ফিচার
রোমানুর রোমান
মানুষের প্রতিনিয়ত যে জীবনাচার্য; ঘটনা, কাহিনী, কর্ম, গল্প। সেলুলয়েডের বদৌলতে তা পর্দায় এসেছে। মানুষ নিজের চলচ্ছবির প্রকাশসন্ধান পেয়েছে। জীবনের গল্পগুলো চিত্রের মধ্যমে তুলে ধরার জায়গা পেয়েছে। বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্যের কারণে সারা দুনিয়া আজ হাতের মুঠোয়, ক্যামেরাবন্দী। টেলিভিশন নাটক তেমনই একটি পর্ব, যা নির্মাণ কারিগরের শিল্পছোঁয়ায় হয়ে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর। এবং ইউটিউবের কারণে নাটক আরো সহজলভ্য হয়েছে। সারা দুনিয়া থেকে যেকোনো মুহূর্তে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নাটক দেখা যায়।
কিন্তু টেলিভিশন বা ইউটিউব নাটক নির্মাণ নিয়ে যদি কেউ ভাবেন— হোক সে ভাবনা নাট্যরচনা-পরিচালনা-প্রযোজনা অথবা অভিনয়কেন্দ্রিক—তাঁকে হতে হবে চৌকস।
শুরুটা একটু গল্পের মতো করেই বলি। এক দেশে ছিল এক টিভি, নাম ছিল তার বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন )।
সেই টিভির ছিল লক্ষ লক্ষ দর্শক। সে সময়কার মানুষ চাকচিক্যের চেয়ে স্বস্তি খুঁজত বেশি। আর তাই সুস্থ বিনোদন চাইতো সবাই। পরিবার ছিল পরিবারের মতোই। তখন যে যার মত মোবাইল ফোনে মুখ গুঁজে বসে থাকতো না। একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতো। এক সাথে বসে গল্প করতো। অফিস বা ক্লাস শেষ করে সবাই বাসায় ফিরে একসাথে মিলে টিভি দেখতো।
সে সময় হুমায়ুন আহমেদ, মামুনুর রশিদ, আব্দুলল্লাহ আল মামুনরা নির্মাণ করেছেন একের পর এক অসাধারণ সব নাটক।
লোহার চুড়ি, আজ রবিবার, আমাদের নক্ষত্র, সকাল সন্ধ্যা, ঢাকায় থাকি, কোথাও কেউ নেই, অসময়, রূপনগর, শুকতারা; এসব নাটকের জন্য সে কি অপেক্ষা সবার! মায়েরা হাতের কাজ শেষ করে নিত, আর ছোটরা জলদি করে নিজেদের পড়াশোনা গুছিয়ে নিত।
এমনকি পত্রিকা থেকে বাবাদের চোখ সরিয়ে নিতেও বাধ্য করতো সেই সময়কার একমাত্র বিটিভি।
টেলিভিশন নাটক বিবেচিত হতো বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে। নাটকের গল্প, অভিনয়, নাম নিয়ে আলোচনা চলতো চায়ের কাপে, পরিবার বন্ধুদের আড্ডায়। অপেক্ষা ছিল নতুন নাটক আসার। কালের যাত্রায় নাটকের গল্প, নির্মাণ আর নামকরণে আসে পরিবর্তন। ভিউ ট্রেন্ড পরাজিত করে শিল্পমানকে। নাটকে ঢুকে যায় অশ্লীলতা।
ডিজিটাল এ সময়ে এসে নাটক প্রচার হচ্ছে টেলিভিশন, বিভিন্ন অ্যাপসহ ইউটিউবে। বলা চলে টিভির চেয়ে মানুষ এখন নাটক দেখছেন ডিজিটাল মাধ্যমেই বেশি। অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো গানের পাশাপাশি নাটক প্রচারের জন্য নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল ব্যবহার করছেন। এমনকি নিয়মিত নাটক নির্মাণও করছেন। অনেক অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টিভিতে প্রচার হওয়া নাটকও নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করে আসছেন।
প্রচারের জন্য নেই কোনো নীতিমালা। তার পরও একটি ভালোমানের নাটক ইউটিউবে প্রকাশ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হচ্ছে। ভিউকে উপেক্ষা করার কোনো কারণ নেই। ভালো-মন্দ পরের হিসাব। যে নাটকের ভিউ বেশি সেই নাটক নিয়েই হয় আলোচনা। এ আলোচনার মাঝেও কিছু নাটক সংলাপের কারণে হয়ে যাচ্ছে বিতর্কিত।
এখনকার নাটক দেখলে হুমায়ুন আহমেদের কোথাও কেউ নেই এর কথা মনে পড়ে যায়। কারণ, একসাথে বসে দেখার মতো কোথাও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই দর্শকের চোখ আজও খুঁজে ফেরে সেই নাটকের সন্ধান।
সেইদিন কী আর আছে? দিন বদলাইছে। এখন নাটকের সময় চল্লিশ মিনিট, যার মধ্যে সাত মিনিটের গান। নায়ক- নায়িকার ফোনে কথা বলার স্লো মোশান দেখবেন পাঁচ মিনিট। সেই সাথে সমপরিমাণ কান্না আর অশ্লীল সংলাপ। বোনাস হিসেবে পাচ্ছেন খোলামেলা পোশাক ও বিভিন্ন ধরনের সুড়সুড়ি দেওয়া দৃশ্য। ব্যাস হয়ে গেল এখনকার নাটক। এসব দিয়েই চলছে দর্শককে কাছে টানার চেষ্টা। গল্প আর শিল্পীদের চরিত্র যাক জল্লায়। নির্মাতার টার্গেট এখন শুধুই ইউটিউব ভিউয়ারস চুটকি ভান্ডার।
প্লে বয়, সোবার ঘর, গরম মহল্লা, এক্সট্রা বয়ফ্রেন্ড, সিসি ক্যামেরা এগুলো নাটকের নাম নাকি হতাশার নাম! নামেই স্পষ্ট বদনাম। কোথায় নেমেছে টেলিভিশন নাটক! অথচ সোনালী দিনের নাটকের নামের মধ্যে ছিল অন্য এক মাধুর্য, ছিল জীবনবোধ।
এক্স গার্লফ্রেন্ড, ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিটস, লাভ এন্ড সেক্রিফাইস, জার্নি বাই লঞ্চ, ব্যাকবেঞ্চার, ব্যাচেলর পয়েন্ট, মি. বয়ফ্রেন্ড, নো লাইস, বয়ফ্রেন্ড ভার্সেস গার্লফ্রেন্ড, টুলেট ব্যাচেলর, ডেড বল, আফটার ম্যারেজ, স্যাটেল ম্যারেজ, অ্যাপয়েন্ট লেটার, জার্নি বাই বাস, লাস্ট সামার, হট এন্ড স্পাইসি, ওয়ান ওয়ে মোর, অটো সার্ভিস, রান, লাভলিংক, লাভ এন্ড কোং, কোর্ট ম্যারেজ, রানওয়ে, লাভলেইন, রোড টু আমেরিকা, বেট, হেই বেবি, ডিসিপ্লিন, রোমান্টিক সিনড্রোম, আউট অফ নেটওয়ার্ক, জাস্ট ফ্রেন্ড, রেস, ককটেল, টিবয়, রিভিশন, এইম ইন লাইফ, ফার্স্ট ইয়ার ড্যাম কেয়ার, ফ্রেন্ডস, কাপল, রুমমেট, সিনেমাটোগ্রাফি, ও মাই গড, টু এয়ারপোর্ট, এমন অসংখ্য ইংরেজি নামের ছড়াছড়ি।
এই টার্ম টেকনোলজিক্যাল ট্রান্সফরমেশনের কারণে আমরা একটা ভিন্ন রূপ দেখতে পাচ্ছি। নাটকের এমন নামের দায়ভার কার? কিভাবে হবে উত্তরণ?
‘নামে কী যায় আসে’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে টিভি নাটকের সোনালি অতীতকে পদদলিত করতে মরিয়া হয়ে পড়েছেন নির্মাতারা। তাদের হাতে পড়ে নাটকের ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। নাটকের মান নেমে গেছে অনেক আগেই। টিকে ছিল নামের সৌন্দর্য, তাও বিলীন হতে বসেছে। এই সবকিছুর বিনিময় হচ্ছে ভিউজ।
কমেন্টবক্স এর গালি আর ধিক্কারের ছাপ একেবারেই দেখা যায় না ইউটিউবের ফকফকে ডলারে। তাই থোড়াই তোয়াক্কা করেন নির্মাতা অথবা অভিনেত্রীরা।
শিল্পীরাই ভিউজ ওপরে তুলতে গিয়ে নিজেদের নিচে নামাতে এতটুকুও কার্পণ্য করেননি তারা। তা প্রয়োজনে নাকি স্বেচ্ছায়? সে প্রশ্নটা না হয় তোলাই থাক। ঘুনে ধরে গেছে সংস্কৃতির গোড়ায়। পচন ধরেছে অনেকদিন আগেই।
কিছু নির্মাতা সংস্কৃতির বারোটা বাজানোর দায়িত্ব নিয়েছেন নিজেদের ঘাড়ে। সেসব ফেরি করে তপ্তির ঢেকুর তুলছেন।
এখন অশ্লীলতা, ভিউ বেশি আর ট্রেন্ডের জোয়ারে টেলিভিশন নাটক ইন্ডাস্ট্রি ভয়ঙ্করে মুখে।
‘শয্যাদৃশ্যের প্রয়োজনে কাহিনী, নাকি কাহিনীর প্রয়োজনে শয্যাদৃশ্য- এ এখন বিরাট ধাঁধা।’ হালের কিছু ওয়েব সিরিজকে ঘিরে ফেসবুকে এখন এমন অসংখ্য মন্তব্যের ঝড়। বাংলাদেশের দর্শক কখনও কল্পনা করেননি, নাটক দেখতে গিয়ে তাদের পর্নো সদৃশ কিছু দেখতে হবে। কখনও ভাবেননি, শালীন-কুলীন প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এমন নগ্ন ও অশালীনরূপে তাদের সামনে হাজির হবেন।
আর তাদের ভাষার কী শ্রী! কী অশ্লীল-অশ্রাব্য শব্দ-বাক্য! সংলাপ নয়, এ যেন মুখে ‘খিস্তি-খেউড়ের খই’! সম্প্রতি ‘বুমেরাং’, ‘সদরঘাটের টাইগার’, ‘১৪ আগস্ট’ নামের ওয়েব সিরিজ দেখতে গিয়ে দর্শকরা এমনই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। অবশ্য তাতে বিব্রত নন শিল্পী-কুশীলব কিংবা নির্মাতা। তাদের কাছে সবকিছুই নাকি ‘গল্পের প্রয়োজনে’! কী সেলুকাস! ভিডিওগুলোয় যৌনতার বাণিজ্যিক সমীকরণ খুব সুস্পষ্ট। সুস্পষ্ট অশ্লীলতার ব্যাকরণ। তাতে দর্শক মনে আশঙ্কা জাগছে- ‘হিট’-এর সোনার হরিণ ধরতে আমাদের নাটক কি এখন তবে যৌনতার ঘোড়ায় ভর করেছে? নাটকের ভিউ পাওয়ার ট্রেন্ড কি তবে পাল্টে যাচ্ছে?
নাট্যরস নিতে গিয়ে দর্শককে কি এখন নিয়মিত, গল্পের প্রয়োজনে রগরগে যৌনরস বা খিস্তি-খেউড় গিলতে হবে? অবশ্য ওয়েব সিরিজ নিয়ে এমন বিতর্ক নতুন কিছু নয়। এই তো কয়দিন আগে যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে জনপ্রিয় ভারতীয় ওয়েব সিরিজ ‘ট্রিপল এক্স’র প্রযোজকদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। ২০১৮ সালে নেটফ্লিস্ক, আমাজন প্রাইম ভিডিওসহ আরও কিছু অনলাইন প্ল্যাটফরমের অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক ওয়েব সিরিজ সরাতে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা হয়। মামলা হয় জনপ্রিয় সেক্রেড গেমস, হাসমুখ বেতাল, পাতাল লকসহ বিভিন্ন ওয়েব সিরিজের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশেও বিতর্ক আর ওয়েব সিরিজ যথারীতি হাত ধরাধরি করেই চলছে।
মেয়ে দেখলে ঘুরতে ইচ্ছে করে পিছ পিছ। ফেসবুকে মানুষকে ডিস্টার্ব করছ, মেয়ে দেখলে লোল পড়ে, অ্যাঁ! অসভ্য। ‘থাপ্পরে লেগে থাকা প্রেম’ নাটকের একটি সংলাপ।
এখনকার নাটকগুলোতে এভাবেই ব্যবহার হচ্ছে অমার্জিত-অসার ও অরুচিকর সংলাপ। বলা হয়, সংলাপ নাটকের প্রাণ। নাটকে চরিত্রগুলো মুখর হয় সংলাপের ভেতর দিয়ে। কিন্তু এখনকার নাটকে তা নেই। এক সময় টিভি নাটক থেকে শুধু বিনোদনই নয়, মানুষ শিখেছেও অনেক কিছু।
বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার ক্ষেত্রে নাটক এক অনন্য ভূমিকা রেখেছে। শিল্পীদের চমৎকার সংলাপে মুগ্ধ হতেন দর্শক। সাহিত্যের রস, নতুনত্ব ও শ্রতিমধুর ছিল নাটকের সংলাপ। শহর বন্দর, গ্রামসহ সব শ্রেণির দর্শকের কাছে এসব নাটক সমাদৃত ছিল। দর্শকরা সেইসব নাটকের সংলাপ আওড়াতেন। সংলাপের কারণে অভিনয়শিল্পীরা পরিচিতি পেতেন। শ্রতিমধুর সংলাপ নাটকের মান বাড়িয়ে দিত বহুগুণ।
কিন্তু আজকাল তার বিপরীতমুখী আমাদের নাটকের সংলাপ। আকর্ষণীয় সংলাপের পরিবর্তে এখন নাটকে চলিত ও আঞ্চলিক ভাষার ছড়াছড়ি। আকর্ষণীয় সংলাপের পরিবর্তে চলছে সাদামাটা সংলাপ। অশুদ্ধ ভাষার পাশাপাশি নাটকে চলছে কুরুচিপূর্ণ সংলাপ। কোনো কোনো নাটকে অশ্লীল সংলাপ ঢাকতে ভিপ ব্যবহার হলেও কখনো কখনো ভিপও ব্যবহার হয় না।
আজকাল নাটকে ভাষার বিকৃতি চরমে পৌঁছেছে। শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই। যে ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া হয়েছে সেই ভাষার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ভাষার অবমাননা করা হচ্ছে। নাটকে ভাষা কিংবা সংলাপের মান বজায় রাখা আমাদের দায়িত্ব। এ জন্য অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা ও চ্যানেল কর্তৃপক্ষ সবারই দায়িত্ব রয়েছে।
এইতো কিছুদিন আগে ধারাবাহিক নাটক ব্যাচেলর পয়েন্ট নিয়ে যা ঘটল। নাটকটি বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের কাছে খুবই জনপ্রিয়। নির্মাণ করেছেন কাজল আরিফিন অমি। নাটকটির প্রতিটি পর্ব ধ্রুব টিভি নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করেন। বর্তমানে নাটকটির চতুর্থ সৃজন চলছে। কিন্তু সম্প্রতি প্রচলিত এই নাটকের কয়েকটি পর্বের সংলাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোর সমালোচনা শুরু হয়। এসব সংলাপকে নোংরা বলে মন্তব্য করছে নেটিজেনরা। তাই সমালোচনা ও আপত্তির মুখে সেসব পর্ব ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলেছে কতৃপক্ষ।
কিন্তু এর চেয়ে আরো অনেক বেশি খারাপ শব্দের অশ্লীল নাটক ছড়িয়ে আছে ইউটিউব জুড়ে। টিভি চ্যানেলের যদিও নিজস্ব রিভিউ বোর্ড থাকে কিন্তু ইউটিউবের ক্ষেত্রে সেটাও নেই। আর টিভি চ্যানেলের নিজস্য যে রিভিউ বোর্ড থাকে তারাও ততটা গুরুত্বসহ দেখে না। কারণ, টিভি চ্যানেলগুলো একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে ভিউজ ও জনপ্রিয়তা বাড়াতে চায়।
এদিকে বাংলা সিনেমা এবছর কিছুটা সোনালী অতীত ফিরে পেয়েছে। গত ৩০ আগস্ট-২২ মস্কোতে ‘আদিম’ সিনেমার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়। এরপর জানা যায় নেটপ্যাক জুড়ি এ্যাওয়ার্ড জিতেছে ছবিটি। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের চুয়াল্লিশ তম আসনে বাংলাদেশের সিনেমা আদিম জিতে নিয়েছে এবং গত বছর কানে রেহানা মারিয়াম নূর প্রদর্শিত হলে তা সব মহলের প্রশংসা পায়।এবছর ঈদে হাওয়া, পরাণসহ বেশ কিছু বাংলা সিনেমা দর্শকদের হলমুখী করলে নতুন করে এখন আলোচনায় বাংলা সিনেমা। তবে এত সব ইতিবাচকতার মধ্যেও সেন্সবোর্ডে আটকে আছে শনিবার বিকেল সিনেমাটি।
সেন্সরবোর্ডে কেন সিনেমা আটকে থাকে? সেন্সরবোর্ড আসলে কী? বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ড তথ্য মন্ত্রণালয়াধীন একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট ১৯১৮-এর মাধ্যমে এদেশে চলচ্চিত্র সেন্সরের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ১৯৫২ সালে ‘ইস্ট বেঙ্গল বোর্ড অব ফিল্ম সেন্সস’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড নামকরণটি করা হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে। বিনোদনের পাশাপাশি জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসার, সংস্কৃতির বিকাশ এবং উন্নত জাতিগঠন ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে সারাবিশ্বে চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে সমাদৃত।
চলচ্চিত্র মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম। সুস্থ চলচ্চিত্র যেমন জীবনের কথা বলে মানুষকে জীবনমুখী হতে শেখায়, তেমনি অসুস্থ চলচ্চিত্রের প্রভাব মানুষ ও সমাজকে বিপথগামী করতে পারে। তাই চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে যারা সংযুক্ত তাদের বিশেষ দায়বদ্ধতা আছে। সেন্সর বোর্ড দর্শকের ওপর বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ওপর চলচ্চিত্রের প্রভাব সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা, নকল প্রবণতা ও দৈন্যদশা দূর করার জন্য বোর্ড বিদ্যমান সংশ্লিষ্ট আইনকানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ করে থাকে এবং দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধকে আঘাত করে এমন চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে বিধিগতভাবে কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকে।
সেন্সর আইন অমান্য করে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হলে এবং চলচ্চিত্রের প্রচারকার্যে কোনো প্রকার বেআইনি কর্মকাণ্ড দেখা গেলে তা জেলা প্রশাসক, জেলা তথ্য অফিসার এবং সংশ্লিষ্ট থানার সহায়তায় বন্ধ করার ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়। দেশের যে-কোনো নাগরিক চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা সম্পর্কে কোনো অভিযোগ জানালে তাৎক্ষণিকভাবে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হয়। চলচ্চিত্রের সচেতন দর্শকগণের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি ও সেন্সর বোর্ডের কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ডে নতুন মাত্রা যোগ হওয়ায় বর্তমানে চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা হ্রাস পেয়েছে।
সেন্সরবোর্ডে চলচ্চিত্র বাছাইয়ের সময় সদস্যগণ ১৯৭৭ সালে প্রণীত সেন্সরশিপ অব ফিল্ম রুলস-এর ১৩নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত নীতিমালা অনুসরণ-পূর্বক সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা আইন-শৃঙ্খলা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ধর্মীয় অনুভূতি, অনৈতিক বা অশ্লীলতা, বীভৎসতা, অপরাধ, নকল প্রভৃতি দিক বিবেচনা করে থাকেন। বাংলাদেশে সাধারণত ‘সর্বজনীন’ বা ”ইউ’ (ইউনিভার্সাল) চিহ্নিত সার্টিফিকেট দেওয়া হয়ে থাকে। এ ধরনের সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র সবার দেখার জন্য যোগ্য।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে বাংলাদেশে কোনো চলচ্চিত্রেই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘এ’ কিংবা ‘এক্স’ চিহ্নিত সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না। প্রয়োজনে এ ধরনের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করা হয় অথবা ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। যেমন ২০০৭-০৮ সালে অশ্লীলতা ও বীভৎসতার কারণে সকল চলচ্চিত্রের ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। এগুলির প্রদর্শনীও বাতিল করা হয়।
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে কোনো চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক ও পরিবেশক এ উদ্দেশ্যে গঠিত কমিটির কাছে আপিল করতে পারেন।
আপিল কমিটি সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্র পুনঃপরীক্ষা করে অভিমত সম্বলিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করে। পরবর্তী পর্যায়ে সরকারি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সেন্সর বোর্ডের নিকট পাঠানো হয়।
সেন্সরবোর্ডের অনুরূপভাবেই টিভি ও ইউটিউব নাটকের জন্যও রিভিউ বোর্ড গঠণ করা যেতে পারে। যা নাটক ও ওয়েব সিরিজের জন্য সব অনিয়ম ও অশ্লীলতা দূর করতে পারে।
রিভিউ বোর্ড বলতে একটি ওয়েব-ভিত্তিক সহযোগী কোড পর্যালোচনা টুল। এমআইটি লাইসেন্সের অধীনে বিনামূল্যে সফ্টওয়্যার হিসাবে উপলব্ধ। পর্যালোচনা বোর্ড বাজার, ClearCase, CVS, Git, Mercurial, Perforce, এবং Subversion এর সাথে একীভূত হয়। রিভিউ বোর্ড Apache বা lighttpd চলমান যেকোনো সার্ভারে ইনস্টল করা যেতে পারে এবং এটি ব্যক্তিগত এবং বাণিজ্যিক উভয় ব্যবহারের জন্য বিনামূল্যে। এছাড়াও একটি অফিসিয়াল বাণিজ্যিক রিভিউ বোর্ড হোস্টিং পরিষেবা, RBCommons রয়েছে। রিভিউ অনুরোধ ম্যানুয়ালি বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পোস্ট করা যেতে পারে REST Web API অথবা Python স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে।
ন্যাশনাল বোর্ড অফ রিভিউ অফ মোশন পিকচার্স (ইংরেজি: National Board of Review of Motion Pictures) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটিতে। চলচ্চিত্র আবিস্কারের মাত্র ১৩ বছর পর চলচ্চিত্র বিষয়ক এই সংস্থাটির জন্ম। সংস্থাটির জন্মের পেছনে কারণ হিসেবে ছিলো ১৯০৮ সালের বড়দিনের প্রাক্কালে তৎকালীন নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র জর্জ বি. ম্যাকলেল্যান জুনিয়রের চলচ্চিত্র প্রদশর্নীর অনুমতি বাতিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।
মেয়র, যিনি ছিলেন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের যুদ্ধ করা এক জেনারেলের পুত্র। বিশ্বাস করতেন এই নতুন আবিস্কারটি সম্প্রদায়ের নীতির সাথে খাপ খায় না। নিজেদের মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায়, হল মালিক মারকাস লো, এবং চলচ্চিত্র পরিবেশকরা দ্য পিপল’স ইন্সটিটিউটের কুপার ইউনিয়নে একত্রিত হয়ে নিউ ইয়র্ক বোর্ড অফ মোশন পিকচার সেন্সরশিপ সংগঠনটির গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীকালে “সেন্সরশিপ” শব্দটি বাদ দিয়ে সংগঠনটির নতুন নামকরণ করা হয়, ন্যাশনাল বোর্ড অফ রিভিউ অফ মোশন পিকচার্স।
নির্মাতারা সিনেমা যেমন সরাসরি দর্শককে দেখাতে পারেন না, প্রয়োজন হয় সেন্সরবোর্ডের ছাড়পত্র।
তেমনি টিভিতে প্রচারিত নাটকগুলোও নির্মাতা সরাসরি দেখাতে পারেন না। এজন্য সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের প্রিভিউ কমিটি বা চ্যানেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগে। তবে ততটা গুরুত্ব দিয়ে রিভিউ করেন না তারা। আর অনলাইনে গান বা ভিডিও প্রকাশে এ ধরনের অনুমোদন বা সেন্সরশিপের ব্যবস্থাই নেই। নির্মাতারা এ ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ স্বাধীন। আর স্বাধীনতা যেখানে অবারিত, অপব্যবহার সেখানে অবধারিত। তাই টিভি ও ইউটিউব নাটের অরাজকতা বা অশ্লীলতা ঠেকাতে চাইলে, এক ধরনের সেন্সরশিপ সিস্টেম রাখা দরকার।
এজন্য সংস্কৃতি বা তথ্য মন্ত্রণালয়ে ‘অনলাইন কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ কমিটি’ নামে কমিটি চালু করা যেতে পারে। অনলাইনে কোনো ভিডিও ছাড়ার আগে এ কমিটিতে জমা দিতে হবে। কমিটি সংশ্লিষ্ট ভিডিওতে অশ্লীলতা, মানহানি, ধর্ম অবমাননা, রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কন্টেন্টের বিষয়টা খতিয়ে দেখবে। তাদের অনাপত্তি পেলেই কেবল ভিডিওটি অনলাইনে ছাড়া যাবে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বিটিআরসিতেও এ ধরনের একটা সেল থাকতে পারে।
পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটও বিষয়টি নজরদারি করতে পারে। তা ছাড়া ইউটিউব কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনক্রমে বাংলাদেশে ইউটিউবের একটা গেটওয়ে খোলা যেতে পারে।
‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’- এ শিরোনামে হুমায়ুন আজাদের একটা কবিতা আছে। আমাদের নাটকও একইভাবে যেন নষ্ট মুনাফাখোরদের দখলে চলে যাচ্ছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা, চলচ্চিত্রের ‘অশ্লীল যুগ’ পেরিয়ে এসেছি। এখন নাটকের জগতেও যেন ওই গ্রহণ লেগেছে। মহামারী রূপ পাওয়ার আগেই রোগটার বিনাশ দরকার। জরুরি সমাধান হিসেবে, দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ নাটকপ্রিয়। তা ছাড়া আমাদের নাটকের উচ্চমানও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত।
সময়ের আবর্তনে বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নাটক, ওয়েব সিরিজ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আমরা চাই এর চারাটি পরিশুদ্ধ হয়ে, কলঙ্ক বা আগাছামুক্ত হয়ে এ দেশে বেড়ে উঠুক। প্রতিষ্ঠা পাক, প্রকৃত ও মুক্তমনা শিল্পচর্চার সর্বোৎকৃষ্ট পাদপীঠ হিসেবে।
(তথ্য সূত্র: বাংলাপিড়িয়া, উইকিপিডিয়া, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ড, বিবিসি, নাগরিক টিভি প্রভৃতি)
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন