রম্যরচনা
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
নাম নিয়ে সে কী বিড়ম্বনা মশাই! নাম নিয়ে সে কী বিভ্রাট! ভাবতে পারিনি এই নামযজ্ঞে মেতে উঠে আমি একটা চাকরি পাবো কোনোদিন।
“নামখেয়ালি” সভার উদ্যোক্তা কানাইসাধন বাবু। ইয়ার দোস্তদের কাছে ছোটো থেকেই কে.সি নামে পরিচিত তিনি। তা এই বাংলায় কে.সি নামের অধিকারীরা একপ্রকার মস্ত সেলিব্রিটি স্ট্যটাস নিয়ে বেঁচে আছেন যুগ যুগ ধরে। তাঁর দফতরে এই সামান্য চাকরিটা না পেলে আমিও কী ছাই জানতাম এই কেসি নামের এত মাহাত্ম্য বাংলা জুড়ে? ইতিমধ্যেই আমার ডেটা বেস উপচে পড়ল বলে।
কলেজস্ট্রীটের কে.সি পাল মানে যিনি যুগ যুগ ধরে বাঙালির মাথায় ছাতা ধরার জন্য বিখ্যাত। ডেটা এন্ট্রি করতে গিয়ে তাঁর কথাই সর্বাগ্রে মনে পড়ল আমার। তারপরেই বাঙলার আনাচেকানাচে কে.সি ঘোষ? যাদের দোকানের নাম দেখলেই আমবাঙালির মনে পড়ে যাদবদের কথা। মানে গোয়ালাদের কথা। অর্থাৎ তারা যে খাঁটি দুগ্ধজাত খাদ্য বেচবেন সেটাই ভরসার মাপকাঠি। তবে কে.সি ঘোষেদের কৃপায় মানে তাদের মিষ্টি খেয়ে বাঙালির স্বাদকোরক বশীভূত হলেও মধ্যপ্রদেশ স্ফীত করার জন্য বাঙালির মনে কিঞ্চিৎ ক্ষোভ আছে বৈকি। তা আমিও জানি। তবুও তিনি বংশ পরম্পরায় সফল মিষ্টান্ন ব্যাবসায়ী। আরো আছে। কে.সি মিস্ত্রী? ভবানীপুরের আম আদমীর পায়ে সস্তার চটিজুতো তুলে দেবার জন্য তিনি বিখ্যাত সেই স্বাধীনতার যুগ থেকেই। হাতিবাগানের কে.সি গোপ? ইয়াব্বড় অবাঙালি সামোসা যার ভেতরে কালো কালো চটকানো আলুর মশলাদার পুর দেওয়া? বাঙালির আখাম্বা সিঙাড়ার কৌলীন্য নেই কিন্তু সিগনেচার আছে নিজস্ব। এরপরেই মনে পড়ল গুঁড়ো মশলার জন্য বিখ্যাত কে.সি দত্ত বাবুকে? বাঙালির মডিউলার কিচেনে শিলনোড়ার পার্ট তুলে দেবার জন্য তাঁর জুড়ি নেই। তবে লাস্ট বাট নট লিস্ট কে.সি দে ওরফে কানাকেষ্ট বাংলার অন্যতম কীর্তণ গানের জন্য বিখ্যাত। আরো আছে অজস্র জানেন? চাকরিটা না পেলে এসব গবেষণা এ জীবনে অধরা থেকে যেত আমার। সেই যে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র যার নামে কৃষ্ণনগর? যিনি তাঁর রাজসভায় গোপালভাঁড় কে পুষেছিলেন, একাল হলে আমিও বোধহয় একটা চাকরিটাকরি পেতাম সেখানে। যদি না অবিশ্যি দুর্নীতি থাকত। তাই নামখেয়ালি সভার এই চাকরিটা পেয়ে আমি বর্তে গেছি। যাক গে কাজের সময় বাজে কথা মোটেও নয়।
বাগবাজারের কে.সি দাসের রসগোল্লা বা কাঁঠালকোয়া সন্দেশ আমবাঙালির স্বাদকোরকে বিশেষ জায়গা করে নিলেও কে.সি নাগ মহাশয়কে আমি অন্ততঃ ক্ষমা করতে পারিনি। পাটিগণিতে নলচৌবাচ্চার জলে হাবুডুবু খেতে খেতে তৈলাক্ত দণ্ডে বাঁদরের মত অবস্থা হয়েছিল আমার। সেই কঠিন অঙ্কের অধ্যায় পেরোতে পেরোতে মানে বাপঠাকুরদার বয়েসের হিসেবনিকেশ করতে করতেই ক্লান্ত আমি যখন সবেমাত্র থিতু হয়েছি ঠিক তখনই এই কানাইসাধনবাবুর সেই নামখেয়ালি সভায় ডাক পড়ল আমার। আমি অবিশ্যি এই কে.সির চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোটো তাই আর পাঁচজনের মত তাঁকে কে.সি বলে ডাকি না। পারলে কিছুই বলি না। আকারে প্রকারে উহ্য রাখি। খুব দরকারে স্যার বলি। ভাববাচ্যে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি আমায় দায়িত্ত্ব দিয়েছেন বাংলা তথা শহরে আরও ক’জন এমন কে.সি আছেন সেই ডেটা এন্ট্রি করে অ্যানালিসিস করতে। আপাততঃ সেটাই আমার কাজ এখন।
কিন্তু তিনি আপনি বলছেন বটে তবে এই সব কে.সি-কে বেশ কয়েকটা গোল দিয়ে বিখ্যাত কিন্তু আমাদের কানু দা। মানে ব্রজের রাখাল কে.সি। যিনি বিখ্যাত ছিলেন প্রেমে ডিচ মারার জন্য। রাধাকে ফেলে রেখে দ্বারকায় রাজা হলেন আর বেমালুম ভুলে গেলেন সব প্রেম পীরিতির কথা। অনেকবার বিয়েও করে নিলেন সেই ফাঁকে। তবে রাজনৈতিক ভাবে সফল তিনি। আমার মালকিন কে.সি তা শুনে থ। এমন স্বপ্নেও ভাবেন নি তিনি। মানে কেউ ভাবায় নি আগে।
এতক্ষণ ধরে কে.সি বৃত্তান্ত বলেই চলেছি। নিজের নামটাই বলতে ভুলে গেছি। আজ্ঞে এই অধম তথ্য রক্ষকের নামও সংক্ষেপে কে.সি, বিশদে কালাচাঁদ। কিন্তু হলে কী হবে আমার বৌ আবার এই সেকেলে নামের এক্কেবারে পক্ষপাতী নয় তাই বিয়ের পরেই এপিঠ-ওপিঠ করে কৃষ্ণেন্দু করে নিয়েছি আমি। তা যা বলছিলাম। বাংলার সব কে.সিদের মধ্যে কী যে একটা নিবিড় নেক্সাস তৈরী করেছি আমি তা স্বয়ং কে.সিই জানেন আর জানে আমার কম্পিউটার।
সেদিন আমার কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ রেখে আমার মালিক কানাইসাধন ওরফে কে.সি গোল গোল চোখ করে বলছিলেন বাংলা থেকে ব্যাবসায় বাণিজ্যে মুখ ঘুরিয়ে নেবার অন্যতম কারণ নিয়ে। তা নাকি এই নাম বিভ্রাটের কারণেই। মানে ব্যাবসা বিমুখ বাঙালি সংখ্যাতত্ত্ব মেনেটেনে অংশীদারদের নামটাম যদি ঠিকমত ব্যাবহার করে তাহলেই নাকি আবার বাণিজ্যে বসত করবে তারা, লক্ষ্মীলাভ নিশ্চিত হবে। তাই কে.সির এই নামখেয়ালি সভা দিয়েই শুরুয়াত। তারপরেই নিউম্যারোলজিস্ট, অ্যাস্ট্রোপামিস্ট, ট্যারো কার্ড রিডার…সবাই একে একে বসবেন বৈকি এই চেম্বারেই। পালা করে। সে ব্যাপারে নিশ্চিত আমার মালকিন কে.সি। তার আগে কে.সি দেখে নিতে চান পরখ করে। কে.সি রা কেউ ব্যাবসায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল কিনা। সব খোঁজ খবর, তথ্যতালাস নিয়ে জানালাম আমি। না এযাবত সব কে.সিরাই নিজের পায়েই সফল। তা সে অংক বই লিখে বেজায় প্যাঁচ কষেই হোক হোক বা মিষ্টি খাইয়ে মানুষের ভুঁড়ি বাড়িয়েই হোক। ব্যাবসা ইজ ব্যাবসা। সেখানে নো কপ্রোমাইজ। লাভের গুড় পিঁপড়ে না খেলেই হল। তাই শক্ত শক্ত পাটিগণিতের অংক, পাকাপোক্ত ছাতা আর চটচটে চিনির দানাদার সবাই সেখানে এক। তেতো মুখে একটানা কেশবচন্দ্র নাগের অংক করে অমন দানাদার মুখে পড়লে জন্ম সার্থক হয় বাঙালির। তা আমিও বুঝি। আমার কেসিও বোঝেন। কিংবা ধরুন ঝমঝমে বৃষ্টিতে কেসি পালের ছাতা মাথায় দিয়ে এসপ্ল্যানেডের কেসি দাসের দোকানের সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াতে দাঁড়াতে ঢুকে পড়তেই হয় একসময় দোকানের অন্দরমহলে আর ঠিক তখনই প্রাণ কেঁদে ওঠে স্পঞ্জ রসোগোল্লার জন্য। এই হল কেসির মাহাত্ম্য। আমি খুউব বুঝি এসব। আমার কেসিও ভালো বোঝেন বলেই না এই নামখেয়ালি যজ্ঞে নেমেছেন তিনি। এই যে সেদিনই কী যেন একটা বড় গ্রুপ এসেছিল তাঁর কাছে। নতুন ব্যাবসা খুলছে বাংলায়। এক ছাদের নীচে মশলাপাতি থেকে শরবত, চা পাতা থেকে সুপার স্পেশ্যালিটি হসপিটাল, হোটেল থেকে ইশকুল-কলেজ সব খুলছে এক এক করে। বলছে বাংলা নাকি বদলে যাবে যদি এই গ্রুপ বাঙালিদের একবার কব্জা করতে পারে। সেই শুনে আমার কেসি বললেন, সব তো ভালো কিন্তু ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায় কিন্তু। বাংলা আগে এমন দেখেছে। ঠকেওছে। গ্রুপ ট্রুপ যাই করুন নিজের পকেট থেকেই টাকা ঢালছেন তো? পাবলিককে বোকাবুদ্ধু বানিয়ে ওসব চিট লিখিয়ে পয়সা তুলছেন না তো? জিগেস করছেন আমার কে.সি।
বুঝলাম আমার কে.সি খুব বুঝদার। ঠিকই তো সেই সেবার চিটফান্ড কেসে একের পর এক কত রাঘববোয়াল গ্রুপ সব পালটি খেল আর বোকাসোকা বাঙালির মাথায় টুপি পরালো। না পারলো নিজেরা দাঁড়াতে না পারলো গরীব গেরস্থ মানুষগুলোর টাকা ফেরত দিতে।
আমার মালিক তখন বললেন, গ্রুপের নাম দিন ‘কে সি গ্রুপ অফ কোম্পানিজ’। তাহলে আর কোনো ভয় থাকবেনা।
এই বলে আমার মালকিন কে.সি তখন ঘরের পর্দা সরিয়ে সেই বিজনেস এন্টারপ্রেনিওরকে পাশের ঘরে সংখ্যাতত্ত্ব বিদের কাছেই পাঠালেন। কিন্তু সেই বিজনেস ম্যান ভদ্রলোক বললেন, কিন্তু কে.সির তো একটা অর্থ থাকতে হবে।
আমার কে.সি অমনি বললেন নাম ইজ নাম। কেশব চন্দ্রও কে.সি আবার কৃষ্ণ চন্দ্রও কে.সি।
ব্যাবসায়ী বললেন তা ঠিক।
কিন্তু এহেন আমার মন তখন তোলপাড় করছে সেই চিট ফাণ্ড কেলেঙ্কারি। ভাবছি কমেডি লিখতে বসেছি কিন্তু তা ক্রমাগতই ট্র্যাজেডিতে পরিণত হচ্ছে। এই কে.সি প্রসঙ্গে হঠাৎ করেই আরেক কে.সি উঁকি দিতে থাকল। তা সেই ইশকুল-কলেজ জীবনে সেই কে.সির সঙ্গে আমার পরিচয়। অনেকদিন বাদে এইসব গ্রুপ, ভুয়ো কোম্পানি, টাকা লগ্নী এসবের অনুষঙ্গে মনে পড়ে গেল তার নাম। চিটফাণ্ড এ টাকা বিনিয়োগ করে কত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ শরণাপন্ন হয়েছিল তার। মানে সেই পটাসিয়াম সায়নাইড বা কেসিএন নামক রাসায়নিকের। কে.সির এই নেগেটিভ তথ্য আমার মালিককে না জানানোই ভালো।
বলতে না বলতেই আমার কে.সি মানে কানাইসাধন বাবু এগিয়ে এলেন আমার দিকে… গাইতে লাগলেন বেশ ফুরফুরে মেজাজে…
“কেশী ঘাট বংশী বট দ্বাদশ পালন
যার সব লীলা কৈল শ্রীনন্দের নন্দন…”
তা শুনে আমি বললাম, বলেছিলাম না স্যার? সেই কেশী অসুর হত্যাকারী আমাদের কে.সি ওরফে নন্দের নন্দন কালাচাঁদই ভরসা। স্যার, বলছিলাম কী, অর্ডারটা কি তবে পাচ্ছি আমরা?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন