ফিচার
কাকলি দেবনাথ
‘গৃহ’ শব্দটার থেকে ‘ঘর’ শব্দটাই আমার বেশি আপন মনে হয়। ছোট থেকেই শুনে আসছি মেয়েদের নিজের ঘর বলে কিছু হয় না। কখনও বাপেরঘর কখনও শ্বশুরঘর তারপর স্বামীরঘর আর সব শেষে ছেলেরঘর। সত্যি কি তাই?
মেয়েরা ছাড়া ঘর হয় নাকি? আমি অনেকগুলো ঘরে থেকেছি। আবার আশে পাশে থাকা অনেক অনেক ঘর দেখেছি। কত ঘর ভাঙতে দেখেছি, কত ভাঙা ঘর জোড়া লাগতে দেখেছি। কত ঘর নতুন করে গড়ে উঠতে দেখেছি … কত ঘর ভেসে যেতে দেখেছি …
বিয়ের আগে আমি যে ঘরটাতে থাকতাম, সেটা ছিল আমার পুতুল খেলার ঘর … আমার মেয়েবেলার ঘর। বাংলো বাড়ির মত সেই ঘরের সামনে বড় একটা ফুলের বাগান। মায়ের পরিচর্যায় শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় কত ফুল যে ফুটত সেই বাগানে। পাশেই ছিল সবজি বাগান। সেটা আবার বাবা দেখভাল করতেন। শীতে ফুলকপি বাঁধাকপি থেকে মটরশুটি, সিম, গরমে উচ্ছে, ঢ্যাঁড়শ সব হত। আমরা ভাই বোনেরা গাছে জল দিতাম। কোঁচর ভরে মটরশুটি তুলতাম। সেই সবজি দিয়ে মা তরকারি রান্না করত। কী স্বাদ সেইসব রান্নার! চেটেপুটে খেয়ে ভাবতাম মায়ের হাতে জাদু আছে। আমার মায়ের মত ভাল রান্না পৃথিবীর কেউ করতে পারে না! মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে এই নিয়ে ঝগড়া হত – সবাই বলত, তার মা বেশি ভাল রান্না করে।
এসব তো বহু বছর আগের কথা। এখন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বড় শপিং মল থেকে প্যাকেট বন্দি অরগ্যানিক ভেজটেবল কিনি। নিজের ছোট্ট কিচেন গার্ডেনে সবজি চাষ করি। তবুও রান্নার স্বাদে মন ভরে না। নিজেকেই জিজ্ঞেস করি মায়ের রান্নার মত স্বাদ কেন হয় না? আজ এই চল্লিশোর্ধ বয়সে এসে বুঝতে পারি পৃথিবীর সব সন্তানের কাছে তার মায়ের হাতের রান্নাই সব থেকে প্রিয়। আসলে মায়ের রান্না তো শুধু রান্না নয়, তাতে মেশানো থাকে অনেকখানি ভালোবাসা। আর ভালো বাসা গড়ে তোলার জন্য ইট কাঠ সিমেন্টের থেকেও বেশি দরকার ভালোবাসার।
ছোটবেলায় ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাজি ভরে টগর ফুল তুলতাম। পাড়ার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আমাদের গাছের ফুল দিয়েই মালা গাঁথা হত। মা শিখিয়ে দিয়েছিল চারটি টগর ফুল কীভাবে এক সঙ্গে গাঁথতে হয়। আজও মালা গাঁথতে বসলে তো মায়ের কথাই মনে পড়ে। বিয়ের কুড়ি বছর পরও বাপের বাড়ি গেলে মায়ের সঙ্গে যতটা সময় কাটাই বাবার পাশে বসে ততটা সময় কাটাই কি? কখনও কখনও তো বাপের বাড়িটাকেই মা মনে হয়। একবার কিছু অসুবিধার জন্য মা কলকাতায় ভাইয়ের বাড়ি এসেছিল। বাবা একাই থাকত ওই বাড়িতে। সেইসময় বাপের বাড়ি যেতে মন চাইত না। সব কেমন যেন ছন্নছাড়া। কোনও শ্রী নেই। আমি না হয় মায়ের সন্তান কিন্তু ওই যে বাগানের গাছগুলো সেগুলো অমন দুঃখী দুঃখী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত কেন? সব চেয়ে আশ্চর্যের কথা- সে বছর আমগাছ, লেবু গাছে কোনও ফুল আসেনি। ওরাও তো ভালোবাসা চায়, তাই না? যেই আদর যত্ন পরিচর্যা নারী দিতে পারে সেটা কি একজন পুরুষের কাছে আশা করা যায়? না আমি পুরুষদের ছোট করছি না তবু কোথায় যেন মনে হয় এই কাজগুলিতে মেয়েরাই বেশি দক্ষ। মা বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর এখন আবার সব আগের মত। আমার কাছে তাই ওটা হয়ত সামাজিক শব্দবন্ধে বাপের বাড়ি। কিন্তু আসলে ওটা আমার মায়ের ঘর।
শ্বশুরবাড়ি এসে দেখলাম অনেক বড় বাড়ি। শ্বশুর শাশুড়ি, দেওর ভাসুর জায়ের জমজমাট সংসার। যত মানুষ তত ধরনের কাজ। শ্বশুর মশাইয়ের স্কুল, ভাসুরের তাঁতের ব্যবসা, স্বামীর বিদেশে চাকরি, দেওরের কলেজ। শাশুড়ি মায়ের কিন্তু সব দিকেই কড়া নজর। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ছেলের বউদের নির্দেশ দেন…ফ্রিজে কী কী সবজি আছে দেখে রাখো। পরের দিন বাজারের ফর্দ করে রাখো। শুধু কি এইটুকু? ছেলের বউরা কে কখন ঘুম থেকে উঠছি, বাসি কাপড় ছেড়েছি কি না, হাতের শাঁখা পলা নোয়া, মাথার সিঁদুর থেকে বৃহস্পতিবারে পায়ে আলতা। কোনটাই তার নজর এড়াত না। সকালের জলখাবার থেকে রাতের খাবার তিনিই মেনু ঠিক করতেন। হ্যাঁ, তিনি সকলের মন বুঝেই ঠিক করতেন, কিন্তু তার অনুমতি ছাড়া কিছু হত না। ছেলের বউরা বাপের বাড়ি কবে যাবে, কবে আসবে। পুজোতে কোন আত্মীয় স্বজনকে কী উপহার দিতে হবে তাও তিনি ঠিক করতেন।
কখনো কোনও কাজে ভুল হয়ে গেলে একবারও শ্বশুর কী বলবেন মনে করে ভয় পেতাম না। মনের কোণে শাশুড়ি মায়ের মুখটাই ভেসে উঠত। আজ শাশুড়িমা বেঁচে নেই তবুও রান্না ঘর থেকে ঠাকুর ঘর, পুজোর বাজার থেকে বাড়িতে মহোৎসব সবেতেই উনি আছেন। এখনো রাধাগোবিন্দর পোশাক বদলানোর আগে মনে হয় মা কীভাবে নাড়ুগোপালকে স্নান করাতেন, গরমে সুতির লেস লাগানো পোশাক, শীতে জরির পোশাক। বসন্তে রঙিন পাগড়ি, শীতে টুপি … এমন আরও কত কি …
অন্য সব ঘর থেকে রান্না ঘরকে বেশি পরিষ্কার রাখতে হবে। রান্না ঘর মোছার সময় ফ্লোর ক্লিনার নয়, জলে গুঁড়ো সাবানের সঙ্গে নিমাইল মেশাতে হবে। বাড়িতে মহোৎসবের দিন দই বা আইসক্রিম নয় অবশ্যই পায়েস রাঁধতে হবে। শাশুড়িমায়ের তৈরি করা নিয়মের কিছু পরিবর্তন করতে চাইলেই সবার আগে মনে প্রশ্ন জাগে মা থাকলে কী বলতেন? খুশি হতেন না রাগ করতেন? আমার শ্বশুরঘর কিন্তু প্রকৃত অর্থেই শাশুড়িমায়ের ঘর ছিল।
এ তো গেল বাপেরঘর আর শ্বশুরঘরের কথা, আমার মতে মায়েরঘর আর শাশুড়িমায়ের ঘরের কাহিনি। এরপর আসি স্বামীর ঘরে। ইয়ে তেরা ঘর, ইয়ে মেরা ঘর। হ্যাঁ এই ঘরে তু তু ম্যায় ম্যায় তো নিত্য দিনের রুটিন। তবু সত্যি সত্যিই কি এই ঘরের একটি পাতাও নড়ে আমার অনুমতি বিনা। কথায় কথায় তো পঞ্চাশোত্তীর্ণ ভদ্রলোককে শুনিয়ে দিই – দেখো বাপু তোমার অফিস, তোমার বাইরের জগত নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু আমার সংসারে আমার নিয়মই চলবে। অফিসের দোর্দন্ডপ্রতাপ বস মুখে কিছু না বললেও মনে মনে যে আমার এই দাপট মেনে নেন তা তার কাজেই প্রকাশ পায়। দুদিনের জন্য কোথাও গেলে ছেলের অনবরত ফোন — কবে ফিরবে, কবে ফিরবে? কই বাবা যে মাসের পর মাস অফিসের কাজে বাইরে থাকে তখন তো এমন করে না? পেপারওয়ালা থেকে দুধ দিতে আসা ছেলেটা দুদিন বাড়ি না থাকলেই খোঁজ নেয়। তাহলে কী করে বলি এটা আমার নিজের ঘর নয়, শুধুই স্বামীর ঘর।
না এখনও ছেলের আলাদা ঘর হয়নি। অর্থাৎ ছেলে বিবাহযোগ্য হয়নি কিন্তু পাড়ার বোস মাসিমা থেকে শুরু করে বেপাড়ার নীলিমা বৌদি সবার মুখেই তো এককথা, ‘ওরে বাবা, আমার ছেলের বাড়িতে তো বৌমার রাজত্ব চলে। ছেলে তো আমার সাত চড়েও রা কাড়ে না।’
উল্টোদিকে মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে একমুখ হাসি নিয়ে বলে, ‘মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরলাম।’ কই জামাইয়ের বাড়ি তো বলে না।
এই প্রবন্ধটি লিখতে লিখতে একটু রিলাক্সেশনের জন্য সোশাল মিডিয়ায় অন্যের জানালায় উঁকি দিয়েছিলাম সেখানে দেখলাম অভিনেতা ইমরান আব্বাস বলছেন, ‘আমায় অনেকে প্রশ্ন করেন আমি সারাক্ষণ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকি কেন? আসলে মায়ের মৃত্যুর পর ঘরটা আর ঘর লাগে না।’
আজ ফাইভজির জমানায় গ্রাম শহর বলে আলাদা তো কিছু নেই … সবই এক। তবুও প্রত্যন্ত গ্রামে অথবা শহরের কোনও কোনও বাড়িতে এখনও মেয়েরা ব্রাত্য। কোথাও মেয়ে ভ্রূণ হত্যা হয়। কোথাও আবার বাড়ির বউটিকে পুড়িয়ে মারা হয়। কখনো শুনি মাকে স্টেশন চত্বরে ফেলে রেখে সন্তান চলে গেছে, কোথাও আবার ছেলের বউয়ের অত্যাচারে শাশুড়িমা ঘর ছাড়া।
আমি যখন ছোট ছিলাম মায়ের কাজে সাহায্য করার জন্য এক আদিবাসী মহিলা রাখা হয়েছিল। তার নাম ছিল দুখী। আমি ডাকতাম দুখী মাসি। সেই দুখী মাসির একটা মেয়ে ছিল। নাম সুখী। আমারই সমবয়সী। দুখী আর সুখী মা মেয়ে মিলে একটা ঘরে থাকত। সুখীর বাবা ওদের সঙ্গে থাকত না। ওদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
সেই সুখীর বিয়ের সময় দুখীমাসি এক অদ্ভুত শর্ত রেখেছিল। বলেছিল, যে ছেলে ঘরজামাই থাকতে রাজি হবে তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেব। আমার মনে আছে একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে, দুখী মাসির কাজ হয়ে গেছে। বারান্দায় বসে বসে বিড়ি খাচ্ছে। দুখী মাসির এই বিড়ি খাওয়াটা আমি খুব অবাক চোখে দেখতাম কারণ সেইসময় গ্রামের মেয়েদের ওইভাবে ধূমপান করতে সচরাচর দেখা যেত না। মা মাসিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হ্যাঁ গো দুখী, তুমি ঘরজামাই রাখতে চাও কেন?’
মাসি একমুখ ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘বিটাছেলেরা তো ভালোবাসার লিগে ঘর বানায় না গো। উরা তু ঘর বানায় মেয়েলোকের উপর রাজ কুরার লিগে। উ ঘরে মেয়ে মানুষের বড় অপমান হয় গো বুদি। উরা ভাবে মেয়ে লোক উদের সম্পত্তি। উ যা করবেক মেয়েমানুষদের তাই মেনে লিতে হবেক। যে ঘুরে মান সুম্মান লাই উ ঘরে বিটি দিবক লাই।’
এই সেদিন এক প্রতিষ্ঠিত মহিলার মুখ থেকে তার জীবন কাহিনি শুনছিলাম। খুব অল্প বয়সে প্রেম করে বিয়ে করেন। স্বামীর ঘরে আসার পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বামী প্রতিনিয়ত তাঁর উপর শারীরিক, মানসিক অত্যাচার চালাতে থাকেন। তারপর যখন পর পর দুটি মেয়ের জননী হলেন তখন তাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হল। কন্যাদের নিয়ে পথে নামলেন তিনি। এরপর তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম আর অপরিসীম কষ্টের কথা তিনি আর বলতে চাইলেন না। বললেন, ‘কী হবে সেসব কথা বলে? আজ আমি প্রতিষ্ঠিত আমার সন্তানরা ভালো আছে। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?’
আমার কিন্তু ওঁর কথা শুনে একটা কথাই মনে হয়েছে, মেয়েদের কোনও ঘর হয় না একথা একেবারেই ভুল। আসলে মেয়েদের ছাড়া কোনও ঘর, ঘরই হয়ে ওঠে না। একমাত্র মেয়েরাই পারে, পথেও রাজপ্রাসাদ বানাতে …
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব সুন্দর লিখেছ। কে বলে মেয়েদের ঘর থাকে না। মেয়েরা ছাড়া ঘর, সংসার কেমন চলে সে আমার অনেক দেখা আছে। মেয়েরা ছাড়া ঘর হয় না।
পড়লাম। সৃজনীটি ভালো লেগেছে,
সবার দেখার বা উপলব্ধি করার ব্যাপার সাংসারিক এবং পারিবারিক দিক থেকে সুনির্দিষ্ট থাকেনা, কিন্তু আপনার বিষয়ভিত্তিক লেখাটি আমার কাছে ভালো লাগায় ভাগ বসিয়েছে! কলমের গতিধারা অব্যাহত থাকুক। ভালো থাকুন।