নন্দিনী নাগ
ছিয়াত্তর বছর পেরিয়ে এল স্বাধীনতা, বহু অর্থ ব্যয়ে উদযাপিত হতে দেখলাম “আজাদী কা অমৃত মহোৎসব”। মূলত যাঁদের জীবনের দামে কেনা এই স্বাধীনতা, একটার পর একটা আন্দোলনে ব্রিটিশদের দেশ ছাড়ার হুঁশিয়ারী দিয়েছিলেন বাংলা আর পঞ্জাবের যেসব নির্ভীক বিপ্লবীরা, আগষ্ট মাস তাঁদের স্মৃতি-তর্পণের মাস। তাছাড়া আগষ্ট তো কেবল স্বাধীনতার বার্তাবাহক নয়, দেশভাগেরও দর্শক। সাধারণ মানুষের অনুভূতির তোয়াক্কা না করে, করাত চালিয়ে চিরে দু’ফালা করে দেওয়া হয়েছিল বাংলা আর পঞ্জাবের শরীর, সেও তো এই আগষ্টেই। বাংলার যন্ত্রণা তো দেখেই চলেছি এ যাবৎকাল, তাই ভাবলাম এই আগষ্ট মাসেই দেখে আসা যাক খন্ডিত পঞ্জাবের যাপনচিত্র, অতএব বেরিয়ে পড়লাম অমৃতসরের উদ্দেশ্যে।
‘অমৃতসর’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ মধুর সরোবর। ইতিহাস বলছে, শহরটি তৈরি হয়েছিল শিখ ধর্মগুরুদের হাতে। পনেরশো সাতাত্তরে চতুর্থ শিখ গুরু, গুরু রামদাস দুটি বড় জলাশয় খনন করান এখানে। তাঁর পুত্র গুরু অর্জুন দেব সেই জলাশয়ের মাঝখানে তৈরি করান ‘হরি মন্দির’, যা এখন স্বর্ণমন্দির নামে ভুবন বিখ্যাত। এই ‘হরি মন্দির’কে কেন্দ্রে রেখে বৃত্তাকারে শহরটিকে ছড়িয়ে তৈরি করা পরিকল্পনা ছিল তাঁর। পিতা গুরু রামদাসের নাম অনুসারে সেই সময় নতুন গড়ে ওঠা শহরটির নাম দিয়েছিলেন ‘রামদাসপুর’। ষোলোশো ছয় সালে গুরু অর্জুনদেবকে হত্যা করা হলে তাঁর পুত্র গুরু হরগোবিন্দ শিখ সম্প্রদায়কে অস্ত্রশিক্ষায় পারদর্শী করে তোলেন, সেই সঙ্গে তৈরি করেন নিজস্ব সৈন্যদল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, গুরু অর্জুনদেব এর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া। কিন্তু মুঘলরা তাঁকে অমৃতসর থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় তাঁর পক্ষে আর প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর মহারাজা রণজিৎ সিংহের আমলে অমৃতসর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছেছিল। আঠারশো শতাব্দীর শুরু থেকেই শিখ সম্প্রদায় বারোটা সার্বভৌম রাজ্যে (মিসল) নিজেদের সংহত করতে থাকে এবং এই শতাব্দীর মাঝামাঝি তাঁরা অমৃতসরের ওপর নিজেদের দখলদারী কায়েম করে নেয়। স্বর্ণমন্দিরকে কেন্দ্রে রেখে তৈরি হতে থাকে একের পর এক ‘কাটরা’ (এস্টেট), পরিধি বাড়তে থাকে অমৃতসরের। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর অবস্থিত হওয়াতে অমৃতসর সহজেই ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মহারাজা রণজিৎ সিংহ ‘হরিমন্দির’ এর (স্থানীয় উচ্চারণে হারমন্দির) সংস্কার করে তাকে এখনকার স্বর্ণমন্দিরের রূপ দেন, শহরের চারপাশে দুই দেওয়ালযুক্ত উঁচু পাঁচিল দেন আর লাহোর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন শিখ সাম্রাজ্য। সেই সময় থেকেই অমৃতসর আর লাহোর দুই যমজ বোন, তাদের কেটে আলাদা করে দেবার যন্ত্রণা তাই বড্ড বেশি। অমৃতসরকে আজও ঘিরে রেখেছে সেই পাঁচিল, আর তাতে রয়েছে বারোটা গেট। তবে শহর এখন আর ওই পাঁচিলের ঘেরাটোপে আটকে নেই, বাইরে পা রেখেছে।
অমৃতসরের আত্মাকে বুঝতে গেলে এইটুকু ইতিহাস জানা জরুরি, তাই একটু শিবের গীত গেয়ে নিলাম।
কলকাতা থেকে সরাসরি বিমান যায় অমৃতসর, আড়াই ঘন্টার উড়ান। সন্ধ্যার বিমানে চেপে রাতে পৌঁছলাম, তাই আমাদের ভ্রমণ শুরু হল পরদিন সকাল থেকে। স্বর্ণমন্দির থেকেই যেহেতু নগরের পত্তন, তাই আমাদের অমৃতসর দেখার পর্বও শুরু করলাম ওখান থেকে।
“জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”- স্বামীজির এই পবিত্র বাণীর সর্বোত্তম প্রয়োগ দেখলাম এই শহরের সব জায়গাতে, বিশেষ করে স্বর্ণমন্দিরে। বাংলা বা ওড়িশার মন্দিরগুলোতে সচরাচর যে ছবি দেখে আমরা অভ্যস্ত তার ঠিক বিপরীত চিত্র দেখলাম এখানে। পুণ্যার্থী এবং পর্যটক মিলিয়ে কয়েক হাজার মানুষের জমায়েত রয়েছে বিশাল এই মন্দিরের সর্বত্র, কিন্তু কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই, বরং প্রত্যেকের সাহায্যের হাত অন্যের দিকে বাড়ানো। প্রতিদিন বিরাট সংখ্যক মানুষ এখানে আসেন কেবল অপরিচিতের সেবা করার জন্য, এই কথা আগেই শুনেছিলাম, এবার স্বচক্ষে দেখলাম। দর্শনার্থীদের জুতোর হেফাজত করা, ঠান্ডা জল বিলি করা, লঙ্গরে রান্না করা, বাসনমাজা, খেতে দেওয়া, বিশাল লঙ্গরখানাটিকে পরিষ্কার রাখা, সবটাই করেন পুরুষ-মহিলা সেবাদারেরা, তাও সুশৃঙ্খল ভাবে। শুধু কি তাই? ওই বিশাল মন্দির চত্বরটা, পায়ে হেঁটে যেটাকে পুরো পরিক্রমা করা বেশ কষ্টসাধ্য, সেটা সর্বক্ষণ ঝকঝকে তকতকে করে রাখা, সেটা কি কম ঝক্কির কাজ? সেই কাজও হয়ে চলেছে নীরবে। কেউ কাউকে কোনো হুকুম করছে না, কেউ তদারকি করছে না, অথচ বিরাট সিস্টেমটা চলছে তরতরিয়ে। অনুপ্রাণিত হয়ে আমরাও সবচাইতে হালকা যে সেবার কাজটি, মানে জল দেওয়ার কাজ, সেটি কিছুক্ষণ করলাম।
মন্দিরের মূলভবনে, যেখানে ‘গ্রন্থসাহেব’ রাখা আছে, সেখানে ঢোকার জন্য এই অফ সিজনেও এত লম্বা লাইন যে সাড়ে তিন থেকে চারঘন্টা লাইনে দাঁড়াতে হবে, একজন স্বেচ্ছাসেবক বললেন। আমার মেয়ে হুইলচেয়ার নির্ভর দেখে একজন স্বেচ্ছাসেবক আমাদের তিনজনকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন বেরনোর দরজায়, এখান দিয়ে অশক্ত, অসুস্থ, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের ভেতরে ঢোকানো হয়। হুইলচেয়ার নিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে না শুনে, আমরা মন্দিরের ভেতরে ঢোকার পরিকল্পনা ত্যাগ করলাম। কিন্তু ওঁরা নাছোড়, আমার মেয়েকে মন্দিরে ঢোকাবেনই। কারণ ওঁদের বিশ্বাস, মূলমন্দিরে ঢুকে পবিত্র ‘গুরবাণী’ শুনলে গুরুর কৃপায় ও সুস্থ হয়ে যাবে। আমাদের আপত্তি কানে না তুলে একজন স্বেচ্ছাসেবক ধরে আনলেন একটি সেবাদার ছেলেকে, সে পিঠে করে বয়ে ভেতরে নিয়ে গেল মেয়েকে, পবিত্রস্থানে বেশ কিছুক্ষণ রেখে ‘গুরবাণী’ শুনিয়ে প্রসাদ দিয়ে তবে ছাড়ল। এরপরে যদি বলি পঞ্জাবিরা প্রচন্ড সেবাপরায়ণ জাতি, নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না।
স্বর্ণমন্দিরে গিয়ে লঙ্গরে খাব না, তাও কি হয়? লঙ্গরে খাবারের সঙ্গে পাওয়া আদর যত্নের কথাও চিরকাল মনে থাকবে। স্বর্ণমন্দিরের ভেতরে রয়েছে শিখ মিউজিয়াম, খাওয়াদাওয়া সেরে গেলাম সেই মিউজিয়াম দেখতে। সেখান থেকেই জানলাম ‘গীতগোবিন্দ’র কবি, বাংলার জয়দেবের লেখা শ্লোকও গ্রন্থিত রয়েছে পবিত্র ‘গ্রন্থসাহেব’ এ।
রোদ আর ঘাম এত ক্লান্ত করে দিয়েছিল সেদিন যে শিখ মিউজিয়াম দেখে আমরা হোটেলমুখো হলাম। তার আগে অবশ্য অমৃতসরের বিখ্যাত লস্যিওয়ালা ‘জ্ঞান দা লস্যি’র দোকানে গলা ভিজিয়ে নেওয়া অবশ্যকর্তব্য ছিল, সেই কর্মে বিন্দুমাত্র অবহেলা করিনি আমরা।
আমাদের পরেরদিনের গন্তব্য ভারত-পাক সীমান্ত, ‘ওয়াগা বর্ডার’। সেখানে ঢোকার দরজা খোলে বিকেল চারটেতে, তাই আগে আমরা অমৃতসর শহরটাকে সেইসঙ্গে আরও কিছু মন্দির দেখে নেওয়ার পরিকল্পনা করলাম। প্রথমে গেলাম ‘দুর্গিয়ানা’ মন্দির। ‘হাথীগেট’ এর কাছে অবস্থিত এই হিন্দু মন্দিরটি সম্ভবত ষোলোশো শতাব্দীতে তৈরি, সরকারী নথি সেরকমই বলছে। তবে উনিশশো একুশে সংস্কারের পর মন্দিরটি এখনকার রূপ পেয়েছে। মন্দিরের স্থাপত্য এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনা দেখে মনে হয় যেন এটি স্বর্ণমন্দিরের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। বিরাট এক জলাশয়ের মাঝখানে দেবী দুর্গার মন্দির, সাদা আর সোনালীতে। সোনালী পাতগুলো সোনার কিনা তা বুঝতে পারিনি বটে, তবে বিরাট বিরাট দরজাগুলো যে রূপোর তৈরি, তা বিলক্ষণ বুঝেছি। দেব-দ্বিজে আমার ভক্তি না থাকলেও মন্দিরের পরিবেশ দেখে মন ভরে গেল। এখানেও ‘লঙ্গর’ রয়েছে দেখলাম তবে সেদিন খাওয়ার অভিপ্রায় ছিল না বলে আর ভেতরে উঁকি দিইনি। মন্দির থেকে বেরিয়ে যে গলিপথ মূল সড়কে পড়েছে, তার আশেপাশে ছিল পুজোর সামগ্রী আর খাবারদাবারের কয়েকটা দোকান, অনেকটা আমাদের দক্ষিণেশ্বর বা কালীঘাটের মতো। খাঁটি ঘিয়ে ভাজা হালুয়া বা ওই জাতীয় কোনো সুখাদ্যের গন্ধ নাকে ঢুকতেই মনটা চনমন করে উঠল। কিন্তু সকালে খাওয়া চমৎকার অমৃতসরী পরোটা তখন পেটে গজগজ করছিল বলে লোভ সম্বরণ করতে হল।
পরের গন্তব্য বৈষ্ণোদেবী মন্দিরের অনুকরণে বানানো আর একটি হিন্দু মন্দির। কৃত্রিমগুহা বানিয়ে তার মধ্যে গোলকধাঁধা পথে নানা দেবদেবী দর্শন।
আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড এরপর নিয়ে চললেন বাল্মিকীর মন্দির দর্শনে। এই মন্দির চত্বরেই নাকি রামায়ণের যুগে ছিল বাল্মিকীমুনির আশ্রম, পরিত্যক্তা সীতা এখানেই আশ্রয় পেয়েছিলেন। ইতিহাস আর পুরাণের বিভেদ রেখাটুকু মন থেকে সাময়িক মুছে ফেলে চললাম সেই মন্দির দর্শনে।
অমৃতসর থেকে লাহোরগামী যে হাইরোড ধরে ওয়াগা বর্ডারে যেতে হয়, সেই পথেই যাওয়া যায় বাল্মিকী মন্দিরে। পুরাকালে পুরো অঞ্চলটাই ছিল গভীর জঙ্গল, তার ভেতরে ছিল ঋষির আশ্রম, বাল্মিকীর তপোবন।
এখানেও সেই একই রকমের মন্দির নির্মাণশৈলী। বিশাল একটা সরোবরের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে মন্দির, তার ভেতরে সোনার তৈরী বাল্মিকীর মূর্তি। এই মন্দিরের পেছনদিকে রয়েছে ভাঙাচোরা পুরোনো মন্দির, সেখানেই আছে সীতার ছোট্টকুটির। লবকুশের জন্মস্থান, মহর্ষি বাল্মিকীর কাছে যেখানে বসে তারা পড়াশোনা করতো, সেসব চিহ্নিত করা আছে দেখলাম। মন্দিরের ভগ্নাবশেষে যেসব পুরনো ইঁট দেখলাম তা অত্যন্ত প্রাচীন বটে, তবে বাংলার সেনবংশের রাজ্যপাটের ধ্বংসাবশেষেও অমন ইঁট দেখেছি বলে মনে হল। ‘রাম’ সম্পর্কিত সবই যেহেতু অত্যন্ত স্পর্শকাতর, তাই এই নিয়ে বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ না করাই ভালো। সবচাইতে আকর্ষণীয় লাগল একটা বহু পুরনো কুয়ো, দেওয়ালে তার লাল-সবুজ শ্যাওলার নক্সা। বেশ কয়েকটা পেছল সিঁড়ি দিয়ে নেমে মাটির নিচে সেই কুয়োর জলের কাছাকাছি পৌঁছনো গেল বটে কিন্তু জল পর্যন্ত নামতে সাহস হল না। কে জানে একবার তলিয়ে গেলে কোথায় গিয়ে পৌঁছব! অযোধ্যায় পৌঁছনোর আপাতত কোনো আকাঙ্খা নেই ব’লে ভয়ে তাড়াতাড়ি পাতাল থেকে উঠে এলাম। কুয়োর পাড়ে বসে ছিলেন একজন দেহাতী বৃদ্ধা, আমার কপালে সিঁদুরের টিপ লেপে দিয়ে তিনি জানালেন, এ হল সীতামাইয়ার দৈনন্দিন ব্যবহারের কূপ। লব আর কুশকে এই কুয়োর জলেই স্নান করাতেন সীতামাইয়া। যমজ হলেও কুশ নাকি লবের জন্মের একমাস বাদে জন্মেছিল, এমন অদ্ভুত কথা লেখা আছে দেখলাম ওদের জন্মস্থান ব’লে চিহ্নিত জায়গাটাতে। বাল্মিকী মন্দিরের সঙ্গেও দেখলাম রয়েছে লঙ্গরখানা, বুঝলাম হিন্দু হোক বা শিখ, এটাই এখানকার ঐতিহ্য।
এবার অমৃতসর-লাহোর জাতীয়সড়ক (গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড) ধরে সীমান্তের দিকে আতারি গ্রামে যাওয়ার পালা। দেশভাগের সময় এই গোটা গ্রামটাই রূপান্তরিত হয়েছিল উদ্বাস্তু শিবিরে, এখন ক্ষেতের সবুজ প্রশান্তি ঢেকে দিয়েছে সব ক্ষতচিহ্ন। আতারি যাওয়ার রাস্তায় খালসা কলেজ, গুরুনানক ইউনিভার্সিটি দেখা গেল, ইমারতি সৌন্দর্যগুণে যা নজর কাড়বেই। আঠারশো বিরানব্বইতে খালসা কলেজ প্রতিষ্ঠিত, অতএব অনেক ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাসাদপম ভবন।
সীমান্তে বি এস এফ এর এলাকায় ঢোকার আগে উদরপূর্তির জন্য আমরা ঢুকলাম ‘লা রোমা ধাবা’তে।
ধাবার মালিকের নিজের ক্ষেত থেকে আসা টাটকা সব্জি দিয়ে চমৎকার স্বাদের পঞ্জাবী খানা। শুনলাম মালকিন নিজে রান্নাঘরে থাকেন, রান্নাতে হাতও লাগান। খাবারের গুণেই ধাবাটাতে সবসময়েই ভীড় থাকে।
সীমান্তে যাবার জন্য যেখানে জমায়েত হতে হয় তার নাম ‘শাহী কিলা’। সেখানে পৌঁছে দেখলাম যেন মেলা বসে গেছে। খাবার, জল, আইসক্রিম, লস্যি বিকোচ্ছে দেদার, সঙ্গে রয়েছে স্যুভেনির শপও। পঞ্জাবের বিখ্যাত ফুলকারি কাজের দোপাট্টা, স্যুটপিসেরও দোকান রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতি বিকেলে শাহী কিলা জমজমাট।
ঠিক চারটেতে চেকপোস্ট খোলা হয়, তবে অনুষ্ঠান শুরু হল প্রায় পৌনে ছটায়। এই অনুষ্ঠান দেখার জন্য অনলাইনে বুকিং করা যায় দু’দিন আগে থেকে, বিনামূল্যে। যাদের বুকিং নেই, তাঁরাও ভেতরে যেতে পারেন, তবে আসন পাবেন ‘আগে এলে সামনে বসবেন’ এই হিসাবে।
ভারত আর পাকিস্তান দুই দেশই একসাথে সন্ধেবেলা সীমান্তে তাদের পতাকা নামায়, পতাকা নামিয়ে গুটিয়ে নিয়ে যাওয়াকে ঘিরেই প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে চলে নানারকম অনুষ্ঠান, দুই পাড়েই। দু’দিকের অনুষ্ঠান অনেকটাই পরস্পরের মিরর ইমেজ, এমনটাই মনে হচ্ছিল। মাঝে গ্রিলের বেড়া থাকায় আমার কৌতুহলী চোখ মাঝেমাঝেই নিজের দেশের দিক থেকে সরে ওপারে চলে যাচ্ছিল, আর লম্বা চওড়া পাহারাদারটির চোখের ইশারা মেনে তাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হচ্ছিল স্বদেশে।
আমার পাশে একজন বৃদ্ধা বসেছিলেন, স্থানীয় গ্রামের বাসিন্দা বলে মনে হল, হতদরিদ্র চেহারা তাঁর। একহাতে গাছের ডাল কেটে তৈরি করা লাঠি ধরা, অন্য হাতটা মুঠো করে তুলে যখন তিনি ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে গলা মেলাচ্ছিলেন, আমার মনে হচ্ছিল, ওঁর কি কিছু থেকে গেছে কয়েক হাত দূরত্বে বেড়ার ওপারে? কিছু রক্তাক্ত স্মৃতি? যার টানে অশক্ত শরীরে উনি একলা এসেছেন এখানে?
অনুষ্ঠান শেষ হল সাতটা নাগাদ। আকাশে তখনও দিনের আলো। সেই আলোয় দেখলাম দু’হাতে বেড়া ধরে এদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক পাকমহিলা, ভঙ্গিটি দেখে মনে হল যেন হারানো স্বজন খুঁজে চলেছে তাঁর উদগ্রীব দুই চোখ। ইচ্ছে করছিল, তার সঙ্গে একটু কথা বলে আসি, তার হাতটা ছুঁয়ে জানিয়ে আসি সমব্যথী আমরাও, কিন্তু সম্ভব হল না। ওদিকের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, হাত নাড়া, ছবি তোলাও নিষিদ্ধ।
এবার হোটেলে ফেরার পালা। শাহি কিলাতে এসে লস্যিতে গলা ভিজিয়ে গাড়িতে উঠলাম। স্মৃতিতে ধরা রইল বি এস এফ পঞ্জাবের জওয়ানদের কাছ থেকে পাওয়া যত্ন আর ভালোবাসা।
পরেরদিনের সফরসূচীর বেশিরভাগটা জুড়ে রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলন আর দেশভাগের ইতিহাসে ডুব দেওয়া, এভাবেই পরিকল্পনা করেছিলাম আমরা। তাই প্রথমদিন জালিয়ানওয়ালাবাগের পাশ দিয়ে ঘুরে এলেও ভেতরে ঢুকিনি, ইতিহাসের সেই দিনগুলোতে পৌঁছতে গেলে সময় তো লাগবেই।
স্বর্ণমন্দিরের হাতার মধ্যেই জালিয়ানওয়ালাবাগ, নিষ্ঠুরতার চিহ্ন শরীরে নিয়ে একশো দশ বছর কাটিয়ে দিল।
তিনজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর মুক্তি আর রাউলাট আইন প্রত্যাহার, এই দুই দাবী নিয়ে নিরস্ত্র মানুষের সমাবেশ চলছিল সেদিন, উনিশশো তেরোর বারোই এপ্রিল, এই মাঠে। সসৈন্য ব্রিটিশ জেনারেল ও’ডায়ার মাঠে এসে মাত্র একটি শব্দ উচ্চারণ করেছিল, ‘ফায়ার!’
নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের দিকে ছুটল গুলি। মোট ষোলোশো পঞ্চাশ রাউন্ড গুলি চলেছিল সেদিন, মাঠের চারপাশের দেওয়ালগুলোতে রয়ে গেছে সেই বুলেটের গর্ত। মাঠের একপাশে ছিল একটা কুয়ো। তাতে ঝাঁপ দিলে গায়ে গুলি লাগবে না, এই ভেবে অনেকেই সেই কুয়োতে ঝাঁপ দিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যরা কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে গুলি করল তাদের উদ্দেশ্যে। কুয়োর ভেতরে পড়ে রইল একশো কুড়িটি মানুষের মৃতদেহ।
মানবনিধন যজ্ঞ চালিয়ে জেনারেল ডায়ার সসৈন্য ফিরে গেল। সারারাত মাঠময়, কুয়োর ভেতরে মৃতদেহের সঙ্গে আহত যন্ত্রণাকাতর মানুষগুলো পড়ে থাকল, শেষটায় মারা গেল। সেই কুয়োটিকে ঘিরে দেওয়া হয়েছে কাচ দিয়ে, কাচে মুখ লাগিয়ে কুয়োর ভেতরটা দেখা যায়, দেখা যায় মার্ক করে রাখা গুলির চিহ্নও।
জালিয়ানওয়ালাবাগে ঢুকতে কোনো টিকিট লাগে না। এর ভেতরে রয়েছে তিনটে গ্যালারি, যেগুলো একরকম মিউজিয়ামও বলা যায়। একটি গ্যালারিতে লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের কৌশলে উনিশশো উনিশের তেরই এপ্রিলকে ফুটে উঠতে দেখলাম। প্রতিটি গ্যালারিতে রয়েছে প্রচুর তথ্য। সেইসময়ের বিভিন্ন খবরের কাগজের কাটিংসহ বহু দুষ্প্রাপ্য ছবি রয়েছে। গণহত্যার আদেশ দিয়ে ডায়ার কতটা প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশরাজের, ওদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন কাগজের কাটিং থেকে জানা গেল তাও।
পঞ্জাব থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের নিয়ে রয়েছে একটা গোটা গ্যালারি। এখানেও ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শো এর সাহায্যে দেওয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে সেই সময়কার ইতিহাস। এই গ্যালারিতেই সসম্মানে রাখা আছে সর্দার উধম সিং এর অস্থিভস্ম সম্বলিত একটি কলস।
যেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগের বর্বরতা দেখেছিল অমৃতসর, তার ঠিক পরেরদিনই অমৃতসর থেকে ষাট মাইল দূরের জনপদ গুজরানওয়ালাতে ঘটেছিল অভিনব পদ্ধতিতে আরও একটি নৃশংস গণহত্যা। অমৃতসরের ঘটনার প্রতিবাদে চোদ্দই এপ্রিল গুজরানওয়ালার নিরস্ত্র জনসাধারণ একটা বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। সেই জমায়েতের ওপর ব্রিটিশ এয়ারফোর্স বম্বিং করে নির্বিচারে বহু মানুষকে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, বিক্ষোভে অংশ নেবার জন্য বহু সাধারণ মানুষকে বন্দী করা হয়, যাদের মধ্যে আবার তিরিশজনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। এই জোড়া গণহত্যার ঘটনা মনে পড়িয়ে দিল হিরোসিমা-নাগাসাকির হত্যাকান্ডের কথা। গুজরানওয়ালার গণহত্যার কথা আগে কোথাও পড়িনি আমি, এই মিউজিয়াম দেখতে এসেই জানলাম। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোর এরকম অনেক না জানা ইতিহাস বুকে করে আগলে রেখেছে জালিয়ানওয়ালাবাগের গ্যালারিগুলো।
আমাদের পরের গন্তব্য ‘পার্টিশন মিউজিয়াম’। দেশভাগের ইতিহাস নিয়ে একটা আস্ত মিউজিয়াম পৃথিবীর আর কোথাও নেই। অমৃতসর শহরের ঐতিহাসিক টাউনহলটিকে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়েছে। যেহেতু স্বর্ণমন্দিরকে কেন্দ্রে রেখে এই শহরের নির্মাণ, তাই সেখান থেকে চলতে শুরু করলে রাস্তা টাউনহলে এনে ফেলবে। এই পুরো পথটা পাথুরে ইঁট দিয়ে বাঁধানো। স্বর্ণমন্দির, জালিয়ানওয়ালাবাগ, টাউনহল-এইসব ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলোর সামনে রয়েছে বড় বড় চক, প্রতিটাই শতাব্দী প্রাচীন পাথুরে ইঁট বাঁধানো। আধুনিক পিচঢালা রাস্তার সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের কৌলিন্য রক্ষা করে চলছে এইরকম কয়েকটা চক। টাউনহলের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল, আঠারশো চৌষট্টিতে তৈরী এই লালরঙা ভবনে পৌঁছনোর রাস্তা যদি হত আধুনিক কালের, তাহলে বড়ই বেখাপ্পা হত! এমন রাস্তায় ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে এলেই বেশি মানাতো, ঘোড়ার খুরের শব্দে জেগে উঠত বহু ঘটনার সাক্ষী এই রাস্তা, এসব ভেবে যেন সময়যানে চেপে পিছিয়ে গেছিলাম একশোবছর। পঞ্জাব সরকারকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়, ইতিহাসকে তাঁরা সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করেছেন, অঙ্গহানি না করেই।
ক্ষমতা হাতবদল করার আগে দেশটাকে দু’ভাগ করতে হবে, ভাগ হবে বাংলা আর পঞ্জাব। সীমানা নির্ধারণ করার জন্য বিলেত থেকে উড়িয়ে আনা হল রাডক্লিফকে, জুলাই মাসের আট তারিখে, রিপোর্ট জমা দিতে বলা হল বারোই আগষ্ট। বিশিষ্ট সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার উনিশশো একাত্তরে রাডক্লিফের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ভাগাভাগি প্রসঙ্গে রাডক্লিফ বলেছেন কাজটা তার পক্ষে খুবই শক্ত ছিল। না তিনি বিন্দুমাত্র জানতেন রাজ্যদুটোকে, না ছিল তাঁর কাছে কোনো মানচিত্র। অতএব একটাই পদ্ধতি, ধর তক্তা মার পেরেক। এইভাবে এলোপাথারি কাঁচি চালিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, ভারতের ভাগে পড়ছে তিনটে বড় শহর, কলকাতা, লাহোর, অমৃতসর আর পাকিস্তান পাচ্ছে কেবল একটা, ঢাকা। অতএব ভাগ সমান করার জন্য লাহোরকে কেটে তিনি জুড়ে দিলেন পাকিস্তানে, লাহোর-অমৃতসর এই দুই ফুসফুস চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। যদি এই ছেলেভোলানো ভাগ না করে পরিসংখ্যানের দিকে তাকাতেন রাডক্লিফ, তবে সাধারণ মানুষের দূর্ভোগ অনেক কম হত, ঠেকানো যেত এত রক্তপাত, মৃত্যু ও ধর্ষণ। পরিসংখ্যান বলছে, উনিশশো একচল্লিশে অমৃতসরে মুসলিম ছিল আটচল্লিশ শতাংশ, হিন্দু পঁয়ত্রিশ শতাংশ, আর শিখ ষোলো শতাংশ। লাহোরে ছিল এর ঠিক বিপরীত ছবি। বিবেচনাহীন ভাগাভাগির কারণে দুদিকের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। এই ঘর ছাড়ারা সকলেই কিন্তু ঘর ফিরে পাননি, ফিরে পাননি স্বজনকে, এঁদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ে গেছেন ‘টোবা টেক সিং’, হারিয়ে গেছেন চিরতরে। পার্টিশন মিউজিয়ামের দেওয়ালগুলোতে এঁদের চোখের জল আর রক্তে লেখা রয়েছে সেইসব দিনের ইতিহাস।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম অনুযায়ী সাজানো হয়েছে মিউজিয়ামের গ্যালারিগুলোকে। তার মধ্যে একটা গ্যালারি সাজানো হয়েছে বাংলাভাগের বেদনা দিয়ে। সেই ঘরে লো ভল্যুমে বাজছে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। সুদূর পঞ্জাবে এসে রবি ঠাকুরের গান শুনতে পেলে ভালো তো লাগবেই। ছবি, মানচিত্রের সাথে সাথে দেওয়ালে লাগানো আছে টিভি সেট, কানে হেডফোন লাগিয়ে তাতে শোনা যায় দাঙ্গা এবং দেশভাগের প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণ।
দুপুরে খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছিল, অথচ তখনও মিউজিয়ামের দোতলাটাতে ওঠাই হয়নি। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা একজন মহিলা বললেন, বেরিয়ে খেয়ে এসে আবার ঢুকতে, এজন্য নতুন করে আর টিকিট কাটতে হবে না। টাউনহলের মধ্যেই রয়েছে দারুণ একটা রেস্টুরেন্ট, সেখানেই সুস্বাদু “হল থালি” দিয়ে উদরপূর্তি করে আবার ঢোকা হল মিউজিয়ামে। এবার গন্তব্য দোতলা, যার পুরোটা সাজানো হয়েছে উদ্বাস্তু আর শরণার্থীদের স্মৃতিতে।
দেশভাগের প্রভাব অমৃতসরের ওপর খুব গভীরভাবে পড়েছিল। এই শহরের অর্ধেকের বেশি মানুষ ঘর ছেড়েছিলেন, দশহাজারের বেশি বাড়ি দেশভাগ পরবর্তী দাঙ্গায় ধ্বংস হয়েছিল। সাতচল্লিশের পর একদশক অমৃতসরের জনসংখ্যা বাড়ার বদলে কমে গেছিল। শুধু তাই নয়, যমজ বোন লাহোরের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার জন্য অমৃতসরের ব্যবসাবাণিজ্য এবং সংস্কৃতিও জোরালো ধাক্কা খায়। পার্টিশান মিউজিয়াম সেই অতীত গৌরব এবং দেশভাগ পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির স্মৃতিও সংরক্ষণ করছে।
দুই পারের মধ্যে ট্রানসিট পয়েন্ট ছিল বলে অমৃতসরকে অনেককিছু দেখতে হয়েছে, বুকে ধরতে হয়েছে দুই পারেরই শরণার্থীদের শোকমিছিলকে। সাতচল্লিশের আগষ্টে শহরের সমস্ত ঘরবাড়ি, স্কুলকলেজ উপচে পড়েছিল বাস্তুহারা মানুষের ভীড়ে, আটচল্লিশের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হয়নি, থেকে গেছিল শরণার্থী শিবির হয়েই। মিউজিয়ামটা দেখতে দেখতে অবধারিতভাবে মনে পড়ছিল “A train to Pakistan” দেখার স্মৃতি।
বিকেলে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম “সাড্ডা পিন্ড”, মানে ” আমার গ্রাম” এ। অমৃতসর থেকে লাহোর যায় যে সড়ক, তার ওপরেই রয়েছে এই অভিনব বেড়ানোর জায়গাটি। সাড়ে সাতশো টাকার টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে খোলা মেলা পরিবেশে, পুরনো দিনের পঞ্জাবী এক গ্রামে। মাটির বাড়ির দাওয়ায় মহিলারা বসে আছে অতিথি আপ্যায়নের জন্য। ঘোলের সরবত, মাক্কির রুটি সর্ষের শাক, ঘি ঢালা রাগির খিচুড়ি, সামনে ভেজে দেওয়া পপকর্ণ, কি নেই তাদের ভাঁড়ারে! গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নিতে পর্যটক হাত লাগাতে পারেন কুমোরের চাকায়, তাঁতে। ট্রাক্টরে চড়তে পারেন, হতে পারেন ঘোড়সওয়ারও। আর এসব ভালো না লাগলে বসে দেখতে পারেন শিখ মার্শাল আর্ট, ম্যাজিক, পুতুলনাচ, শারীরিক কসরত, সাইকেল, মোটরসাইকেলের সার্কাস। এমনকি মাথা ম্যাসাজ করানোরও ব্যবস্থা আছে। বিকেলে যেন গ্রামে মেলা বসেছে, আর আমরা পর্যটকরা সেই মেলায় ঘুরছি, এমন বোধ হচ্ছিল। গ্রামে অনেকগুলো দোকানও রয়েছে, তাতে পঞ্জাবী হস্তশিল্প “ফুলকারি” কাজের কাপড় বিক্রি হচ্ছে, গ্রামের অনেক ঘরেই মেয়েদের বসে বসে এই সূচীশিল্প করতে দেখলাম। পঞ্জাবী জুতোর দোকানসহ স্যুভেনির শপ ও আছে।
গ্রামের মোড়লমশাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। টান টান চেহারার অশীতিপর মানুষটির জন্ম পশ্চিম পঞ্জাবের গ্রামে। ওদেশে এখনও অনেক স্বজন রয়ে গেছেন শুনলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “যোগাযোগ আছে? যেতে ইচ্ছে করে না?”
“তিরাশি সাল পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল, নিয়মিত পত্রালাপ চলতো দুই তরফে” বৃদ্ধ জানালেন।
“তারপর?”
“উগ্রপন্থী বলে সন্দেহ করছিল। তাই চিঠিপত্র চালাচালি বন্ধ করতে হয়েছে। আর কোনো যোগাযোগ নেই।”
এমন দীর্ঘশ্বাস অমৃতসরের ঘরে ঘরে। আমাদের ড্রাইভার ছিলেন সুবিন্দার সিং। ষাটোর্ধ এই সজ্জন মানুষটির কাছে শুনেছি, ওপার থেকে চলে আসার সময় ওঁর ঠাকুমা আসেননি এদেশে। আর কোনোদিন নিজের ভিটেয় ফেরা হবে না আশংকায় তিনি থেকে গেছিলেন ভাইদের আশ্রয়ে। এই মানুষগুলোর কাছে ‘ভারত’, ‘পাকিস্তান’ এসব নিরর্থক শব্দের চাইতে অনেকবেশি প্রিয় নিজের গ্রাম, নিজের জন্মভিটে। ওটাই তাঁদের দেশ। সুবিন্দার সিং ও চান পাকিস্তানে নিজের পিতৃপুরুষের গ্রামে স্বজনের সন্ধান করতে। পঁচাত্তর বছর পর তাঁদের কাউকে পাওয়া যাবে কি না কে জানে!
“সাড্ডা পিন্ড” এ সন্ধ্যাবেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ পঞ্জাবী নাচগানের অনুষ্টান। বিরাট এক অডিটোরিয়ামের স্টেজে জমকালো পোশাকে কুশীলবরা, আর খাটিয়ায় দর্শকদের বসার ব্যবস্থা। খাটিয়ায় আরাম করে বসে অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে অনেকটাই রাত হয়ে গেল, সময় যেন মিলখা সিংয়ের গতিতে দৌড়চ্ছিল।
রাতের খাওয়া এখানেই, ওই এক এন্ট্রি ফি তেই সব খরচ ধরা আছে। দারুণ সুন্দর রেস্টুরেন্টে এলাহী আয়োজন, যা খুশি যত খুশি খেতে পারো, সুদৃশ্য পোশাকধারী ওয়েটাররা সার্ভ করার জন্য হাসিমুখে তৈরি।
একটা পুরো দিন কাটানোর জন্য “সাড্ডা পিন্ড” খুব ভালো জায়গা, আমাদের যদিও অর্ধেক দিন কাটিয়েই ফিরতে হল। ভেতরে থাকারও ব্যবস্থা আছে, অনলাইনেও বুকিং করা যায়। কৃত্রিম হলেও গ্রামটা বড্ড ভালো, “আমার গ্রাম”ই বটে।
পরেরদিন আমাদের গন্তব্য গোবিন্দগড় ফোর্ট। মহারাজা রঞ্জিত সিংহের তৈরি এই দুর্গ দেখে আমাদের অমৃতসর ভ্রমণে দাঁড়ি টানতে হবে। তার আগে অবশ্য পায়ে হেঁটে শহরের কিছু জায়গায় ঘুরে শহরের সাথে আত্মীয়তা পাতাতে হবে।
সকালে ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়ে পড়লাম, কারণ কুলবন্ত সিংয়ের দোকানে কুলচা খেতে হবে। স্বর্ণমন্দিরের হাতার মধ্যে সরু ঘিঞ্জি গলি নিমি রোড, সেখানেই কুলবন্ত সিংয়ের দোকান। শিখদের পবিত্র পঞ্চ “ক” এর সাথে অমৃতসরে এসে আরও দুটো “ক” যোগ করা যায় অনায়াসে, কুলচা আর কুলফি। এই দুটো জিনিস অবশ্যই চেখে দেখতে হবে এখানে বেড়াতে এলে।
অমৃতসরে এসে ‘ফুলকারি’ কাজের কাপড় না কেনা শুধু অন্যায় নয়, ঘোরতর পাপ। পেট ঠান্ডা করে আমরা তাই পাপমোচনে চললাম। এখানকার বিখ্যাত কাপড়ের বাজারটা টাউনহলের সামনের রাস্তায়, নাম “হলবাজার”। খুব পুরনো বাজার এটা। সতেরশ সালে “কাটরা আলুওহালিয়া” নামে এখানে টেক্সটাইলের বড় বাজার তৈরি হয়েছিল, তখন টাউনহল তৈরি হয়নি। বর্তমান হলবাজার তারই উত্তরসূরী। স্বর্ণমন্দিরের চক থেকে সোজা গেলেই হলবাজারে পৌঁছনো যায়, তাই পায়ে হেঁটেই কেনাকাটা সারলাম।
চাঁদি ফাটানো রোদ মাথায় নিয়ে ঢুকলাম গোবিন্দগড় ফোর্টে। দুর্গের মূল ফটকে যাওয়ার গাছের ছায়ায় ঢাকা পথের দুধারে পর পর রয়েছে ঐতিহাসিক তথ্যে ঠাসা শ্বেতপাথরের ফলক। দুর্গকে ঘিরে রয়েছে পরিখা, সেটা পেরিয়ে দুর্গে পা রেখে মনে হয় না এটা দুশো বছর আগের নির্মাণ, এত ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। অনেকগুলো কামানের চোখ রাঙানি পার হয়ে ভেতরে পা রেখে পাওয়া গেল নহবতখানার আপ্যায়ন, যাকে বলে রাজকীয় অভ্যর্থনা।
পুরনো কেল্লা ধ্বংস হয়ে যাবার পর মহারাজা রণজিৎ সিংহ এই শক্তপোক্ত দুর্গটি বানান আঠারোশো ছয় সালে। বাইরে থেকে আসা শত্রুদের ওপর নজরদারী চালানোর জন্য এই দুর্গ বানানো হয়েছিল, যাতে নগর এবং স্বর্ণমন্দিরকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। জানলাম, ইংরেজরা অমৃতসরের দখল নিয়ে নেবার পর জেনারেল ও’ডায়ার এই দুর্গকে হাসপাতাল বানিয়েছিল। তারপর দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি তেমন, পড়েছিল ভগ্নদশায়। প্রকাশ সিং বাদল এর সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুর্গটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে, এখন তো একেবারে ঝাঁ-চকচকে।
দুর্গটির মধ্যে রয়েছে তিনটে মিউজিয়াম। আর রয়েছে রাজা রণজিৎ সিংহের জীবন নিয়ে তৈরি অ্যানিমেটেড ফিল্ম সেভেন ডায়মেনশনে দেখানোর ব্যবস্থা। ফিল্ম শো এর জন্য নির্দিষ্ট সময় আছে, তাই ওটা দেখে নিয়ে ঢুকলাম মিউজিয়াম দেখতে। রাজা রণজিৎ সিংহের কাছ থেকেই ব্রিটিশরা কোহিনূর হীরে ছিনিয়ে নিয়েছিল, তাই তোষাখানায় রাখা আছে কোহিনূরের রেপ্লিকা। দেখলাম, তবে দুধের সাধ ঘোলে মিটল না এক্ষেত্রে।
দুর্গের মধ্যে রাজকীয় রেস্তোঁরা আছে, আছে জুস এবং লস্যির দোকান। দুর্গ ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে খেয়েদেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিতে সমস্যা নেই। উট কিংবা ঘোড়ায় চড়ে দুশো বছরের পুরনো দুর্গের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোরও ব্যবস্থা আছে, পর্যটকরা চাইলে এতে চড়ে ঘুরে বেরিয়ে নিজেদের বেশ রাজা উজির ভাবতে পারেন।
দুর্গভ্রমণের সঙ্গে শেষ হল এবারকার মতো অমৃতসর ভ্রমণ, রাতের বিমানে ঘরে ফেরার পালা। নতুন আর পুরনোর মিশেলে তৈরি এই সুন্দর শহর, শহরের চওড়া পথ এবং ততোধিক প্রশস্ত মনের মানুষগুলোকে পেছনে ফেলে রেখে বিমান বন্দরের দিকে যখন গাড়ি ছুটছিল, তখন মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেছিল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন