micro-story-sohoyatri

সহযাত্রী
মহুয়া সমাদ্দার


রিমিতা ট্রেনে উঠেই কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। ভীড় ঠেলে সেদিকেই এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার ঠিক উল্টোদিকে মুখোমুখি এক চিলতে জায়গায় নিজেকে কোনওক্রমে সেঁধয়ে দিয়েই ফোনটা বের করে মুখের সামনে তুলে ধরলো। মোবাইল ধরাই সার। দেখছে না সে কিছুই।

দেখবেই বা কী করে? মুখের সামনে হুবহু অম্লানের মতো দেখতে একটা ছেলে বসে থাকলে অন্য কোনও দিকে চোখ ফেরানো যায়? অন্য কেউ হঠাৎ করে দেখলে একে অম্লান বলেই ভুল করবে,

এটা এক্কেবারে নিশ্চিত। সেও প্রথমটায় সেটাই করেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভালো করে চাইতেই বুঝতে পারলো এটা আর যেই হোক অম্লান নয়। কারণ, এই ছেলেটার ঠিক ঠোঁটের ওপরেই একটা তিল রয়েছে। যেটা অম্লানের ছিল না। আর তিলটার জন্যে ছেলেটাকে আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। সে বসার কয়েক মুহূর্ত পরেই বুঝতে পারলো যে ছেলেটার আশেপাশে ওর কিছু বন্ধুবান্ধব স্তরের মানুষজন রয়েছে। হয়তো ওর কলিগ। এদের মধ্যেই একজনের কথা থেকেই রিমিতা পরিষ্কার বুঝতে পারলো যে এরা সবাইই ইঞ্জিনিয়ার এবং দমদমের বিখ্যাত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিরত। এটাও সে জেনেছে যে অত্যন্ত লাজুক ছেলেটা এই তিরিশ বছরের জীবনে একটা প্রেমও ঠিকঠাক করে উঠতে পারেনি। তাই বিয়েও হয়নি।

রিমিতার সঙ্গে ইতিমধ্যেই দিন পাঁচেক দেখা হয়েছে ছেলেটার। ওর নামও সে ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছে। তমাল। তমালকে একবার দেখতেই এই ট্রেনটা ধরেছে সে আজ কদিন ধরে। কিন্তু জানুয়ারি থেকে সেটা আর সম্ভব হবে না। আজই ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার শেষ দিন। কারণ,

ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভর্তি নেওয়া ছাড়া তাদের স্কুলে তেমন একটা কাজের চাপ থাকে না বলে তাদের হেডমিস্ট্রেস এই সময়ে তাদের একটু লেট নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামান না। কিন্তু

জানুয়ারির দু তারিখ থেকে আবারও অ্যাটেনডেন্সে কড়াকড়ি শুরু হবে। তখন তার আর এই বিশেষ বারাসাত লোকালের জন্যে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। অন্তত আরও ঘন্টাখানেক আগেই তাকে পৌঁছে যেতে হবে তার স্কুলে। সে আজই তাই কিছু একটা ছল করে তমালকে তার মোবাইল নাম্বারটা জানিয়ে দিতে চায়। কলেজে পড়াকালীন অম্লানকে হারিয়েছে ক্যান্সার নামক মারণব্যধির কারণে। তারপর থেকে অনেক বছর কেটে গেলেও এখনও পর্যন্ত কাউকেই সে আর ভালোবাসতে পারেনি। ইচ্ছেই হয়নি কখনও।

অনেক ভেবেচিন্তে একটা উপায়ও বের করেছে সে। এই আঠাশ বছর বয়সে ব্যাপারটা বেশ হাস্যকরই হবে হয়তো। কিন্তু সে নিরূপায়। সে বাড়ি থেকেই একটা কাগজে তার নাম আর নাম্বার লিখে সেটাকে দলা করে ব্যাগে পুরে নিয়ে এসেছিল। সেটাকেই সে ছল করে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলতে গিয়ে তমালের গায়ে ফেলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই তমাল চমকে তার দিকে তাকাতেই সে –ভেরি সরি। –বলে উঠলো। তমাল ওর দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে কাগজের দলাটা বাইরে ছুড়ে ফেলে দিলো।

শান্ত, অবশ মন নিয়ে আজ সে স্কুলে এসেছে। টিফিনের সময়ে সব কলিগরা হাসি, গল্প ইত্যাদি করতে করতে খাচ্ছে। শিখাদি হঠাৎ বললো – এই রিমিতা, কী রে? আজ যে খাচ্ছিস না বড়!

আজ তার এতটুকুও খাওয়ার ইচ্ছে নেই। অম্লানকে সে ইতিপূর্বেই হারিয়েছে। আজ তমালকেও সে হারালো। সে জলভরা চোখে টিফিনব্যাগ থেকে খাবার বের করতে গিয়েই চমকে উঠলো। এটা কী?

একটা কাগজ না? আশ্চর্য! সে কাঁপাকাঁপা হাতে কাগজটা খুলতেই বেরিয়ে পড়লো একটা ছোট চিঠি।

প্রিয় রিমিতা,
আপনার মোবাইলে কলিগদের সঙ্গে বলা কথা শুনেই আপনার নাম ইত্যাদি সম্পর্কে জেনেছি। আমি এটাও জানি যে জানুয়ারি মাস থেকে আমাদের আর দেখা হবে না। জানি না কেন।

আপনাকে দেখার পর থেকে আমার মনের ভেতরে অদ্ভুত এক অশান্তি শুরু হয়েছে। আপনাকে আমার নাম্বারটা জানালাম। আপনি রোজই আমার পাশে একটা ব্যাগ রেখে প্যাসেজ ছেড়ে পেছন ঘোরেন। সেই সময়েই চিঠিটা ঢুকিয়ে দেবো ঠিক।

বিরক্ত বোধ করলে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দেবেন।

ইতি,
ট্রেনের সহযাত্রী

রিমিতা মাথা নীচু করে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *