শতবর্ষ স্মরণে
নবকুমার বসু
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে বাংলা সাহিত্যকে যিনি সর্বাধিক সমৃদ্ধ এবং প্রভাবিত করেছিলেন বা করতে পেরেছিলেন, তিনি একইসঙ্গে সমরেশ বসু এবং কালকূট। উনিশ বা চব্বিশ খ্রীষ্টাব্দের এগারই ডিসেম্বর (১১.১২.১৯২৪) তিনি জন্মগ্রহণ করেন অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের উপান্তে মুন্সীগঞ্জে। প্রয়াত হন উনিশ বা অষ্টআশি সালের বারই মার্চ (১২.৩.১৯৮৮)। সুতরাং তাঁর জীবদ্দশায় ব্যাপ্তি ছিল তেষট্টি বছর তিনমাস। আর তাঁর সাহিত্য জীবনের সময়কাল ছিল মোটামুটি চারটি দশক বলা যায়। সঙ্গে আরও দু-আড়াই বছর যোগ করা যায় এবং যার অর্থ সমরেশ বসু বাংলাসাহিত্যে আপন প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছিলেন নিতান্তই অল্প বয়স থেকে।
কীরকম সময়ে সমরেশ বসু লিখতে এলেন তার একটা ধারণা দেওয়া যাক।
চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি আমাদের দেশের সোশিও-পোলিটিকো-ইকোনমিকো পরিস্থিতিতে একটা অতীব সংকটের বাঁক অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। আমাদের বাস্তব তখন এমন একটা মূল্যবোধহীন সংকটের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে, যেখানে জড়িয়ে যাচ্ছে ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবারেরও বহুবিধ সমস্যা। সারা বিশ্বেই রাজনৈতিক অস্থিরতা যার কারণ সকলের জানা। ভারতবর্ষকে তার মধ্যে একটা জায়গা খুঁজতে হচ্ছে। একটা অবস্থান খুঁজছেন ভারতীয়রাও। কেননা তা জীবনকে প্রবাহিত করছে বিভিন্ন দিক থেকে। স্বার্থের সংঘাত হয়ে উঠেছে অনিবার্য।
ভারতবর্ষ দাঁড়িয়ে আছে এক চূড়ান্ত এবং নির্মম বিপর্যয়ের সামনে।
পূর্ববঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতায় আর নোয়াখালিতে রক্তাক্ত হানাহানির মধ্যে দিয়ে জন্ম নেবে ভারতের স্বাধীনতা, এবং কেউ-ই প্রায় জানে না, সেই স্বাধীনতায় কী ফল হবে! কোন রাজরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে! মানুষের মনে, কল্পনার চোখের সামনে একটিমাত্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, দেশটা এক থাকবে কি না!
সময়টার দিকে খেয়াল রেখে স্মরণ করুন বাংলার সাহিত্যাকাশে তখন তিন বন্দ্যোপাধ্যায় বিভূতি-মানিক ও তারাশঙ্কর উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো বিরাজ করছেন। চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে যদিও এই তিনটি স্তম্ভের সাহিত্যসৃষ্টির অধিকাংশ উল্লেখযোগ্য দান বাংলাসাহিত্য পেয়ে গেছে। তারমধ্যে হঠাৎ-হঠাৎ চমক সৃষ্টির মতো এক একটি রচনা উপহার দিচ্ছেন নতুন লেখকরাও যেমন সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সন্তোষকুমার ঘোষ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। এছাড়াও রয়েছেন তথাকথিত কল্লোলযুগের খ্যাতিমানরা প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধকুমার সান্যাল, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত… বুদ্ধদেব বসুও।
দেশীয় রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক তথা সাহিত্যিক এহেন পরিমণ্ডলে, এইরকম একটা সময়ে, হঠাৎ সমরেশ বসু নামের এক বাইশ বছরের যুবকের লেখা গল্প যে-বিষয় নিয়ে স্ফুরিত হল, তা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকার উনিশশ ছেচল্লিশের শারদ সংখ্যায় ‘আদাব’ গল্প লিখে এবং একইসঙ্গে বাংলা সাহিত্য পাঠককূলকে চমকিত করে, বলা যায় আনুষ্ঠানিক ভাবে সুত্রপাত হল তাঁর সাহিত্যিক জীবনের।
মনে হল যেন, উনিশশ ছেচল্লিশ-এ দাঁড়িয়ে, তৎকালীন বর্তমানের তীব্রতম সংকটকে সাহিত্যের বিষয়ীভূত করে নিয়ে এক নবীন লেখক যেন নিজের কাঁধের ওপর একটা দায় তুলে নিলেন… যে দায় মূলত এক সচেতন শিল্পীর, মাটিতে পা রেখে চলা প্রবল মনুষ্যত্বের এক আন্তরিক অনুভূতিশীল, গভীর মনস্কতার এক তরুণ সাহিত্যিকের। আর ঠিক সেই একইরকম দায়বদ্ধতা দেখব তাঁর পরবর্তী সৃষ্টিসম্ভারেও যেখানে বারবার সমরেশ বসু প্রমাণ করবেন, যে বিষয়কে তিনি সাহিত্যে ধরতে এবং তুলে আনতে চাইবেন, সেগুলো আমাদের জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বাঁক অথবা সূত্রপাত। পরিকল্পনা করবেন এমন ধরনের সব গল্প – উপন্যাসের, যা সমকালীন বাংলা সাহিত্যের মানকে তিনি অধিষ্ঠিত করবেন উচ্চাসনে।
আজ তাঁর অর্থাৎ সমরেশ বসুর জন্মশতবর্ষের নিবন্ধ রচনার প্রায় প্রাককথন হিসাবেই তাঁর কয়েক দশক পরবর্তী বঙ্গসন্তান এবং লেখক হিসাবে এই কথাগুলি বলতে হল, যেহেতু, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ এবং রূপকার হিসাবে যখনই সমরেশ বসুর নামোল্লেখ করা হয়, আশ্চর্যভাবেই দেখা যায়, সাম্প্রতিক লেখক লেখিকাদের কোন ধারণাই নেই যে, কোন অবস্থান থেকে, কেন এবং কোন রচনায় এই কায়স্থ লেখকটি উঠে এসেছিলেন। সেই প্রেক্ষাপটটি জানাবার উদ্দেশ্যে সমরেশ বসু পাঠ না করলে যে এই সময়ের অর্থাৎ আধুনিক বাংলাসাহিত্যের ভিত্তি বা বেস্ সম্পর্কে জ্ঞান অসম্পূর্ণ থাকে। কিংবা তাঁকে অবহেলা করার অর্থ, মূর্খ কালীদাসের ‘নিজের বলে থাকা ডাল কাটা’র মতো সাহিত্য রচনা করতে যাওয়া, এই বোধটি নতুন প্রজন্মের থাকা উচিত।
এই প্রসঙ্গে কিঞ্চিত আলোচনা ও আলোকপাত করতে হবে নিবন্ধের শেষদিকে।
আপাতত শতবর্ষেও প্রাসঙ্গিক এবং অন্যতম সাহিত্যিক সমরেশ বসুর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা করাই আমাদের উদ্দেশ্য। বলা যেতে পারে প্রয়াণের ছত্রিশ বছর পরেও যাকে নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল থাকে, সাহিত্য পাঠকদের উৎসাহ থাকে এবং চতুর ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ক্ষমতালোভী, যশোপ্রার্থী, তথাকথিত সংস্কৃতিবান নিম্নমেধায় লেখক-সাহিত্যিকদের আগ্রহ থাকে না, তাঁকে একটু তুলে ধরা, তাঁর সম্বন্ধে বলা, তাঁকে স্মরণ করাই আমাদের এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য। অপারবাংলা পত্রিকার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্তরে বাঙালি পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য এই উদ্যোগ।
সমরেশ বসু ব্যাতিক্রমী লেখক ছিলেন প্রথম থেকে। কিন্তু তাঁর সেইসব রচনার কাল এবং জগত কীরকম আশ্চর্যজনক ভাবে পরবর্তী রচনাস্রোতে নতুন বাঁকে ফিরেছিল এবং খুব তীব্রভাবে বিদ্ধ করেছিল সাহিত্য পাঠকদের, সেই উদাহরণেরও অভাব নেই। একবার-দুবার নয় বারবার। একেবারে তরুণ বয়স থেকে এভাবে উঠে আশা তাঁকে চিহ্নিত করেছিল ব্যতিক্রমী ভূমিকায়। ফলে দশকে দশকে অনিবার্যভাবেই করে তুলেছিল বড় লেখক।
আমাদের ভাবা উচিত, ভাবতে ইচ্ছে করে, কলম বন্ধ করে তিনি চলে যাওয়ার পরে, আজীবন কাজের মধ্যে দিয়ে আসলে তিনি কী বলে গেলেন! নিজের দেশ-সময়-মানুষ সম্পর্কে তাঁর ভাবনা, দর্শনটা কী? গল্প-কাহিনি-ঘটনা কিংবা চিত্তাকর্ষক চরিত্র সৃষ্টি কিংবা প্রকৃতি বর্ণনার কথা নয়। জানতে হবে তাঁর মন, ভাবনাশক্তির উৎস, তার মান এবং তার বক্তব্য কী? এই সচেতন প্রশ্ন না তুললে, উত্তর না খুঁজলে, অন্তত সমরেশ বসুর মতো একজন সাহিত্যিক ও সৃষ্টি সম্পর্কে কোনো সুবিচার করা হয় না। কেন সমরেশ বসু সম্পর্কেই বিশেষ ভাবে এই মন্তব্য? কেননা তাঁর কাছাকাছি সময়ে, আগে-পরে সাহিত্যিকদের ক্ষমতা ও সৃষ্টিমালা অস্বীকার না করেও বোধহয় বলা যায়, জীবনের যে অবতলে নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে নিতে পারলে সেখানকার বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করা যায়, নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলা যায়, যে কর্ম তিনি জীবনভর যেভাবে করেছিলেন সাহিত্যের প্রয়োজনে অনেক লেখকই সেইভাবে, সেই স্তরে পৌঁছাতে পারেন নি। তাঁর এহেন সম্পৃক্ত হওয়া এবং অন্বেষণ যেমন তাঁর প্রথম জীবনের গল্প উপন্যাসের মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে পরবর্তী পর্বেও তিনি সেখান থেকে সরে আসেননি। আর সেইসব বাস্তবের মধ্যে মানবিকতার বিভা দেখতে পাওয়া, সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া এবং তার শিল্পিত প্রকাশই করে গেছেন স্বনামে, ছদ্মনামে। অবশ্যই কিছু ব্যতিক্রম সেখানে ছিল মাঝেমধ্যে… সম্ভবত খ্যাতির কারণে।
প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে আরও দু একটি কথা বলতে হবে। (বস্তুত চার দশকের লেখক জীবনে যিনি নিরন্তর নিজেকে বিকশিত করেছেন, একের পর এক রচনায় আমূল বদলে ফেলেছেন সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি, আর অধিকার করে থেকেছেন বাংলা সাহিত্যজগতের কেন্দ্র… এমন বড় মাপের একজন স্রষ্টা সম্পর্কে দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করাও শক্ত কাজ।) যেহেতু আমরা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে এবং সমরেশ বসুর শতবর্ষে পদার্পণের বাহানায়, তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে একটা প্রশস্তির ডালা সাজাতে চাইছি না (এবং তা সম্ভবও না), অথচ তাঁর জীবনও সাহিত্য সম্পর্কে একটু ধারণা করতে চাইছি, সেই কারণেই দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের উল্লেখ করতেই হয়, যা এখনকার পাঠকমহলেও তাঁর সম্পর্কে জানার ব্যাপারে একটুখানি উৎসাহিত করতেও পারে।
অনেকেই জানেন, যাকে আমরা স্কুল কলেজের লেখাপড়া বলি, সমরেশ বসুর তা প্রায় ছিল না। ক্লাস এইটে পড়ার সময়ই চূড়ান্ত অমনোযোগের অভিযোগে বিতাড়িত হওয়ার পরে আর কোনোদিন ওমুখো হননি। লেখালেখির শুরু কিশোর বয়স থেকেই। তখন থেকে যোগাযোগ বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে। কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে ট্রেনারের কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে জুটমিলস্ ট্রেডইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উনিশ শ ছেচল্লিশ সালে কম্যুনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় আদাব- ছোটগল্প লিখে প্রবল সাড়া ফেলেছিল। তখন থেকেই পরের পর গল্প- উপন্যাস লিখতে লিখতে পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই তিনি পরিচিত লেখক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সেই পরিচিতি ছিল কম্যুনিস্ট লেখক হিসাবে।
অথচ রাজনৈতিক বোধবিশ্বাস এবং তত্ত্বগত অবস্থান থেকে একটুও না সরে যে সাহিত্যসৃষ্টি, তা কতখানি মানবিক, মানুষিক এবং শিল্প হয়ে উঠবে, এই প্রশ্নে নিজের মধ্যে জর্জরিত হয়েছিলেন সমরেশ। তারপরেই সরাসরি প্রশ্ন তুলেছিলেন, কম্যুনিস্ট পার্টি করার জন্য সাহিত্য করছি, না, সাহিত্য করার জন্য কম্যুনিস্ট পার্টি করছি? তুলেছিলেন তার কারণ, সব রাজনৈতিক দলই তাদের ফতোয়া সুবিধে এবং প্রয়োজনমতো বদল করে এবং সেটাকেই চোখে ঠুলি পরানোর মতো সদস্যদের চোখে পরিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য, এই ফাঁকটুকুর মধ্যে দিয়েই তুমি দুনিয়াকে দ্যাখো। মানুষ, জীবন, বাস্তবতাকে বোঝো। বাইরে যেও না। কিন্তু শিল্পী কি তা পারেন? সমরেশ বসু তীব্র অথচ বিনীতভাবে এই মতাদর্শের বিরোধিতা করেছিলেন। এটি ছিল তাঁর সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের অন্যতম পরিচয়।
তাঁর বক্তব্য ছিল, যে কোনো কিছুর থেকে জীবন বড়। রাজনীতির সীমাবদ্ধতা অনেক সময়েই জীবনের উদার সীমাহীনতাকে তাদের নীতির কারণেই প্রশ্রয় দিতে অপারগ। কিন্তু সাহিত্যিকের কাছে, জীবনে ফাঁকি দিয়ে মহৎ সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব না। সমরেশ বসু আজীবনই বামপন্থী ছিলেন। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে সেই প্রথমপর্বের পড়ে আর কোনোদিনই কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকেননি। প্রসঙ্গত এখানেই বলা যেতে পারে, বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক উপন্যাস বলতে যা বোঝায়, ভাসা-ভাসা ওপর ওপর রাজনীতির কথা নয়, বা গল্প নয়, সাহিত্য পদবাচ্য যা কিছু , তার প্রতিফলন আছে সমরেশ বসুর রচনায়। দীর্ঘ উপন্যাস ‘যুগ যুগ জীয়ে’ থেকে শুরু করে ‘বিটি রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতী কাফে’, ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’, ‘তিনপুরুষ’, ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে… বাংলায় প্রকৃত রাজনৈতিক রচনা। পাঠক বোঝেন, রাজনৈতিক হলেও এইসব রচনা জীবনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। উঠে এসেছিল সময়ও।
কিন্তু জীবন তো বিশাল, সীমাহীন। সাহিত্যিকও বড় হন সেই বিশালতার শরিক হয়ে। সমরেশ বসু তাই হয়েছিলেন। রাজনীতি করতে করতে তাকে অতিক্রম করে তিনি মানুষ আর জীবনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। স্রষ্টা ছিলেন বলেই বারবার তাঁর রচনার উৎসমুখ বদলে গেছে। কখনও তার জন্য সমালোচিত হয়েছেন। বিতর্ক হয়েছে তাঁর রচনা নিয়ে। বাজারী অপবাদ শুনতে হয়েছে। ব্যক্তিজীবন নিয়ে টানাপোড়েনও কম যায়নি। কিন্তু মানুষ এবং সাহিত্যিক জীবনের কোনো শাসনের মালিন্য তাঁকে স্পর্শ করেনি। নিজেকে ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন। আবার স্বকীয়তাও বজায় রেখেছেন। সাহিত্য ছিল তাঁর পেশা ও ধর্ম। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও, প্রতিষ্ঠানের চাকরি করেন নি কোনোদিন। আবার হিপোক্রিসি-ও সরিয়ে রেখেছিলেন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে। কৃতজ্ঞচিত্তে লিখিত ভাবেই বারবার উল্লেখ করেছেন তাঁর সাহিত্যজীবনে আনন্দবাজার পত্রিকার ভূমিকার কথা, যার সূচনা হয়েছিল, কুম্ভমেলায় যাওয়ার জন্য তাঁদের কাছে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে।
এখানেও পরিসরের অভাবে এটুকু উল্লেখ করেই থামতে হবে যে, আবাপ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ পরবর্তী ফসল – ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ কালজয়ী রচনার মধ্যে দিয়েই প্রকৃত অর্থে জন্ম হয়েছিল কালকূট-এর, যিনি সমরেশ বসুরই আর এক সত্ত্বা… আর এক নাম। অথচ বিষয় ভাবনায়, বর্ণনা ও রচনাশৈলিতে অনন্য আর এক সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। সুতরাং কালকূটকে এবং তাঁর রচনার মূল প্রসঙ্গ আলোচনায়, স্বভাব বুঝে নেওয়ার জন্য, সমরেশ বসুর জীবন, সাহিত্য যে সর্বদা জানতেই হবে, এখন কোনো দায় বা অনিবার্যতা নেই। কালকূট এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন স্বয়ম্ভর আর একজন কথাসাহিত্যিক।
ঠিক সত্যি কথাটি বলতে গেলে বলতে হয়, একটি মানুষের মধ্যে এই দুজন লেখকের অস্তিত্ব ও অবস্থানের জন্যই, তিনি এমন একটি উচ্চতায় পৌঁছে যান, গুণগত মান-খ্যাতি ও বৈচিত্রে, যে তাঁর নাগাল পাওয়া মুস্কিল হয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যের ধারক-বাহকরা খুব ভাল করে জানেন, সমরেশ বসু আজীবন তাঁর লেখালেখি নিয়ে কী প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। খ্যাতি এবং যশের সঙ্গেই অবহেলা-বিতর্ক-নেতিবাচক সমালোচনা এবং ঈর্ষার শিকার হয়েছেন। সরকারি এবং সম্মাননীয় পুরস্কারের জন্য বারবার তাঁর নাম প্রস্তাবনার পরে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। নকশাল আন্দোলনের সময় প্রত্যক্ষভাবেই জীবন সংশয়ের হুমকি ছাড়াও খতম-তালিকায় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ওপরের দিকে। আর আশ্চর্যের কথা যে, সরকারি ভাবে বাঙালি সাহিত্যিকটিকে তখনও কোনো অবলম্বন দেওয়া হয়নি। তা নিয়ে সোচ্চার হননি তাঁর তথাকথিত বন্ধুরাও।
কিন্তু সাহসী মানুষের শিরদাঁড়াটি ছিল অক্ষত। তখনও একদিকে যেমন লিখেছেন ‘বিশ্বাস’, ‘ওদের বলতে দাও’, ‘মানুষ শক্তির উৎস’… ইত্যাদি। তেমনই কালকূট-এর কলমে বেরিয়েছে ‘কোথায় পাব তারে’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘আরব সাগরের জল লোনা’… ইত্যাদি। আজও যারা (পড়ুন বাঙালি সাহিত্যজগত), সমরেশ বসুর জন্মশতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসেও, তাঁর সম্পর্কে উদাসীন, তূষ্ণীভাব অবলম্বন করেন, তাঁদের অন্তত এটুকু মনে করিয়ে দেওয়াই যায় যে, একজন না, দুজন সাহিত্যিকের খ্যাতির যোগফলটুকু অন্তত তাঁরা যেন হিসেব করে নেন। সমরেশ-কালকূট অবিচ্ছেদ্য হয়েও, ভিন্ন দর্শনের দুই ব্যক্তিত্ব। মানুষটিকে ব্যতিক্রমী লেখক অভিধা দেওয়ার সময়, এই অনস্বীকার্য ব্যতিক্রমের বিষয়টি মনে রাখতে হবে। সেইসঙ্গে তাঁর প্রতিভার বিষয়টাও।
সমরেশ বসুর ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়েনের মতোই তাঁর শিল্পকর্মও নানা ওঠাপড়ায় ভরপুর। ব্যক্তিজীবনের প্রতিচ্ছবি যেমন কঠিন ও কোমল হয়ে ফুটেছে তাঁর রচনায়। তেমনই মানুষভেদে জীবনযাপনের গভীরে যাদের নিবিড় বিরাজ, তাদের মধ্যে যে সত্যমিথ্যা, দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতের আবর্ত, জটিলতা, তাকেও বিনা দ্বিধায় গ্রহন করেছেন সাহিত্যচর্চায়। সেই আশ্চর্য জীবনবোধ থেকেই হয়তো সৎসাহিত্যের শিক্ষা নেবে উত্তরকালের পাঠক এবং লেখকও। বর্তমান লেখক এবং তাঁদের বন্ধুগোষ্ঠির এক অনুষ্ঠানে (তখন সব তরুণ তুর্কি বাংলা সাহিত্যের, ১৯৭৮ সাল)। সমরেশ বসু বলেছিলেন, ‘এবার পুজোসংখ্যার উপন্যাস শেষ করতে বড়ো দেরি হয়ে গেল… কিন্তু আমি তো কোনো ফাঁকি দিইনি! নেহাৎ শরীরটা… একদিন হাত থেকে কলম পড়ে গেল…।’
মনে আছে তরুণ সবকটি লেখক (সত্তর দশকের) সেদিন নির্বাক বিস্ময়ে এই নিয়ত আত্মপীড়নে জর্জরিত স্বনামধন্য কথাকারের অকপট উক্তি শুনেছিল। ‘আমি তো ফাঁকি দিইনি!’ মনে হয়েছিল, শিক্ষক বা পথপ্রদর্শক রূপে ভাবতে ভাল লাগে যে মানুষটাকে, এখনও সেই পরিণত শিল্পীরই শিক্ষার্থীপর্ব শেষ হয়নি! ক্লান্তি ও অসুস্থতার গ্লানি সরিয়ে… সব মনিলতা ছাপিয়ে, অবশেষে সব তুচ্ছ করে সেই হাসিটি হেসেছিলেন সমরেশ। মনে হয়েছিল, সেই হাসি আসলে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা অভিযাত্রীর অলঙ্কার। হয়তো তাঁর মরণোত্তর বেঁচে থাকার ইঙ্গিতও।
উনিশ বা ছেচল্লিশ থেকে উনিশ-শ অষ্টআশি সমরেশ বসুর সম্পূর্ণভাবেই সাহিত্যের সঙ্গে জীবনযাপন। এই যাপন পক্রিয়ার মধ্যে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, কোনো অস্পষ্টতা নেই। কেননা লেখা যে তাঁর শুধু জীবিকা ছিল, তাই না। ছিল তাঁর জীবনশক্তিও। তিনি এমনই একজন লেখক এবং মানুষ, যিনি বারংবার এই শিল্পকর্মের জন্য (জীবনভর) একইসঙ্গে যন্ত্রণা ও আনন্দ উপভোগ করেছেন। হয়তো সচেতন পাঠক তা প্রত্যক্ষও করেছেন। একই বৃক্ষে বিভিন্ন ফুলের সহাবস্থানের মতো, সমরেশ বসুকে দেখে আমাদের মনে হতেই পারে, একজনের মধ্যে যেন বহুজনের উপস্থিতি… বহুবিধ বৈচিত্রের নির্বিরোধ সহাবস্থান ঘটেছে লেখকটির মধ্যে। সেই বহুর উদাহরণ বা তালিকা দেওয়ার উপায় বা অবকাশ নেই বর্তমান নিবন্ধে। জীবনরসিক একজন শিল্পীর ক্ষেত্রে নীতিবাগীশ সমালোচকরা নেতিবাচকভাবে সেই চেষ্টা অতীতে (তাঁর জীবদ্দশায়) করলেও, লেখকের শতবর্ষে আর তার প্রয়োজনও নেই। বরং জীবদ্দশায় একের পর এক রচনায় স্বনামে বা ছদ্মনামে প্রতিবারই নতুন সুরে, ভিন্নতর ভাষায় জীবনের যে আশ্চর্য আর বৈচিত্রময় আলেখ্য শুনিয়ে গেছেন, আমরা ফিরে তাকাতে পারি সেইদিকে, যেখানে মানুষই চরম সত্য বলে তিনি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। ভাবলে সত্যি অবাক হতে হয়, অথচ অস্বীকারই বা করি কি করে যে প্রয়াণের পরে সাড়ে তিনদশক অতিক্রম হয়ে গেলেও, কোথায় আর একজন সেই জাতগোত্রের বাঙালি লেখক, যিনি জীবনবোধ-রচনায়-সমালোচনায়-বিতর্কে-গভীরতায়-গাম্ভীর্যে-মনুষ্যত্বে-আঘাতে-প্রেমে-দুরন্তপনায় তাঁর সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারলেন কিংবা আলোচিত হলেন অথবা অতিক্রম করে গেলেন!
তাহলে কি জনসংখ্যা নিরিখে বঙ্গভাষা সক্ষম আন্তর্জাতিক খেতাব পেলেও আমরা এক স্থবির, স্থির, নিস্তরঙ্গ, আত্মমুখী গুরুত্বহীন ভাষার ধারক-বাহক, কর্মী হয়ে থেকে গেলাম! কী জানি, এহেন মন্তব্য বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে গেল কিনা! বিশেষত যাঁরা চর্চায়, রচনায়, সৃষ্টিতে বাংলা ভাষাকেই অবলম্বন করেছেন, তাঁদের কাছে! কিন্তু তা সত্ত্বেও কি বাস্তব পরিস্থিতি অন্য কথা বলে? একথা সত্য, মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন রচনায় কোনো সাহিত্যিক অবশ্যই হঠাৎ উজ্জ্বল সৃষ্টির নজির রেখেছেন। তাই নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা, কথাবার্তাও হয়ে থাকতে পারে। তথাপি সমরেশ–কালকূট এর যোগ্য উত্তরসুরি বা সমকক্ষ… যাঁকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যজগত এবং পাঠককূল ধারাবাহিক ভাবে উদ্বেলিত হয়েছেন, অস্থির হয়েছেন, মুগ্ধ অথবা ক্ষুব্ধ হয়েছেন… নতুন শতাব্দীর দুটি দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও কি পাওয়া গেল? নাকি গোষ্ঠীদ্বন্ধ আর নিরক্ষর আত্মপ্রচারের ঢাক পেটানোর উদ্যোগে, জেগে ঘুমানোর বাহানায়, চর্বিতচর্বণে সস্তা-চটুল অতিপ্রাকৃত রচনার রমরমায়, গুণীর অবহেলায় ধামা চাপা পড়ে গেল সমরেশোত্তর এই বঙ্গের সৃষ্টিশীলতা!
আসলে তিনি জাতলেখক ছিলেন বলেই, আজও তাঁর সম্পর্কে বলতে(পড়ুন লিখতে) গেলে, অনতিঅতীত এবং সাম্প্রতিককালের বাংলা সাহিত্যের মধ্যে অনিবার্যভাবেই একটি তুলনামূলক আলোচনা উঠে আসে। একটি সঙ্গত প্রশ্ন সাহিত্য প্রেমী তথা সাহিত্য পাঠকদের মনে আসতেই পারে।
বিগত তিনটি দশকে সমরেশোত্তর বাংলা সাহিত্য কতটা এগিয়েছে কেউ বলবেন?
আত্মতুষ্ট ও আত্মপ্রচারে উৎসাহ দেওয়া একশ্রেণির সাহিত্য ব্যবসায়ীর কাছে এ ধরনের প্রশ্ন তোলার অর্থই নাকি নেতিবাচক মানবিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। তাঁরা যুক্তি দেন, বাংলা সাহিত্যের বাজার যথেষ্ট ভাল, বই বিক্রির সংখ্যা এবং অর্থনৈতিক আদানপ্রদান ক্রমবর্ধমান। সম্ভবত বই বিক্রির নিরিখে তাঁদের এই যুক্তিকে কিছুটা মান্যতা দেওয়া যায়। কিন্তু কারণ আছে তার পেছনেও। বহু অলেখক ইদানীং টাকা ইনভেস্ট করেন বই ছাপানোর জন্য এবং তাঁরা জেনেই টাকা খাটান যে, এই টাকার তথাকথিত রিটার্ন যাকে বলে, তা থাকবে না। তাহলে খরচ করেন কেন?
মূলত দুটি কারণ। প্রথমত কালো টাকার ব্যবহার। দ্বিতীয়ত, হাতে পয়সা এলেই মানুষের নাম কেনার প্রবণতা। প্রসঙ্গটির ইতি টানলাম এখানেই।
সচেতনভাবে মনে রাখতে হবে আমরা এখানে নিছক একজন গল্পকার বা কাহিনিকারের কথা বলছি না। এমন এক যুগপুরুষ সাহিত্যিকের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁকে স্মরণ করছি। যার ব্যক্তিত্ব-সৃষ্টিসম্ভার-শিরদাঁড়া… সব কিছু মিলিয়েই, বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে এমন একটা স্থান এবং উচ্চতায় অবস্থান করছেন, অনেক বিরোধিতা সত্ত্বেও যাঁকে সেখান থেকে নামানো যায়নি। আমরা জানি, কালের প্রেক্ষিতে আমাদের দেশিয় যাবতীয় ইতিহাসকেই বিকৃত করা সম্ভব – ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক প্রচার ও প্রভাবের দ্বারা। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেমন পুরস্কার নির্ধারিত হয় ক্ষমতাহীন মানুষদের সঙ্গে ওঠাবসায়, পরিচিতি ও পদলেহনে। তা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত কালের গর্ভেই নিমজ্জিত হয় মধ্যমেধার স্বীকৃতি। যা টিকে থাকে, তা মানুষের অনুভব আর ভালবাসা থেকে উৎসারিত প্রতিদান। সাহিত্যিক সমরেশ বসু স্বীকৃত এবং পুরস্কৃত হয়েছেন সেই মানুষের আশীর্বাদে।
আমাদের পরিসর সীমাবদ্ধ এবং সংক্ষিপ্ত। সেটুকু মনে রেখেই আপাতত শতবর্ষের আলোয় সমরেশ বসুরই আর একসত্ত্বা, তাঁর ছদ্মনাম ‘কালকূট’ কেও স্মরণ করা বাঞ্ছনীয়। বাংলা সাহিত্যে এই বিষয়চিত্ত ব্যতিক্রম হিসাবে একমেবাদ্বিতীয়ম বলতে হবে। একই মানুষের দ্বৈতসত্ত্বা। লেখক সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম গ্রহণ এমনকিছু বিরল বা অভিনব ব্যাপার কিছু নয়। বিষয়ান্তরের ভাবনায়, রচনার বৈচিত্র্য সন্ধান করতে গিয়ে লেখকরা অনেক সময়ই ছদ্মনাম গ্রহণ করতেন… যদিও স্বনামের প্রতি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস না থাকলে, ছদ্মনামের ঝুঁকি অনেকেই নিতে চান না। যে কারণে সাম্প্রতিকালে ছদ্মনাম গ্রহণের প্রবণতা আর দেখা বা শোনা যায় না। তথাকথিত খ্যাতিমানরা স্বনামের আত্মপ্রচার করতেই উঠে পড়ে লেগেছেন। যাক।
সমরেশ বসু-কালকূট যুগের পরে, সম্ভবত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই একমাত্র লেখক যিনি নীললোহিত, নীলউপাধ্যায়, সনাতন পাঠক ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন নানাবিধ পত্রিকাধর্মী রচনার জন্য। সুনন্দ নামে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা বৈকুণ্ঠ পাঠক নামে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ও কিছু রচনা লিখেছিলেন। সুনীল কিছুটা সমরেশ বসুর কালকূট ছদ্মনামের লেখা দেখেই সম্ভবত অনুপ্রানিত হয়েছিলেন। এবং কিছু ভ্রমণ বিষয়ক কাহিনি রচনা করেছিলেন নীললোহিত ছদ্মনামে। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, নীললোহিত কখনই কালকূট – এর সমগোত্রীয় আর এক সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেনি এবং সম্ভবত পরবর্তীকালে সুনীল সে চেষ্টাও করেননি।
কালকূট প্রকৃতপক্ষেই এক বিশেষ দৃষ্টিসম্পন্ন স্বয়ম্ভর একজন কথাসাহিত্যিক। এই ছদ্মনামের আড়ালে সমরেশ বসু যে সৃষ্টিসম্ভার রেখে গেছেন। তিনি খুব সচেতনভাবেই সেখানে তাঁর ব্যক্তি পরিচয় প্রচ্ছন্ন রাখতে চেয়েছিলেন। সুতরাং বিষয়টিকে এভাবেও ভাবা যায় যে, কালকূটকে জানা ও বোঝার জন্য সমরেশ বসুকে… তাঁর জীবনযাপন ও জীবনের যাবতীয় ঘটনাপঞ্জীকে জানতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ব্যক্তি এক হলেও ব্যক্তিত্বে কালকূট ছিলেন অন্য একটি সত্ত্বা।
বলে রাখা দরকার, প্রাথমিকভাবে সমরেশ বসু তাঁর এমন বিষয়ক রচনা, ভ্রাম্যমান সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের কথা লেখার জন্য কালকূট ছদ্মনাম ব্যবহার করলেও, পরবর্তীকালে সেই ভ্রমণ কিন্তু বাস্তব এবং পার্থিব ভ্রমণের জায়গা থেকে সরে গিয়েছিল। তখন তিনি নিজের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভ্রমণকে রূপান্তরিত করেছিলেন মানসভ্রমণে। খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, অমৃতকুম্ভের সন্ধানে বা স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গনে জাতীয় উপন্যাস থেকে জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্য, অমাবস্যায় চাঁদের উদয় বা শাম্ব উপন্যাসের ভ্রমণ সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং তা ভাবদর্শন বা পুরানের পথে পথে নিজস্ব ভাবনা আর বিশেষভাবে দেখার চোখ, ব্যাখ্যা নিয়ে মনে মনে ভ্রমণ করেছেন।
তবে একথাও ঠিক, কালকূট-এর সমগ্র সাহিত্য পরিমণ্ডলের মূল বিষয় হচ্ছে চলমান মানুষ। কখনও ধূলিময় পথ কখনও খরস্রোতা নদী, কখনও নিবিড় পর্বতমালা বা কখনও ব্যস্ত জনপদ তাঁর উপন্যাসের পটভূমি হয়ে উঠলেও কিংবা ইতিহাস বা পুরাণের আলোআঁধারি বর্ণনা পরিক্রমা হলেও, মানুষ এবং মানুষের প্রেম নিয়েই তাঁর লেনাদেনা। যে কারণে বলা যায়, মানুষে মানুষে ভাবের বিনিময় সেই কালকূট এর জীবন, মেধা মনন ও মন্ত্রের এবং বিশ্বাসের চাবিকাঠি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কালকূট সবসুদ্ধ চৌত্রিশ বা পঁয়ত্রিশটি কাহিনি রচনা করেছেন এবং তার প্রতিটি উপন্যাস। কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে একই মানুষের এহেন দ্বৈতসত্ত্বার খ্যাতি, যা কালজয়ী হিসাবে চিহ্নিত এবং সাহিত্যের শ্রেষ্ঠসম্ভার বলে বিবেচিত, আর কোনো সাহিত্যিকের জীবনে ঘটেনি। তিনি একটি মানুষ হলেও, বিস্ময়কর প্রতিভার জন্যই তাঁকে দুজন সাহিত্যিকের কৃতিত্বের যোগফল দিতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য আন্তর্জাতিক স্তরে বা উন্নত দেশে জন্মালে, সমরেশ-কালকূট-এর যে মূল্যায়ন হতো, এদেশে তা হল না।
পরিশেষে, সমরেশ বসু জন্মশতবর্ষের নিবন্ধ তাঁর অশেষ অথচ অসমাপ্ত উপন্যাসের উল্লেখ ছাড়া সমাপ্ত হতে পারে না। প্রবল আগ্রহ, উদ্দীপনার সঙ্গে প্রকাশিত এবং পরিচিত সেই উপন্যাসের নাম ‘দেখি নাই ফিরে’।
সমরেশ বসু তাঁর জীবদ্দশার শেষ দশকেও আবার নতুন বাঁক নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে জীবন ভিত্তিক উপন্যাস রচনার অভাব মেটাতে। নির্বাচন করেছিলেন কালজয়ী এক শিল্পী ও ভাস্করের জীবনকাহিনীকে উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে আবিষ্কারের। সেই শিল্পী ও ভাস্কর ছিলেন রামকিঙ্কর বেজ। সত্যি বলতে কি, সমরেশ বসুর এই চরিত্র নির্বাচন অবলম্বন করেই একটি নিবন্ধ রচনার প্রয়োজন, তাঁকে লেখক হিসাবে চিনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সেই সুযোগ আমাদের এখানে নেই। শুধু পাঠকের জ্ঞাতার্থে এটুকু উল্লেখ করেই থামব, যে রামকিঙ্করের মতো জন্ম শিল্পী, কৃতী এবং অপরিমেয় মেধাসম্পন্ন মানুষ হয়েও, ব্যক্তি পরিচয়ে যাঁর পায়ের নিচে কোনো মর্যাদার অধিষ্ঠানভূমি ছিল না, সমরেশ বসু তাঁকেই নির্বাচন করেছিলেন তাঁর জীবনপন্যাসের নায়ক হিসাবে। কিন্তু কেন?
কারণ হিসাবে শুধু এটুকু বলি, সমরেশ বসু সারাজীবনের সাহিত্যসৃষ্টির অনন্যতা যা– তা হচ্ছে এমন মানুষকে নিয়েই তিনি লিখেছেন, যে বা যারা আহত, ক্লিষ্ট, দুর্গত অবস্থার মধ্যেও পরাজয় মানে না এবং শিরদাঁড়া শক্ত করে উঠে দাঁড়ায়… সব প্রতিরোধ উপেক্ষা করে এবং সাহসে ভর করে। সহজেই অনুমান করা যায়, তাঁর নিজের সাহিত্যজীবনে যে সংগ্রাম আর যে মনস্কতা নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর লেখার চরিত্র নির্বাচনেও সেই বোধ, মানসিকতা আর সাহস ক্রিয়াশীল ছিল। রামকিঙ্করের জীবনযাপন ও ধারণের ব্যাতিক্রমী ধ্যানধারণার সঙ্গে সম্ভবত সমরেশ বসু কোথাও না কোথাও সাযুজ্য অনুভব করেছিলেন। অতঃপর শুরু হয়েছিল সেই বিরল, ব্যতিক্রমী যুগ্মযাত্রা। বলা যায়, বাংলা বা ভারতীয় সাহিত্যে সমাজের অবতলের মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের গৌরব আবিষ্কার করাই ছিল সমরেশ–সাহিত্যের মূল কথা এবং তাঁর ধর্ম। আর সেই জীবনব্যাপী অন্বেষণই যেন রামকিঙ্কর বেজ-এর চরিত্র মূর্তিতে একটি সংহত প্রতীক পেয়েছিল – যা পর্বে পর্বে উন্মোচিত হয়ে চলেছিল তাঁর সেই ধারাবাহিক উপন্যাসে দেশ পত্রিকার পাতায় পাতায়।
রামকিঙ্কর সম্পর্কে তথ্য আহরণের কাজ তথা গবেষণা সমরেশ বসু শুরু করেছিলেন একেবারে ধুলোমাটি থেকে। কেননা রামকিঙ্করের জন্মস্থান, পরিবার, পারিবারিক পরিচয় অবস্থান এবং তাঁর কর্মজীবন… কোনো কিছু সম্পর্কেই তথ্য-ইতিহাস-রচনা কিছুই প্রায় ছিল না। সমরেশ বসু প্রবল স্থৈর্যে, সচেতন শৃঙ্খলায়, অসুস্থ শরীর নিয়েও সেই আনুপুঙ্খ অন্বেষণ শুরু করেছিলেন যাতে নিশ্ছিদ্র হয় তাঁর উপন্যাসের শরীর। আর সেই শ্রমে তাঁর জীবনপাতও হল অকালে।
অসমাপ্ত থেকে গেল ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাস – মাত্র এক তৃতীয়াংশ প্রকাশের পরেই। অথচ সেই এক তৃতীয়াংশের বিশালতাই প্রমাণ করে দিয়েছিল। সাহিত্যে জীবনধর্মী উপন্যাস রচনার গভীরতা অনুধাবন করতে হলে ‘দেখি নাই ফিরে’ বারবার হাতে নিয়ে পড়তে হবে। দেশ সম্পাদক লিখেছিলেন… দুঃখ করব না, কেননা স্বয়ং ঈশ্বরের কাজও তো অসমাপ্ত থেকেছে…।
মহান সাহিত্যিকের জন্মশতবর্ষের নিবন্ধও, আমি জানি, এই পত্রিকা এবং পরিসরের নিরিখে আর বিস্তারের উপায় নেই।
তথাপি মনে হয়, আজকের বাংলা সাহিত্যের পরিসর এবং দিগন্ত কোথায় যেন মলিনতায় ছেড়ে যাচ্ছে, সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় ঘনিয়ে আসছে অনুজ্বল মেদুরতা! আর সেই অবস্থার মধ্যেও আজ থেকে সাড়ে তিনদশকের পূর্বে রচিত সমরেশ বসুর কালজয়ী আখ্যান তথা উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’ এখনও সৃজন প্রতিভার এক উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
জন্মশতবর্ষে তাঁর জন্য রইল বাংলা ভাষাকর্মীদের তরফ থেকে মরণোত্তর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও নমস্কার।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন