Short Story – Mrs. Malhotra

মিসেস মালহোত্রা
ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

মিসেস মালহোত্রা বহুদিন হল মুম্বাইয়ের বাসিন্দা। স্বামী মারা গেছেন বেশ কিছুদিন। জলন্ধরের ফার্ম হাউস, চাষবাস, হাঁস মুরগীর জিম্মা ভাগনেকে দিয়ে চলে এসেছেন মুম্বাইয়ের লোয়ার প্যারেলে। ছেলের বাংলোর কাছেই নিজের অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, ছোটখাট। মাঝে মাঝে জলন্ধরে যান। কড়া নজর রাখেন, কেউ কাজে ফাঁকি দিচ্ছে কিনা। ভাগনের কাছ থেকে সম্পত্তি বাবদ প্রাপ্তির হিসেব নিকেশটাও কড়ায় গণ্ডায় বুঝে আসেন।

মিসেস মালহোত্রা একটু অন্যমনস্ক ইদানীং। টুকটাক দুর্ঘটনা ঘটছে কিছু সেজন্য। বাড়িতে একটি কথা বলা ময়না পুষেছেন কিছুদিন হল। তার নাম মিস্টার হেনরি। কোন লোকজনের সাড়াশব্দ পেলেই সে বলত, “হু ইজ ইট?” তাকে কথা শেখানো ছিল। আসলে বারবার কোন কথা বললেই ময়না সেটা শিখে যায়।      

ইতিমধ্যে মিসেস মালহোত্রার উকিল, জরুরি কিছু কাগজ নিয়ে একদিন এসেছেন সই করাবেন বলে। আসবার আগে আসার কথা জানিয়েও ছিলেন। কিন্তু সে সব বেমালুম ভুলে মিস্টার হেনরিকে বাড়িতে রেখে অন্যমনস্কভাবে মিসেস মালহোত্রা একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন। উকিলবাবু দরজা ধাক্কিয়েছেন, বেল বাজিয়েছেন। ময়না ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করেছে, “হু ইজ ইট, হু ইজ ইট?” তিনি জবাবে বলেছেন “ইয়োর লইয়ার, ইয়োর লইয়ার।” ময়না তো আর কথা জানে না। বারবার শুনলে তবে না সে কথাটা শিখবে। কিন্তু উকিল জানেন না, যে ভেতরে কোন মানুষ নেই। আছে কেবল একটা কথা বলা পাখি। পাখি বলে চলেছে “হু ইজ ইট, হু ইজ ইট?” প্রায় আধঘণ্টা ধরে তিনিও জবাব দিচ্ছেন “ইওর লইয়ার, ইওর লইয়ার।” শেষকালে বলতে  বলতে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। ক্লান্ত হয়ে প্রায় খাবি খাচ্ছেন, হার্ট অ্যাটাক হবার মত অবস্থা। দরজার বাইরেই কাগজপত্র নিয়ে বসে পড়েছেন। এদিকে মিসেস মালহোত্রা ভ্রমণ সেরে ফিরে এসেছেন। নিজের ফ্ল্যাটের চাবি খুলে ঢুকতে যাবেন, করিডোরের আলোটা জ্বলছে না। আলো আঁধারিতে ঠাওর করতে পারলেন, কে যেন মেঝেতে বসে আছে। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন, “হু ইজ ইট। হু ইজ ইট?” ইতিমধ্যে ময়না তো বারবার শুনে শুনে জবাবটা শিখে গেছে, ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠল, “ইওর লইয়ার, ইওর লইয়ার।”    

যাই হোক অল্পের ওপর দিয়ে সেবার ফাঁড়াটা কেটে গেছিল।

এদিকে লোয়ার প্যারেলের নামকরা রেস্তোরাঁ পাম বাই বেন্ট চেয়ার। চারতলার ওপরে আহা সে কী অপূর্ব অ্যামবিয়েন্স। না দেখলে বোঝাই যাবে না। বিশাল চওড়া বারান্দা, বড় বড় ঘর। সর্বত্র সোফা চেয়ার টেবিল পাতা। পছন্দমতো জায়গা দেখে বসে পড়লেই হল। নানা রকম ওয়াল হ্যাঙ্গিংস, শ্যান্ডেলিয়ারে এক আচ্ছন্ন পরিবেশ। খাবার দাবারের তুলনা নেই। কী না পাওয়া যায়! তার যেমন স্বাদ তেমনি পরিবেশন। মালহোত্রা মাঝে মাঝে সেখানে আসেন, একা একা সময় কাটাতে। আবার বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করা বা মেলামেশার স্থান হিসেবে এই জায়গাটাই পছন্দ করেন। যাই হোক, মিসেস মালহোত্রার মন মেজাজ খারাপ। কেন খারাপ তা কেউ জানে না। সব ঠিকঠাক চলছে, ছেলে ছেলের বউ মাকে খুব ভালোবাসে। সবসময় খবরাখবর নেয়। নিজেদের কাছে রাখতেও চায়, কিন্তু স্বাধীনচেতা মালহোত্রা তাতে রাজি নন। আসলে ওই উকিল ভদ্রলোকের প্রতি তাঁরও একটু ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট হয়ে গেছে। ভদ্রলোক জাতে পার্শি। বিপত্নীক। মালহোত্রা পাঞ্জাবী। এই বয়েসে সবারই একটা সমবয়স্ক সঙ্গী লাগে। ভদ্রলোকও মিসেস মালহোত্রার প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু কথাটা পাড়তে সাহস হচ্ছে না। যদি প্রত্যাখ্যাত হন। মিসেস মালহোত্রার বাড়ির লোকজনেরা যদি আপত্তি করে!  বলা বাহুল্য, মিসেস মালহোত্রার সম্পত্তির ওপর তাঁর কোন লোভ নেই। মুম্বাই উচ্চ ন্যায়ালয়ে ওকালতি করে করে তাঁরও সম্পত্তি নেহাত কম নয়। থাকার মধ্যে আছে কেবল এক দূর সম্পর্কের মাসি। এছাড়া তিনকুলে তাঁর খবর নেবার কেউ নেই। চাকরবাকরের ভরসাতেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন।  

নিজের মাসি মিসেস ইরানিকেই তিনি পাঠিয়েছেন, মিসেস মালহোত্রার কাছে। মালহোত্রাও কথাবার্তা বলতে বেশ আগ্রহী। কিন্তু যথেষ্ট অন্যমনস্ক। ময়নার সঙ্গে ইদানীং তাঁর সঙ্গী হয়েছে এক কুকুর। কুকুর পুষছেন তিনি। বাড়িতে কুকুরকে রেখে এসেছেন সেই পাম বাই বেন্ট চেয়ার রেস্তোরাঁয়। নিরিবিলিতে কথা বলার উপযুক্ত স্থান। সঙ্গে পছন্দমতো খাদ্য পানীয়। মিসেস ইরানি এসে দেখছেন মিসেস মালহোত্রা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। দুজনে অর্ডার দিলেন চেরি ব্লসম আর অ্যামন্ড বেল্লিনি ককটেইল। মহিলাদের গল্প জমানোর জন্য এ এক উৎকৃষ্ট পানীয়। মুখোমুখি বসেছেন দুজনে। মিসেস মালহোত্রার পায়ের কাছে একটি কুকুর বসে আছে। দেখে শান্তশিষ্টই মনে হচ্ছে। দুজনের কথাবার্তা এরকম হচ্ছে।

“আজ বড্ড গরম পড়েছে।” 

“হ্যাঁ কিন্তু ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। ভালোই লাগছে।” 

“তা বটে।”

“আপনার কুকুরটা মানুষ পছন্দ করে, না রেগে যায়? বিস্কিট খায়?”

“মানুষ ভীষণ পছন্দ করে। আর বিস্কিট খেতেও খুব ভালবাসে।”

মিসেস ইরানির ব্যাগে সবসময়ই কিছু বিস্কিট আর কুকিজ থাকে। টেবিলের তলায় হাত বাড়িয়ে কুকুরটাকে বিস্কিট খাওয়ানোর চেষ্টা করতেই বিপত্তি। বিস্কিট ছুঁয়েও দেখলো না। উল্টে মিসেস ইরানির হাতেই ঘ্যাঁক করে কামড় বসিয়ে দিল।

“একী, আপনি বললেন যে আপনার কুকুর মানুষ ভালোবাসে, কাউকে কামড়ায় না, খুব শান্ত! এই কুকুরটা তো আমার হাতেই কামড়ে দিল।”    

“কী আশ্চর্য, এই কুকুরটা যে আমার তা আপনাকে কে বলল? আমি তো একবারও আপনাকে তা বলিনি, আপনিও জানতে চান নি। আমার কুকুরটা তো বাড়িতেই আছে।” মিসেস মালহোত্রা জবাব দিলেন।

যাই হোক, এই সব ঘটনার পরে যা ঘটে তা বলাই বাহুল্য। চিকিৎসা ইনজেকশন ইত্যাদি সেরে মিসেস ইরানি কিছুটা ধাতস্থ হলেন, মিসেস মালহোত্রাও খুবই লজ্জিত হলেন। তাঁর অন্যমনস্কতার কারণে একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তিনি সময় মতো বাড়ি থাকলে উকিলবাবুর মূর্ছা ও পতন ঘটত না। আবার একটু সজাগ থাকলে প্রথমেই বলে দিতে পারতেন এটা তাঁর কুকুর নয়। উকিলবাবুর মাসিকেও তাহলে আর কুকুরে কামড়াত না।    

কিন্তু উকিলবাবু দমবার পাত্র নন। মিসেস মালহোত্রাকে তাঁর খুব পছন্দ হয়ে গেছে, অনেকটা ওই অন্যমনস্কতায় কারণেই। তাই কিছুদিন বিরত থাকার পর তিনি আবার সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। ভরসা সেই সারমেয় দংশিত মাসি। তাকেই জিজ্ঞেস করলেন কীভাবে মিসেস মালহোত্রার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। মাসি ততদিনে কুকুরের কামড় টামড় ভুলে গিয়ে অনেকটাই সুস্থ আর স্বাভাবিক হয়েছেন। মিসেস মালহোত্রার প্রতি তাঁর সহানুভূতিরও অভাব নেই। তিনি বললেন, “একটা কিছু উপহার দে ভদ্রমহিলাকে।” কিন্তু কী উপহার দেয়া যায়? এদিকে পার্শিদের মধ্যে তো পশুপাখি পোষার বেশ রেওয়াজ আছে। মিসেস মালহোত্রাও কুকুর এবং পাখি পোষেন। যাই হোক মাসি আর বোনপো মিলে গোটা মুম্বাইয়ের নানা গিফট শপ ইত্যাদি খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত একটি পেট শপে ঢুকলেন যেখানে মাছ খরগোশ কুকুর বেড়াল থেকে হেন জন্তু জানোয়ার বা পাখি নেই যা পাওয়া যায় না এবং পোষা যায় না। ইঁদুর, বাঁদর, বেজী, খরগোশ, গিনিপিগ, ময়না, টিয়া কাকাতুয়া, ঈগল, কী নেই?  

বোনপো শেষমেষ পেট শপের ম্যানেজারকে বলেই ফেললেন, “এমন একটা স্পেশাল কিছু দেখান যা কারও নেই। ভূভারতে নেই।”

অনেক ভেবে চিন্তে মাথা চুলকে ম্যানেজার একটা নাদুস নুদুস পাখি দেখালেন দুজনকে।

উকিল বললেন, “তো? এটা কী আর এমন।”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান। এই পাখিটির দাম একটু বেশি পড়বে। দশ হাজার টাকা।”

“সেকী? এতো দাম? এটা তো অতীব সাধারণ একটা পাখি।”    

“আহ্‌হা। শুনুন না।” বলেই তিনিই জানালেন, এটি একটি অত্যন্ত বিদ্বান এবং পণ্ডিত পাখি। হিন্দি পুস্তু উর্দু ফার্সি স্প্যানিশ ইংরেজি সমেত মোট দশটা ভাষায় কথা বলতে পারে এই পাখি। অনর্গল বলতে পারে এবং বুঝেই বলে। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে একেবারে মানুষের মতো। চাই কী দোভাষীর কাজও করতে পারে। “নিয়ে যান, ঠকবেন না।” 

পরীক্ষা টরীক্ষা করে নিঃসন্দেহ হয়ে পাখিটিকে উকিলবাবু কিনে নিয়ে গেলেন। পরের দিন সকালেই স্পেশাল কুরিয়ারে মিসেস মালহোত্রার ঠিকানায় পাখিটি পাঠিয়ে দিলেন।       

অফিস থেকে ফিরে তাঁর উপহারটি মিসেস মালহোত্রার কেমন পছন্দ হল জানার জন্য সেদিন সন্ধেবেলাতেই ফোন করলেন।  সত্যি বলতে কী, সারাদিন জানার জন্য ছটফট করছিলেন। কিন্তু শিষ্টাচার বিরোধী হবে বলে বেশি জিজ্ঞেস করতেও পারছিলেন না, আগ্রহও দেখাতে পারছিলেন না। অপেক্ষায় ছিলেন, কখন মিসেস মালহোত্রা ফোন করেন। যাই হোক, যা বলছিলাম, সন্ধের দিকে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। আর পারলেন না। নিজেই ফোন করে জানতে চাইলেন, উপহারটি কেমন। 

মিসেস মালহোত্রা উচ্ছ্বসিত জবাব দিলেন, “চমৎকার। জলন্ধরে এই রকম পাখি আমরা ছোটবেলায় ফাঁদ পেতে প্রচুর ধরেছি এককালে। বেশি কিছু না, সামান্য ভাজা খেতেই এতো ভালো লাগে যে তা আর বলার নয়। বহুদিন এই সুস্বাদু পাখির আস্বাদ পাই নি। গতকাল সেই অভাব পূরণ হল। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এই উপহারের জন্য।”

উকিলবাবুর হাত থেকে ফোনটা ঠক করে পড়ে গেল।   

                                          -শেষ-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *