দুর্গাপুজো
রাজিকা মজুমদার
বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। আর এই দুর্গাপুজোই যে বাঙালির তেরো পার্বণের শ্রেষ্ঠ উৎসব তা বলাই বাহুল্য। নীল-সাদা পেঁজা তুলো মেঘ, খোলা মাঠে কাশ ফুলের ঢেউ, মাটির উঠোনে ছড়ানো ভোরের শিউলি সুবাস—সবই যে এই উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা বলাইবাহুল্য। বাংলার এই দুর্গোৎসবের শুরুটা ঠিক কীভাবে হয়েছিল, প্রথম দুর্গাপুজো কারা করেছিলেন—এসব নিয়ে পুরাণের নানা দিক তো আছেই, ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গেছে বহু জনশ্রুতিও। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে কতই-না দুর্গাপুজো দেখা যায়! শুধু পশ্চিমবঙ্গই-বা কেন? ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে দুর্গাপুজো নিয়ে কত কথা, কত তথ্য যে শুনতে পাওয়া যায়! তেমনই কোনো কোনো দুর্গাপুজো বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আলোকময় করে তোলে, উজ্জ্বল করে তোলে বাঙালির ইতিহাসকে। আমরা আজ কথা বলব হাওড়া জেলার পাতিহাল গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজো যা এ. টি. দেব-এর দুর্গাপুজো নামে খ্যাত।
বিখ্যাত সেই এ. টি. দেব-এর অভিধান, দেড়শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দেব সাহিত্য কুটীর, বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত দুই মাসিক পত্রিকা ‘শুকতারা’, ‘নবকল্লোল’ সবেই শুরু হয়েছিল এ. টি. দেব-এর হাত ধরে।
বহু পূর্বে হুগলির দ্বারবাসিনী গ্রাম থেকে কৈবর্তরা এসে হাওড়ার এই পাতিহাল অঞ্চলে বাস করতে শুরু করেন। তখন এখানে কেবল জঙ্গল ও খাল-বিলে পূর্ণ। কৈবর্তরা এখানে মাছধরা থেকে শুরু করে চাষবাসও শুরু করলেন। ওইসব ছোট ছোট চাষি অর্থাৎ পাতি চাষিরা হাল-বলদ নিয়ে চাষ করত বলেই এই গ্রামের নাম হয় ‘পাতিহাল’। এই পাতিহাল গ্রামের জোড়ামন্দির তলায়, বর্তমান মজুমদার বাড়ির পূর্বপুরুষ কায়স্থ বংশীয় শাণ্ডিল্যগোত্রীয় শোভারাম দে মজুমদার যে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন, সেই পুজো আজও তাঁর বংশধরেরা পরম নিষ্ঠা সহকারে করে চলেছেন। বর্তমানে পুজোটি আশুতোষ দেব বা এ. টি. দেবের পুজো নামেই খ্যাত।
আশুতোষ দেব তথা এ. টি. দেব’রা এ গ্রামের আদি বাসিন্দা নন। তাঁরা এসেছিলেন পাণ্ডুয়ার ইলছোবা-মণ্ডলাই গ্রাম থেকে। সেখানেই ছিল পৈতৃক বাড়ি। শোভারাম দে-র বাবা ছিলেন এলাকার নামকরা পণ্ডিত। শোনা যায় মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁর পরামর্শ নিতেন। বলাইবাহুল্য মাত্র সতেরো বছর বয়েসে শোভারাম বাবার কারণেই পাণ্ডুয়ার সেরেস্তায় চাকরি পেলেন। সেখানে নিজ কাজে বিশেষ পারদর্শিতার জন্য ফৌজদার তাঁকে মজুমদার উপাধি দেন। দে থেকে মজুমদার হলেন তাঁরা। তখন বাংলায় নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের আমল। গ্রামের বাড়িতে প্রচুর সম্পত্তি কেনেন শোভারাম। এর কিছুকাল পরে তিনি ইলছোবা ছাড়লেন। এলেন হাওড়ার পাতিহালে। ধীরে ধীরে পাতিহালেও গড়ে তুললেন প্রচুর সম্পত্তি। হয়ে গেলেন জমিদার। তাঁর পুত্র উমাপ্রসাদের ছেলে বরদাপ্রসাদ। ছেলেবেলা থেকেই বরদাপ্রসাদ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে তাঁকে লেখাপড়া ছাড়তে হয়েছিল। শোনা যায়—জমিদারি হারিয়ে কলকাতায় বই ফেরি করতেন তিনি। ঘাড়ে বই নিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতেন। নিজের সততা ও পরিশ্রম দিয়ে একসময় বইব্যবসার কাজে নামেন কোমর বেঁধে। সপরিবারে কলকাতায় চলে এসে স্বপ্ন দেখেছিলেন বই ফেরির পরিবর্তে বই তৈরি করবেন তিনি। আর সেখান থেকেই এলেন মুদ্রণশিল্পে। কলকাতার ঝামাপুকুর লেন-এ বরদার ছাপাখানা বসে ১৮৬৩-৬৪ সালে। তাঁর এই লড়াই ছিল ভিতরে ও বাইরে—দু’জায়গাতেই। আর তাঁর এই বই ব্যবসার রক্ষণাবেক্ষণ ও শ্রীবৃদ্ধিসাধনে তৃতীয় পুত্র আশুতোষই যে হবেন ভাবীকালের যোগ্য কাণ্ডারী—তা তিনি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। আর সেই জন্যই মৃত্যুকালে ব্যবসার যাবতীয় কর্তৃত্ব দলিল মারফৎ তৃতীয় পুত্র আশুতোষ দেব তথা এ. টি. দেব -এর হাতেই তুলে দিয়ে যান।
আশুতোষ দেব বি পি এম’স প্রেসের অভাবনীয় শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন। প্রেসের পাশাপাশি প্রকাশনার দিকেও তাঁর ঝোঁক যায়। তিনি একে একে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, পাঁচালী প্রভৃতি ছাপতে শুরু করলেন। আর কঠোর অধ্যাবসায় এবং নিষ্ঠার জোরে তিনি একখানা কালজয়ী অভিধান প্রকাশ করলেন। সেসময় পিতা বরদাপ্রসাদ জীবিত। এই অভিধানই রাতারাতি গ্রন্থজগতে পুত্র আশুতোষকে বিখ্যাত করে দিল। এরপর থেকেই আশুতোষের দর্শনীয় উত্থান। সে ইতিহাস আজও অমর হয়ে আছে। বরদাপ্রসাদ ‘দে’ পদবি ব্যবহার না করে ‘দেব মজুমদার’ ব্যবহার করতেন। আশুতোষের পরিচয় দেব হিসেবেই।
পুরনো পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সূত্র থেকে অনুমান করা যায় যে কীভাবে এই এ. টি. দেবের বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল। যদিও এই পুজো কোন ব্যক্তি প্রথম শুরু করেছিলেন তার কোনো লিখিত তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন স্মৃতিচারণ মূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ থেকে এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী—এ. টি. দেবের পুজো আনুমানিক ২৫০-৩০০ বছর পুরনো।
এই পুজোর নিজস্ব কিছু রীতি ও বৈশিষ্ঠ্য আছে। মজুমদার পরিবারের রীতি অনুযায়ী জন্মাষ্টমীর দিন নিজ বসতভূমির মাটি কেটে তার সঙ্গে গঙ্গামাটি মিশিয়ে দুর্গা দালানের একধারে রাখা হয়। ওইদিন সকালে গৃহদেবতা রঘুনাথের (শালগ্রাম শিলা) পুজো করবার পর পুরোহিত সেই মাটি দেবী দুর্গার কাঠামোয় দেন। এই রীতিকে বলা হয় ‘গায়ে মাটি’। আর এর ঠিক কয়েকদিন পর থেকেই মৃৎশিল্পী প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু করেন।
দেবদের একচালার প্রতিমা তৈরি করা হত। দেবী দুর্গার ডানপাশে উপরে বসতেন দেবী লক্ষ্মী। তাঁর পদতলে থাকতেন সিদ্ধিদাতা গণেশ। যদিও এই গণেশের চারটি হাত নয়। এই গণেশের দুটি হাত। গণেশের দুটি হাত হওয়ার পিছনে অবশ্য একটি আকর্ষণীয় গল্প রয়েছে। আগে মজুমদারদের প্রতিমা আসত কুমোরটুলি থেকে নৌকা করে। এই গ্রামে এখনও নোলোর খটি নামে একটি জায়গা রয়েছে। এটি ছিল নৌ যোগাযোগের বাণিজ্য কেন্দ্র। এই নোলোর খটিতেই রয়েছে বদর পিরের থান। এটি পির মাঝি-মাল্লাদের উপাস্য। এই পথেই প্রতিমা আসত তখন। সেখান থেকে মজুমদারদের প্রজারা দুর্গাদালানে প্রতিমা বয়ে আনতেন। একবার প্রতিমা আনার সময়ে গণেশের একটি হাত ভেঙে যায়। তিন হাতের গণেশ পুজো অশুভ। তাই গণেশের হাত হয়ে যায় দুটো। এখনও সেই রীতি চলছে। সম্ভবত গণেশের হাত ভাঙার পরে কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা আনা বন্ধ হয়ে যায়। দুর্গাদালানেই তৈরি হতে শুরু করে প্রতিমা।
জমিদারি প্রথামতো পুজোর কটা দিন নিজ গ্রাম সহ আশেপাশের সমস্ত গ্রামগুলিকে আগে নিমন্ত্রণ ও পাত পেড়ে খাওয়ানোর চল ছিল। সে ব্যবস্থা এখন আর নেই। গ্রামের সকলে এখনও পুজোয় সামিল থাকেন যদিও সেই জাঁকজমক এখন ফিকে হয়ে গেছে। তার উপর করোনার কারণে গত কয়েক বছর প্রতিমা আর ঠাকুরদালানে তৈরি করানো হচ্ছে না। প্রতিমা আনা হচ্ছে বাগনানের বাইনান থেকে।
এক সময় মজুমদার বাড়ির পুজোর সময়ে চাঁদের হাট বসে যেত। কলকাতার ঝামাপুকুর লেন থেকে কর্তাব্যক্তিরা আসতেন পাতিহালে। এ. টি. দেব আসতেন সপরিবারে। এখনও সেই রীতি মেনে চলেছেন তাঁর উত্তরপ্রজন্ম। এ. টি. দেবের পৌত্র শ্রী বরুণ চন্দ্র মজুমদার এখনও তাঁর পুত্র, দেব সাহিত্য কুটীরের বর্তমান ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং ‘শুকতারা’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী রাজর্ষি মজুমদার এবং তাঁর কন্যা, অন্যতম ডিরেক্টর তথা ‘নবকল্লোল’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রীমতী রাজিকা মজুমদারকে নিয়ে সপরিবারে পাতিহালের পুজোতে উপস্থিত থাকেন। সকলের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে ভগ্নপ্রায় মজুমদার বাড়ি। এ. টি. দেবের এই দুর্গাপুজো পাতিহাল তথা জগৎবল্লভপুর এমনকি হাওড়া জেলার বনেদি বাড়ির পুজোর ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছে।
গ্রন্থঋণ:
১। ‘বই ব্যবসা ও পাঁচ পুরুষের বাঙালি পরিবার’— রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।
২। ‘পাতিহাল মজুমদার বাড়ির দুর্গাপুজো’, নবকল্লোল (শারদীয়া ১৪৩০)
৩। ‘পাতিহালের বনেদি বাড়ির পুজো’— দীপক দাস।
৪। ‘পশ্চিমবঙ্গ, হুগলি জেলা সংখ্যা—১৪০৩’—তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
৫। ‘জগৎবল্লভপুর জনপদকথা’—শিবেন্দু মান্না।
৬। ‘ইতিহাসে মোড়া পাতিহাল’— যুগের খবর।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন