short-story-rosgolla-tiramisu

রসগোল্লা তিরামিসু
ইন্দ্রনীল সান্যাল


ব্রুকলিনের এই পুঁচকি ফ্ল্যাট থেকে ব্রিজটা দেখতে পাওয়া যায়। এটা বিরাট পাওনা। রোববার সকাল আটটা নাগাদঘুম থেকে উঠে পঁচিশ বছরের মিলি মুখার্জি শোওয়ার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ব্রুকলিন ব্রিজ দেখতে পেল। রোববার সকালে দেরিতে ওঠার বিলাসিতা করাই যায়। কারণ গতকাল সারাদিন খেটেখুটে সে গোটা সপ্তাহের জমে থাকা বাড়ির কাজ সেরেছে। কাপড় কাচা,ইস্ত্রি করা,ঘর পরিস্কার,সাপ্তাহিক বাজার— সব কমপ্লিট।

নিউ ইয়র্ক শহরের পাঁচটি বরো বা সরকারি জেলার মধ্যে সব থেকে জনবহুল বরো হল ব্রুকলিন। অফিস যেতে আসতে অনেকটা সময় চলে যায়। অফিসের কাজও অনেক। ওই দিনগুলোয় তাই নিজের জন্যে সময় বার করা মুশকিল। সেই জন্যে পড়ে থাকে সপ্তাহান্ত। এখানকার বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে সে অনেকবার উইকেন্ড কাটাতে এদিক সেদিক চলে গেছে। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। তার কারণ এ দেশে আসার পরে জাঙ্ক ফুড আর বিয়ার খেয়ে,একটানা অফিসে বসে কাজ করে ওজন বেড়েছে দশ কেজি। মিলিকে এখন দৃশ্যত মোটা বলে মনে হয়।

দেশে থাকার সময়ে মিলি জানত ‘অপুষ্টি’মানে নাইজেরিয়া আর ইথিয়োপিয়ার হাড় জিরজিরে বাচ্চা। এখানে এসে জানল,আমেরিকার ওজনদার আম আদমিও অপুষ্টির শিকার। সেই অপুষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজেও ঢুকে যাবে, এটা ভাবতেই পারেনি।

বাগবাজারের যৌথ পরিবারে বড় হওয়া, বাগবাজার মাল্টি পারপাস স্কুলে পড়াশুনো করা, প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় ভাল ফল করে দেশের অন্যতম প্রধান কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার সায়েন্সে ডিগ্রি অর্জন করা—গোটা প্রক্রিয়ার সময় মিলি ছিল দেশলাই কাঠির মতো রোগা। মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম দশজনের মধ্যে স্থান লাভ করার পরে টিভি থেকে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সেই এ-ভি ক্লিপ এখনও আছে। তখনকার আর এখনকার মিলির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত।

যাক গে! ওসব ভেবে লাভ নেই। মিলি জাঙ্ক ফুড খাওয়া বন্ধ করেছে, অ্যাপার্টমেন্টের একতলায় যে জিমটা আছে সেখানে যোগ দিয়েছে। আগামি এক বছরের মধ্যে সে দশ কেজি ওজন কমিয়ে আগের মতো ছিপছিপে হবে। হবেই! ব্রুকলিন ব্রিজের দিব্যি!

তবে বাঙালি তো! খাওয়া দাওয়া কি আর বন্ধ করা যায়?ওজন কমানোর চক্করে তার একটা নতুন প্যাশন তৈরি হয়েছে। ব্রুকলিনের ফ্ল্যাটে সে বাড়ির রান্নারিক্রিয়েট করার চেষ্টা করছে।

কলকাতায় থাকার সময় এসব করার কথা মিলি স্বপ্নেও ভাবেনি। বাড়িতে মা আর জেঠিমাআছেন। তাঁদের ওপরে আছেন ঠাকুমা— যাকে ‘ঠাম্মা’বলে মিলি। হেঁসেলে তাকে কেউ ডেকে পাঠায়নি,সেও যায়নি। প্রতিটি মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত,বাঙালি বাড়িতে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে একই ছবি। পড়াশুনোর পাট চুকিয়ে যারা বাড়ির ভাত খেয়ে আপিস করে, তারা ভাগ্যবান। বাকিরা বেঙ্গালুরু, নয়ডা, গুরুগ্রাম গিয়ে অথবা ইউএসএ, ইউকে-র শহর বা মফস্‌সলে গিয়ে হাড়ে হাড়ে বোঝে ‘বেসিক লাইফ স্কিল’না-শেখার সমস্যা। এদেশে থাকতে গেলে গাড়ি চালানোর পাশাপাশি ঘর সাফ করা, কাপড় কাচা,রান্না করা এবং বাসন মাজা বাধ্যতামূলক।

সপ্তাহের কাজের দিনগুলোর জন্যে কেজো রান্না চমৎকার পারে মিলি। তবে রোববারের ব্যাপার আলাদা। সে দিন বাড়ির রান্না! দেশের রান্না! দেশে কবে ফিরতে পারবে তার ঠিক নেই। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর দুরাশায় মা,জেঠিমা বা ঠাম্মার রান্না রাঁধছে মিলি। গত সপ্তাহেও সে রোববার লাঞ্চের জন্যে ভাত আর ডালের সঙ্গে আলু পোস্ত রাঁধার চেষ্টা করছিল। পোস্তটা ঠিক হয়নি। কেন কে জানে! আজ দেখা যাক।

শেফের এপ্রন পরে কাজ শুরু করল মিলি। একঘন্টা পরে ঘেমেনেয়ে একশা হয়ে ঠাম্মাকে ফোন করল।

আশি বছরের বুড়ির জ্ঞান দিব্যি টনটনে। নাতনির কাছ থেকে আইফোন উপহার পেয়ে সবার আগে ‘ফেসটাইম’করা শিখেছেন।

ঠাম্মার ফোনে রিং হচ্ছে…




ঠাম্মা ফোন ধরে দেখলেন যে মিলি গোলাপি ট্র্যাকস্যুট পরে,একহাতে একবাটি আলুপোস্তআর অন্য হাতে একটা ফর্ক নিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ফোনটি খাবার টেবিলে দাঁড় করানো আছে। মিলি দেখল যে ঠাম্মা সাদা শাড়ি পরে বাগবাজারের বাড়ির দালানের আরামকেদারায় বসে হাতে রাখা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

প্যানে গলতে থাকা মাখনের মতো উষ্ণ গলায় ঠাম্মা বললেন,“কী হল, রে?”

“আলু পোস্ত রাঁধার চেষ্টা করছি। কিন্তু পোস্তটা কিছুতেই ঠিকমতো বেটে উঠতে পারছি না।” কাঁদো কাঁদো গলায় পোস্তর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সময় মিলি বাটি থেকে একটা আলু ফর্কে গেঁথে ঠাম্মাকে দেখাল।

ক্যামেরার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ঠাম্মা হাসছেন। “আমার জৈবনে পোস্ত ছিল গরিবদের খাবার। এখন আর তা নেই। কী দাম! বাপ রে! আজকাল আবার এই বাড়িতে অ্যাভোকাডো টোস্ট খাওয়ার ধাস্টামো চালু হয়েছে। যেমন বাজে খেতে তেমন বাজে দেখতে। তুই যখন পুঁচকি ছিলি তখন ওই রকম সবুজ-সবুজ ‘অ্যা’ করতিস।”

মিলি ওয়াক তুলে বলল,“রান্না নিয়ে কথা বলার সময় পটির আলোচনা চলবে না। তুমি আমাকে বলো,পোস্তর পেস্টের টেক্সচার ঠিক হচ্ছে না কেন?”

“পোস্ত, পেস্তা, পেস্তো, পাস্তা…” ভাবছেন ঠাম্মা! “একই হরফ! কত খাবার! এটা কখনও ভেবেছিস। আচ্ছা তুই যে পেস্তোর কথা বলেছিল ওটা যেন কী?”

“পেস্টো একরকমের সস। ঠাম্মা, বাজে না বকে প্লিজ হেল্প মি!”

“ওকে!” ইংরিজি শব্দ ভাণ্ডার থেকে একটি শব্দ বার করে ঠাম্মা বলেন,“বাড়িতে শিলনোড়া আছে?”

“কাম অন ঠাম্মা!” চোখ পাকায় মিলি। “এটা কলকাতা নয়! হ্যান্ড ব্লেন্ডার বা মিক্সার-গ্রাইন্ডার আছেদিয়ে কাজ হবে?”

“হবে বই কি! তুই কি পোস্ত ওই মেশিনে বেটেছিস?”

“হ্যাঁ! কিন্তু সেই টেক্সচারটা আসছে না।”

“মিক্সির যে কৌটোয় পোস্ত বাটছিস, ওতে একটু গরম জল মিশিয়ে দে। তারপরে কিছুক্ষণ ঘোরা। হয়ে যাবে। তবে খুব মসৃণ করিস না।”

“তাই?” বলে মিলি। “আচ্ছা ঠাম্মা, তোমাকে ম্যাক অ্যান্ড চিজের রেসিপিটা বলেছিলাম। ট্রাই করেছ?”

“ছানা দিয়ে নুডল রান্নার কথা বলছিস তো?”

“কাম অন ঠাম্মা! ওটা চিজ!”

“তোর বাপ নিউ মার্কেট থেকে ব্যান্ডেল চিজ নিয়ে এসেছে। রাতে ম্যাক আর চিজ খাবে সবাই। একটু পরে আমিই রাঁধব। তবে পেস্ট বানানোর সময় একটু কাসুন্দির তেল দেব। আর মাখনে এক চিমটে পাঁচফোড়ন দেব।”

“ম্যাক অ্যান্ড চিজে পাঁচফোড়ন? তোমাকে হাতে পেলে সাহেবরা খুব পিটবে!”

“কোনও সাহেব বয়ফ্রেন্ড হয়েছে নাকি? ফোন ঘুরিয়ে দেখা তো! আমি ওকেও শিখিয়ে দেব।”

“তুত!” লজ্জা পেয়ে ফোন কাটে মিলি।

এই ভাবেই সপ্তাহ কাটে, মাস কাটে, বছর চলে যায়। মিলি দশ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলে আবার আগের মতো। এখানকার বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে তার যোগাযোগ কমেছে। কারণ তার জীবনে একটি প্রেম এসেছে। ইতালিয়ান-আমেরিকান ছেলেটির নাম মারিও। সে মিলির সহকর্মী।

এক বছর পরে, রোববার সকালের কুকিং ক্লাসে নাতনিকে লুচি ভাজা শেখানোর সময় ঠাম্মা বললেন, “গত সপ্তাহে তুই যে পিপুফিশুর রেসিপি বলেছিলি…”

“পিপুফিশু না!” আর্তনাদ করে মিলি, “তিরামিসু!”

“ওই একই হল!” মিলির প্রতিবাদ উড়িয়ে দিয়ে ঠাম্মা বলেন, “ওইটা নিয়ে আমি একটা পরীক্ষা করেছি। আজ রসগোল্লা তিরামিসু বানিয়েছি!”

“হায় হায়!” কপাল চাপড়ায় মিলি, “তুমি আমার বয়ফ্রেন্ডের বুক ভেঙে দিলে।”

“তোর বয়ফ্রেন্ড কি ইতালিয়ান?” ফিক করে হাসেন ঠাম্মা। “কই! দেখি আমার নাতজামাইকে!”

মিলি লজ্জা পেলেও আইফোন তাক করল মারিওর দিকে। আজ না হয় কাল কথাটা বলতেই হত। ঠাম্মাকে সবার আগে বলাই নিরাপদ। ঠাম্মা বুঝিয়ে বলবে বাবামাকে। মিলি যে আর দেশে ফিরবে না, সেটা সবাই জানে। এবার এটাও জানুক যে সে একজন ইতালিয়ানকে বিয়ে করছে। লিভ ইনের কথা জানার দরকার নেই।

ঠাম্মা থেমে থেমে বললেন, “ফুলকো লুচি ভেজে বরকে খাওয়ানোর জন্যে একটা সিক্রেট রেসিপি লাগে। সেটা কী জানিস?”

“কী গো?” প্রশ্ন করে মিলি।

“মারিওর প্রতি ভালবাসা তো লাগবেই। তার সঙ্গে এক চিমটি দুষ্টুমি মেশাতে হবে। না হলে লুচি ফ্ল্যাট হবে। জীবন হোক বা লুচি, কোনও কিছুই ফ্ল্যাট হলে ভাল লাগে না।”

মিলি একগাল হেসে বলল, “মনে রাখব ঠাম্মা!”




“আমি যে ব্লু-বেরি প্যানকেকের রেসিপি পাঠিয়েছিলাম, সেটা ট্রাই করেছ?”রোববারের এক সকালে মারিওর সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার সময় পূর্ণগর্ভা মিলি প্রশ্নকরল ফেসটাইমে। কপাল ভাল যে রোববার সকালে লেবার পেন শুরু হয়েছে। কাজের দিনে হলে মারিওকে পাওয়া যেত না।

খুঁটিয়ে মিলিকে দেখে এক গাল হেসে বললেন, “বিয়োতে যাচ্ছিস?”

“ঠাম্মা! মুখে একটু আগল দাও!” আপত্তি করে মিলি।

“মারিও ওসব বুঝবে না।” মুখ ঝামটা দেন ঠাম্মা, “হ্যাঁ! ওটা করে সবাইকে খাইয়েছি। তবে একটু মটিফাই করেছি।”

“মটিফাই নয়। মডিফাই!” ধমক দেয় মিলি।

“তোর বাপ মেপ্‌ল সিরাপ এনে দেবে বলেছিল। আনার নামটি নেই। রোজ বলে ভুলে গেছি। আমি বাধ্য হয়ে নলেন গুড় দিয়ে ব্লু বেরি প্যানকেক বানিয়েছি।” গর্বের সঙ্গে বলেন ঠাম্মা, “অবশ্য ব্যাটারে একটু নারকেল কোরাও দিয়েছিলাম। যাতে মানিকজোড় হয়।”

“ঠাম্মা! ওটা আর প্যানকেক নেই। সব রান্নায় একটা অথেনটিসিটি থাকে। পিঠে আর প্যানকেক এক নয়। ব্লু বেরির জন্ম এক জায়গায় আর নলেন গুড়ের জন্ম অন্য জায়গায়। এটার সঙ্গে ওটা মিশিয়ে দিলে যে ফিউশান হয়, সেটা সব সময় ভাল হয় না।” আর কথা বাড়াল না মিলি। হাসপাতাল এসে গেছে।

সুস্থ, সবল এবং গোলাপি পুত্রসন্তান নিয়ে নাজেহাল মিলির ফোনে সকালবেলা একটি অডিও ক্লিপ এল। মিলির বাবা পাঠিয়েছেন। তাতে ঠাম্মা বলছেন, “নাতির ছেলের ছবি আর ভিডিও দেখলাম। কিন্তু জ্যান্ত ননীর পুতুলকে নিয়ে বোধ হয় নাড়াঘাঁটা করা হবে না। আমার শরীর আর টানতে পারছে না।”

থমকাল মিলি। আবার শুনতে লাগল। ঠাম্মা হাঁফাতে হাঁফাতে বলছেন,“নাতির নাম কী রাখলি?আমার ইচ্ছে, ওর নাম হোক রসগোল্লা তিরামিসু!”

ধ্যাত! হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলে মিলি। আজ ভোরেই বাবাফোন করেছিলেন। ঠাম্মা গতকাল রাতে ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন। কোনও কষ্ট পাননি। এখন তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া তোড়জোড় চলছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিলি ভাবল, দেশের সঙ্গে যে কয়েকটা বন্ধন ছিল, তার একটা কেটে গেল। চোখ বন্ধ করে সে দেখতে পাচ্ছে বাগবাজারের লাল ইটের বাড়ি,ধোঁয়াটে রান্নাঘর, মা-জেঠিমার হুড়োহুড়ি, ঠাম্মার নজরদারি, বাবা-জেঠার আপিস যাওয়ার তাড়া, ভাইবোনদের দুষ্টুমি, স্কুলে নিল ডাউন হয়ে থাকা…

চোখের জল মুছে মিলি ভাবল,পরিযায়ীদের জীবনে সব রান্নারই এক মাত্র গোপন উপকরণ হল ছেড়ে আসা দেশের প্রতি টান!



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *