short-story-songkromon

সংক্রমণ
সুমন মহান্তি


মেজবাবু হাতকাটা পল্টুকে দেখে বললেন, “বল, কী খবর এনেছিস?’’

প্রাক্তন ওয়াগন-ব্রেকার হাতকাটা পল্টু এখন পুলিশের বিশ্বস্ত ইনফর্মার। সে দাঁত বের করে হাসল, “এক্কেবারে নিরামিষ খবর, স্যার।’’

“নিরামিষটাই শুনি।”

“বাপ রিটায়ার্ড কেরানি। দাদা সরকারি চাকুরে। বালুরঘাটে থাকে এখন। ছেলেটা কাঠবেকার। লোকে বলে নাটবল্টু ঢিলে আছে। তারকাটা আইটেম। খায়দায় আর ঘুমোয়।’’

“কোনো কুকর্ম করেছিল আগে?’’

“বলার মতন তেমন কিছু নয়। বেপাড়ার এক সুন্দরী মেয়েকে প্রস্তাব দিয়েছিল। মেয়েটি নাকি ভিড়ে অনেক লোকের সামনেই চড় মেরেছিল।”

“বাজে প্রস্তাব নিশ্চয়ই?’’

পল্টু হেসে বলল, “লাভ-কেস।’’

মেজবাবু উদাস হয়ে গেলেন। সুপর্ণার কথা মনে পড়ে গেল। শহরের অনেক যুবক তার প্রেমে পাগল হয়েছিল, তিনিও সাহস করে সরাসরি বলে ফেলেছিলেন। সুপর্ণা চড় না মারলেও বিশ্রী অপমান করে বলেছিল, “নিজের দিকে তাকিয়েছ কখনো? গুন্ডার মতো দেখতে, বাপের হোটেলে খাওয়া ছাড়া কোনও কাজ করো না। কী যোগ্যতা আছে তোমার?’’

এখন আবার সেই ভুলে যাওয়া অপমান চিনচিনে ব্যথা হয়ে ফিরে এল। মেজবাবু দু’বছর বাদে পুলিশ সাব-ইনস্পেক্টরের চাকরিতে জয়েন করেছিলেন। তদ্দিনে সুপর্ণা এন. আর. আই পাত্রের গলায় মালা দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা হয়ে গেছে। মেজবাবু জানতে চাইলেন, “পার্টি-ফার্টি করে? আজকাল কীসব আর্বান নকশালের গপ্প শুনি। ভবেশ সাহা লিখিত অভিযোগে ওকে অ্যান্টিসোশ্যাল বলেছেন।’’

পল্টু আবার দাঁত বের করে হাসে, “ওটা একটা অকম্মার ঢেঁকি। বিড়ি টানে আর একা-বোকা হয়ে ঘুরে বেড়ায়।’’

মেজবাবু বললেন, “ঠিক আছে। তুই যা এখন।’’

দুপুরেই ছেলেটাকে কোর্টে পেশ করতে হবে। তার আগে একটু জেরা করে নিতে হবে। যা দিনকাল পড়েছে কিছুই হালকাভাবে নেওয়া চলে না। এসব পেটি কেসের হ্যাপা তাঁকেই সামলাতে হয়। সকালে স্থানীয় পশুপ্রেমী সংগঠন ‘পশুপ্রাণ’ থানার সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছে।

লক-আপে ছেলেটির সামনে চেয়ারে বসলেন মেজবাবু।

“অশ্রুকুমার?’’

ছেলে বলা অবশ্য অন্যায়, যুবক বলাই উচিত। অশ্রুকুমার ভয়ের চোখে তাকাল, “মারবেন নাকি?’’

“না। তবে যা জানতে চাইছি ঠিকঠাক জবাব দিবি।’’

“আপনাকে মশা কামড়াচ্ছে না?’’

“মশা?’’

“হ্যাঁ, মশার কথাই বলছি। লক-আপে মশা মারার কয়েল দেওয়া হয় না কেন? সারারাত শালারা জ্বালিয়েছে। ঘুমোতে পারিনি একটুও।’’

মেজবাবু শ্লেষের গলায় বললেন, “ভুল হয়ে গেছে। তোর মতো ভি. আই. পি-র জন্য কয়েলের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। তা বৃত্তান্তটা শুনি। হঠাৎ দুষ্কর্মের ইচ্ছে হল কেন?”

“শুনবেন?’’

“ভণিতা না করে বলে ফেল।”

“আজ্ঞ্রে, ক’দিন ধরেই ইচ্ছেটা খুব জ্বালাচ্ছিল।”

“ইচ্ছে?’’

অশ্রুকুমার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত করে বলল, “আজ্ঞে, হ্যাঁ। দু’খানা পা খুব সুড়সুড় করছিল। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। প্রাণায়াম করলাম, দশ কিলোমিটার সাইকেল করলাম, তবু সুড়সুড়ে ভাবটা গেল না। সারাক্ষণ জ্বালায়। তারপর স্যার, বুঝলেন কিনা, ব্রেনে সিগন্যাল পেলাম।”

মেজবাবু কৌতুকের চোখে তাকালেন। হাতকাটা পল্টু ঠিক খবরই দিয়েছিল, ছেলে একেবারে তারকাটা।

“সিগন্যাল?’’

“হ্যাঁ। কেউ যেন বলল, ওরে বোকা, কাউকে লাথি মারলেই সুড়সুড়ানি বেমালুম হাওয়া হয়ে যাবে।’’ মেজবাবু আমোদ পেয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন, “অমনি তুই কান্ডটা ঘটালি?’’

অশ্রুকুমার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না। প্রথমে খাতা-পেন নিয়ে হিটলিস্ট বানাতে শুরু করলাম।’’

“জঙ্গিরা যেমন লিস্ট করে?’’

“কী যে বলেন, স্যার! ঘোর সমস্যায় পড়ে গেলাম। স্কুলে ঝগড়ার সময় বন্ধুদের কাছে লাথি খেয়েছি, ফুটবল খেলতে গিয়ে পেছন থেকে লাথি, অন্য পাড়ায় ঘোরাঘুরি করার জন্য দাদাদের লাথি, জীবন একেবারে লাথিময়। কিন্তু বত্রিশ বছরের এই লাইফে কাউকে লাথি মারার কথা ভাবতেও পারিনি, সেই সাহস হয়নি। তারপর ধরুন গিয়ে প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে ল্যাং, সেটাও তো একরকম লাথি। পিতৃদেবও মাঝেমধ্যে লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেবার হুমকি দেন,’’ অশ্রুকুমার নাগাড়ে বলে সামান্য দম নিল।

“হিটলিস্টের কথা হচ্ছিল।”

“বলছি, স্যার। রেপিস্ট বাঁচানো উকিল লাহাবাবু, ঘুষখোর অফিসার ঘোষবাবু, পাঁচশো টাকা ফি নিয়ে পেশেন্টকে দু’মিনিট সময় দেওয়া ডাক্তার, প্র্যাকটিকাল মার্কসের ভয় দেখিয়ে টিউশন পড়তে বাধ্য করা মাষ্টার, টাকা ঝেঁপে বড়লোক হওয়া উঠতি নেতা কালুদা, বুঝলেন স্যার, লিস্ট করতে করতে টায়ার্ড হয়ে গেলাম।’’ “হুম।”

“লিস্ট করলেও সাহসে কুলোল না। এদের যেকোনো একজনকে লাথি মারলে উত্তমমধ্যম প্রহারে আধমরা হয়ে যেতে পারি। জেলে যেতে পারি, লাইফ হেল হয়ে যেতে পারে। হাতের কাছে খুঁজেপেতেও এমন কাউকে পেলাম না যাকে লাথি মারলে কোনো রিস্ক নেই। এদিকে স্যার পায়ের কাতুকুতু বেড়েই যায়। অস্থির লাগে, সারাক্ষণ পা চুলকোই, তেল মালিশ করি। এমন সুড়সুড়ি যে কিছুতেই ক্ষান্ত হয় না।” মেজবাবু কপট রাগে চোখ পাকালেন, “এত ভনিতা কেন? আসল কথায় আয়।’’

“ সরি, স্যার। আমাকে আবার লাথি মারবেন না যেন। ওসব অভ্যেস আপনাদের আছে কিনা!”

“পুলিশ কি নিরামিষ আইটেম যে লাথি-লাঠি মারবে না? বাবা-বাছা বলে খাতির করলে কোন মানুষ ল’ অ্যান্ড অর্ডার মানে এদেশে?’’ মেজবাবু বললেন।

“সেদিক থেকে আমি একেবারে খাঁটি অহিংস। গায়ে মশা বসলেও মারি না। নে, যত ইচ্ছে চোষ, তোদেরও বাঁচার অধিকার আছে। তাছাড়া বেকার ছেলের রুক্তের দামই বা কী আছে বলুন?’’

মেজবাবু মাথা নেড়ে হাসেন, “বুঝলাম। তারপর?’’

“ইচ্ছের মাথায় গিঁট মেরে দিলাম। শপথ নিলাম, জোড়া পা যত প্রলোভনই দেখাক না কেন লাথি মারার মতো হিংস্র কাজ করব না। শয়তানের প্রলোভনে পড়ব না।’’

“তা সেটা শেষপর্যন্ত রাখা গেল না কেন?’’

“রাখতেই তো চেয়েছিলাম। গোল বাধাল গোলা।”

“গোলা?’’

“আজ্ঞে, কুকুরটার নাম গোলা।’’

“গোলা তোর কোন ক্ষতি করেছিল?’’

অশ্রুকুমার গরগর করে ওঠে, “সাহাবাড়ির পোষা নেড়িকুত্তা হল গোলা। সারাক্ষণ আমাদের গলির রাস্তায় শুয়ে থাকে। সাহারা তাকে শুধু তিনবেলা খেতে দেয়। এমনিতে শান্ত, বিপক্ষের কুকুর দেখলে ঘেউঘেউ করে। ওটা কুকুরের স্বভাব, মানুষের মতোই ঝগড়াটে। মানুষের মতন কুকুরদের মধ্যেও এলাকা দখল আর ক্ষমতা দেখানোর লড়াই আছে।”

“ভাষণ না দিয়ে আসল কথায় আয়।”

“আসছি স্যার। একমাত্র আমাকে দেখলেই সে উঠে ঘেউঘেউ করে তেড়ে আসত। একবার তার তাড়া খেয়ে সাইকেল নিয়ে উলটে পড়েছিলাম।’’

“হুম।”

“কিছুতেই বুঝতে পারি না যে শুধু আমাকে দেখলেই ও এত ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ে কেন? কত দু’নম্বরি লোক ওর পাশ দিয়ে গটগটিয়ে যায়। ও ঘুরেও তাকায় না। শুধু আমার বেলায় ওর কেন এমন বৈষম্যমূলক আচরণ? ঠিক করলাম, এবার একটা বোঝাপড়া করে নিতেই হচ্ছে।’’

“বোঝাপড়া?’’

“হ্যাঁ, স্যার। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পড়েছেন?’’

“একটু-আধটু। ইতিহাস আমার দুচোখের বিষ ছিল।”

“দেশের স্বাধীনতার জন্য একদল আলাপ-আলোচনায় বিশ্বাসী ছিলেন, আর একদল সশস্ত্র বিপ্লবে। আমি অহিংস পথ বেছে নিলাম। কী আশ্চর্য, নিজের পাড়াতে আমার চলাফেরার স্বাধীনতা থাকবে না?” অশ্রুর চোখের পাতা কাঁপতে লাগল।

“তারপর?’’

“গতকাল সন্ধেয় যথারীতি গলিপথে হেঁটে যাচ্ছি। ব্যাটা দিব্যি কুন্ডলী পাকিয়ে চোখ বুজে আরামে শুয়েছিল। পায়ের শব্দ পেয়েই উঠে পড়ল। ঘেউঘেউ করতে করতে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠে পড়ল। অন্যবারের মতো হনহনিয়ে পালিয়ে গেলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম যে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। স্থির চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুই আমার সঙ্গে কেন এমন করিস গোলা? আমি তোর কোন ক্ষতিটা করেছি? তখন গোলা কী বলল জানেন?’’

“কী বলল শুনি?’’

“বলল যে বেশ করি, হাজারবার করব।”

“কুকুরটা এটা বলল?” মেজবাবুর চোখ কপালে উঠল, “কুকুর মানুষের ভাষায় কথা বলল?’’

“কুকুরের ভাষা আমি বুঝি, স্যার। ঝগড়াটে মানুষ আর ঝগড়াটে কুকুর তো এক ভাষাতেই কথা বলে।”

“হুম। তখন তুই কান্ডটা ঘটালি?’’

“না, স্যার। তবু অহিংস ছিলাম, মাথা ঠান্ডা রেখেছিলাম। বোঝালাম যে এটা অন্যায় হচ্ছে। গোলা আবার লেজ নাড়িয়ে ঘেউঘেউ করে উঠল। স্পষ্ট বুঝলাম যে সে কী বলল। গোলা বলল যে তুই একটা বেকার, কাঠবেকার, তোকে সম্মান কেন করব? গুরুত্বই বা দেব কেন?”

“এরকম বলল?’’ মেজবাবু মুচকি হেসে তাকালেন।

“হ্যাঁ। বললাম, এটা ঠিক নয়। খুব খারাপ হবে কিন্তু।”

“আচ্ছা!’’

“তা শুনে চোখেমুখে গোলার অবজ্ঞা ফুটে উঠল, জানেন? বলল, শালা ধম্মের ষাঁড়, তোর আবার ধমকি দেওয়া! ঘেউ ঘেউ ঘেউ,’’ অশ্রুর চোখ এবং কান লাল হয়ে ওঠে, “কী বলছে বেশ বুঝতে পারলাম। বলল যে জাতে নেড়িকুত্তা হলেও তার দাম আছে। বাবুরা তাকে আদর করে খেতে দেয়। তোকে তো বাড়িতেও খাওয়ার আগে ও পরে খোঁটা দেয়, রে। ধিক ধিক ধিক।’’

“বাড়িতে সত্যিই এমন বলে?’’

“বলে না আবার? দাদা জ্ঞান দেয় ফোনে, বউদি খোঁটা দেয় পাশ থেকে। বাবা তাল দেয়। শুধু মা মুখে কুলুপ এঁটে থাকে।’’

“আচ্ছা।’’

অশ্রু বলল, “মাথা নীচু করে চলে আসছিলাম। এবার গোলা তেড়ে পায়ের সামনে এসে ঘেউঘেউ করতে শুরু করল। বলল, পালাচ্ছিস যে! শোন, তোকে পৃথিবীর সবাই র‍্যাগিং করে এসেছে, আমিও করব। তোকে ভড়কাতে পারলে মনে সুখ পাই। ভাবুন স্যার, একটা নেড়িকুত্তার মধ্যেও স্যাডিস্টিক প্লেজার! অন্যকে অত্যাচার করে সুখ পাওয়ার শখ। পৃথিবীর এমন হাল যে রাস্তার নেড়িকুত্তাও খুঁচিয়ে আনন্দ পায়!’’

মেজবাবু ধৈর্য হারালেন, “শেষ কর তাড়াতাড়ি।’’

অশ্রু বলল, “শেষ তো হয়েই এসেছে। রেগেমেগে ধাঁই করে মারলাম এক লাথি। পায়ে আধফাটা চটি, কোনো সুরক্ষা নেই, কামড়ের ভয় জয় করে ফের লাগালাম কষে এক লাথি। এই পাতি ডরপোক কুত্তাকে এতকাল ভয় পেয়ে এসেছি! এর ঘেউঘেউ সার, কথা বেচে খাওয়া দু’নম্বরি লোকজনের রোয়াব এটা। যোগ্যতা নিয়ে কথা বলা? এম. এস. সি. পাশ অশ্রুকুমারকে অপমানের সাহস পায়? বদলা নিতেই হবে আজ। পরপর চারটা লাথি কষালাম। গোলা লুটিয়ে পড়ল। সাহাবাবুর বাড়ির লোকজন ছুটে এসে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে এল। আপনারা লক-আপে পুরে দিলেন আমাকে।’’

“পোষাপ্রাণীর ওপর অত্যাচারের কেস। ওটুকু ব্যবস্থা তো নিতেই হত। সাহাবাবু খুব ক্ষেপে আছেন। পশুপ্রেমী সংগঠন বিক্ষোভ দেখিয়েছে। যাক গে, গোলা মরেনি। পশু হাসপাতালে তার ট্রিটমেন্ট চলছে।”

“তোরও মনে হচ্ছে ট্রিটমেন্ট দরকার। কোনও সাইকিয়াট্রিস্ট না দেখালে তোর রোগ সারবে না।’’ মেজবাবু লক-আপ থেকে বেরিয়ে এসে নিজের চেয়ারে বসে থাকলেন।

ছেলেটাকে জামিনযোগ্য কেসই দেবেন। কী আশ্চর্য, তাঁর পা দুটিও এখন কেমন যেন সুড়সুড় করছে। তিনি কত অন্যায় দেখেন, কিছু করতে পারেন না, তাঁর হাত-পা বাঁধা। ছোট-বড়-মেজো নেতা, মন্ত্রী, ওপরতলার পুলিশকর্তা সব্বাই যেন হুড়মুড়িয়ে তাঁর হিটলিস্টে ঢুকে পড়ছে। ফোঁস করার উপায় নেই, গোলমেলে জায়গায় ট্রান্সফার করে দেবে। এইসব লোকেরা কেউ তাঁকে নিজের মতো কাজ করার স্বাধীনতা দেবে না কেন?

ছোঁয়াচে ইচ্ছেটাকে তাড়ানোর জন্য মুখে কড়াডোজের জর্দাপান গুঁজে ফাইলে মন দিলেন মেজবাবু।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *