তিনটে ভাই। নতুন বৌ নীলা বাড়ি দেখে মুগ্ধ। মধ্যবিত্ত ভাড়াবাড়িতে জন্ম। বাবা করতেন সরকারি চাকরি। বাংলায় গ্রাজুয়েট। এক ভাই দুই বোন নিয়ে সাধারণ সংসারের মেয়ের রূপ দেখে পছন্দ হয় শ্বশুরের। বড়ছেলের বৌ করতে দেরি করেননি। একতলা – দোতলা মিলিয়ে মল পরে ঝমঝম করে ঘুরে বেড়াতে স্বপ্নের মত লাগত নীলার। নিজের বাড়ি। মাস গেলে টাকা গুণে অন্যের হাতে দিতে হয় না। শ্বশুরকে যত্ন করতেন। বিশেষ যত্ন। শাশুড়ি পাত্তা পেত না। জরুরি জিনিস লুকিয়ে ফেলে টুক করে খুঁজে দিতেন। বাড়ির দলিল। কোথায় গেল কোথায় গেল – তুমুল কলরবের মধ্যে পাওয়া যেত সিন্দুকের পিছনে! নীলা খুঁজে দিত। সোনার ঘড়ি পাওয়া গেল বিশ্বাসী কাজের লোক হরিনাথের ঘর থেকে। চোখের জল মুছে বিদায় নিল হরিনাথ। শ্বশুর আফিম খেতেন। ডিবে খুঁজে না পেলে বকুনি দিতেন নিরীহ শাশুড়িকে। মনের কষ্টে মরেই গেল বেচারি। নীলা হয়ে উঠল শ্বশুরের হাতের লাঠি। অবলম্বন। তারপর আর কি! বাড়ি শ্বশুর লিখে দিলেন তার নামে। দ্যাওরদের তর্জন গর্জন অশ্লীল ইঙ্গিত — কিচ্ছু গুরুত্ব দেননি। লোভ না থাকলে লাভ হয় না। খাঁটি কথা বলেছে অর্ক।
হাতের বই গুটিয়ে ফেলেন নীলা। বৈশাখ মাসের শেষ হতে চলল। গুমোট গরম। রাত বাড়ছে। নিচের থেকে ডিনার খেয়ে এসেছেন। মাছের ঝাল ভালোই করেছিল কুন্তী। অর্ক দুমদাম করে খায়। টুবাই মাছ খাবেই না। চিকেন হয়েছে আলাদা করে। প্রমা কেমন চুপচাপ খেল। মেয়েটা কম খায়। রোগা হওয়ার বাতিক। যা খুশি করুক। মাথায় চড়ে না নাচলেই হল। সেটা করবে না। জাত চেনা যায়। নিরীহ। অনেকটা অর্কের বাবার মত। বুঝবে, দেখবে ফুটবে না মুখ। বেচারার দল! হাই তুলে, চশমা ভাঁজ করে, বালিশ আঁকড়ে শুতে যাবেন দরজায় ছায়া পড়ে।
প্রমা।
নীলা ডাকে —- কি রে?
প্রমা আনমনা। মেঝে ঘষটে এগিয়ে এসে বসে খাটের পাশে। দুর্বল লাগে মেয়েটাকে। চোখের কোনে কালি। নিস্তেজ গলায় বলে —- বিরক্ত করলাম?
—- কেন বিরক্ত করবি? আয় এখানে।
প্রমা বলে — গরম লাগছে? এসি চালাও নি?
—- না রে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস আসছে।
প্রমা বিছানার পাশে বসে। থেমে থেমে বলে —–জানো মা, তানিয়ার ডিভোর্স হয়ে গেল। নীলা বালিশে ভর দিয়ে উঠলেন। বৌমার কিছু হয়েছে। আবোল তাবোল বকছে। ডিভোর্স তো হবেই জানা কথা ছিল। তিনি স্নেহের সুরে বললেন — যা। বিশ্রাম কর। তানিয়া আবার বিয়ে করবে, চিন্তা কিসের?
প্রমা প্রায় ডুকরে উঠল — ওর বাড়িটা … কত সুন্দর গাছ লাগিয়েছিল … ব্যালকনিতে দোলনা … সব চলে গেল?
নীলা এবার রেগে গেলেন। রাত দুপুরে ঢং হচ্ছে? কড়া গলায় বললেন — চাকরি করে। ফ্ল্যাট কিনে ফেলবে। এত ভাবনা কিসের? তুই শুতে যা।
প্রমা অদ্ভুত গলায় বলে, তোমার বাড়ি চলে গেলে আরেকটা বাড়িতে থাকতে কষ্ট হবে না তোমার? ছিটকে ওঠেন নীলা — তুই … আমার বাড়ি নিয়ে … বলবি কি হয়েছে?
থরথর গলায় প্রমা বলে — বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। ফ্ল্যাট হবে। আমরা একটা ফ্ল্যাট পাব। আর… অনেক টাকা। অর্কর ব্যবসা মন্দা যাচ্ছিল। প্রমা কেঁদে ফেলে।
কুন্তী দরজার সামনে দুধের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে।
গুমোট গরমে হাঁসফাঁস করেন নীলা। অর্ক কোথায়?
ছেলেকে গল্প বলছে। চোর -শিকারির গল্প।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
এক কথায় অনবদ্য….অসাধারণ…প্রতিবারের মতো…
থ্যাঙ্কু
Sundor Lekha..
Lipi datta
Khub bhalo laglo .porlam purota .
অত্যন্ত ভাল লেখা।বরাবরের মত এবারও খুব ভাল লাগল।
অসাধারণ লেখা।মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লাম।