আলম খোরশেদ
আমাদের অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত ভিন্ন ভূগোলের রাজ্যগুলোতে বেড়াতে যাবার, আদর করে যাদেরকে সাত বোন নামে ডাকা হয়ে থাকে। তো, এই সপ্ত ভগিনীর দুইজন, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের মুখদর্শন হয়েছিল আমাদের আগেই। আর, বাড়ির পাশের মিজোরামকেও উঁকি মেরে কিঞ্চিৎ দেখে নেওয়া গিয়েছিল ইতঃপূর্বে সাজেক ভ্রমণের সময়।
হাতে রইল আর চার রাজ্য: অরুণাচল, আসাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুর। আদতে, এই চার বোনের দেখা পেতেই, আমরা ক’জন সমমনা ভ্রমণসঙ্গী মিলে ২০১৯ সালের অক্টোবরের শুরুতে বেরিয়ে পড়েছিলাম প্রায় তিন সপ্তাহের এক দীর্ঘ সফরে। গল্পে গানে কবিতায়, আহারে ও বিহারে, হাসি ও ঠাট্টায়, প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস ও প্রত্যাশাভঙ্গের বেদনায়, ক্ষণিকের অভিমান ও বন্ধুত্বের অমলিন উষ্ণতায়, সর্বোপরি সৌন্দর্যসান্নিধ্যের বিস্ময় ও মুগ্ধতায় এক অন্যরকম অপার্থিব আনন্দে কেটে গিয়েছিল সেই স্মরণীয় ভ্রমণের দিনগুলো আমাদের।
এখানে, অপারবাংলা-র ভ্রমণপ্রিয় পাঠকদের জন্য পর্বে পর্বে লিপিবদ্ধ করে রাখছি আমাদের সেই অসামান্য পর্যটন অভিজ্ঞতার একখানি চকিত সারসংক্ষেপ।
আগরতলায় প্রবেশ ও ইম্ফলে প্রস্থান
আমরা তিনজন: আমি, জীবনসঙ্গিনী মাহীয়া ও বিশ্ব- পর্যটক বন্ধু মধুমিতা, ভ্রমণ শুরু করেছিলাম স্থলপথে, আখাউড়া সীমান্ত হয়ে আগরতলার ভেতর দিয়ে। সেখানে, শহরের প্রান্তে, নির্জন, নিরিবিলি এক হোম স্টে’তে রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুরে আগরতলা বিমানবন্দর থেকে আমরা উড়াল দিই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবরঞ্জিত ও নেতাজির শেষজীবনের স্মৃতিবিজড়িত মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের উদ্দেশে।
সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন অপর চার ভ্রমণসঙ্গী, স্থপতিত্রয়ী জেরিনা হোসেন, আবু ইমামউদ্দিন, হোসনে আরা ও চাটগাঁর বিশিষ্ট চা-বিশারদ মাহমুদ হোসেন মুরাদ। ইম্ফলে আমাদের প্রথম সন্ধ্যাটি কাটে বিশ্বের সর্ববৃহৎ নারীপরিচালিত বাজার ‘ইমা কেইথাল’ পরিদর্শন করে, যেখানে প্রায় পাঁচ হাজার নারী প্রতিদিন অত্যন্ত পেশাদারভাবে জগতের তাবৎ পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে সানন্দে ও নির্ভয়ে তাদের বাণিজ্য পরিচালনা করে। এটি সচক্ষে অবলোকন করা ছিল সত্যি এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
এরপর, কাছেই একখানি সাদামাটা রেস্তোরাঁয় মণিপুরের ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে, আমাদের ডেরা ‘হোটেল ক্লাসিক গ্রান্দে’তে ফিরে গানে, গল্পে, কবিতায় মহানন্দে উদ্বোধন করা হয় মোহনীয় এক ম্যারাথন নৈশআড্ডামালার।
মণিপুরে প্রথম পূর্ণাঙ্গ দিন
দিনটি বেশ ঘটনাবহুলই ছিল বলা চলে। সকালে দলবেঁধে হোটেল-রেস্তোরাঁর সমৃদ্ধ বুফেতে সৌজন্যমূলক প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে। প্রথম বিরতি ইম্ফল ওয়ার সেমেটারিতে, যেটি দেখতে ছিল অনেকটা আমাদের চাটগাঁরটির মতোই।
সেখানে খানিকটা সময় কাটিয়ে আমরা চলে গেলাম মণিপুর রাজন্যের প্রাচীন দুর্গপ্রাসাদ কাংলা ফোর্ট পরিদর্শনে। বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই দুর্গ আঙিনা ঘুরে দেখতে আমরা তাই একখানা চতুশ্চক্রযানই ভাড়া করে ফেলি। তাতে চড়ে বেশ আয়েশ করেই গোটা অঙ্গনটি ঘুরে দেখে মণিপুর রাজ্যের সুপ্রাচীন ইতিহাসের একটি চকিত পাঠ নেওয়া গেল। সেখান থেকে গিয়েছিলাম ঐতিহ্যবাহী গোবিন্দজির মন্দিরে, মূলত বিশুদ্ধ নিরামিষ ভোজনের লোভে। কিন্তু আমরা গিয়ে পৌঁছানর আগেই ভোজনপর্ব সাঙ্গ হওয়াতে অগত্যা মন্দির দর্শনশেষে একটি চৈন রেস্তোরাঁতেই মধ্যাহ্নভোজন সারতে হল।
আহারশেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল জওহরলাল নেহেরু মণিপুর ডান্স একাডেমি। উদ্দেশ্য, ইম্ফলের স্বনামধন্য নাট্যকেন্দ্র ‘কলাক্ষেত্র’ প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা, কিংবদন্তিতুল্য নাট্যব্যক্তিত্ব হাইসনাম কানহাইলালের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে আয়োজিত, তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি হাইসনাম তোম্বা নির্দেশিত নতুনতম নাটক, ‘ইয়ামাতা আমাসুং কেইবু কেইঐবা’র প্রারম্ভিক প্রদর্শনী অবলোকন। যুগপৎ মণিপুরি ও জাপানি উপকথা আশ্রিত নিরীক্ষাধর্মী নাটকটি উপভোগের পাশাপাশি, সেদিনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল নাটকশেষে কানহাইলালের সাধনসঙ্গিনী, সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাট্যাভিনেত্রী ইমা সাবিত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপচারিতা।
বুকভরা তৃপ্তি নিয়ে হোটেলে ফিরে আসার একটু পরেই পূর্বের কথামতো, একখানি ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি পুতুল হাতে, আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন প্রতিভাবান তরুণ চলচ্চিত্রকার পবন হাওবাম। তিনি পরদিন ভোরেই বিশ্বখ্যাত ইয়ামাগাতা প্রামাণ্যচিত্র উৎসবে যোগ দিতে জাপান চলে যাবেন বলে লবিতে দাঁড়িয়েই সংক্ষিপ্ত আলাপ হল তাঁর সঙ্গে। রাতে হোটেলের উল্টোদিকের ঝুপড়িতে বসে গরম গরম রুটি-তড়কা আর সব্জি-মাংসের নৈশাহার শেষে যথারীতি ঘরোয়া আড্ডায় মেতে উঠি আমরা। আর এর মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটে মণিপুর রাজ্যে আমাদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ, মনোরম দিনটির।
ইম্ফলে দ্বিতীয় দিবস
সকালে যথারীতি দলবেঁধে প্রভূত খুনসুটি ও কলহাস্যসমেত উপাদেয় বুফে ব্রেকফাস্ট সেরে, হোটেল লবিতে আরও খানিকটা গল্পগুজব করে অবশেষে বেরিয়ে পড়া গেল দিনের প্রথম কর্মসূচি- বর্তমান ভারতের অন্যতম প্রধান ও নন্দিত নাট্যনির্দেশক, প্রবীণ নাট্যজন রতন থিয়ামের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎ ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত, পরিচালিত বিশ্বখ্যাত নাট্যাঙ্গন ‘কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার’ দর্শনের উদ্দেশ্যে।
ইম্ফল শহরের প্রান্তসীমায় অবস্থিত কোরাসের বিশাল, বিস্তীর্ণ ও অপূর্ব নান্দনিক ক্যাম্পাসখানি দেখে তো আমরা রীতিমত স্তম্ভিত! দূরদর্শী ও স্বাপ্নিক রতন থিয়াম মাত্র আটাশ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালে তাঁর এই স্বপ্নের চারাটি রোপণ করেছিলেন, যা আজ ফুলে ফলে পল্লবিত হয়ে বিশ্বনন্দিত এক নাট্য নন্দনকাননে পরিণত হয়েছে। পুরো অঙ্গনটি ঘুরে দেখার পর আমরা এর প্রাণপুরুষ রতন থিয়ামের সঙ্গে মিলিত হই চমৎকার এক ছায়াসুনিবিড় উন্মুক্ত আঙিনায়। সেখানে তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তাঁর এই নাট্যাঙ্গন নির্মাণের উদ্দেশ্য ও অভিজ্ঞতা, সর্বোপরি তাঁর দীর্ঘ দিনের অর্জিত নাট্যভাবনা ও দর্শনবিষয়ে মন খুলে কথা বলেন, আমরা যা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাই গভীর মনোযোগে। তাঁর এই মূল্যবান নাট্যালাপের একপর্যায়ে প্রায় বেরসিকের মতোই আমাদের গাত্রোত্থান করতে হল পরবর্তী গন্তব্যের টানে। তবে, তাঁর আগে জগদ্বিখ্যাত এই নাট্যগুরুর সঙ্গে এবং তাঁর সৃষ্ট শিল্পাঙ্গনের কিছু ছবি তুলে নিতে ভুলি না আমরা।
পরবর্তী কর্মসূচি উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ মিষ্টি পানির হ্রদ লকটাক ভ্রমণ, যা বিশ্বময় পরিচিতি পেয়েছে হ্রদের ওপর জৈববস্তু দ্বারা গঠিত, অগুনতি ভাসমান ক্ষুদ্রাকার দ্বীপভূমিসমূহের কল্যাণে। সেখানে পৌঁছে লেকের লাগোয়া পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে হ্রদদর্শন, পাশেই এক পর্যটন-রেস্তোরাঁয় মাছভাতের মধ্যাহ্নভোজন, অতঃপর নীল জলরাশির বুকে নৌকোভ্রমণ ইত্যাদি সাঙ্গ করে আমরা ছুটে চলি পার্শ্ববর্তী ঐতিহাসিক মৈরাং শহরে অবস্থিত নেতাজি সুভাষ বসুর স্মৃতিজড়িত, আজাদ হিন্দ ফৌজ বা আই এন এ মিউজিয়াম পরিদর্শনে। কিন্তু আমাদের কপাল মন্দ। আমরা পৌঁছানোর মিনিট কয়েক আগেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়, তবু দ্বাররক্ষীকে বলে কয়ে আমরা মিউজিয়াম আঙিনায় ঢুকে নেতাজির ভাস্কর্যের সঙ্গে ছবি তুলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। এখানে উল্লেখ্য, এই মৈরাং শহরেই নেতাজির নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ সম্মুখযুদ্ধে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশবাহিনীর পরাজয় ঘটে; যে-কারণে মৈরাংকেই আজাদ হিন্দ ফৌজের সদর দপ্তর ঘোষণা করে সেখানে সগৌরবে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হয় সেদিন। দিনটা ছিল ১৪ই এপ্রিল, ১৯৪৪ সাল ।
এই ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে আমরা এর পর যাই কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত পৃথিবীর একমাত্র ভাসমান বন্যপ্রাণী উদ্যান কেইবুল লামজাও সন্দর্শনে, যেটি মূলত লকটাক হ্রদেরই একটি সম্প্রসারিত অংশ। এই ভাসমান পার্কের আরেকটি সুখ্যাতি রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় নাচিয়ে হরিণ সাংগাইয়ের সর্বশেষ চারণভূমি হিসাবে। উদ্যানের মূল প্রাঙ্গণে পৌঁছে প্রথমেই আমরা তাই একটা নৌকো ভাড়া করে ঘন তৃণভূমির ভেতর দিয়ে, সরু খাল বেয়ে ভাসমান পার্কের খুব কাছাকাছি চলে যাই সেই দুর্লভ সোনার হরিণের সন্ধানে। সেখানে হরিণের দেখা না মিললেও নৌকো থেকে নেমে ভাসমান উদ্যানের জলজ ভূমিতে বেশ খানিকটা লম্পঝম্প করা গিয়েছিল বটে। তবে ফেরার আগে, উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে দূরে, আবছায়ার মতো একখানি হরিণ দেখার সাধও মিটেছিল বৈকি আমাদের কারও কারও।
ততক্ষণে সূর্যদেব পাটে বসে গেছেন বলে আমরাও ফেরার পথ ধরি। পথিমধ্যে টংঘরের বিস্বাদ চা-পান, হোটেলে ফিরে খানিক চাঙা হয়েই ফের নবমীর রাতে ইম্ফলের সবচেয়ে বড় ও জমজমাট পুজোমণ্ডপ দর্শনে বেরিয়ে পড়া এবং তুমুল হৈহল্লা শেষে, ঝাঁপ বন্ধ হতে চলা দিল্লি দরবার রেস্টুরেন্টের মুসলিম মালিক মোহাম্মদ আকবরের প্রায় হাতে পায়ে ধরে দোকান খুলিয়ে গোশত-পরোটা ও বিরিয়ানি সহযোগে জম্পেশ এক নৈশভোজের মাধ্যমেই সফল সমাপ্তি ঘটে ইম্ফলে আমাদের ঘটনাবহুল দ্বিতীয় দিবসের।
ইম্ফল থেকে কোহিমা
ইম্ফলের হোটেলে আমাদের স্মরণীয় শেষ প্রাতরাশ সেরেই আমরা বাকশো প্যাটরা বাঁধাছাঁদা করে প্রস্তুত হই, প্রতিবেশী বোন নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার উদ্দেশে রওনা হব বলে। এবড়োখেবড়ো পার্বত্যপথে অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ এবং যথারীতি হাসিগানে মেতে থেকে বিকেল নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই কোহিমার উপকণ্ঠে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল ভিলেজে। ফিবছর ডিসেম্বরের এক থেকে দশ তারিখ অব্দি চলা এই উৎসবে নাগাল্যান্ডের মানুষ, প্রকৃতি, ইতিহাস, হস্তশিল্প, সংগীত ও সাহিত্যকে সাড়ম্বরে উদযাপন করা হয় বেশ বিস্তৃত পরিসরে, যা ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের কাছে একটি অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। এর আগে অবশ্য ছোট্ট দুটো পাহাড়ি শহরে চা-পান ও মধ্যাহ্নভোজনের প্রলম্বিত বিরতি নেয়া হয়েছিলো বার দুয়েকের জন্য।
হর্নবিল নামের দীর্ঘোষ্ঠ ঈগল পাখিটি নাগাল্যান্ডের জাতীয় বিহঙ্গবিশেষ, যার উল্লেখ নাগা সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা ও লোককথার অনেকটুকু জুড়ে আছে। হর্নবিল ভিলেজে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই শুরু হল বেরসিক বৃষ্টির বাগড়া। তো, এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই, পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সুবিন্যস্ত পুরো উৎসব প্রাঙ্গণটি তড়িঘড়ি ঘুরে দেখা আর ছবি তোলা হল বেশুমার। তারপর বৃষ্টিস্নাত বাকি পথটুকু পাড়ি দিয়ে সোজা কোহিমায় আমাদের এক রাতের ডেরা, ছিমছাম, নিরিবিলি ইস্ট গেট হোটেলে।
সেখানে দ্রুত সাফসুতরো হয়ে, একপ্রস্থ আড্ডা দিয়ে, হোটেলের ডাইনিংয়েই সুস্বাদু ডিনার সেরে নেয়া গেল। দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত আমাদের কেউ কেউ তখনই শয্যায় ঢলে পড়লেও, অদম্য চার সাহসিকাকে সঙ্গে নিয়ে আমি রাতের কোহিমাকে দেখতে বেরিয়ে পড়ি। ইম্ফলের মতো এখানেও দেখলাম শহরগুলো অল্পরাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। তবে আমাদের হোটেলখানি শহরের মোটামুটি কেন্দ্রস্থলে হওয়াতে, তখনও কিছুটা জীবনের স্পন্দন ধ্বনিত হচ্ছিল চারপাশে; বিশেষ করে মশলার সুগন্ধে ম ম করা জমজমাট স্ট্রিটফুডের স্টলগুলোকে ঘিরে। আমাদের খাদ্যরসিক দুই স্থপতি জেরিনা আপা ও হোসনে আপার উৎসাহে, পরদিন প্রাতরাশের জন্য মোমো আর সসেজ নিয়ে আমরা অতঃপর, আসামের শিলচর থেকে আগত জনৈক পানদোকানির কাছ থেকে মাহীয়ার কেনা রসালো পানের খিলিতে ভাগ বসিয়ে, ফুরফুরে মেজাজে, হালকা চালের পদব্রজে শীতার্ত হোটেলকক্ষে ফিরে নিদ্রাদেবীর উষ্ণ আলিঙ্গনে ধরা দিই সে-রাতের মতো।
ইতিহাসকন্যা কোহিমাদর্শন
নাগাল্যান্ড প্রদেশের রাজধানী কোহিমা। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ব্রিটিশদের হাতে, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তৈরি ছোট্ট, ছিমছাম নান্দনিক শহর একখানি। এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী এবং ইংরেজিতে অভ্যস্ত। মেয়েরা পোশাকে আশাকে পাশ্চাত্যের অনুসারী এবং সর্বত্রই বেশ স্বাধীন, স্বনির্ভর ও সপ্রতিভ।
তো, সকালে আমরা হোটেলে কন্টিনেন্টাল কায়দায় প্রাতরাশ সেরে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়ি। প্রথমেই যাই, হোটেলের পাশেই অবস্থিত পাহাড়জুড়ে তৈরি বিশালায়তন ওয়ার সেমেটারিতে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানের সঙ্গে সম্মুখসমরে নিহত অগুনতি সৈনিকের শেষ শান্তির ঠিকানায়। সেটি দর্শনশেষে স্থানীয় হস্তশিল্পবিপণী থেকে কিঞ্চিৎ কেনাকাটা সেরে, নিকটবর্তী রাজভবন ও ইংরেজ আমলের ডিসি বাংলো দেখে, আমরা চলে যাই পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত সুবিশাল, দৃষ্টিনন্দন মেরি হেল্প কোহিমা গির্জাদর্শনে।
পাহাড়ের অনেক উঁচুতে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক গির্জাটির নির্মাণের সঙ্গে আমাদের ঢাকার তৎকালীন পাদ্রিসম্প্রদায়ের সম্পৃক্তির কথা জেনে খুব ভালো লাগল। অতঃপর, পাহাড় থেকে নেমে কর্মব্যস্ত অথচ সুশৃঙ্খল শহরের পথে খানিক ঘোরাঘুরি করে, সম্পূর্ণ বাঁশ দিয়ে নির্মিত ‘ব্যাম্বু মার্কেটে’ টুকটাক কেনাকাটাশেষে, স্থানীয় একটি ছোট্ট ঘরোয়া রেস্তোরাঁয় বসে, আমাদের দুপুরের আহার সেরে রওনা দিই এশিয়ার প্রথম ‘গ্রিন ভিলেজ’, খনোমার এক পার্বত্যকুটিরে রাত্রিযাপনের উদ্দেশে।
ভারতের প্রথম পরিবেশবান্ধব পল্লী খনোমা
কোহিমাদর্শনশেষে একটু বেলাবেলিই রওনা দিলাম আমরা ভারতের প্রথম পরিবেশবান্ধব পল্লী তথা ‘গ্রিন ভিলেজ’ খনোমার উদ্দেশ্যে। সদ্যসমাপ্ত বর্ষামৌসুমের প্রকোপে, এমনিতেই জরাজীর্ণ পার্বত্য রাস্তার অবস্থা নাকি আরও শোচনীয় আকার ধারণ করেছে, তাই এই সাবধানতা। বাস্তবেও এর সত্যতা মিলল; দুয়েক জায়গায় তো ভয়ংকর ভূমিধসের জন্য বিকল্প পথেই যেতে হল আমাদের। তবে গোটা পথের নিসর্গদৃশ্যরাজি ছিল ভারি মনোরম। সূর্য ডোবার ঠিক আগে আগে খনোমা পৌঁছে, বিশেষ করে আমাদের রাত্রিযাপনের ডেরা, পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত সরাইখানা ডোভিপাই ইন এর সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতায় আমরা পথশ্রমের ক্লান্তি ভুলে গেলাম মুহূর্তেই।
খনোমা পাঁচশত বছরের পুরনো একটি পার্বত্যপল্লী, যার লোকসংখ্যা সাকুল্যে সাড়ে তিন হাজার এবং যাদের অধিকাংশই আঙ্গামি আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্য, একদা যাদের কুখ্যাতি ছিল নরমুণ্ডশিকারী হিসাবে। অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ব্রিটিশদের দ্বারা বিজিত হবার পর তাদের সিংহভাগই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে এবং ক্রমে নরঘাতকের কুখ্যাতি ঘুচিয়ে শিক্ষিত, শান্তিকামী, সৌন্দর্যপ্রিয় ও প্রবলভাবে প্রকৃতিপ্রেমিক একটি জনগোষ্ঠী হিসাবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে। এতটাই যে, এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারত সরকার খনোমাকে দেশের প্রথম প্রকৃত পরিবেশবান্ধব পল্লী হিসাবে ঘোষণা দেয়।
এই পল্লীতে বন্যপ্রাণী শিকার ও বৃক্ষনিধন নিষিদ্ধ; এখানে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে যাবতীয় চাষাবাদ হয়; কৃষিকাজে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক জুমের পরিবর্তে ধাপচাষের প্রচলন হয়েছে এবং সর্বত্রই পরিচ্ছন্নতা ও উদ্যানচর্চাকে উৎসাহিত করা হয়, যার ফলে খনোমার চতুষ্পার্শ্বে অফুরন্ত সবুজের সমারোহ আর এন্তার পুষ্প ও বিহঙ্গের হাতছানি; এর জল ও বায়ু শতভাগ বিশুদ্ধ; এর আকাশে বাতাসে ছড়ানো এক অপার্থিব শান্তি ও স্নিগ্ধতার সার্বক্ষণিক অনুভূতি। এহেন এক প্রাকৃতিক স্বর্গরাজ্যে, প্রিয়জন সান্নিধ্যে, গান, গল্প ও কবিতায়, একটি অপরূপ রাত্রিযাপনের আস্বাদন আমাদের ভ্রমণাভিজ্ঞতায় নতুন ও অমূল্য এক মাত্রা যোগ করেছিল বৈকি।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ নদী-দ্বীপ মাজুলি
খনোমার অনিন্দ্যসুন্দর পার্বত্যপল্লীতে একটি অনাস্বাদিতপূর্ব রাত্রি কাটিয়ে পরদিন প্রসন্ন ভোরে আমরা রওনা করি দূর আসামের সমতলের দিকে, যেখানে বিপুল ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে আছে, সম্প্রতি ইউনেস্কো থেকে বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি-পাওয়া, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী-দ্বীপ মাজুলি, সার্বক্ষণিক নদীভাঙনের পরও যার আয়তন এখনও প্রায় চারশত বর্গমাইলের মতো।
হাজার বছরের পুরনো এই দ্বীপটির বৈশিষ্ট্য, এটি একটি সমতলভূমি, প্রায় নদীভাসা অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও, মূলত নানাগোত্রের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাসভূমি, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাতিটির নাম মিশিং। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ মহাঋষি শঙ্করদেবের নেতৃত্বে নববৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা এই অপরূপ, শান্তশ্রী, জলসিঞ্চিত, চিরসবুজ, বিহঙ্গমুখর দ্বীপটিতে এসে আশ্রয় নেয়।
মূলত এই বৈষ্ণবীদের ব্যতিক্রমী, সৌন্দর্যপ্রিয় জীবনচর্যার প্রভাবেই এই নিরিবিলি দ্বীপটি ক্রমে আসামের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে আদিবাসী সংস্কৃতি ও জীবনধারার মিশ্রণ এবং অনবদ্য নিসর্গরূপ আর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের সমাবেশে এটি আজ বিশ্বঐতিহ্যের অংশ, সংবৎসর যা মুখরিত থাকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় আর নানাবিধ লোকজ উৎসবের সুনন্দ কলরবে।
তো, দিনভর গাড়িতে বসে আমরা ডিমাপুর হয়ে আসামের জোড়হাট পৌঁছে, দিনের শেষ ফেরি ধরে উত্তাল ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে, রক্তিম সূর্যাস্তশেষে ভরসন্ধ্যানাগাদ এসে পৌঁছুই বহুপ্রতীক্ষিত মাজুলি দ্বীপে। আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয় মিশিংস্থাপত্যে নির্মিত ছিমছাম বাঁশের টংঘরে। স্থানীয় বুনো কুক্কুটের মাংসসহযোগে পরম তৃপ্তির নৈশাহার সেরে ক্লান্ত শরীরে অতঃপর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়তে বিশেষ বিলম্ব হয় না কারোরই।
পরদিন লোভনীয় প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়ি দ্বীপভ্রমণে। সত্র নামে পরিচিত একাধিক প্রাচীন বৈষ্ণব ধর্মাশ্রম পরিদর্শন, একটি নান্দনিক মুখোশ নির্মাণকেন্দ্র ঘুরে দেখা, আদিবাসী বয়নগৃহ থেকে কিঞ্চিৎ কেনাকাটা, দুপুরে এনচান্টিং মাজুলি নামে দারুণ একটি নবনির্মিত রিসোর্টে স্থানীয় লোহিত নদীর সুস্বাদু মৎস্য দিয়ে আনন্দ-আহার সমাপন, মাজুলির স্নিগ্ধসবুজ, শ্বেতবকের বিচরণধন্য প্রকৃতির মাঝখানে উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়ানো, বিকেলে আদিবাসী মিশিংপল্লী দর্শনশেষে ফিরে আসি আমাদের যার যার চিলতে টংঘরে। তারপর ধড়াচূড়া ছেড়ে, মহানন্দে নৈশভোজ গ্রহণ ও গভীর রাত অব্দি প্রাণখোলা সম্মিলিত আড্ডার ভেতর দিয়ে শেষ হয়ে আসে আমাদের দেহমন সতেজকরা স্মরণীয় মাজুলি ভ্রমণ।
নামেরি অভয়ারণ্যে তাঁবুঘরে রাত্রিযাপন
মাজুলির পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নামেরি ইকোক্যাম্প, যা মূলত আসামের একটি বিখ্যাত বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যের মাঝখানে অবস্থিত পর্যটক অবকাশকেন্দ্র। এর অন্যতম আকর্ষণ সুনসান আরণ্যক পরিবেশে বিশেষভাবে তৈরী তাঁবুঘরে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা। তো, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, রাস্তার ধারের ধাবায় বসে বিচিত্র সব খাদ্যবস্তু আস্বাদন এবং পথে পথে নানাবিধ বিপত্তি মোকাবিলা করে অবশেষে যখন সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের উদ্দিষ্ট গন্তব্যে এসে পৌঁছানো গেল, তখন তার অভূতপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর সবুজে ঢাকা, ছায়াঘন, নৈঃশব্দ্য-নিমজ্জিত পরিবেশের আবেশে মুহূর্তে পথশ্রমের ক্লান্তি ভুলে আমাদের দেহমন চাঙা হয়ে উঠল।
আরও ভালো লাগল আমাদের থাকার জন্য নির্ধারিত অভিনব, রীতিমতো রোমান্টিক তাঁবুঘরগুলো দেখে। অতঃপর ঝটপট পোশাকবদল করে, স্নান ইত্যাদি সেরে আমরা বসে পড়ি নৈশভোজ পূর্ববর্তী ক্ষুধাবর্ধক আড্ডায়। আড্ডাশেষে, লাগোয়া লোকজ রেস্তোরাঁয় আয়েশি উদরপূর্তির পর, আরেকপ্রস্থ হুল্লোড়ে টেবিলটকে এন্তার রাজাউজির মেরে আমরা রাত নিশুতির আগেই ফিরে যাই যার যার তাঁবুতে, নিদ্রাদেবীর আরাধনায়।
পরদিন ভোরে উঠে আমাদের সম্মিলিত প্রাতর্ভ্রমণ, তাঁবু-বারান্দায় বসে সকালের চা-পান, অবকাশকেন্দ্রের কাছেই অবস্থিত ব্রহ্মপুত্রের বিখ্যাত, কিন্তু অধুনা বিলুপ্তপ্রায়, মহাশোল মাছের পুনরুজ্জীবন প্রকল্প পরিদর্শন, ষোড়শপচারে সজ্জিত রাজকীয় প্রাতরাশ গ্রহণ, সেখানে সদ্য অরুণাচল-ফেরত, কোলকাতার এক উষ্ণ ও আন্তরিক তরুণ বাঙালি দম্পতি দেবাংশু-বিদিশার সঙ্গে পরিচয় ও প্রাণের আলাপ সাঙ্গ করে অতঃপর আমরা আমাদের পরবর্তী অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেবার জন্য আঁটঘাট বেঁধে প্রস্তুত হই।
স্বপ্নের অরুণাচল স্বপ্নই থেকে গেল
সত্যি বলতে কি, আমাদের উত্তর-পূর্ব ভারত, তথা সপ্ত-ভগিনী ভ্রমণের প্রধান লক্ষ্যই ছিল সুদূর উত্তরে অবস্থিত, একেবারে চিনের সীমান্তবর্তী সুউচ্চ প্রদেশ, বরফঢাকা শ্বেতশুভ্র অরুণাচল দর্শন; অতি সম্প্রতি যাকে নিষেধের অবগুণ্ঠন তুলে সর্বসাধারণের জন্য শর্তসাপেক্ষে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। আমরা শর্তানুযায়ী, আগেভাগেই অরুণাচল সরকারের কাছে যথাযথ আবেদনও করে রেখেছিলাম। কিন্তু, অজানা কারণে, আমাদের অরুণাচল প্রবেশের নির্ধারিত দিনের আগমুহূর্তেও সেই কাঙ্ক্ষিত ছাড়পত্র হাতে পাইনি আমরা। তবুও স্বপ্নের অরুণাচলের এত কাছাকাছি এসে ফিরে যেতে মন চাইল না আমাদের।
নামেরি থেকে পরদিন সকালে তাই সাহস করে আমরা নিকটবর্তী অরুণাচল সীমান্ত চেকপোস্ট ভালুকপংয়ের উদ্দেশে রওনা হই, যদি অন্তত আমাদের করা আবেদনপত্রখানির কপি দেখিয়ে, সমবেত অনুনয়বিনয়ের মাধ্যমে সীমান্তরক্ষী মহাশয়ের করুণার উদ্রেক করে প্রবেশের অনুমতি সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু, হা হতোস্মি! আমাদের এতজনের এত অনুরোধ, উপরোধেও আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটাতে সম্মত হলেন না, তাঁর আবাসভূমিটির মতই শীতল ও প্রস্তরবৎ সীমান্তপ্রহরী মহাশয়। সান্ত্বনা এটুকুই, এই কদিনের উদ্দাম অভিযানের ধকল সইতে না পেরে ঠিক অই মুহূর্তেই আচমকা আমার জুতো ছিঁড়ে গেলে, অরুণাচলের এই সীমান্তশহরের খানিকটা অভ্যন্তরে হেঁটে গিয়ে জুতো মেরামত করিয়ে নেবার সদয় অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল। এই সুবাদে এযাত্রায় আপাতত এইটুকু অরুণাচল দর্শনের সৌভাগ্য হল আমার।
ব্যর্থ ও বিফল-মনোরথ আমরা অতঃপর সিদ্ধান্ত নিই, রাতটা এই ভালুকপং সীমান্তশহরেই অবস্থিত প্রশান্তি নামক সুন্দর, সরকারি পর্যটনকুটিরে কাটিয়ে কিছুটা প্রশান্তি খুঁজে নেওয়ার, এবং প্রায় পাথরছোড়া দূরত্ব থেকে অধরা অরুণাচলের পার্বত্য আকাশরেখা অবলোকন করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করব। জায়গাটা সত্যি বেশ দৃষ্টিনন্দন ও প্রশান্তিময়; আঙিনা থেকেই দেখা যায় অরুণাচলের শান্ত, সবুজ নিসর্গদৃশ্য আর তার একেবারে গা ঘেঁষে বয়ে গেছে খুবই কাব্যিক নামের এক বিখ্যাত পাহাড়ি নদী, জিয়া ভরলি।
তো, দুপুরে ভরপেট আহার এবং তৎপরবর্তী সংক্ষিপ্ত দিবানিদ্রাশেষে আমরা পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে, একখানা পাথরভরা স্বচ্ছতোয়া পার্বত্য ঝরনাধারা অতিক্রম করে, সুবিস্তীর্ণ শুভ্র কাশবন পাড়ি দিয়ে, বিকেলের মায়াময় জিয়া ভরলির জল ছুঁয়ে আসি। তখন সূর্যদেব সবে পাটে বসেছেন, কিন্তু পাহাড়ি ঐরাবতদলের আচমকা আগ্রাসনের ভয়ে আমরা তাঁর অস্তগমনের দৃশ্য পুরোপুরি উপভোগ না করেই অপরূপ অপার্থিব এক গোধূলি-আলোর আভা গায়ে মেখে তড়িঘড়ি ফেরার পথ ধরি। অবশ্য, ফেরার পথে আশ্রয়পল্লীর লাগোয়া, জনৈক হাসিখুশি আদিবাসী দম্পতির ঘুপচি দোকানে বসে, সুস্বাদু মমো আর ধোঁয়াওঠা চা-পানের সঙ্গে এক প্রস্থ সান্ধ্য আড্ডার পাশাপাশি, চরাচর উদ্ভাসিত করে উদিত হওয়া, লক্ষ্মী পূর্ণিমার পূর্ণশশীর শোভা উপভোগ করতে ভুলি না আমরা।
রাতে, আমাদের ভোজনালয়ের সন্নিকটেই দেখি আসামের কিংবদন্তিতুল্য সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার সুবিশাল প্রতিকৃতিতলে, লক্ষ্মী পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বসেছে উদ্দাম নৃত্যগীতের আসর; তাতে সোৎসাহে যোগ দিয়ে, নিজেরাও কয়েক পাক নেচে নিয়ে আমরা অবশেষে ফিরে আসি আপন ডেরায়। তারপর ফের গল্প আর গান আর হাসির তোড়ে ভুলে যাই আমাদের অরুণাচল যেতে না পারার সব আক্ষেপ আর আহাজারি, এবং আরেকটি নতুন ভোরের স্বপ্ন নিয়ে এক সময় তলিয়ে যাই সুখনিদ্রার কোলে।
ভ্রমণশেষের ভাঙা হাট, গুয়াহাটিতে দুইরাত
অরুণাচল প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে আমরা অতঃপর আসাম প্রদেশের রাজধানী গুয়াহাটি চলে আসি। উদ্দেশ্য দ্বিবিধ: গুয়াহাটিতে অবস্থিত অরুণাচল সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দপ্তরপ্রধানের সঙ্গে দেখা করে কাঙ্ক্ষিত ছাড়পত্র আদায়ের শেষ চেষ্টা করা এবং অন্যথায়, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে, অর্থাৎ মন্দের ভালো হিসাবে গুয়াহাটি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো যতটা পারা যায় দেখে নিয়ে সেখান থেকেই আমাদের উত্তর-পূর্ব ভারতভ্রমণের ইতি টানা।
যেই কথা সেই কাজ। একটানা গাড়ি চালিয়ে দুপুর নাগাদ গুয়াহাটি পৌঁছে, ছোট্ট ছিমছাম বুটিক হোটেল পালাসিওতে বাক্সপ্যাটরা ও অপর সহযাত্রীদের গচ্ছিত রেখে, আমাদের অঘোষিত দলপতি ও কোষাধ্যক্ষ্যা, যথাক্রমে মুরাদ ভাই ও মধুমিতাকে নিয়ে আমরা দৌড় দিই উদ্দিষ্ট সেই সরকারি দপ্তর অভিমুখে। সেখানে কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, নতুনভাবে আবেদনপত্র পূরণ ও নির্ধারিত মাশুল প্রদান করে, আশা ও আশ্বাস নিয়ে বিকেল নাগাদ ফিরে আসি হোটেলকক্ষে।
হোটেলে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম ও বিশ্রম্ভালাপ সেরে, বিকেলে সদলবল বেরিয়ে পড়া গেল গুয়াহাটির শহরকেন্দ্র অভিমুখে, তার আলো ঝলমল সান্ধ্যরূপ দর্শনের লক্ষ্যে। শহরের বিখ্যাত সেন্ট্রাল মলের অভ্যন্তরে খানিক ঘোরাঘুরি এবং ফুডকোর্টে পিৎজা ভক্ষণশেষে আমরা এক পর্যায়ে ওপরতলার সিনেপ্লেক্সে ঢুকে পড়ি সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত, সোনালী বসু পরিচালিত, বিষণ্নসুন্দর বলিউডি ছবি পিঙ্ক ইন দ্য স্কাই দেখার বাসনায়। দীর্ঘ ও কিছুটা ক্লান্তিকর ছবি শেষ হতে হতে প্রায় মধ্য রাত হয়ে গেলে, বিধ্বস্ত শরীরে হোটেলে ফিরে আর অযথা বাক্যব্যয় না করে সোজা সেঁধিয়ে যাই অপেক্ষমাণ নিদ্রাশয্যায়।
পরদিন সকালটাও কাটে অরুণাচল দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ ও দেনদরবারে, আমাদের সেই PAP (Protected Area Permit) নামধারী অধরা সোনার হরিণের পিছু ধাওয়া করে। অবশ্য, দুপুর নাগাদই আমরা মোটামুটি জেনে যাই যে, মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিক হওয়ার অপরাধে এবং ভারত সরকারের সাম্প্রতিক অভিবাসনবিধি, বিতর্কিত এনআরসির অদৃশ্য খড়্গের কোপে পড়ে এবার আর অরুণাচলের শিকে ছিঁড়বে না আমাদের কপালে। ফলে আর কালক্ষেপ না করে, বাকি সময়টুকু আমরা গুয়াহাটির যতটুকু সম্ভব দেখে নিতে তৎপর হই।
একটু বেলা পড়ে আসতেই আমরা বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে যাই ছোট্ট সুন্দর সংস্কৃতিকেন্দ্র ‘মাটি’ দর্শনে, সেখান থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে হস্তশিল্পবিপণী ‘পূর্বশ্রী’তে। এরপর গুয়াহাটির বিখ্যাত ফ্যান্সিবাজারের কাছাকাছি এক জনাকীর্ণ শ্রী লেদারের শোরুম থেকে অবধারিত শস্তার পাদুকাক্রয় এবং রাতের ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী উদ্যান ও শতবর্ষী প্রমোদপোত আলফ্রেস্কো গ্রান্দ এর ঘাটপ্রাঙ্গণে বেড়িয়ে ও সবশেষে এক বাঙালি দম্পতি পরিচালিত চিলেকোঠার রেস্তোরাঁয় মাছেভাতে উদরপুজো সেরে তাড়াতাড়িই হেটেলের পথ ধরি।
হোটেলে ফিরে আমরা যার যার মতো ‘এক্সিট প্ল্যান’ প্রণয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দেখা গেল, ইমাম ভাই কালবিলম্ব না করে পরদিনের বিমানেই ঢাকা ফিরে যেতে বদ্ধপরিকর; জেরিনা আপা, মুরাদ ভাই আর হোসনে আরা আপা সড়কপথে শিলং ও সেখান থেকে দুদিন বাদে সীমান্ত পেরিয়ে সিলেট প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী, এবং মধুমিতা আসন্ন ভাইফোঁটা উৎসবে যোগ দিতে কলকাতা যেতে উদগ্রীব। মাঝনদীতে হালভাঙা নৌকার মতো দিশেহারা আমরাও অগত্যা মধুমিতারই লেজুড় ধরি। ঠিক হয়, পরদিন দুপুরে আমরা তিনজন মিলে উড়াল দেব কল্লোলিনী কলকাতার পথে। বিমানবন্দরে আমাদের সদানন্দ সহভ্রামণিক ইমাম ভাইয়ের দেখা পেয়ে এমন আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম আমরা, যে প্রায় প্লেন মিস হবার উপক্রম হয়েছিল। মাইকে নিজেদের নাম ঘোষণা শুনে, পড়িমরি ছুটে গিয়ে বিশেষ বাসে চড়ে বিমানে পৌঁছে শেষ রক্ষা হয়েছিল আমাদের। অতঃপর, নটে গাছটি মুড়োলো, আমাদের উত্তর-পূর্ব ভারতভ্রমণের গল্পখানিও ফুরোলো।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন