সোমজা দাস
দুলাল হাজরার দোকানের সামনে দিয়েই আসত-যেত মেয়েটা।
একটা নীল রঙের সাইকেল ছিল, সরকারি প্রকল্প থেকে পাওয়া। সেটাতে প্যাডেল ঘোরাত বনবন করে। সাইকেল এগোত হাওয়া চিরে। রোগা মেয়েটার পিঠে তখন দুটো ডানা দেখতে পেত দুলাল।
বাবা যখন মারা গেল, দুলালের তখন সবে ষোল। লেখাপড়ার পাট চুকেছিল আগেই। বন্ধুদের সঙ্গে রাজাউজির মেরে দিন কাটছিল দিব্যি। স্টেশনের কাছে এই মনিহারি দোকানটা থেকে যা রোজগার হত, তাই দিয়ে সংসার চলে যেত।
দুলালের বাবা যে রাতে রেললাইনে মাথা দিল, সেদিন নাইট শোয়ে সিনেমা দেখে বাড়িতে ফিরেছিল দুলাল। একটা হেব্বি মারকাটারি বই এসেছিল রূপশ্রী হলে। ফেরার সময় দলে পড়ে খানিকটা নেশাও করেছিল। বাবার শরীরটা কাটাছেঁড়ার পরে যখন বাড়ি এল, তখনও দুলালের চোখ লাল।
বাবার মরার কারণ জানা যায়নি। মাকে অনেকবার শুধিয়েছিল দুলাল। মা বলে, “কেমনে জানব? সারাটা দিন তো দোকানেই কাটাত মানুষটা। বাড়িতে যতক্ষণ থাকত, ক’টা কথা বলত? কে জানে, বুকের ভেতর কোন দুঃখ মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল! জিজ্ঞাসা করলে বলত, মেয়েমানুষ মেয়েমানুষের মতো থাকো। অত কথা কীসের!”
মায়ের কথা মিথ্যে নয়। রোজই দোকান বন্ধ করার পর নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকত বাবা, একা। বিড়ি ফুঁকত একের পর এক। মা বাড়িতে অপেক্ষায় থাকত বাড়া ভাত নিয়ে। একেকদিন ভাত জুড়িয়ে কাঠ হত। বাবা না খেয়েই শুয়ে পড়ত বিছানায়।
দুলালের কাচা বয়স তখন। মনে হত, বাবার বুকের ভেতরে একটা বন্ধ ঘর আছে। যেটার চাবি হারিয়ে গেছে। কিংবা হয়তো লুকিয়ে রেখেছে বাবা। সে ঘরের ভেতর কী আছে, সে হদিশ জানে না কেউ।
তারপরে কেটে গেছে আরও তিন বছর। দোকান ভালোই চলছে দুলালের হাতে পড়ে। মা বলে, সে নাকি তার বাবার চেয়ে ব্যাবসা ভালো বোঝে।
সকাল সকাল দোকান খোলে দুলাল। একটু তাড়াতাড়িই আসে আজকাল। মেয়েটা সেই সময়ে সাইকেল চালিয়ে টিউশনে যায়। ফেরে বেলায়। আবার দশটা নাগাদ সামনের রাস্তা ধরেই যায় ইশকুলে। ফিরতে ফিরতে চারটা বাজে প্রায় রোজই। আজকাল সে অপেক্ষা করে থাকে মেয়েটার জন্য। ঘড়ির দিকে তাকায় বারবার। অমন পাখির মতো মেয়ে, মন তো টানবেই!
আজকাল দুলালের মন ভালো নেই। গত কদিন ধরে মেয়েটাকে একটা ছেলের সঙ্গে দেখতে পাচ্ছে। ওর সাইকেলের প্যাডেলের গতি কমেছে। ডানা দুটো মুড়ে রাখে পিঠের উপর। দুই বেনীর স্বাধীনতা মুখ লুকিয়েছে, পিঠের উপর শ্যাম্পু করা ফাঁপানো চুল। দুলালের বলতে ইচ্ছে করে, চুল খুলে অমন করে ঘুরতে নেই মেয়ে। ভূতে ধরে।
আজকাল ও রোজ টিউশনে যায় না, জানে দুলাল। সঙ্গের ছেলেটা সেদিনগুলোয় একটা বাইক নিয়ে আসে। স্টেশনের কাছের স্ট্যান্ডে সাইকেলটাকে রেখে ছেলেটার বাইকে উঠে বসে মেয়েটা। জড়িয়ে ধরে থাকে দুই হাতে। হাওয়ায় ওড়ে ওর খোলা চুল। খুব হাসে দু’জনে। দুলালের বুকের ভেতরে জ্বালা করে। মনে হয় বলে, ভুল ভুল। ও ছেলে তোমার ডানা কেটে দেবে। তোমার আকাশ কেড়ে নেবে মেয়ে। পালকগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে উড়িয়ে দেবে হাওয়ায়।
বলা হয় না। চোয়াল শক্ত হয় দুলালের। হাতের মুঠো ঘামতে থাকে। দোকান বন্ধ করে নদীর ধারে গিয়ে বসে সে আজকাল।
সেদিন দোকান খুলতে দেরি হয়েছিল। বেলা বাড়তেই জানা গেল, কয়েক মাইল দূরে নদীতে ভেসে উঠেছে লাশ। খোঁজ মিলছিল না দু’দিন আগে থেকেই। পরিবার লোকলজ্জার ভয়ে পুলিশের সাহায্য নেয়নি।
বেলা বাড়ে। দুলালের দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে। যন্ত্রের মতো হাত চলে তার। ওজন মেপে জিনিস দেয়। হিসেব করে। খুচরো ফিরিয়ে দেয় খদ্দেরকে। বিকেল নাগাদ মেয়েটা যায় দোকানের সামনে দিয়ে। আজ সাইকেলটা নেই। বাইকও না। বদলে চার চাকার সাইকের ভ্যানে নীল প্লাস্টিকে মোড়া শরীরটা শুয়ে থাকে নিশ্চল হয়ে। সেই শরীরে হাজার দাগ। ঠোঁটের কোণে কালসিঁটে। দুলাল তাকিয়ে থাকে, যতক্ষণ না দৃষ্টিসীমার বাইরে বেরিয়ে যায় ভ্যানটা।
বাইকওয়ালা ছেলেটাকে নাকি তুলেছে পুলিশ। ছেলেটা কান্নাকাটি করেছে খুব। বলেছে, ও খুন করেনি। ও নাকি ভালোবাসত মেয়েটাকে। বিয়ে করতে চেয়েছিল।
রাত বাড়লে নদীর ধারে গিয়ে বসল দুলাল। বসে রইল নদীর দিকে তাকিয়ে। আজকের পরে আরেকটা চাবি হারিয়ে যাবে বরাবরের মতো। পকেট থেকে বের করে বিড়ি ধরায় একের পর এক। বিরবির করে বলে, “আমি বলেছিলাম। আগেই বলেছিলাম। ডানা কাটা পড়লে পাখি বাঁচে না।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
বাহ্ বেশ