মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর
রাত প্রায় এগারোটা। শীতের শেষভাগ। ইস্কাটনে এসেছিলাম এক কলিগের বাসায়। বউ সাথে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। হাঁটতে বেশ লাগছে। বাসা আমার পরিবাগে। হেঁটেই ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথ দিয়ে চলা শুরু করলাম। সাকুরা বারের সামনে আসতেই ও আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে। জিজ্ঞেস করি, ‘কি হলো?’ বউ বলে, ‘ঐ যে দ্যাখো, লোকটা আমার দিকে ক্যামন করে তাকিয়ে আছে!’ চেয়ে দেখি ভদ্রলোককে। আমারই বয়সী কিংবা খানিকটা বড়ই। সাকুরা থেকেই বের হয়েছে। ঢুলু ঢুলু চোখ, বোঝাই যাচ্ছে ড্রাংক। বউকে বলি, ‘ভয় পেয়েছো?’ এবার সে ফিসফিস করে বলে. ‘বাহ, ভয় পাবো না! তুমি পাগল হলে যেভাবে তাকাও লোকটি কিন্তু সেভাবেই তাকিয়েছিলো।
ফার্মগেট এলাকায় যাদের যাতায়াত আছে তাদের চোখে নিশ্চয়ই পড়েছে। পাগলটির বয়স কত হবে? দেখে তো ত্রিশ/পয়ত্রিশ বলেই মনে হয়। সম্পূর্ণ দিগম্বর। সুঠাম দেহ। গ্রীকভাস্কর্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ভদ্রলোকেরা না দেখার ভান করে। আশেপাশে হেঁটে চলা মহিলাদের দেখি আড়চোখে একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিতে। নাহ্, পাগলটা মোটেই ভায়োলেন্ট নয়। মাঝে মাঝে সে অট্টহাসি দিয়ে ভরাট গলায় চিল্লায়, ‘মানুষ কই গেল রে? মানুষ কই গেল রে?’ সেদিন দেখি এক গামছা বিক্রেতা লাল টকটকে নতুন গামছা লোকটিকে দিয়ে বল, ‘এই নেও …গামছাটা দিয়া সতর ঢাইক্যা ফালাও এলা!’ পাগলটি এবার হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে বলে ওঠে, ‘হারামজাদা, তুই কী পাগল হইছোস? আমি কাপড় পড়ুম কেন? কারে দেইখা আমি শরম পামু? মানুষ কই? মানুষ কই রে?’
আমার চোখে ভেসে ওঠে মানুষ খোঁজার তপস্যায় হারিকেন হাতে গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনেসের মূর্তি।
মার্গারেট আমার গার্লফ্রেন্ড। গত তিন বছর ধরে আমরা লিভটুগেদার করছি। দুজনেই বায়োরোবটিকসের ছাত্র। নীতু আমাদের দুজনের যৌথ প্রজেক্টে সৃষ্টি।
ত্বরিৎ শিখে নেওয়ার অস্বাভাবিক ক্ষমতা নীতুর। মার্গারেটের চালচলনের অনেকটাই সে আত্মস্থ করে ফেলেছে। অবাক হতে হয় ওর সাইকোলজিকাল ডেভোলেপমেন্টের কথা ভাবলে। সত্যিই মিরাকুলাস।
নীতু আমাদের সাথেই থাকে। ঘর গোছানো থেকে শুরু করে রান্নাবান্না হাসিমুখে নীতুই করে দেয়। মার্গারেট আর আমি বেশীরভাগ সময়ই নীতু বিষয়ক ডেটা অ্যানালাইসেই ব্যস্ত থাকি।
সেদিন মার্গারেট গেছে শপিং-এ। বাসায় আমি আর নীতু। নীতু হঠাৎ এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। আমি তো হতভম্ব। আামার দোনামনা ভাব দেখে সে বলে উঠে, “যন্ত্র হলেও তো আমার ফিলিংস আছে, তোমরা তো আমার সামনেই ওসব করো, আমারো কি ইচ্ছে করে না?”
মদ আমাকে মাতাল করে না। আমি উপভোগ করি। আমার লিমিট আমার জানা থাকায় সবসময়ই স্টেডি থাকি। তবে কয়েক পেগ পেটে পড়লেই আমার চারপাশের জড়-অজড় সবকিছুই মাতাল হয়ে যায়। এই যে এ মূহুর্তে টেবিলে রাখা মদের বোতলটি টলোমলো করে উঠছে, মদ কি ছলকে উঠবে! পাশের টেবিলে বসে গিলছে দুজন, ওরা বোধ হয় হাজব্যান্ড-ওয়াইফ, কিংবা ফিয়ান্সে ..দোলকের মতোন ওরাও দুলছে। টেবিলের পায়ার দিকে চোখ পড়ে, বুঝতে পারছি কিছুক্ষণের মাঝেই টেবিলটি হাঁটা শুরু করবে। বারের মিউজিক সিস্টেমে ভেসে আসছে আমার প্রিয় শিল্পী লায়নেল রিচির রোমান্টিক গান। কিন্তু এ কী রিচির গলা এতো কর্কশ লাগছে কেন … সেও কি মাতাল হয়ে গেল আজ!
চারপাশের মাতালদের দেখে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। খাস ঢাকাইয়া ভাষায় গালি দিয়ে উঠি, ‘মাংগের পুত, লিমিট না বুইঝা তোগরে খাইবার কয় কোন হালায়?’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন