হিন্দোল ভট্টাচার্য
তুমি অন্ধকারকে ভয় পাও?
অন্ধকারকে কে না ভয় পায়? তুমি পাও না? না দেখতে পেলেই তুমি ভয় পাবে। অন্ধকার, মানে সে তো অন্ধকার ছাড়া আর অন্য কেউ নয়।
কিন্তু অন্ধকার কে? শ্মশানে জমে থাকা অন্ধকার আর কবরখানায় জমে থাকা অন্ধকার এক? রাতের আকাশের দিকে তাকালে যে অন্ধকার, ঘরের ভিতরেও কি সেই অন্ধকার? নাকি আমরা সবাই একটা অন্য কিছুর ছায়ায় বসে আছি? মুখ ফিরিয়ে বসে আছে কেউ। আর তার ছায়ার মধ্যে গড়ে উঠেছে চাঁদ, পৃথিবী, বৃহস্পতি, বৃষ, মীন, সপ্তর্ষিমণ্ডল, বৃশ্চিক, কর্কট, ছায়াপথ নিয়ে তৈরি এই আকাশ। আমরা আবার সেই আকাশেই একটা ছোট্ট গ্রহে বসে আছি।
তার মানে তুমি ভূতের ভয় পাও না?
ভূত কি অন্ধকার? ভূত তো আলোতেও থাকতে পারে। কিন্তু অন্ধকার তো অন্ধকার ছাড়া আর কোথাও থাকতে পারে না।
বিকেলের এই সময়টা সুশোভন বসে থাকে পুকুরের পাশে। শহরের এই অঞ্চলে এই পুকুরটা যে এখনো আছে, তার কৃতিত্ব অবশ্য সুশোভনের বাবার, যিনি, তাঁর ঠাকুরদার আমলের এই পুকুর এবং তার সংলগ্ন ছোট্ট শিবমন্দিরটাকে একটি ট্রাস্টি করে এই দুটিকে দেবোত্তর সম্পত্তি করে গেছিলেন। এ জন্য আশেপাশের মাঠ, পুকুর শস্যক্ষেত সব বুজিয়ে উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি এবং ঝাঁ চকচকে আবাসন কমপ্লেক্স গড়ে উঠলেও, এই পুকুর এবং শিবমন্দিরটি এখানেই রয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এলাকার এম.এল.এ পুকুর এবং শিবমন্দিরটাকে রক্ষা করার জন্য চারিদিক দিয়ে উঁচু রেলিং দিয়ে ঘিরেও দিয়েছেন। বড় বড় প্ল্যাকার্ড পড়েছে, পুকুরে আবর্জনা ফেলা যাবে না, স্নান করা যাবে না, বাসন মাজা যাবে না। পুকুর এবং শিবমন্দিরটা এখন রীতিমতো একটা দেখার বিষয় এখানে।
সুশোভনের মনে পড়ে আগে এখানে পুকুরটা এত বন্দি অবস্থায় ছিল না কোনোদিন। পুকুরটার চারপাশে ঝোপঝাড় ছিল। পুকুরটার গায়ে লাগানো একটা আলপথ ছিল আর উত্তরের দিকে ছিল একটা বিরাট বড় ধানক্ষেত। এই ধানক্ষেতের অপরপ্রান্তে ছিল সরকারদের সীমানা। এখন সেই এলাকাটির নাম সরকারপুর। কবে নাম পালটে গেল তা জানা থাকলেও, সেই সরকারপুর এখন দূর থেকে দেখা যায় না। কারণ যেখানে ওই ধানক্ষেত ছিল, সেখানে এখন বিরাট একটা আবাসন। নাম সূর্যমুখী। সূর্যমুখীর দুটি টাওয়ার প্রায় তিরিশ তলা। আকাশকে প্রায় ফুঁড়ে দিয়েছে বলা যায়। টুইনটাওয়ারের পাশে দুটি মেজো টাওয়ার আছে। সেগুলিও কুড়ি তলা। যেখানে হুশ হুশ করে গাড়িগুলি চারতলায় উঠে যায়। সেখানে গ্যারেজ। কারপার্কিং। সুশোভন ভাবে ওই টুইন টাওয়ারের মাথা থেকে এই পুকুরটাকে কেমন দেখতে লাগে! নিশ্চয় একটা আয়তচক্ষুর মতো?
সুশোভনের বাবা যখন মারা যান, তখন নকশাল আন্দোলন। সরকারপুরের দিকে কেউ যেত না। মাঝেমাঝে গুলির শব্দ শোনা যেত। এখান থেকে মাত্র তিন কিলোমিটারের মধ্যেই ইস্টার্ন বাইপাস। ফলে, এলাকাটি এখান প্রায় সোনার খনির মতো দামি। সুশোভন এখনো সেই গুলির শব্দের প্রতিধ্বনি শুনতে পায়। একদল ছেলেমেয়ে কিছু একটা করতে চেয়েছিল। সুশোভনও তখন পঁচিশ বছরের যুবক। উনিশশো সত্তর সাল। এখন আশিটা বছর কাটিয়ে সুশোভনের নিজের জন্যই কষ্ট হয়। অন্তত যারা অমন একটা জীবন বেছে নিয়েছিল, তারা এক বা দুদিন হলেও বাঁচার মতো বেঁচেছিল। কিন্তু তার এই আশি বছরের জীবনে বাঁচার মতো বাঁচার জীবন কি একটি দিনও গেছে?
মুহূর্তের মধ্যে একটি একটি করে ছবি মনের মধ্যে ভেসে চলে যায়। ছোটোবেলায় যখন এই শিবকালীপুরে মেলা বসত, তখন আশেপাশের সমস্ত এলাকা থেকে লোক সেই মেলায় আসত। সে কী আর আজকের কথা? আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে যখন সুশোভন বাড়ি থেকে এক টাকা নিয়ে ছুটে ছুট্টে যেত এই পুকুরের পূর্বদিকের বিরাট মাঠটায়, সেখানে বছরের এই শেষদিকে দশ দিনের বসত এই মেলা। লোকের মুখে মুখে ফিরত শিবকালীপুরের মেলা। ওদের যে বাড়িটা ছিল এই পুকুরের ঠিক সামনেই। বেশ বড় বাড়ি। দালান ছিল প্রকাণ্ড। সেখানে সব চাষিরা এসে ধান দিয়ে যেত। ভিতরে সবসময় লোক। আর দালান ঘিরে ছিল বারান্দা। একতলায় সেই বারান্দার সংলগ্ন ঘরগুলোই ছিল বসার ঘর, রান্নার ঘর, অতিথি এলে তাদের থাকার ঘর, পড়ার ঘর ইত্যাদি। খাবার ঘরও ছিল একটা বেশ বড়। সেখানে সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খাওয়া হত সকাল সন্ধে। বাড়ি মানেই একটা জমজমাট ব্যাপার। তাও ছোটবেলায় সে শুনতে পেত তার বাবা বলছেন, এ বাড়ি জমজমাট ছিল আমাদের ছোটবেলায়। এখন যা দেখছিস তার কাছে কিছুই না। তখন ছিলাম আমরা জমিদার। এখন আমাদের অধীনে কিছু জমি আছে মাত্র। কত লোক চলে গেছে। আর আমারও কি সাধ্য আছে অত লোককে খাওয়ানোর।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টান পড়ল সবকিছুতেই। নকশাল আমলে নজর রাখা হত সুশোভনের উপর। গ্রামের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেছিল। কলকাতার কলেজে পড়লেও, সুশোভনের পক্ষে বাবার মতের বাইরে যাওয়া অসম্ভব ছিল। রোজ রাতে সে দেখতে বাবাকে এই পুকুরের পাড়ে শিবমন্দিরে পুজো করতে। তারপর তিনি এই পুকুরের পাড়েই বসে থাকতেন। সে সময় কাউকে পুকুরের ধারে যেতে নিষেধ করতেন। কেউ গেলে খুব রাগ করতেন। যখন ফিরে আসতেন চোখ লাল। মা বলত, বাবা সেখানে নেশা করতে যেত। কিন্তু বাবা তা স্বীকার করতেন না।
আজ সে বাড়ি নেই।
পুকুর আর শিবমন্দিরটা রয়ে গেছে। পুকুরের ধার দিয়ে নীল সাদা হ্যালোজেনের লাইট। সুন্দর পার্কের মতো করে রাখা। সেখানে ছোট ছোট গাছ। গাছের বনসাই। ফুলের গাছ ইত্যাদি। এলাকাটি যত সুন্দর রাখা যায়। পার্কে প্রচুর বেঞ্চ। আবাসন থেকে নেমে লোকেরা এখানে মর্নিং ওয়াক করতে আসে, ইয়ারফোন কানে জগিং করে। কেউ কেউ বেঞ্চে বসে পুকুরের দিকে তাকিয়ে একবুক বাতাস নেয়। আবাসনগুলোর বিজ্ঞাপনে বলা হয়- প্রকৃতির সান্নিধ্যে ভালো থাকার ঠিকানা। সুশোভনও এমন একটা আবাসনেই এখন থাকে। বাবা মারা যাওয়ার পর সুশোভনের ওপর আরও দায়িত্ব এসে পড়ে। কিন্তু তার পক্ষে এই চাষ ইত্যাদি সামলানো সম্ভব ছিল না।
মাঝেমাঝে মনে হয় সুশোভনের, যে জীবনে সে কিছুই করল না। এটা তখনই মন হয়, যখন তার নিজের আবাসনের উঁচু ছাদের দিকে তাকায়। আবাসনের লোকগুলো বাঙালি। কিন্তু কথা বলে ইংরিজিতে। সুশোভন এই বুড়ো বয়সেও এই কায়দা এখনো রপ্ত করতে পারল না। তার জিভে এখনো খেলুম করলুম গেলুম চলে। কিন্তু নিজে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবেই অবসর নেওয়ায় এটুকু অন্তত বোঝে, এদের বলা ইংরেজি ভুলে ভরা। কিন্তু তাদের কনফিডেন্সের দিকে তাকালে অবাক হয়ে যেতে হয়। এ যুগটাই তবে নিশ্চিত ভাবে ভুল করার? কনফিডেন্সের সঙ্গে অশিক্ষিত থাকার মধ্যে এবং সেই অশিক্ষিত থাকার বিষয়ে গর্ব করার মধ্যে একধরনের মায়াবাস্তবতা আছে। এ যেন দিবাস্বপ্নের মধ্যে ঘুম থেকে উঠে সারাজীবন দিবাস্বপ্নের মধ্যেই কাটিয়ে দেওয়া। কিন্তু সুশোভনের জীবনও কি তাই নয়? এই আশি বছর বয়সে এসে নিজের জীবনকে একটা দিবাস্বপ্ন বলেই মনে হয়। পার্থক্যটা এখানেই, এই দিবাস্বপ্ন শুধুই দুঃস্বপ্নের।
তিরিশ বছর বয়সে যখন সে বিয়ে করে অমৃতাকে, তখন সে একটা স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছে। বাড়ির একান্নবর্তী সংসারও ভেঙে গেছে। ছেলে জন্মালো সাতের দশকের শেষে। কাকা কাকিমা চলে গেল ছেলের বাড়ি নিউ ইয়র্কে। বহু মানুষ এই বাড়িতেই মারা গেল। সবাই অন্য নানা দিকে চলে গেল। জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হল সাতের দশকের শেষের দিকেই। শুধু বাড়িটা পড়েছিল সুশোভনের। অমৃতা আর পুত্র নির্বাণকে নিয়ে তার সংসার। আর ওই পুকুরটা। সাতের দশকের শেষে, আটের দশকের শুরুতে তখন আশেপাশের জমিগুলিও বিক্রি হতে শুরু করে দিয়েছে। ইস্টার্ন বাইপাস বলে একটা রাস্তা নাকি হবে। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। আর সেই রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন জমিও কিনতে শুরু করল এখানে। বাড়ি করতে শুরু করল। ছোট ছোট বাজার তৈরি হল। ঠিক যেমন গ্রামের টাউনের বাজারগুলো হয়। কিন্তু যারা কিনল তারাও বেচে দিল নয়ের দশকের গোড়ায়। প্রোমোটাররা এসে সব ফ্ল্যাট করে দিল। আস্তে আস্তে তখন পুকুরের উত্তরে সেই চাষের ক্ষেত বিক্রি হয়ে গেছে। চাষিরা তখন পার্টি করছে। কোনও কোনও চাষির ছেলেই প্রোমোটার। ঢেকে গেল দিগন্ত। তবু তখনও অল্প অল্প আকাশ দেখা যেত। কিন্তু আর কয়েক বছরের পর, যখন ইস্টার্ন বাইপাস বলে রাস্তাটাও বেশ চকচকে হয়ে উঠছে, তখন দিগন্ত সম্পূর্ণ ঢেকে গেল। শুধু দিগন্ত নয়, আশেপাশের ছোট ছোট ফ্ল্যাটগুলো ভেঙে আবার বড় বড় আবাসন হয়ে গেল। তার পরে আবার সেগুলোও বিক্রি হবে এবং সেগুলো ভেঙ্গে আরও বড় আবাসন তৈরি হবে।
এখন সুশোভন আকাশ দেখতে পায় না। যেটুকু দেখা যায় তা এই পুকুরটার জন্য। একটা মাঝারি ফ্ল্যাট পেয়েছে সুশোভন অমৃতা। অমৃতা যদিও দুহাজার দশের দিকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মরেই গেল। বেশিদিন ভোগায়নি। ছেলে তার বান্ধবী রূপুকেই বিয়ে করল দুহাজার পনেরতে। হোটেল ম্যানেজমেন্টের কোর্স করে চলে গেল বউ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া। সেখানেই নাকি থাকবে। বাবার জন্য একজন আয়া রেখে দিয়েছে। সে আসে সকাল আটটায়। চলে যায় রাত আটটায়। বাকি সময়টা সুশোভনের নিজস্ব।
সব ছিল, সব চলে গেল। এখন কিছুই নেই। শুধু খবর আছে। ছেলের দেওয়া মোবাইলে মাঝেমাঝে তার কাছে বার্তা আসে। ইস্টার্ন বাইপাস এখন খুব ব্যস্ত। শুধু তাই নয়, কিছু দূর হেঁটে গেলেই দেখা যায় মেট্রো রেলের ব্রিজ। দীর্ঘ দীর্ঘ ব্রিজ। কয়েকদিনের মধ্যেই এখান থেকে এয়ারপোর্ট নাকি যাওয়া যাবে ট্রেনেই। মানুষ খুশি। কিন্তু আকাশটা অনেকটাই ঢেকে গেছে।
তুমি এত ভয় দেখানো বন্ধ করো, তাহলেই দেখবে, তোমায় কেউ ভয় পাবে না।
পুকুরের ধারে বসে বলল সুশোভন।
হিম পড়ছে। এত সন্ধে অব্দি বসে থাকা উচিত না। নিমোনিয়া হলে এই বয়সে ভেন্টিলেটরে থেকেই মৃত্যু। ছেলেকে তো আর দেখাই যাবে না। দেহটা পোড়াতে হয়ত আসবে। কিন্তু সাবধানে থাকাই ভালো।
বুড়ো হয়ে গেছ। এত বুড়ো হয়ে গেলে চলবে?
দেখতেই তো পাচ্ছ, এলাকার উন্নয়ন হয়েছে। কত মানুষ এখানে। কাছেই হাসপাতাল। বিরাট বড় শপিং মল, সোঁ সোঁ করে গাড়ি যাওয়ার রাস্তা। ভালো লাগছে না? কিন্তু দেখো তোমার এই পুকুরটা তো আছে। শিবমন্দিরটাও আছে। সবাই দেখতে আসে। ভয় দেখাও কেন?
ভয় দেখাই না তো। আমিও তো ভয় পাই। আমি এই আলোকে ভয় পাই। এত আলো, এত রকমের আলো। আমার সারা রাত মাথা ঝিমঝিম করে।
সুশোভন চুপ করে থাকে।
আসলে কয়েকদিন আগে আবার এম.এল.এ সুশোভনের বাড়িতে এসে হাজির। বাবুয়া নামেই তাকে জানে সুশোভন। ওর বাবা ছিল সুশোভনের বাবার কাছে চাকরি করা ভাগচাষি। বাবুয়ার ভালো নাম অমিত দাস।
দাদা, কিছু একটা করুন। পুকুর তো আবার জেগে উঠেছে। এই কদিন আগে আমাকে চন্দ্র আবাসনের কয়েকজন লোক বলল, পুকুরের ধারে বেড়াতে গেছিল রাতের দিকে। একটু মালমূল চলছিল আর কী। জানেনই তো। তো, পুকুর থেকে সে উঠে এমন ভয় দেখিয়েছে একজনকে স্টেন্ট বসাতে হয়েছে, আবার মাঝরাতে নাকি পুকুরটা থেকে নানা আওয়াজ আসে। লোকে মন্দিরে পুজো দেওয়া অবশ্য বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এত পুজো করলে আর সেই সব ফুল ছুঁড়লে, তো পুকুরের জল নোংরা হবে। তাতেও পুকুরের রাগ। একজন তো তলিয়েই যাচ্ছিল পুকুরে। এসব বন্ধ করার জন্যই রেলিং দিই। কিন্তু তিনি তো কিছুই শুনছেন না। আপনার কথাই একমাত্র শোনেন। দেখুন না। পুকুরভূত যদি এভাবে ভয় দেখায় তাহলে এলাকায় আর কেউ বাড়ি কিনবে না। অনেকে বলছে কেন বাড়ি কিনলাম এখানে।
এত লোকে ভূতের ভয় পায়? অথচ এরা তো খুব মডার্ন।
মডার্ন ছাড়ুন। ওই বাইরেই। ভিতরে সেম। শিবরাত্রির লাইন দেখেননি?
দেখেছি। ভগবানে যারা বিশ্বাস করে, তারা ভূতে বিশ্বাস করবে স্বাভাবিক। কিন্তু যে তাদের ভয় দেখাচ্ছে সে ভগবান না ভূত কীকরে বিচার করল?
সে দাদা আপনিই জানেন। লোকে জানে, যে ভয় দেখায় সে ভূত আর যে ভয় তাড়ায় সে ভগবান।
ভুল জানে।
তারপরই বিকেলে সুশোভন লাঠি হাতে এই রেলিং-এর দরজা পেরিয়ে আসে পুকুরপাড়ে। অনেকদিন কথা হয়নি।
এও আজকের গল্প নয়। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগের কথা। সুশোভনের ঠাকুরদাদার ভাই। তিনি ছিলেন জমিদারদের বিরুদ্ধে। চাষিদের বন্ধু। সেই যুগের কমিউনিস্ট, যখন কমিউনিস্ট পার্টিও তৈরি হয়নি। দেশ স্বাধীন হয়নি। এখানে চাষের ক্ষেত, পুকুর আর চারদিকে জলা-জঙ্গল। জলা দিয়ে দিয়ে নাকি চলে যাওয়া যেত সুন্দরবনে। কুমির আসত। বাঘ আসত। পরে তারাও সরে গেছিল। জোয়ার এলে, জলাগুলির জলও বেড়ে যেত। সেই কমিউনিস্ট ঠাকুরদাদার সঙ্গে তুমুল ঝামেলা হয়েছিল সুশোভনের ঠাকুরদাদার, বাবার এবং আশেপাশের জমিদারদের। একদিন তিনি নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যান। কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। কিন্তু তিনি মারা গিয়েছিলেন কিনা তাও কেউ জানে না। তাঁর নাম ছিল অদ্বৈত। কিন্তু সব লোক তাকে আবু বলে ডাকত। ডাকনাম কেন আবু হল, সে বিষয়ে কিছু জানা না গেলেও, আবু নামটা এলাকাতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে। যখন কলকাতা শহরে পড়াশুনো করে বিলেত ফেরত ডাক্তার আবু ওরফে অদ্বৈত গ্রামের সাধারণ মানুষের সেবা করতে শুরু করে দেন। তার সঙ্গে সঙ্গে চাইতেন স্কুল করতে। লোকেদের মন থেকে কুসংস্কার দূর করতে। আর জমিদারের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে। মনে হত, জমিদারের সন্তান সাধারণ মানুষের এত প্রিয়, সেই জমিদার কীভাবে মানুষের কাছে যম হয়ে ওঠেন। স্বাধীনতার আগে ইংরেজদের কাছের লোক সুশোভনের ঠাকুরদা আবুকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। লোকে বলে, ছেলের বাবাকেই ছেলেকে মেরে দিয়েছে। আবার কেউ কেউ বলে, দেশ ছেড়ে চলে গেছে আবু। কিন্তু আবু কোথায় হারিয়ে গেছিল সে বিষয়ে কেউই কিছু জানে না।
সূশোভনের বাবা জানত আবু কোথায় আছে। গল্পচ্ছলে সুশোভনকে বলেছিলেন তিনি, আবু আর কোথাও যায়নি। আবু এই পুকুরেই আছে।
তুমি কী করে জানলে, আবু এই পুকুরেই আছে?
আমি জানি, এক গভীর রাতে, দেশ যেদিন স্বাধীন হল, সেদিন আবু জল থেকে উঠে এসেছিল। আমি তখন পুকুরের ধারে বসেছিলাম। দূরে প্রচুর মানুষ হল্লা করছিল। সে কী দেখতে। গায়ে শ্যাওলা, মাথায় কচুরিপানা। একটা লোক। আমি তো দেখেই ভয় পেয়ে গেছি। কিন্তু সে বলে- ভয় পেও না। ভয় পেও না। আমি তোমার দাদু হই। আমার নাম আবু। আমি বললাম, তুমি তো হারিয়ে গেছ। তখন বলল, কোথাও হারিয়ে যাইনি। আমি লুকিয়ে আছি। এই পুকুরের মধ্যে আমি লুকিয়ে আছি। লোকজনের আজ খুব আনন্দ তাই না? দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে। শোনো, খুব সাবধানে থেকো। বাবাকে গিয়ে বলবে, গণ্ডগোল হবে। ধর্মে ধর্মে গণ্ডগোল। আমি আছি। বলে, সে জলের মধ্যে হারিয়ে গেছিল।
তারপর আর আসেনি?
এসেছে, যখন বিপদ হয়েছে। তখন উঠে এসেছে জল থেকে। কিছু স্পর্শ করতে পারেনি আমাদের। কোনো অন্যায় সে হতে দেয়নি এখানে।
আবু সবসময় উঠে আসে না। আবু যে উঠে আসে, তা সব লোকে জানেও না। কিন্তু সুশোভনকে যখন প্রোমোটাররা বলেছিল এই পুকুর এই মন্দির বেচে দিতে, তখন আবু একদিন অন্ধকারে পুকুর থেকে উঠে এসে বলেছিল, সব দেবোত্তর করা আছে। লোকে যখনই এই পুকুরের কিছু ক্ষতি করতে গেছে, তখনই সে অনুভব করেছে পুকুরে কেউ আছে। আবু আর কারো সঙ্গে কথা বলে না। শুধু বলে সুশোভনের সঙ্গে। এম.এল.এ-র কথা শুনে, সুশোভন তাই বসেছিল পুকুরের পাড়ে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এমন সময় কণ্ঠস্বর শুনে সুশোভন বুঝল তিনি জল থেকে উঠে এসেছেন।
যাই হোক, তুমি ওদের এমন ভয় দেখিও না।
আমি তো ভয় দেখাতে চাইনি। কিন্তু কী হয়ে গেল বাবু।
আবু তুমি তো জানো নয়ের দশকের পর থেকেই সব গেছে। এখন মানুষ শুধু ভোগ করতে জানে।
আমি ভয় পাই। তুমি জিজ্ঞেস করলে না, আমি ভয় পাই কিনা। আমি ভয় পাই এদের। আমি ভয় পাই এই সময়টাকে। এই সময়টাকে দেখলে আমার মনে হয় দেখতে মানুষ হলেও, কেউ মানুষ নয়।
তুমি যেমন ভূত না।
আমি তো ভূত না। আমি এই পুকুরের মধ্যে ডুব দিয়েছিলাম লেঠেলদের কাছ থেকে বাঁচার জন্য। তারপর যে মাছের মতো আমি শ্বাস নিতে পারি, সে খবর আমার কাছে আগে ছিল না। প্রথমে একবুক অক্সিজেন নিয়ে আমি জলে ডুব দিয়েছিলাম। তারপর দেখলাম আমি তো দিব্যি বেঁচে আছি। অক্সিজেন ছাড়াই।
তুমি কমিউনিস্ট। তবু এখনো বেঁচে আছ। আমাদের এখানে সব কমিউনিস্ট মরে গেছে। সারা পৃথিবীতে কতজন কমিউনিস্ট বেঁচে আছে, তাই বা কে জানে।
শোনো, যদি সব কমিউনিস্ট মরে যায়, তাহলেও একজন কমিউনিস্টকে বেঁচে থাকতে হবে। আর তাই আমি বেঁচে থাকব।
কিন্তু তুমি কি আর দেখনি কীভাবে এখানে কমিউনিস্টরা মানুষের উপর অত্যাচার করেছে। ছেলের রক্ত দিয়ে ভাত মেখে খাইয়েছে মাকে।
আমি জানি। ওরা কমিউনিস্ট ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টি মানে কমিউনিস্ট না। বৌদ্ধ সঙ্ঘ মানে বৌদ্ধ না। বুদ্ধ তো অনেক দূরের ব্যাপার। তুই শুধু আমাকে খাবার দিয়ে যাস। এই পুকুরের ধারে যেমন তোর বাবা দিয়ে যেত সারাজীবন।
কিন্তু আবু, আমার বয়স আশি। এলাকার লোকজন তোমায় ভয় পায়। আমি যেকোনও দিন মরে যেতে পারি। তারপর তোমাকে কে খেতে দেবে? লোকে তো তোমার কাছেই ঘেঁষবে না। আবার তুমি ভয় না দেখালে লোকে তোমার এই পুকুরটাকে বুজিয়ে দেবে। তুমি তখন কোথায় লুকিয়ে থাকবে?
সে তো বুঝতে পারছি। আমার উভয় সঙ্কট। কিন্তু আমাকে তো বেঁচে থাকতেই হবে। পৃথিবীতে একজনও কমিউনিস্ট থাকবে না?
সুশোভন বলল, তোমার পুকুরটাকে রেলিং দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। শিবমন্দিরে লোকে পুজো দিতে আসে। পুকুরটাকে এখন আর বোজাবে না। কিন্তু তুমি কাউকে ভয় না দেখালে, আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করতে পারি।
কী?
শুনলেই তুমি রাগ করবে। কারণ তোমার কাছে ধর্ম মানে আফিম।
আফিম তো বটেই। একজন কমিউনিস্ট হিসেবে আমি সব ধর্মকেই আফিম মনে করি।
ঠিক আছে, কিন্তু বাঁচতেও তো হবে। আমি তো মরে যাব। তোমাকে তো বেঁচে থাকতে হবে, যাতে মানুষ একদিন না একদিন কমিউনিজমের প্রতি আবার আকৃষ্ট হয়। সত্যি সত্যি কমিউনিস্টদের অভাব বুঝতে পারে।
কিন্তু কীভাবে?
তোমার ভোগের ব্যবস্থা করব। তার জন্য একটা কাহিনি তৈরি করতে হবে। যাকে বলে, তোমাকে ভগবান বানাতে হবে। ভূত না। ভূতের জন্য কেউ ভোগ দেয় না। ভগবানের জন্য দেয়।
দেবতার জন্ম?
ঠিক দেবতা নয়। বলব এ পুকুরটা এক পীরের। যিনি এই এলাকাকে দীর্ঘদিন ধরে রক্ষা করেছেন। তার জন্য দুবেলা কোনও না কোনও বাড়ি থেকে এক প্লেট ভাত, মাছ তরকারি এই পুকুরের কাছে দুবেলা দিয়ে আসতে হবে। দিয়ে চলে যেতে হবে। পরের দিন ফাঁকা প্লেট নিয়ে যেতে হবে। আবার খাবার দিয়ে যেতে হবে। তা না হলে এলাকার বিপদ।
সেই তো আবার কুসংস্কার বিক্রি করবে।
আরে, আমি যতদিন বেঁচে থাকব আমিই তো দিয়ে যাব। কিন্তু আমি মরে যাওয়ার পর থেকে এমন না হলে তুমি তো খেতে পাবে না।
আমাকে জিজ্ঞেস করলে না আমি অন্ধকারকে ভয় পাই কিনা?
হ্যাঁ।
আমি ভয় পাই মনের অন্ধকারকে। একদিন সত্যি সত্যিই যদি আমি বিশ্বাস করতে শুরু করে দিই আমি পীর। আমি ভগবান। আমার তো কিছু করার ক্ষমতা আদৌ নেই। আমার কাছে এসে কেউ অসুখ সারাতে চাইলে আমি পারব না। কেউ ভালো রেজাল্ট চাইলে আমি পারব না। আমার কাছে এসে মানুষ দুঃখ দুর্দশার কথা বললে, আমি শুধু শুনতে পারব। আর কিছুই করতে পারব না। আমি পারব না কিছু করতে।
কিন্তু কেউ তো একজন থাকবে, যে শুনবে। তার জন্যও তোমার বেঁচে থাকা প্রয়োজন। তার জন্যও একজন কমিউনিস্টের বেঁচে থাকা প্রয়োজন। আজ আসি। তুমি একটু শান্ত থাক। তোমার সহ্যশক্তি আরো বাড়াতে হবে। কারণ তোমার সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলার আর কেউ থাকবে না।
চুপ করে রইল আবু।
অন্ধকার পার্ক থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে এল সুশোভন। ঘরে পৌঁছে ফোন করল এম.এল.এ-কে।
হ্যাঁ, কিছু হবে না এখন আর। তবে একটা কথা দিতে হবে।
হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন।
পীর সাহেবকে মানে পীর সাহেবের পুকুরের ধারে রোজ দু’বেলা দুপ্লেট খাবার দিতে হবে সবার আড়ালে। এলাকার লোককেও বলতে পারেন। আবার পার্টি থেকেও করতে পারেন। পরদিন এসে থালা নিয়ে যাবেন। আমি যতদিন আছি, আমি দিয়ে আসব।
নিশ্চয়। এ আর বলতে। বলছি, একটু সাহেবকে বলা যাবে?
কী ব্যাপারে?
এই আমাকে একটু দেখতে। মানে ইলেকশন তো এসেই গেল।
তিনি থাকবেন।
ফোন কেটে দিল সুশোভন।
থাকতেই হবে অদ্বৈতকে। লুকিয়ে হলেও থাকতেই হবে। যতদিন না আবার লড়াইটা শুরু হয়।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন