short-story-raat-dokhol

রাত দখল
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়


ক’দিন ধরে চারদিকে পোস্টার পড়েছে ‘রাত দখল’ ‘রাত দখল’, ফেসবুকে, হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপগুলোতে ভরে গেছে লাইক আর কমেন্টস–এ৷ পাতাসি তার বন্ধু লায়লাকে লিখল, কী রে, লায়লা৷ সত্যিই কি সবাই রাত জাগবে?

লায়লা তার উত্তরে লিখল, আমাদের পাড়ায় তো অনেকেই যাবে শুনছি৷

––তুই যাবি নাকি!

––আমি তো যাবই৷ যা সব টিভিতে দেখছি, শুনছি, তাতে গা শিউরে উঠছে৷ যারা এ ধরনের কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কিছু তো একটা করার দরকার৷ তুই যাবিনে?

পাতাসি লেখে, আমার তো যাওয়ার খুব ইচ্ছে৷ কিন্তু আমাদের পাড়াটা যেন কেমন–কেমন৷ কেউ কারও সঙ্গে মেশে না, কথা বলে না৷

––তোদের কদমতলা থেকে আমাদের শিবমন্দির অনেকটাই দূরে৷ না হলে আমাদের সঙ্গে যেতিস৷

পাতাসি লেখে, দেখি বাবাকে বলে৷ বলব সকাল–সকাল ঘরে ফিরতে৷ বলব আমাকে আর মাকে নিয়ে রাত দখলে যেতে৷

পাতাসির বাবা সুরজিৎ পেশায় ড্রাইভার৷ ছোটো–বড়ো সব রকম গাড়ি চালানোর লাইসেন্স আছে, কিন্তু কোনও স্থায়ী চাকরি এখনও পায়নি৷ তার নাম লিখিয়ে রেখেছে মহেন্দ্র ড্রাইভার সেন্টারে৷ রোজ সকালে উঠে স্নান–খাওয়া সেরে বেরিয়ে যায় বকুলতলা মোড়ের ড্রাইভার সেন্টারে৷ মহেন্দ্রবাবু তার জন্য রোজই একটা না একটা ডিউটি রেখে দেন৷ কোনও কোনও দিন একটা ডিউটি শেষ না হতে আবার ফোন করেন, সুরজিৎ, সন্ধেয় একটা এয়ারপোর্ট ডিউটি আছে৷

দুটো ডিউটি পেলে সুরজিৎ মহাখুশি৷ একদিনে ডাবল ইনকাম৷ তাতে সংসার চালাতে একটু সুবিধে হয়৷

কিন্তু আজ বেরনোর সময় পাতাসি তার জামার আস্তিন টেনে বলল, বাবা, মা আর আমি আজ রাত দখল করব৷ তুমি সকাল–সকাল ঘরে ফিরবে৷ আমাদের নিয়ে যাবে৷

সুরজিৎ এর–ওর মুখে শুনছে রাত দখলের গল্প৷ বিষয়টা তার মাথায় তেমন ঢোকেনি৷ তবে আর জি কর হাসপাতালে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে তা জেনেছে খবরের কাগজ পড়ে৷ পাতাসি বেশ বড়ো হয়ে উঠেছে৷ এবার ক্লাস টুয়েলভ৷ সামনের বছর উচ্চমাধ্যমিক৷ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলেই পাগল–পাগল করে তার মা লাবণ্য৷ প্রায়ই বলে, সামনের বছর কলেজে ভর্তি হবে৷ বাসে বা অটো করে অনেকটা যাতায়াত করতে হবে৷ পারবে তো যা দিনকাল পড়েছে আমার খুব ভয় করে৷

সুরজিৎ তাকে সাহস জোগায়, সব মেয়েই তো যাওয়া–আসা করে৷ অত ভয় পেলে চলে?

কিন্তু এখন যে–ঘটনাটা ঘটে গেল আর জি করে, তারপর লাবণ্য আরও শঙ্কিত হয়ে পড়েছে৷

বকুলতলার দিকে যেতে যেতে মাথার মধ্যে বিষয়টা নিয়ে তোলাপাড়া করছিল সুরজিৎ৷ পাতাসি পইপই করে বলে দিয়েছে তুমি ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরে আসবে সন্ধে–সন্ধে৷ আমি আর মা বেরোব রাতের বেলা হাঁটতে৷ তুমি একটু দূরে–দূরে থাকবে৷

গিয়েই হয়তো দেখবে মহেন্দ্রবাবু ডিউটি স্লিপ লিখে রেখেছেন৷ যদি অনেক দূরের ডিউটি হয়, তবে মহেন্দ্রবাবুকে বলে বদলে নেবে ডিউটিটা৷ স্লিপ নিয়ে তাকে বেরতে হবে ক্লায়েন্টের বাড়িতে, তাঁর গাড়ি নিয়ে বেরোতে হবে তাঁদের গন্তব্যে৷ গাড়ি নিয়ে বেরোনোর সময় নির্দিষ্ট থাকে, কিন্তু ক্লায়েন্ট যতক্ষণ না ছাড়বে, তার ঘরে ফেরা হবে না৷ তা জানে বলেই তার আঠারো বছরের মেয়ে বলে দিয়েছে, বাবা, দিনের বেলা যাঁর ডিউটি নেবে, জিজ্ঞাসা করে নেবে সন্ধের মধ্যে ছাড়বেন কি না৷

আজকের ক্লায়েন্ট রায়দিঘির পল্লববাবু৷ তাঁর ফলের ব্যবসা আছে৷ প্রথমে কোলে মার্কেট, তারপর আরও দুটো ফলপট্টিতে কাজ মিটিয়ে ঘরে ঢুকতে পারল সন্ধে পাঁচটার মধ্যে৷

পাতাসি লাফিয়ে উঠে বলল, ও বাবা, তুমি কী ভালো৷ রাত এগারোটা পঞ্চান্নয় শুরু হবে মিছিল৷ খাওয়াদাওয়া সেরে রাত্রি সাড়ে এগারাটো নাগাদ বেরোলেই ধরতে পারব ওদের৷

সুরজিৎ জিজ্ঞাসা করল, যাদের সঙ্গে হাঁটবি, তুই সবাইকে চিনিস?

জবাব দিল পাতাসির মা লাবণ্য। বলল, কেউ না কেউ চেনা বেরোবেই৷ পাড়ার সব জায়গায় আলোচনা হচ্ছে, এরকম জঘন্য কাণ্ড মুখ বুজে সহ্য করা যায় না৷ প্রতিবাদ জানাতেই হবে৷

এগারোটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে ওরা প্রস্তুত, ঠিক সেসময় ফোনটা এল মহেন্দ্রবাবুর কাছ থেকে, সুরজিৎ, পঞ্চাননতলার পল্লব কুণ্ডু একজন ড্রাইভার চেয়েছেন৷ এখনই যেতে হবে৷ ওঁর বাড়ির সবাই মিছিলে বেরোবে৷ ওঁদের নিয়ে গিয়ে কাছাকাছি জায়গায় নামিয়ে দেবে৷ গাড়িটাকে কাছাকাছি কোথাও রেখে দেবে যাতে মিছিল শেষ হলে গাড়িতে করে ফিরতে পারেন৷

সুরজিৎ কুণ্ঠিত হয়ে বলল, জীবনদা, আজ সারাদিন ডিউটি করেছি, এখন আর পারব না৷

––সুরজিৎ, আমি আরও কয়েকজন ড্রাইভারকে ফোন করেছিলাম, সবারই রাতে অন্য ডিউটি আছে, তুমি এ যাত্রা ডিউটিটা করে দাও৷ পল্লববাবু বলেছেন, ‘রাত দশটার পর ড্রাইভারের ভাড়া ঘন্টাপ্রতি ডাবল হয়ে যায়, তার চেয়ে অনেক বেশিই দেব৷’ পল্লববাবু আমাদের পুরোনো ক্লায়েন্ট৷

ফোন রেখে সুরজিৎ বলল, লাবণ্য, ডিউটিটা না করলেই নয়৷ মহেন্দ্রবাবু আমার উপর অসন্তুষ্ট হলে আমার রুজিরোজগার কমে যাবে৷ রোজ ডিউটি দেবেন না৷ কিংবা ভালো ডিউটিগুলো আমাকে না–দিয়ে অন্য কাউকে দেবেন৷ খুব মুশকিলে পড়ে যাব৷ সংসারটা তো চালাতে হবে।

পাতাসি স্তম্ভিত হয়ে বলল, তোমাকে কি যেতেই হবে?

––হ্যাঁ, মা যেতেই হবে৷

পাতাসি অনকক্ষণ গুম হয়ে থেকে কান্না–কান্না গলায় বলল, তোমাকে কি আমি রোজ রোজ এরকম বলি৷ আজকে আমাদের যেতেই হবে৷ কোনও কথা শুনতে চাই না৷ আমার বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে৷ রণিতাদি ফেসবুকে লিখেছে, ‘আজ মেয়েদের অধিকার বুঝে নেওয়ার দিন৷ আজ আমাদের রাত দখল৷’ কত লাইক আর কমেন্ট পড়েছে জানো৷ আমার বন্ধুরা সবাই লিখেছে, আমরা যাচ্ছি, রণিতাদি৷ আমিও লিখেছি, ‘আমিও যাচ্ছি, রণিতাদি৷ সঙ্গে মাকেও নিচ্ছি৷ বাবাও যাবে সবাইকে সাহস জোগাতে৷

সুরজিৎ কোনও কথাই বলতে পারল না৷

––বাবা, তুমি তোমার মালিককে বলো আজ কিছুতেই যাওয়া যাচ্ছে না৷ বলো বাড়িতে আজ খুব জরুরি কাজ আছে৷

সুরজিৎ বলল, দ্যাখ মা, আমার কোনও পার্মানেন্ট কাজ নেই৷ ড্রাইভার সেন্টারের মালিক আমাদের অন্নদাতা৷ তাঁর কথা না–শুনলে নিশ্চয় রেগে যাবেন আমার উপর৷

বলে সুরজিৎ গায়ে শার্ট গলিয়ে বেরিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে৷ বুঝতে পারল খাটের এক কোণে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পাতাসি৷

পল্লববাবু নিজে গেলেন না গন্তব্যে৷ তাঁর দুই মেয়ে, পিঙ্কি আর রিঙ্কি গাড়িতে উঠে বলল, কাকু, আজ আমাদের রাত দখল৷

সুরজিতের বুকের ভিতরটা চিনচিন করে ওঠে৷ রোহিতবাবুর দুই মেয়ে অন্যদিন খুব সেজেগুজে বেরোয়, আজ একদম ‘সিম্পিল’৷ দুই মেয়ে গাড়ি নিয়ে চলেছে কলেজে স্কোয়ার অভিমুখে৷

দুজনেরই ভিতরে চাপা উত্তেজনা৷ মিছিল কীরকম হবে তা নিয়ে আলোচনা করছে দুজনে৷ কথা শুনে মনে হচ্ছে এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷

পথে আরও কয়েক জায়গায় জমায়েত৷ চারদিকের রাস্তা থেকে পিলপিল করে মানুষজন আসছে৷ অল্পবয়সি মেয়েদের ভিড় বেশি৷ কিশোরী থেকে তরুণী––সবার চোখেমুখে প্রবল উত্তেজনা৷ কোনও সাজগোজ নেই, যে যার মতো বেরিয়ে পড়েছে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে৷

সুরজিৎ লক্ষ করছিল সবই যেন চলেছে কোনও কিছু জয় করতে৷ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, তোমরা ওখানে কতক্ষণ থাকবে, পিঙ্কি?

পিঙ্কি উত্তেজিত হয়ে বলল, কতক্ষণ মানে কাকু, আজ আমাদের রাত দখল৷ গোটা রাজ্য দখল করে নেব সারা রাতের জন্য৷ মোবাইল খুললেই দেখতে পাচ্ছি সব ক’টা বড়ো শহরে মানুষ বেরিয়ে পড়েছে কাতারে কাতারে৷

––ও, সুরজিৎ গাড়ি চালাচ্ছে, কিন্তু অন্য দিনের মতো আজ গাড়ি চালানোয় তার মোটে উৎসাহ নেউ৷ পাতাসির ফুঁপিয়ে কান্না এখনও কানে বাজছে তার৷ একমাত্র মেয়েকে বড়ো করে তুলছে কত কষ্ট করে৷ কত আশা তার মেয়েকে ঘিরে৷

ভাবতে ভাবতে ক্যাঁচ করে ব্রেক কষল সুরজিৎ৷ তিন–চারজন কিশোরী জোরে জোরে পায়ে পায়ে চলেছে কোনও গন্ত্যবের দিকে৷ পিছনে একটা গাড়ি আসছে সে খেয়াল নেই৷ গল্প করতে করতে এসে পড়েছিল তাদের গাড়ির সামনে৷ সবাই এমন উত্তেজিত যে, গাড়ি চাপা পড়তে পারে সেদিকে কোনও মন নেই৷

––কাকু, একটু জোরে চালাবেন? মিছিল রওনা দিলে খুব মুশকিলে পড়ে যাব আমরা৷

সুরজিৎ পায়ের চাপ বাড়িয়ে দিল অ্যাকসিলেরেটরে৷ কিন্তু রাস্তায় লোক বেড়ে চলেছে৷ ফুটপাথ ছেড়ে নেমে এসেছে রাস্তায় ৷ আবারও মাঝেমধ্যে ব্রেক করতে হচ্ছে ৷ সুরজিৎ কখনও এত মানুষ দেখেনি এত রাতে৷

কিন্তু কলেজ স্কোয়ার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারল না গাড়ি৷ সামনে লোকে লোকারণ্য৷ যাকে বলে জনজোয়ার৷ এত মানুষ রাতের ঘুম ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছে চারদিক থেকে। চিৎকার ভেসে আসছে, ‘জাস্টিস ফর….’

গড়ির মধ্যে বসেই পিঙ্কি–রিঙ্কি চেঁচিয়ে উঠল, ‘আর জি কর’৷

পরের মুহূর্তে দুজন বলল, কাকু, এখানেই নেমে যাচ্ছি আমরা৷ আপনি গাড়িটা একটু দূরে কোথাও রাখুন৷ আমাদের হয়ে গেলে ফোন করে দেব আপনাকে৷

সুরজিৎ গাড়ি সাইড করে থামাতেই দুজনে নেমে গেল হুড়মুড় করে৷ নেমে এমন দৌড়ে মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে যেন ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে৷

সুরজিৎ ফিরল সকাল সাতটায়, দেখল লবণ্য আর পাতাসি বেশ হাসিখুশি৷ পাতাসি বলল, বাবা, আমরা সারারাত হেঁটেছি মিছিলে৷

সুরজিৎ বিস্মিত, দুজনে মিলে গেলি? ভয় করল না?

পাতাসি ডগোমগো হয়ে বলল, ভয় করবে কেন৷ এই রাতটা ছিল ভয় তাড়ানোর রাত৷



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *