নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
বৌদ্ধ কথাটি এসেছে বুদ্ধ শব্দটি থেকে। সাধারণভাবে বলা যায় যাঁরা বুদ্ধের পথ অবলম্বন করেন তাঁরাই হলেন বৌদ্ধ। ‘বুদ্ধ’ এই শব্দটি আবার এসেছে ‘বোধি’ শব্দটি থেকে। অর্থাৎ যিনি বোধ বা বিশেষ জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনিই হলেন বুদ্ধ। বুদ্ধ কোনো বিশেষ ব্যক্তির নাম নয়। যিনি বোধিলাভ করেছেন তিনিই বুদ্ধ। অর্থাৎ বুদ্ধ একটি অবস্থার নাম। তবে বুদ্ধদেব বলতে সাধারণত শাক্যবংশীয় গৌতমবুদ্ধকেই বোঝানো হয়। তিনি বলে গেছেন যে বা যাঁরা অষ্টাঙ্গিক মার্গ অবলম্বনের মাধ্যমে ধ্যান সাধনায় ব্রতী হয়ে সাধনায় একাগ্রতার সঙ্গে অগ্রসর হবেন, তাঁরা সকলেই বুদ্ধত্ব লাভ করে বুদ্ধ হতে সক্ষম হবেন।
বুদ্ধ তাঁর জীবিত কালেই স্বীকার করে গেছেন তাঁর আগে বহু বুদ্ধগণ একই ভাবে ধ্যানসাধনায় সফলতার মাধ্যমে বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন। তাঁর আগে আরও চব্বিশজন বুদ্ধ ছিলেন এবং তিনি হলেন পঁচিশতম বুদ্ধ। এই কথাটি তিনি প্রথম বলেছিলেন, তাঁর পিতা শুদ্ধোদনকে। বোধলাভের পরে কপিলাবস্তুতে তিনি যখন আবার পদার্পণ ক’রে সেখানে ভিক্ষা করছিলেন, তা দেখতে পেয়ে তাঁর পিতা শুদ্ধোদন অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে বুদ্ধকে বলেছিলেন, তিনি ক্ষত্রিয় এবং তিনি এই রাজ্যেরই রাজপুত্র। রাজপরিবারের আচরিত রাজধর্ম পালন না করে তিনি কখনোই ভিক্ষাব্রত অবলম্বন করতে পারেন না, কারণ তা তাঁর বংশের আচরণীয় কোনো ধর্ম নয়। উত্তরে বুদ্ধ পিতাকে বলেন, তিনি তাঁর প্রকৃত পরিবারের ব্রতই এখন আচরণ করছেন, কারণ তিনি পৃথিবীর বুকে বুদ্ধবংশের বর্তমান প্রতিনিধি এবং তাঁদের (বুদ্ধবংশীয়দের) আচরিত রীতি ভিক্ষাব্রত পালন করছেন। তাঁর পূর্ববর্তী দীপঙ্করবুদ্ধসহ সমস্ত বুদ্ধগণ এই ভিক্ষাবৃত্তিকেই অবলম্বন করে প্রব্রজ্যায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। সেইসব বুদ্ধগণ ও তাঁর মতো প্রত্যেকে অরণ্যের এক একটি বিশেষ গাছের নীচে সাধনায় ব্রতী হয়ে বুদ্ধত্বলাভ করেছিলেন। এইভাবে বুদ্ধ জনমানসে অরণ্যের বৃক্ষরাজিদের সংরক্ষণের এক পরম মঙ্গলময় বার্তাও দেন। আমরা জানি বুদ্ধ (বর্তমান বুদ্ধগয়ার) উরবিল্ব নামক স্থানে সেনানী গ্রামের বনভূমির একটি বিশাল অশ্বত্থ গাছের তলায় বসে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
বুদ্ধের সমকাল ও তাঁর পরবর্তী সময়ের বহু বিবরণ আমরা পাই পালি সাহিত্যের সুবিশাল ভাণ্ডারে। সেখানে বহু কাহিনি ও উপকথায় ছড়িয়ে আছে সেই সময়ের সমাজ, গাছপালা, চিকিৎসা পদ্ধতি, রাজনীতি, পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জা, আচার আচরণ এবং নানাবিধ খাদ্য ও পানীয়ের কথা। বুদ্ধের জীবদ্দশায় সেইসব কাহিনিকে অবশ্য লেখা হয়নি। তখন সেসব শুনে শুনেই শ্রমণেরা যুগের পর যুগ ধরে মনে রাখতেন। পরবর্তীকালে সেগুলিকে লেখা হয়, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে সব লিখিত রূপও আবার বিচ্ছিন্ন হতে হতে একেবারে হারিয়ে যায়। অশোকের সময় বুদ্ধবচন সমূহ সিংহলদ্বীপে পাঠানো হয়েছিল থের মহিন্দ ও থেরী সংঘমিত্রার মাধ্যমে। তাঁরা সিংহলে গিয়ে সেখানকার ভাষায় বুদ্ধের বচন সমূহ সংরক্ষিত করেছিলেন। সময়টা ছিল বুদ্ধের পরিনির্বাণের আড়াইশো বছরের মধ্যে। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পাঁচশো বছর পরে বিশিষ্ট পালিভাষাবিদ বুদ্ধঘোষ সিংহলে গিয়ে সেইসব সংরক্ষিত বুদ্ধবচনের অনুবাদ করেছিলেন, তৎকালীন মগধের কথ্যভাষায়। এখন ফিরে যাচ্ছি বুদ্ধের জীবদ্দশায়। সেইসময়ের কিছু খাদ্যের বিবরণের সন্ধানে।
বুদ্ধের সমকালের খাবার
বুদ্ধ বোধিলাভের আগে সুজাতার নিবেদিত পায়সান্ন গ্রহণ করেছিলেন। পায়স গ্রহণের পরবর্তী বহুদিন তিনি নিরবিচ্ছিন্ন ধ্যানে অবস্থান করেছিলেন। আসুন সেই বিষয়ের আলোচনা দিয়েই এই প্রবন্ধের সূচনা করি। প্রাথমিকভাবে বুদ্ধের জীবনকথায় বুদ্ধের গ্রহণ করা খাদ্যসমূহ নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, বুদ্ধ বোধিলাভের আগে গ্রহণ করেছিলেন সুজাতার কাছ থেকে পায়সান্ন এবং বোধিলাভের পরে তিনি ত্রপুষ ও ভল্লিক নামক দুই বণিকের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন মন্থ ও মধুপিণ্ড। এরপর শ্রাবস্তীতে তিনি প্রায় বাধ্য হয়েই বিরুদ্ধবাদীদের চক্রান্তে তাঁর অলৌকিক শক্তির প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর সমস্ত বিরুদ্ধবাদীরা সেই শক্তির কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ হয়ে পরাজয় স্বীকার করে নেন। সেই সময় তিনি গণ্ড নামক রাজবাড়ির উদ্যানের একজন মালির কাছ থেকে একটি আম গ্রহণ করেছিলেন।
আম বিষয়ে এখানে কয়েকটি কথা বলার আছে। তখন টক ও মিষ্টি বিভিন্ন রকম স্বাদের আম পাওয়া যেত। রাজাদের পাকশালায় আমের স্বাদ পরীক্ষার জন্যও কর্মী ছিল। বিশেষ করে রাজা পসেনদি ও বিম্বিসার তাঁদের রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে আমের বাগান গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন ভালো জাতের আমগাছগুলিকে বাছাই করার পর পালন করা হত। আম বিষয়ে বুদ্ধের ভিক্ষুদের প্রতি নির্দেশ ছিল তাঁরা যেন অদত্ত কোনো ফল নিজে থেকে নিয়ে গ্রহণ না করেন। এইসব আমের বাগানগুলিকে বলা হত অম্বলঅট্ঠিক, অর্থাৎ আমগাছের চারা যেখানে পালন করা হয়। এমন অম্বলঅট্ঠিক শ্রাবস্তীতে ছিল, ছিল বর্তমান নালন্দায়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে পরে গড়ে ওঠে সেখানে বুদ্ধের জীবদ্দশায় ছিল একজন পাবারিক শ্রেষ্ঠীর আম বাগান। পাবারিক অর্থাৎ বস্ত্র ব্যবসায়ী। এমন অপর একজন পাবারিক শ্রেষ্ঠী ছিলেন চুন্দ। চুন্দের আম্রকাননে চুন্দের আতিথ্যেই বুদ্ধ জীবনের শেষ অন্ন গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া রাজগৃহে জীবকের আম্রকানন এবং বৈশালীতে অম্বপালীর আমবাগান তো বিশেষ বিখ্যাত। কারণ এই দুটিই এঁরা দুজনেই সেখানে বুদ্ধকে আমন্ত্রণ করে এনে তাঁকে দান করেছিলেন। রাজারা আমগাছের ফলের প্রকৃতি অনুযায়ী জাত বাছাই করে এসেছেন সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক কাল থেকে। তাই বর্তমানে সুমিষ্ট ফল হিসেবে আমরা এখনকার আমকে পেয়েছি। বুদ্ধ খোসা না ছাড়িয়েই দ্রুততার সঙ্গে আম খেতে পারতেন। সেই পদ্ধতিতেই তিনি গণ্ডম্বের দেওয়া আমটি খেয়েছিলেন। পরে এ বিষয়ে আলোচনা করব।
এর পরবর্তীকালের ঘটনা প্রবাহে দুর্ভিক্ষের সময় একবার বুদ্ধের ছোলার ছাতু গ্রহণের বিবরণ আমরা পাই। তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল। ভিক্ষুরা কিছুটা ভাজা ছোলা পেয়েছিলেন এবং সেটিকে তাঁরা উদ্খলের সাহায্যে ভেঙে ছিলেন এবং তা-ই বুদ্ধকে পরিবেশন করেছিলেন। এ ছাড়া উপাসকদের আমন্ত্রণে বুদ্ধ তাঁদের গৃহে পদার্পণ করে অনেক সময় যবাগূ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। দরিদ্র ও বৃদ্ধা উপাসিকা পুণ্যার (পালিতে পুঞ্ঞা; কারণ ণ্ণ এর উচ্চারণ হয় ঞ্ঞ এর মতো।) কাছ থেকে তিনি একবার গমের আটার কয়েকটি বাসি রুটি খেয়েছিলেন। সেই উপাসিকা ছিলেন অত্যন্ত গরীব, তাঁর আপনজন কেউ ছিল না। তিনি ভিক্ষা করে কয়েকটি রুটি সংগ্রহ করে বুদ্ধকে দান দিতে চেয়েছিলেন। বুদ্ধ তাঁর কাছ থেকে রুটিগুলি গ্রহণ করেছিলেন এবং রাজার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ একদিনে একাধিক জনের কাছ থেকে ভিক্ষা বু্দ্ধ গ্রহণ করতেন না।
বৈশালীর বারবণিতা অম্বপালীর নিমন্ত্রণ বুদ্ধ গ্রহণ করেছিলেন, এই নিয়েও সমাজের অনেকের ভ্রূকুটি তিনি উপেক্ষা করেছিলেন। তবে পালি লিখিত উপাদান সমূহে অম্বপালীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে সেখানে কী কী খাদ্য বুদ্ধ গ্রহণ করেছিলেন তার কোনো রকম বিবরণ আমরা পাই না। তেমনই বুদ্ধ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন মগধরাজ বিম্বিসারের, রাজপুত্র অভয়ের, কোশলরাজ পসেনদির, রাজা উদয়নের, উদয়নের পুত্র বোধি রাজকুমারের, মগধের রাজবৈদ্য জীবকের, বহু উপাসক ও উপাসিকাদের মধ্যে বিশেষ ধনশালী বিশাখা ও অনাথপিণ্ডকের আতিথ্য ইত্যাদি। এইসব ধনবান ব্যক্তিবর্গের গৃহে আমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়ে তিনি ও ভিক্ষুরা কী কী খাবার খেয়েছিলেন তার কোনো বিবরণ বৌদ্ধ কাহিনিগুলিতে নেই। তবে আজীবক ও তীর্থিক উপাসকেরা ‘শ্রমণ গৌতম’ ও তাঁর শিষ্যগণ গৃহপতিদের গৃহে আমন্ত্রণ রক্ষায় যান, এই বলে তাঁদের সমালোচনা করতেন, সে বিষয়ের কিছু কিছু উল্লেখ আছে পালি গ্রন্থাদিতে।
তখন গোত্র উল্লেখ করে কোনো ব্যক্তি বিশেষকে বোঝানো হত। এখনকার দিনে যেমন পদবী উল্লেখ করা হয়, খানিকটা তেমন। গৌতম হল বুদ্ধের গোত্রের নাম। তাই তিনি তখন পরিচিত ছিলেন শ্রমণ গৌতম অথবা শাক্যবংশীয় বলে শাক্যমুণি বা শাক্য গৌতম হিসেবে। অপরদিকে তিনি তাঁর মাসি গৌতমীর পালিত সন্তান বলেও তাঁকে গৌতম বলা হত।
বুদ্ধের সমকালে ভাত বা চালের ব্যবহার করা হত নিমন্ত্রণ বা উৎসব উপলক্ষে। ভাত ছিল বিশেষত ধনীদের খাদ্য। সাধারণ মানুষের খাবার ছিল, যব ও ছোলার ছাতু। যবচূর্ণকে জলে ফুটিয়ে তাতে নুন এবং মধু মিশ্রিত করে একরকম পাতলা পানীয় তৈরি করা হত। কোনো ভিক্ষু বহুদূর পথ পরিভ্রমণ করে এলে তাঁকে এই উষ্ণ পানীয় দিয়ে অভ্যর্থনা করা হত। এছাড়া ক্ষেতে মুগের চাষ করা হত। মুগডাল ও যবাগূ চূর্ণ গরম জলে সেদ্ধ করে তাতে নুন এবং আদা ও পিপুল শুঁঠ দিয়ে এক রকম অর্ধ-তরল পদার্থ তৈরি করা হত। যা সাধারণত দুপুরের খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হত। এটিকেও যবাগূ বলা হত। তবে এটি পানীয় নয়, খাদ্য। এছাড়া খাওয়া হত নানা রকমের শাক। জাতকের গল্পে পেয়েছি গরীব পরিবারগুলি শাক এবং শ্যামক নীবার সেদ্ধ খেয়ে বেঁচে থাকতেন। এই শ্যামক নীবার হল আজকের শ্যামা চাল। এটি এক প্রকার মিলেট। এখনকার দিনে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে এটি ধনী পরিবারগুলিতে খাদ্য হিসেবে বেশি ব্যবহার করা হয়। তখন লোনকার নামে কিছু গ্রাম ছিল সেইসব পল্লীর লোকেরা লবণ তৈরি করতেন। পাহাড়ের মাটি থেকে খনিজ লবণ কিংবা নদীর মোহনার মাটি থেকে নুন তাঁরা তৈরি করতেন। তবে চিনি বা গুড়ের ব্যবহার তখনও ছিল না। তখন খাবারকে মিষ্টি করতে মধু ব্যবহার হত।
সে সময় পশুপাখি বধ করে কেটে তার মাংস বাজারে বিক্রি করতেন ব্যাধেরা। তাদের কাছে বিভিন্ন বনের পশুপাখির মাংস পাওয়া যেত। একটি জাতকের গল্পে আছে একজন ব্যাধ বিভিন্ন অংশের মাংস বিতরণ করছেন বিভিন্ন মানুষের ভাল ও মন্দ ব্যবহার অনুযায়ী। কাউকে চামড়া ও নাড়ি, কাউকে মেটে, কাউকে বা সব থেকে সুস্বাদু অংশের মাংস তিনি বিতরণ করছিলেন। অশোকের শিলালিপিতে রাজবাড়ির খাদ্য হিসাবে নূন্যতম ব্যবহার করার জন্য ময়ূর, তিতির, হাঁস, মুরগী, হরিণ, শশক ইত্যাদি বহু প্রাণীর মাংসের বিষয়ে উল্লেখ আছে।
এছাড়া বিনয় পিটকের বিবরণে আছে একটি বিশেষ পদের কথা। যেটিকে বলা হয় কুল্মাষ। এটি সম্ভবত যব, চাল ও ডাল মিশ্রিত একটি শক্ত খাবার। হয়তো আজকের খিচুড়ির এটি একটি প্রাচীন রূপ। একটি সূত্রে আমরা দেখতে পাই ভিক্ষু সুদিন্নকে একজন দাসীর বাসি কুল্মাষ ভিক্ষা হিসেবে দান করার বিবরণ।
এছাড়া এক একটি পৃথক হাঁড়িতে ভাত, ডাল ও তরকারি সহযোগে ফুটিয়ে তৈরি করা হত আলিপাক অন্ন। তখনকার দিনে ভিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আলিপাক অন্ন গৃহপতিরা সকালে উনান জ্বেলে প্রথমেই তৈরি করতেন। খাদ্যদানকে বিশেষ পুণ্যের কাজ বলে মনে করা হত সেই সময়ের সমাজে।
জাতকের একটি গল্পে আছে একজন কৃপণ ব্যক্তির কথা। সে গরুদের জন্য রান্না করা মোটা চালের ভাত একবার বোধিসত্ত্বকে দান করেছিল। বোধিসত্ত্বের সঙ্গে দেবতারাও ওই কৃপণের বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁরা তখন বলেন যে তাঁরা এখনই ঘরের বাইরে গিয়ে গ্রামে প্রচার করবেন যে এমন মোটা চালের গরুর খাবার সে ভিক্ষায় দিয়েছে। এই কথায় সেই কৃপণ ভয় পেয়ে তাদের খাওয়ার জন্য রান্না করা শালিচালের ভাত ও ব্যঞ্জন এনে পরিবেশন করেন। এই বিবরণ প্রমাণ করে যে ভিক্ষায় খারাপ খাবার দেওয়াকে একটি সামাজিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। এবং পশুদের খাদ্য হিসেবে মোটাচালের ভাত প্রস্তুত করা হত।
বুদ্ধ নিজের অতীতের স্মৃতিচারণ করেছেন মজ্ঝিম নিকায়ের কিছু সূত্রে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন রাজপুত্র অবস্থায় যৌবনে তিনি প্রতিদিন সোনার থালায় পরিবেশিত হিমবন্তদেশের অতি সুগন্ধী পুরানো শালিধানের পলান্ন, নানাবিধ মাংসাদি, ফলমূল এবং ঘি-পক্ক বিভিন্ন রকম পিষ্টকাদি খেতেন। বুদ্ধের শেষ খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে আমরা জানতে পারি দীঘনিকায়ের মহাপরিনিব্বাণ সূত্র থেকে। পরিনির্বাণের আগে বুদ্ধের শূকরমদ্দব গ্রহণ এবং তার পরে তাঁর অত্যন্ত অসুস্থ হওয়ার ঘটনাটি একটি ঐতিহাসিক বিতর্কিত বিষয়। আপাতত এইসব ঘটনাবলীর কথাই এখানে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করব।
সুজাতার বুদ্ধকে পায়সান্ন দান:
বুদ্ধ ঊনত্রিশ বছর বয়সে কপিলাবস্তু ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলেন। যেদিন তিনি প্রব্রজ্যা নিয়ে সংসার ত্যাগ করেন সেদিনটিতেই তাঁর পুত্র রাহুল জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধের মন শিশুকাল থেকেই ছিল সংসার বিমুখ। তিনি পুত্রলাভ করার পর প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন “এবার এক রাহুর আবির্ভাব হয়েছে!” অর্থাৎ এবার আবার একটি নতুন বিপত্তির আগমন হয়েছে। সেই থেকেই পরে তাঁর পুত্রের নামকরণ হয়েছিল রাহুল। বুদ্ধ পুত্রের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে সংসারবাস করতে আর চাননি, তাই সেই দিনটিতেই সংসার চিরকালের জন্য ত্যাগ করেন তিনি। এরপর তিনি কন্থক নামক তাঁর প্রিয় অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে গভীর রাতে নগরের সুউচ্চ প্রাচীর ডিঙিয়ে বেরিয়ে পড়েন পথে। যেতে যেতে বুদ্ধের যাত্রাপথে অনোমা নদী আসে। সেখানে তিনি তাঁর সঙ্গী দাসীপুত্র ছন্নকে কন্থকের দায়ীত্ব দিয়ে নদীর অপর তীরে গভীর বনের ভেতর চলে যান। এর পরবর্তী সময়ে তিনি প্রথমে অরাড় কালাম ও পরে রামপুত্র উদ্রকের আশ্রমে কিছুদিন করে বাস করেন। পরে তাঁদের আশ্রমও ত্যাগ করে তিনি গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে নিজের চেষ্টায় ধ্যান সাধনায় বিশিষ্টতা অর্জন করে ছয় বছরের দীর্ঘ তপস্যার শেষে এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে বোধিলাভ করেন। এই দীর্ঘ তপস্যায় প্রথমদিকে তিনি তীব্র কৃচ্ছসাধন করতেন। বুদ্ধ বলেছেন সেই দারুণ কৃচ্ছসাধনের সময় তিনি গাছ থেকে ঝরে পড়া ফল কিংবা পাতা খেয়ে থাকতেন। প্রথমদিকে অন্ন গ্রহণ করতেন একটি কুলের আঁটির পরিমাণে। পরে তা আরও কমিয়ে সারাদিনে একটি যবের দানা কিংবা একটি মাত্র চাল খেয়ে থাকতেন। কিন্তু এর ফলে তিনি শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁর সুন্দর গৌরবর্ণ শরীরের রং পরিবর্তিত হয়ে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যায়। পেট পিঠের মেরুদণ্ডের সঙ্গে লেগে যায়। শরীরে কোনো মাংস ছিল না। ছিল কেবল হাড় ও চামড়া। একদিন তিনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। বহু সময় তাঁর সংজ্ঞা ছিল না। তখন তাঁর মনে হয়েছিল সাধনায় সফল হতে গেলে তাঁকে শারীরিক শক্তি হারালে চলবে না। তাই তিনি আগেকার সেই তীব্র কৃচ্ছসাধন ত্যাগ করে অবলম্বন করলেন মজ্ঝিমপন্থা বা মধ্যম-পন্থা। ফলে সাধনার শেষদিকে আবার শক্ত আহার গ্রহণ করতে শুরু করেন তিনি।
সেই সময় সেনানী গ্রামে একজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় শ্রেষ্ঠীকন্যা থাকতেন। সেনানী গ্রামের গ্রাম সীমানায় অরণ্যের পরিসীমায় একটি সুবিশাল বটগাছ ছিল। সুজাতা বিয়ের আগে সেই গাছের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যদি তিনি উপযুক্ত ধনশালী পতি এবং প্রথম গর্ভে পুত্র সন্তান লাভ করেন তাহলে প্রতি বছর একলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে এখানে এই বৃক্ষচাতালে অর্ঘ্যদান করবেন। তখন গৃহপতিরা গৃহসীমানা বা গ্রাম সীমানায় থাকা বৃক্ষদের বিশেষ শুভফলদায়ী মনে করতেন এবং বিশ্বাস করতেন প্রতিটি মহীরুহের ভেতর কোনো না কোনো দেবতা বাস করেন এবং নিজেদের মঙ্গলের জন্য তাঁরা বৃক্ষপূজার মাধ্যমে সেই দেবতার পূজা করতেন। সুজাতা নিজের মনোবাসনা অনুসারে রোজ তাঁর দুগ্ধবতী গাভীদের বিশেষ পরিচর্যা করতে লাগলেন। তিনি প্রতিদিন তাঁর গরুদের সবুজ যষ্টিমধুবন থেকে তৃণ এনে খেতে দিতেন।
বৈশাখী পূর্ণিমার দিন খুব সকালে শয্যাত্যাগ করে সুজাতা দুধ আনতে গোয়ালে গিয়ে গরুদের সামনে পাত্র রাখার সঙ্গে সঙ্গে দুগ্ধধারা আপনা থেকেই সামনে রাখা পাত্রে জমা হতে লাগল। সুজাতাকে দোহন করতেও হল না। সেই সময় কোনো বাছুরও গাভীদের সামনে আসেনি। এই ঘটনায় আশ্চর্য হয়ে সুজাতা ভাবলেন আজকে এমন অলৌকিক ঘটনা যখন ঘটেছে, তখন এই দুধ দিয়ে পায়সান্ন প্রস্তুত করে তিনি আজই সেই ন্যগ্রোধ (বট) বৃক্ষের দেবতার পুজো করবেন।
তিনি দুধ নিয়ে ফিরে এসে একটি নতুন পাত্রে দুধটুকু ঢেলে পাকশালায় গিয়ে উনানে আগুন ধরিয়ে দুধের পাত্রটি তাতে বসালেন। সেই সময় সুজাতা এক আশ্চর্য ঘটনা দেখলেন। আগুনের যথেষ্ট তাপ থাকা সত্ত্বেও দুধ কখনোই পাত্র থেকে উথলে পড়ে যাচ্ছে না, বরং দুধ জ্বাল হওয়ার সময় তা দক্ষিণমুখে পাক খেয়ে পাত্রের গায়েই এসে সঞ্চিত হচ্ছে। দুধে বড় বড় বুদ বুদ বা ফেনা হলেও এতটুকুও ধোঁয়া বের হল না। এক আশ্চর্য দিব্য সুগন্ধ নির্গত হচ্ছিল সেই সময়। জাতক নিদান কথায় আছে, সে সময় চারজন লোকপাল দেবতা উপস্থিত হয়ে সুজাতার উনানের আগুনের তাপ ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। নানা লোকের বহু দেব দেবতারা উপস্থিত হয়ে মহাপৃথিবীর চারটি দ্বীপসমূহ থেকে যাবতীয় পুষ্টিকর ও সুগন্ধী উপাদান ও দিব্য মধু এনে সেই দুধে মিশ্রিত করছিলেন। দুধে যাতে কিছু ময়লা বা ধুলো কিংবা কীট-পতঙ্গ না পড়ে যায়। সেই কারণে সেই পায়সান্নের উপরের অংশে মহাব্রহ্মা একটি দিব্য শ্বেতছত্র দিয়ে আচ্ছাদন করে রেখেছিলেন। আগুনের সরবরাহ যাতে নিরবিচ্ছিন্ন থাকে তাই দেবরাজ শক্র অন্তরীক্ষ থেকে সারাক্ষণ জ্বালানী কাঠ উনানে সরবরাহ করছিলেন। যদিও এইসব অলৌকিক দৃশ্য সাধারণ মানুষের চোখে দৃশ্যমান হয়নি এবং তাই কারো কাছে কিছু ধরা পড়েনি। তবে দিব্য সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল দূর দূরান্তে।
সুজাতা সেই ঘন অতি সুগন্ধী দুধে মধু ও চাল মিশ্রিত করে পায়স রান্না সম্পন্ন করলেন। তারপর একটি সোনার নতুন পাত্রে পায়স ঢালতে গিয়ে দেখলেন সেই পায়সান্ন এতটাই ক্ষীরযুক্ত হয়েছে যে তা একেবারে নিঃশেষে এসে সেই সোনার পাত্রটিকে পূর্ণ করে দিল। তিনি তা দেখে খুব আনন্দিত হলেন। তিনি সোনার পায়সপূর্ণ পাত্রটিকে ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে পাত্রের নীচে পদ্মপত্র রেখে পাত্রটিকে নূতন রেশমবস্ত্র দিয়ে আচ্ছাদিত করলেন। একটি ভৃঙ্গারে সুগন্ধি পানীয় জল রাখলেন এবং পদ্মপাতা দিয়ে তা ঢাকা দিলেন এবং এরপর তিনি তাঁর দাসী পূর্ণাকে (পালিতে পুণ্ণা) বললেন,
“পুণ্ণে! অজ্জ অম্হাকম দেবতা অতীব পসন্ন, ময়া এত্তকে কালে এভরূপম আচ্ছরিয়ম নাম ন দিট্ঠ পূব্বম —”
“পুণ্না! মনে হচ্ছে আমার বৃক্ষদেবতা আজ আমার প্রতি অতি প্রসন্ন। আমি আজকের মতো এমন আশ্চর্য শুভ লক্ষণ আগে কখনও দেখিনি!”
এরপর সুজাতা পুণ্ণাকে সেই ন্যগ্রোধ বৃক্ষের বেদীটি পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে রাখতে বললেন। যাতে সেখানে গিয়ে তিনি দেবতাকে পায়সান্ন ও জল নিবেদন করতে পারেন।
সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। খুব ভোরে সুখনিদ্রা থেকে উঠলেন বুদ্ধ। তিনি শেষরাতে অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখেছেন সেদিন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা বিষয়ে আচার্য বিশ্বামিত্রের কাছে বালকবেলায় বিশেষ পাঠ নিয়েছিলেন কুমার সিদ্ধার্থ। আচার্যের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন বুদ্ধিমান সিদ্ধার্থ। নিজের দেখা স্বপ্নের অর্থ তিনি উপলব্ধি করে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। স্বপ্নে তিনি দেখেছেন, তাঁর শরীরটা বিরাট হতে হতে যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। এই সুবিশাল পৃথিবী যেন তাঁর শয্যা। উত্তর মেরু পর্বত যেন তাঁর মাথার বালিশ। তিনি পূর্বের সমুদ্রকে বাঁ হাতে ধরে রেখেছেন। ডান হাতে ধরে রেখেছেন পশ্চিম সমুদ্রকে। তাঁর পা দুটি দক্ষিণের সমুদ্রের দিকে ন্যস্ত। তাঁর নাভি থেকে একটি বিশাল বৃক্ষ বেরিয়ে আকাশ স্পর্শ করেছে।
এর অর্থ তিনি উপলব্ধি করলেন যে তিনি অবশ্যই বোধি বা পরম জ্ঞান লাভ করে বুদ্ধ হবেন এবং তিনি একটি নতুন ধর্মমত জগতে প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন যা মুমুক্ষু মানুষকে শান্তির পথ দেখাবে।
এই স্বপ্নদৃশ্য বুদ্ধের মনে যাবতীয় দ্বিধা দ্বন্দের অবসান ঘটিয়েছিল। তিনি খুব ভোরে নৈরঞ্জনার তীরে গিয়ে স্নান সেরে গ্রামের সীমানায় সেই বটগাছটির বেদীতে এসে বসলেন। তখনও পাখিরা জাগেনি। পূব আকাশ লাল হয়ে এসেছে। বনভূমির বুকে প্রস্ফুটিত হয়েছে অসংখ্য শালতরুর ফুল। দিব্য গন্ধে বনভূমির বাতাস আকুল হয়ে আছে। বুদ্ধ ভিক্ষার্থে গ্রামে যাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। কারণ গৃহপতিরা তখনও ঘুম ভেঙে ওঠেননি। সেদিন তিনি অন্তিম সাধন সমরে বসার আগে সামান্য কিছু শক্ত খাবার খেয়ে নিতে চাইছিলেন। তাঁর সাধনার শক্তিতে তাঁর চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠেছিল। তাঁর সমস্ত শরীর থেকে শুভ্র আলোর মতো এক রকম জ্যোতি নির্গত হচ্ছিল।
এমন সময় সেখানে পুর্ণা বটগাছতলাটি পরিষ্কার করতে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর হাতে ছিল সন্মার্জনী ও গোবর জলের পাত্র। বুদ্ধকে দেখে পূর্ণা চমকে উঠলেন। বুদ্ধের আলোকিত উপস্থিতি ও সোনার মতো উজ্জ্বল শরীর দেখে পূর্ণা দূর থেকেই ফিরে গেলেন সুজাতার কাছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে সুজাতাকে বললেন,
“আজ আপনার দান গ্রহণ করবেন বলে সেই বৃক্ষদেবতা স্বয়ং বৃক্ষের বাইরে এসে বসে আছেন। আপনি তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে আসুন। সুজাতা তখন এই সুখবর পাওয়ার আনন্দে সেই মুহূর্তেই পূর্ণাকে দাসীত্ব থেকে মুক্তি দিলেন। এরপর সুজাতা সেই বটবৃক্ষ চাতালে গিয়ে বুদ্ধকে পায়সান্ন ও জল দান করে প্রার্থনা করলেন,
“আমার যেমন মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে, তেমন এই পায়স গ্রহণ করে আপনার মনোবাসনাও পূর্ণ হোক। বুদ্ধ সোনার পাত্রটি দান হিসেবে প্রথমে নিতে না চেয়ে সুজাতার কাছ থেকে কেবল জলের পাত্রটিই গ্রহণ করলেন। কিন্তু সুজাতা বুদ্ধকে সোনারপাত্রসহ পায়সান্ন দান নিতে অনুরোধ করলেন। বুদ্ধ এরপর পায়সটুকু গ্রহণ করলেন নৈরঞ্জনার তীরে পূর্বমুখী হয়ে বসে। তিনি ঊনপঞ্চাশবারে ধীরে ধীরে পায়সান্নটি নিঃশেষে গ্রহণ করলেন।
এই পায়সটুকুই ছিল বোধিলাভের পরবর্তী সাত সপ্তাহকাল পর্যন্ত সময়ে বুদ্ধের গ্রহণ করা একমাত্র খাবার। এই দীর্ঘ সময়টুকু তিনি শৌচক্রিয়া, অবগাহন কিংবা খাদ্য গ্রহণ কিছুই করেননি, কেবল নিরবিচ্ছিন্ন ধ্যানসুখে সেই সময় অতিবাহিত করেছিলেন।
ত্রপুষ ও ভল্লিকের বুদ্ধকে মধুপিণ্ডক ও মন্থ দান:
ললিতবিস্তরে আছে বোধিলাভের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত বুদ্ধ বোধিবৃক্ষমূলেই বসেছিলেন। দ্বিতীয় সপ্তাহে দীর্ঘ চংক্রমণ করেছিলেন। চংক্রমণ অর্থাৎ জাগ্রত অনুধ্যানের সঙ্গে ছন্দোবদ্ধ পদচারণা। এভাবে পঞ্চম সপ্তাহে প্রচণ্ড ঝড় জল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মুচলিন্দ বৃক্ষমূলে কাটিয়ে সপ্ত সপ্তাহে রাজায়তন বৃক্ষমূলে এসে বসতে তাঁর হাতমুখ ধোয়ার ইচ্ছে হল। তাঁর ইচ্ছা জাগ্রত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা ফলদান করল। দেবরাজ শক্র তাঁকে দাঁত মাজার জন্য এনে দিলেন হরীতকী ও অর্জুনগাছ ও নাগলতার ডাল। এবং অনবতপ্ত হৃদ থেকে আনলেন বিশেষ দিব্য ঔষধি মেশানো জল। বুদ্ধ হাতমুখ ধুয়ে বসতেই সে সময় সেখানে মহাপথ দিয়ে পাঁচশো মাল বোঝাই গরুর গাড়ি নিয়ে থেকে যাচ্ছিলেন উৎকলদেশের দুই বণিক। ত্রপুষ ও ভল্লিক। তাঁরা দূর থেকে বুদ্ধকে দেখে তাঁকে খাদ্যদান করতে সেখানে এলেন। এই সময় দেবরাজ শক্র বুদ্ধকে কষ্টিপাথরের ভিক্ষাপাত্র দান করলেন। তাতে দুই বণিক দিলেন মন্থ ও মধুপিণ্ডক দান দিলেন। মন্থ হল যব ও ছোলাকে ভেজে জাতায় চূর্ণ করে প্রস্তুত সেই সময়ের একটি জনপ্রিয় খাদ্য। এই খাদ্য সহজে নষ্ট হয় না। তাই এই দুই বণিক তাঁদের সঙ্গে বাণিজ্যযাত্রায় এটি নিয়ে এসেছিলেন। এবং মধু পিণ্ডক হল মধু, ঘি, চর্বি, শুকনো ফল ইত্যাদি দিয়ে পাকানো এক রকমের শুকনো লাড্ডু বা নাড়ু। এর স্বাদ মিষ্টি বলে একে মধু পিণ্ডক বলা হত।
ত্রপুষ ও ভল্লিক এই দান দিয়ে প্রার্থনা করলেন তাঁদের চিরস্থায়ী সুখ। এঁরাই বুদ্ধের প্রথম দ্বিবাচিক উপাসক। যাঁরা বুদ্ধ ও ধর্মের শরণ নিয়েছিলেন, কারণ তখনও সংঘের প্রতিষ্ঠা হয়নি। তাই তাঁরা ত্রি-শরণ গ্রহণ করতে পারেননি।
বুদ্ধের গণ্ডম্ব-আম গ্রহণ:
শ্রাবস্তীতে তীর্থিক ও আজীবকদের চক্রান্তে বুদ্ধ ও সংঘের নামে কলঙ্ক প্রচারিত হয়েছিল। এই পরিস্থিতে বুদ্ধকে অলৌকিক শক্তির পরীক্ষায় আহ্বান জানান বিরুদ্ধবাদীরা। প্রথমে শক্তি প্রদর্শনে তিনি রাজি ছিলেন না। পরে বিম্বিসারের অনুরোধে তিনি রাজি হন এবং বলেন যে তিনি শ্রাবস্তী নগরের গণ্ডম্ব নামক আমগাছের তলায় তাঁর ঋদ্ধি প্রদর্শন করবেন। এখন কোনটা গণ্ডম্ব আমগাছ তা বিরুদ্ধবাদীরা বুঝতে না পেরে শ্রাবস্তী নগরের প্রায় সমস্ত পথের ধারে থাকা আমগাছ কেটে ফেলেন, যাতে বুদ্ধ ঋদ্ধি প্রদর্শন না করতে পারেন। কিন্তু রাজার বাগানে সেদিন একটিমাত্র পাকা আম হয়েছিল। রাজার মালি সেই আমটি পেড়ে তা নিয়ে রাজবাড়ি যাচ্ছিল। পথে বুদ্ধকে দেখে সে বিশেষ মুগ্ধ হয়ে রাজাকে না দিয়ে বুদ্ধকেই আমটি দান করেন। দান করা আমটি বুদ্ধ তক্ষুণি তলায় ফুটো করে খেলেন। এরপর আমটি মাটিতে ফেলে সেখানে তাঁর হাত ধুতেই সঙ্গে সঙ্গে মাটি ভেদ করে উত্থিত হল একটি সুবিশাল আমগাছ। গাছটি ছিল পাকা আমে ভরা। বুদ্ধ বলেন, যেহেতু গণ্ড নামক মালি এসে তাঁকে এই (অম্ব) আমটি দান করেছে, তাই এই বৃক্ষের নাম দেওয়া হল গণ্ডম্ব। এখন এখানেই তিনি তাঁর ঋদ্ধি শক্তি দেখাবেন। সেদিনটি ছিল আষাঢ়ের পূর্ণিমা তিথি। সেদিনটি ছিল পরিষ্কার এক মেঘমুক্ত সন্ধে। বুদ্ধ এখানে তাঁর বিশেষ অলৌকিক শক্তি যমক-প্রতিহার্য্য দেখান। তিনি আকাশে নিজের শূন্যে ভাসমান শরীর থেকে একই সঙ্গে আগুন ও জল নির্গত করেন। এর ফলে তীর্থিকরা পরাজয় স্বীকার করে সেখান থেকে পালিয়ে যান। দর্শকেরা বিজয় উল্লাসে ও মহা আনন্দে সেই গণ্ডম্ব আমগাছটির পাকা আম খেয়ে আঁটিগুলি আজীবক ও তীর্থিকদের দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলেন।
বুদ্ধের শূকর-মদ্দব গ্রহণ:
এখন কী এই শূকর মদ্দব? বিরুদ্ধবাদীরা বলেন শূকর মদ্দব হল শূকরের মাংস। এবং সেটি ছিল পচা বা দূষিত। সেটি বেশি খেয়েই বুদ্ধের মৃত্যু হয়েছিল। আসলে তা নয়। মদ্দব অর্থাৎ রসায়ন। এই রসায়নটি ছিল লঘুপাক এবং বয়স্কদের শরীরের বলবৃদ্ধির সহায়ক। পালিতে মাংসকে বলা হয় মাংস। সুতরাং শূকরের মাংসকে হঠাৎ মদ্দব বা রসায়ন কেন বলা হবে? প্রকৃতপক্ষে পাবা নগরে চুন্দের আমবাগানে বুদ্ধ-সংঘের জন্য বস্ত্র ব্যবসায়ী বা পাবারিক শ্রেষ্ঠী চুন্দ একটি আরাম তৈরি করেছিলেন। অসুস্থ ও দুর্বল শরীরে বুদ্ধ সেখানে উপস্থিত হলে চুন্দ তাঁর শরীরের বলবৃদ্ধি দায়ক ওই শূকর মদ্দব প্রস্তুত করিয়ে ছিলেন। হ্যাঁ, বুদ্ধ পাবাতে আসার আগে ভোগনগরে থাকার সময় কঠিন রক্ত অমাশয়ে আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিছুটা সুস্থ হতে তিনি পাবাতে পায়ে হেঁটে এসে উপস্থিত হন। সাধারণত রসায়ন দেওয়া হত বৃদ্ধদের। আয়ুর্বেদ সংহিতায় আছে রসায়ন বৃদ্ধদের শরীরের ক্ষয় ক্ষতির মেরামত করে। শক্তি বৃদ্ধ করে।
অনেক ঐতিহাসিকদের মতে শূকর মদ্দব হল একরকম স্বয়ংজাত মৃতভোজী উদ্ভিদ। অর্থাৎ এক রকমের মাশরুম। এই মাশরুমের স্বাদ ছিল অতি উত্তম, এবং তা ছিল শূকর মাংসের মতো খুবই নরম এবং এটি ছিল সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর, তাই এটি একটি রসায়ন। সম্ভবত এই কারণেই এর নাম ছিল শূকর-মদ্দব। ঐতিহাসিকদের মতে এই শূকর মদ্দব সংগ্রহের সময় একই রকম দেখতে বনভূমির কোনো ভয়ানক বিষাক্ত মাশরুম সংগ্রহ করা হয়েছিল ভ্রান্তি বশতঃ। ভবিষ্যৎদর্শী বুদ্ধ সেদিন চুন্দকে ডেকে আগেই বলেছিলেন, “আমাকে পরিবেশনের পরে অবশিষ্ট শূকরমদ্দব মাটির তলায় গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে। কাউকে এই শূকরমদ্দব দেওয়া যাবে না। এমনকী কোনো পশু পাখি বা কীট পতঙ্গও যেন এটি না খায়। এই কথাটি থেকেই বলা যায় সেদিনের শূকর মদ্দবটি ছিল বিষাক্ত। বুদ্ধ সব জেনেও তা গ্রহণ করেছিলেন, কারণ এর আগেই তিনি নিজের আয়ু-সংস্কার বিসর্জন দিয়েছিলেন।
এই খাদ্য গ্রহণ করার পর তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর শরীরে শুরু হয় প্রদাহ। বিষাক্ত মাশরুমে পটাশিয়াম-সায়ানাইড থাকে এটি ছিল তারই বিষক্রিয়া। শেষরাতে শুরু হয় তীব্র উদরাময় ও যন্ত্রণা। তিনি তবুও খুব ভোরে পাবা ত্যাগ করে আরও উত্তরদিকে এগিয়ে যান। তাঁর ক্রমাগত রক্তমল নির্গত হচ্ছিল। তবুও তিনি পথ চলতে থাকেন। সঙ্গে ছিল আনন্দ। সেদিনটি ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। সেদিন সন্ধের আগেই কুশীনারা নগরের মল্লদের শালবনে এসে উপস্থিত হন তিনি। কিছুটা দূরে বয়ে চলেছিল হিরণ্যবতী নদী। সেখানে যমজ দুটি শালগাছের মাঝখানে শয্যা বিছিয়ে উত্তরদিকে মাথা করে শেষ শয্যায় আসীন হন ক্লান্ত বুদ্ধ। দীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছর ধরে তিনি ধর্ম প্রচার করেছেন। মৃত্যুর আগেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তিম সময়ে কিছু প্রশ্ন নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন তীর্থিক সন্ন্যাসী সুভদ্র। বুদ্ধ তাঁকেও ফেরাননি। সমস্ত শারীরিক কষ্ট অতিক্রম করেও বুদ্ধ তাঁকে উপসম্পদা দান করেছিলেন। তিনিই ছিলেন বুদ্ধের অন্তিম শিষ্য। এরপর শেষরাতে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ সম্পন্ন হল। তাঁর মায়িক দেহটি তিনি ত্যাগ করলেন। সম্রাট অশোক এখানে একটি স্তম্ভ নির্মাণ করে স্থানটি আমাদের বা ভাবীকালের জন্য চিহ্নিত করে গেছেন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন