লালন সাঁই – রবীন্দ্রনাথ: সংগীতচিন্তা পরম্পরা
এমরান হাসান
ফকির লালন সাঁইজির অধিকাংশ বাণীতে ধর্ম সমন্বয়, আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধতা, জাতিভেদ ও ছুঁৎমার্গের প্রতি ঘৃণা ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর আদর্শ ও জীবনাচরণের কোনো অমিল পাওয়া যায়নি। ধর্মের বাহ্যিক আচার—অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা সোচ্চার। অপরদিকে প্রাণহীন অসার বস্তু, অনৈসর্গিক বা অতিপ্রাকৃত শক্তির তুলনায় মানবীয় কর্ম ও মহিমাকেও তাঁর গানে অনেক বড় করে দেখিয়েছেন তিনি। তাঁর এই মানবমহিমাকীর্তন সেই যুগে দুর্লভ ছিল এমন কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। শ্রেণি-বর্ণ বিভক্ত ধর্মীয় আচার-শাসিত সমাজে ছুঁৎমার্গ, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ যে প্রবল সামাজিক ও মানবিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তার বিরুদ্ধে লালন সাঁই সবসময়ই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ভেদনীতির বিরুদ্ধে সদর্পে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর বক্তব্য। সে সময় হিন্দু—মুসলমানের সামাজিক বিরোধ তো ছিলই, সাধনার পথে অগ্রসর হয়ে তিনি দেখলেন এখানেও রয়েছে ভেদ-বিরোধ। সাধনার রীতিনীতি আর ফলাফল সবই বিভক্ত। এক ধরনের বিরক্তিবোধ থেকেই লালন সাঁই উভয় মতের দিকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গেয়ে উঠেন:
ফকিরি করবি ক্ষ্যাপা কোন রাগে?
আছে হিন্দু—মুসলমান দুই ভাগে
ভেস্তের আশায় মমিনগণ
হিন্দুরা দেয় স্বর্গেতে মন
ভেস্ত—স্বর্গ ফাটক সমান
কার বা তা ভালো লাগে
ফকির লালন সাঁইজির দর্শন, বাণী ও সংগীতচিন্তা বাংলার অনেক কৃতী মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এই মনীষীর সময়কালে যাবতীয় নিপীড়ন, মানুষের প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা বিদ্যমান সমাজ, প্রগতি ও বিকাশের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি তাঁর বাণীর মাধ্যমে সকল কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দার্শনিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিলেন তাঁর অনেক গানে। পাশাপাশি তাঁর শিষ্যরাও এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন মানুষের কোনো ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বা জাত বিশেষণ নেই। তিনি সাধনার মাধ্যমে সহজ সরল ভাষায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন চলমান অন্ধবিশ্বাস আর মনুষ্য ভেদাভেদকে, যে কারণে তাঁর বাণীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বহু লেখক, সাহিত্যিক, সম্পাদক ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। তবে রবীন্দ্রনাথই এই দর্শন দ্বারা তৎকালে সর্বাপেক্ষা প্রভাবিত ছিলেন এমন মন্তব্য করাই যায়। লালন সাঁইজির বাণীর ভাবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গানের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। লালনের গানে যে অপৌত্তলিক গূঢ় আধ্যাত্মিকতার রহস্যময় ভাব আছে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মদর্শনের কিছু মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। সেটাই এক সময় তাঁকে লালন সম্বন্ধে উৎসাহিত করে। রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র লালন সাঁইজির দর্শনের উঠোনে বিচরণই করেননি, এর অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছেন। বাউল সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আন্তরিক অনুরাগের কথা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, কবিতায় বাউল—প্রসঙ্গ ও দর্শন উঠে এসেছে। যেমন ‘অভিসার’ কবিতাটির কথাই ধরা যাক-‘কে এসেছ তুমি ওগো দয়াময় / শুধাইল নারী, সন্ন্যাসী কয় / আজি রজনীতে হয়েছে সময়, এসেছি বাসবদত্তা’’
প্রাণের গভীরে গিয়ে আঘাত করে এই কবিতার মর্মবাণী। আবার তাঁর আত্মজৈবনিক কবিতাতেও বাউলচেতনার সঙ্গে একাত্মতার পরিচয় ঘোষিত হয়েছে:
তরুণ যৌবনের বাউল
সুর বেঁধে নিল আপন একতারায়
ডেকে বেড়ালে
নিরুদ্দেশ মনের মানুষকে
অর্নিদেশ্য বেদনার খেপা সুরে।
(পঁচিশে বৈশাখ)
লালন সাঁই’র মনের মানুষকে রবীন্দ্রনাথ নিজেও খুঁজেছেন নিজের মনোভূবনে। ক্রমশ তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন ‘রবীন্দ্র-বাউলে’। বাউলগানের ভিন্ন ভিন্ন সুর, বাণী ও তত্ত্বকথা একদিকে তাঁকে যেমন আকৃষ্ট করেছিলো সেই সময়ে, অপরদিকে তেমনি তিনি প্রভাবিত হয়েছেন বাউলের বেশভূষায়ও। বাউলদের আলখাল্লা রবীন্দ্রনাথের অনন্য এক মানস—প্রতীক হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রমানসে বাউল প্রভাবের মূলে রয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত লালনচর্চা ও লালন শিষ্য—সম্প্রদায়ের সাহচর্য। এ কথা অকাট্য সত্য যে, শিলাইদহে অবস্থানকালে তিনি লালন সাই’র গান সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে লালনের গানের খাতা আনিয়ে ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী বামাচরণ ভট্টাচার্যকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ২৯৮টি গান নকল করিয়ে নেন। এই খাতা সম্পর্কে লালনগীতির সংগ্রাহক মতিলাল দাশকে লালন সাই’র পরম স্নেহভাজন শিষ্য ভোলাই শাহ বলেছিলেন- ‘দেখুন, রবিঠাকুর আমার গুরুর গান খুব ভালোবাসিতেন, আমাদের খাতা তিনি নিয়া গিয়াছেন, সে খাতা আর পাই নাই, কলিকাতা ও বোলপুরে চিঠি দিয়াও কোনো উত্তর পাই নাই’।
লালন সাঁইজির যে দুটি গানের খাতা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আসেন নিজের সঙ্গে সে খাতাগুলো শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত রয়েছে, যার আখ্যাপত্রে লেখা- ‘Songs of Lalan Fakir – Collected by Rabindranath’. দুটি খাতায় মোট গান সংখ্যা ২৯৮১৩২২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন থেকে মাঘ অবধি, প্রবাসী পত্রিকার হারামনি বিভাগে রবীন্দ্রনাথ লালন সাঁইজির মোট কুঁড়িটি গান প্রকাশও করেন। ১৯২৫ সালে ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসে তিনি অনুবাদ করে শোনান লালনবাণীর একাংশ—
Nobody can tell whence the bird unknown
Comes into the cage and goes out
I would feign put rounds its feet
The fetter of my mind
Could I, but capture it.
খুব সম্ভবত লালন সাঁইজির গানের এটিই প্রথম ইংরেজী অনুবাদ। এই বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন;
‘That this unknown is the profound reality, though difficult of comprehension, is equally admitted by the English poet as by the nameless village singer of Bengal, in whose music vibrate the wing beats of the unknown bird, only ShellyÕs utterance is for cultural few, while the Baul song is for the tillers of the soil, for the simple folk of our village households, who are never bored by its mystic transcendentalism’.
উপরের মন্তব্যে রবীন্দ্রনাথ পদকর্তা হিসাবে কোথাও লালনের নাম ব্যক্ত করেননি, তাঁকে ‘Nameless village singer’ বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ১৯২৫ সালের বক্তব্যে তিনি লালন সাঁইজির বাণী অনুবাদ করেছিলেন,অপরদিকে বাউল বস্তুবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অবহিত ছিলেন তার প্রমাণ ১৯৩১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত তাঁর ‘Hibbert lecturers – Bauls of bangal’ —শীর্ষক বক্তব্য।১৯৩১ সালে এই দীনহীন সন্ত—বাউলদের মানবধর্ম বিষয়েই তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এই বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
‘The human body, despised by most other religions, is thus for them the holy of holies, wherein the divine is intimately enshrined as the man of the heart. And in this wise is the dignity of man upheld by them.’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে তাঁর চেতন এবং অবচেতন মনে শুধু যে লালনের গানের সুরকেই জুড়েছেন তা-ই নয়, তিনি তাঁর রচিত গানের অনেক ক্ষেত্রে অনেক বাউলগানের বাণীর অন্তর্নিহিত ভাবকে গ্রহণ করেছেন নিঃশঙ্কচিত্তে। রবীন্দ্রনাথের গানে বাউলদর্শন, বিশেষ করে বাউলগান ও রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই প্রধান আলোচ্যরূপে লালন—প্রসঙ্গ ফিরে ফিরে আসে। এই বিষয়ে একটি কথা মনে রাখা জরুরি যে, বাউলদর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে সখ্য তা মূলত লালন সাঁইজি’র গানের মাধ্যমেই। রবীন্দ্র—মানসে হয়ত আর কোন বাউল লালন সাঁইজির মতো এত বেশি প্রভাব ফেলতে পারেননি। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ লালন সাঁইজির বাণীর অন্তর্নিহিত ভাববোধ থেকেই প্রবলভাবে জ্ঞানপ্রাপ্ত, আত্মপলোব্ধি প্রাপ্ত হয়েছেন। লালন সাঁইয়ের বাণী ও সুরের ভাব-ভাষা, শব্দ-দর্শন সবকিছুই তিনি আস্তিকরণ করেছেন নিজের মতো সন্তর্পনে। তিনি লালন সাঁইজির অনেক গানের অন্তর্দর্শনকে ধারণ করে নতুন গান রচনা করেছেন এবং সেগুলো যে স্পষ্টতই রবীন্দ্র-বাউলের রচনা এ মন্তব্য নির্দ্বিধায় করা যায়।
লালন সাঁইজির বাণী তথা বাউল গান—বাউল দর্শনের মূল সুরকে বলা যায় আত্মতত্ত্ব সন্ধানী সুর। বাউল শিরোমণি লালন সাঁইজি সারাজীবন নিজেকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। বাউল দর্শনের মূল সুরই হল নিজেকে জানো, নিজেকে চেনো। এই নিজেকে জানা ও চেনার মধ্য দিয়েই বাউলেরা সেই মনের মানুষ, আরেক মানুষ, অধর মানুষের খোঁজ করে ফিরেছেন। বাউল দর্শনের আদিপবের্র প্রথম পাঠই হচ্ছে আমি কী? আমি কে? এবং আমি কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে সাধনার পথে চলা। এই আদি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বাউলেরা ব্যাকুল সর্বদা। এই প্রশ্নের উত্তর তাঁরা খুঁজে বেড়িয়েছেন আপন দেহ—জরিপের মধ্য দিয়ে। এইদিক থেকে বিবেচনা করলে বাউলগানকে দেহ—জরিপের গান বললেও ভুল বলা হবে না। এই মানবদেহের বাইরে তাঁরা আর কোনো কিছুতেই আস্থা রাখেননি, রাখতে চাননি। এজন্যই নিজের দেহকে জরিপ করে এর আড়াল—আবডালের আগম—নিগম খবর জেনে সেই পরমের সঙ্গে লীলাভরে বাস করার সাধনায় বাউল মত্ত থেকেছেন, আত্মহারা হয়ে ফিরেছেন। আর তাঁদের এই ব্যাকুল মনের অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে তাঁদের গান, তাঁদের দর্শনের মধ্য দিয়ে। বাউল নিজেদের জীবনাচারের কথা বলতে গিয়ে, নিজেদের আপ্ততত্ত্বের নিগূঢ় চিন্তার কথা বলতে গিয়েই গান করেছেন, একতারাতে সুর বেঁধেছেন। তাই বাউলের গান দেহজরিপের গান, বাউলের গান আত্মতত্ত্ব, আত্মদর্শনের গান এবং সে কারণেই বাউলের গান শুধু গীতিকবিতাই নয়, এটি একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জীবনদর্শন, ধর্মদর্শন, জীবনাচারের অবিসংবাদিত সংবিধান।
রবীন্দ্র-বাউল তাঁর হৃদয়ের একতারাতে যে মধুর সুরব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে নিজের অন্তরাত্মায় এক গভীর বোধের তোলপাড়ের সৃষ্টি করেছিলেন সে কথা সর্বজন বিদিত। ব্যাকুল আক্ষেপে বারবার তাঁর প্রাণের সেতারে বেজে উঠেছিল এক মহাজাগতিক সুর। লালন সাঁইজি বাণীর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের এই যে আত্মোপলব্ধি,তা অপরূপ ব্যাকুলতার বহিঃপ্রকাশ যা বুদ্ধ দর্শনের ‘আত্মং বিদ্ধিং’ এরই প্রতিবিম্ব। দু’জনেই তাঁদের মনের মানুষ এবং জীবনদেবতার সন্ধান করতে গিয়ে হৃদ—দুনিয়ার পাহাড় জঙ্গল চষে বেড়িয়েছেন, কিন্তু কোথাও তাঁকে খুঁজে পাননি। অবশেষে তাঁরা তাঁদের নিজের দেহের মধ্যে, নিজের মনের মধ্যে সেই অসীম অধরাকে উপলব্ধি করে চরম পুলক অনুভব করার কাজটি করেছেন। এই উপলব্ধি দর্শনের,হৃদয়ের ভালোবাসার, হৃদয়ের অভিন্ন সাধনার উপলব্ধি। এই একটি জায়গায়ই ফকির লালন সাঁইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব। রবীন্দ্রনাথ এই ভাবনায় মাতোয়ারা। এই উপলব্ধির ভেতর দিয়েই বুঝতে পারা যায় যে কত অমূল্য মানব জীবনের উপলব্ধ এই ভাববোধ! লালন সাঁইজির একটি পদে প্রকাশ পেয়েছে এভাবে-
‘এমন মানব জনম কি আর হবে
মন যা কর ত্বরায় করো এই ভবে’
একই উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথের লেখায়ও প্রকাশিত হয়েছে অবলীলায়:
‘জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ
ধন্য হলো ধন্য হলো মানব জীবন জীবন।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে যখন এই উপলব্ধি আসে তখন হয়তো তাঁর আবারো অধরা—অচেনা সেই বাউল জীবনের কাছে ফিরে যাওয়া জরুরি মনে হয়। তিনি হয়তো তখন আপন মনে, আপন ধ্যানে সেই পরম মানুষকে উপলব্ধির ভেতর দিয়ে তাঁর সঙ্গে মহামিলনের আকাক্সক্ষা করেন। রবীন্দ্র—বাউলের মরমের তারে তারে তাই সেই একই বিশ্বাস, একই আবেগ, একই অনুভূতি, একই দর্শনের সুর—লহরি ভেসে উঠেছে। আপন ঘরের এই ‘আমি’ সত্য ও মূর্ত হয়ে ওঠে আপনার মাঝে আলেক মানুষের বিকাশের চরম পর্যায় হিসেবে এটিই লালনের দর্শন,বাউলের দর্শন। এখানে সবকিছুতে ‘আমি’ই সত্য হয়ে ওঠে। আমার আপনার মাঝেই সেই পরমতত্ত্ব ভর করে নিজেকে পূর্ণতা দান করে জগতে প্রকাশ করেছে। নিজের বাণীতে যেমন ফকির লালন সাঁই বলেছেন:
‘আমি সত্য না হইলে গুরু সত্য হয় কোনকালে
আমি যেই রূপ দেখ না সেই দীন দয়াময়’
রবীন্দ্র-বাউলের গানেও এই বোধ-চিন্তা প্রকটভাবে ধরা পড়ে ‘আমি’র আড়ালে সেই অজানা মানুষ যে নিজেকে প্রকাশ করার খেলা খেলেছে জগতে, আমার চোখ দিয়েই সেই নিরূপ পরম যে জগৎকে দেখার ছল করেছেন—এই কথাটিই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন তাঁর অনেক লেখায়।
লালন এবং রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি সাক্ষাৎ নিয়ে গবেষকগণের মধ্যে মতভেদ থাকলেও রবীন্দ্র-মানসে লালনদর্শন তথা বাউলদর্শনের প্রভাবের কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আবার রবীন্দ্র-লালনের মুখোমুখি সাক্ষাতের ব্যাপারটি যে একেবারেই ঘটেনি এমনটি বলাও দুঃসাধ্য তবে অসম্ভব নয়, কারণ রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ সালের শেষের দিকে জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসার পূর্বে ১৮৭২ এবং ১৮৭৫ তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শিলাইদহে এসেছিলেন এবং এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের দেখা হয়েছে বলে অনেক গবেষক দৃঢ়ভাবেই তাঁদের মত ব্যক্ত করেছেন। লালন সাঁইজির প্রথম জীবনীকার শ্রী বসন্ত কুমার পাল রবীন্দ্রনাথের কাছে এই বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত জনিত সহযোগিতা চেয়ে চিঠি লিখলে তার জবাবে কবির পক্ষে তাঁর একান্ত সচিব সুধীর চন্দ্রকর কতৃর্ক ১৯৩৯ সালে লিখিত পত্রে রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি স্পষ্টভাবে না হলেও স্বীকার করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বিষয়টি একেবারে আড়াল না করেই তাঁর একান্ত সচিব সুধীর চন্দ্রকর শ্রী বসন্ত কুমার পাল মহাশয়কে লিখেছিলেন-
‘কবি আপনার চিঠি পেয়ে সুখী হয়েছেন। আপনাকে এই মহৎ কাজে সাহায্য করতে পারলে তিনি আরো সুখী হতেন সন্দেহ নাই। ফকির সাহেবকে তিনি জানতেন বটে কিন্তু সেতো বহু দিন আগে; বুঝতেই পারেন এখন সে সব সুদূর স্মৃতির বিষয়, তাঁর মনে তেমন উজ্জ্বল নয়। তবে তিনি বললেন, কলকাতায়, ‘লালবাংলা’ ২০ নং মে ফেয়ার, বালিগঞ্জ, এই ঠিকানায় শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় থাকেন, তিনিও ফকির সাহেবকে জানতেন, তাঁর কাছে খোঁজ করলে অনেক বিষয় আপনার জানবার সুবিধা হতে পারে।’২
এই পত্রে ঠিক কোন বিষয়টি পত্রলেখক আড়াল করে গেলেন আর কেন-ই বা আড়াল করে গেলেন তা সচেতন এবং অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মগজে সহজ-অনুয়মেয় বলেই ধরে নেয়া যায়। আরো একটি তথ্যবহুল ঘটনা এখানে যুক্ত করা সমীচীন হবে বোধকরি। শচীন্দ্রনাথ অধিকারী তাঁর লেখায় বলেছেন:
‘সেদিন রবীন্দ্রনাথ ভোরে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে একতলার আপিসঘরে নিজ টেবিলের সামনে বসে লেখাপড়া করছেন। ঘরের মধ্যে একধারে দু—তিন খানা বেঞ্চ প্রজাদের বসবার জন্য পাশাপাশি সাজানো রয়েছে। এমন সময়ে একদল প্রজা এসে তাঁকে সেলাম দিয়ে সসম্ভ্রমে তাঁর সামনে নজরানা ধরে দাঁড়াল। রবীন্দ্রনাথ তাদের বসতে বললেন। তারা সেই বেঞ্চগুলোর উপর বসল। এই প্রজারা গোরাই নদীর পরপারে কুষ্টিয়ার নিকটস্থ ছেঁউড়িয়া গ্রামের অধিবাসী। তারা প্রায় ষোল—সতের জন এসেছে বাবুমশায়ের কাছে জমিজমার দরবার করতে। বাবুমশাই শিলাইদহ সদর কাছারির ম্যানেজার (নায়েব) বাবুকে ডেকে পাঠিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। পরে ম্যানেজারবাবু এলেন তাঁর কাগজপত্র নিয়ে। খুব দরবার হল। দরবার শেষ হতে বেলা প্রায় এগারটা বাজল। প্রজারা সার বেঁধে দুলাইনে বেঞ্চে বসেছিল। তাদের সবার পেছনে বসেছিল একজন বৃদ্ধ। তার কোনই দরবার ছিল না এমন কি, তার কোনরকম বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্যও ছিল না। সে শুধু নীরবে সেই তিন—চার ঘণ্টা ধরে দুটি চোখ ভরে রবীন্দ্রনাথকে দেখছিল তাঁর মুখের কথা শুনছিল চুপটি করে। বৃদ্ধের গায়ের রং বেশ ফরসা, গায়ে—মুখে বসন্তের দাগ, মাথায় লম্বা চুল ঝুঁটি করে বাঁধা। মুখে পাকা লম্বা দাড়ি, নারদ ঋষির মত। চেহারাখানা বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত। রবীন্দ্রনাথ কয়েকবার তার সেই সৌম্য বিহ্বল মুখখানার দিকে চাইলেন, কিছু বলবার বা শুনবার জন্যও যেন উৎসুক হলেন; কিন্তু প্রজাদের দরবারের গোলমালে সেই অজানা অচেনা মানুষটির কোন পরিচয়ই নেবার সুযোগ পেলেন না। তিন—চার ঘণ্টা দরবার করে তারা যেমন দল বেঁধে এসেছিল, তেমনি দল বেঁধেই চলে গেল।
রবীন্দ্রনাথ স্নানাহারের জন্য দোতলায় চলে গেলেন। এদিকে নিচের তলায় তাঁর ছেলেমেয়েরা মহা কলরবে খেলা করছে। স্নানাহার সেরে এসে তিনি শুনতে পেলেন একতলায় ছেলেমেয়েদের হাস্য—কলরব ক্রমে বেড়েই চলেছে। ব্যাপার কি আজ ছেলেমেয়েদের এত হাস্য—কলরবের কারণ কি?
ঠিক এমনি সময়ে তাঁর বড় মেয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস হাতে নিয়ে সকৌতুকে হাসতে হাসতে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, মেয়ের হাতে একটি লাঠি, কিন্তু কী অদ্ভুত সেই লাঠি! আজকালকার ছড়ি নয়, সেকালের গ্রাম্য লাঠি। তেলে—জলে পেকে লাঠিটা ঘোর কালো কুচকুচে। লাঠিটার হাতল সাপের মুখের মত বাঁকা, নানারকম কারুকাজ করে সেটাকে হুবহু সাপের আকৃতি দেওয়া হয়েছে। ছেলেমেয়েরা সবাই তাঁর চারদিকে দাঁড়িয়ে তাদের কৌতূহল মেটাবার জন্য তাঁকে নানান রকমের প্রশ্ন করতে লাগল। কী অদ্ভুত লাঠি! ছেলেমেয়েরা এমন জিনিস কখনও দেখেনি। তারা প্রশ্নের পর প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথকে ব্যস্ত করে তুলেছে। মানুষের হাতের লাঠি এমন অদ্ভুত কেন? কী রহস্যের আবরণে কোথা থেকে এই অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্য খচিত লাঠিটি শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে এসে হাজির হল! রবীন্দ্রনাথ চাকরদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কার লাঠি?’ কিন্তু চাকর—দারোয়ানেরা কেউ ঐ অপরূপ লাঠির হদিশ দিতে পারল না। রবীন্দ্রনাথ নিজেও দস্তুরমত কৌতূহলী হয়ে পড়েছেন, তাঁর হাতে আজ হঠাৎ এ কার অভিজ্ঞান এসে পড়ল, এ কোন্ অচেনা—অজানার স্মরণ—চিহ্ন! হযরত মিঞা নামে ছেঁউড়িয়ার একজন বরকন্দাজ বলল, ‘হুজুর, এ লাঠি আমাদেরই গ্রামের লালন সাঁই ফকিরের’, রবীন্দ্রনাথ সেই বিখ্যাত ফকিরের নাম শুনেছিলেন, কিন্তু কোনদিন চোখে দেখেননি। হযরত বরকন্দাজ বলল, ‘আমি জানি হুজুর, ঐ লাঠি লালন ফকিরের। আজ সকালে ছেঁউড়ের প্রজারা দরবার করতে এসেছিল। তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই লালন ফকির ছিল।’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘লালন ফকির এসেছিল? বলিস্ কি? কিন্তু সে আমার সঙ্গে একটা কথা বললে না আমায় কেউ তাকে চিনিয়েও দিলে না?’ সকালবেলাকার সেই সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধের চেহারাখানা রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে গেল। তিনি ফকিরের ঐ সুন্দর অপরূপ লাঠিখানা নেড়ে নেড়ে দেখলেন, সাঁইজির এই অভিজ্ঞান যত্ন করে নিজের কাছে রাখলেন। হুকুম দিলেন, ‘একজন আমলা গিয়ে কাল সকালেই যেন ছেঁউড়ে থেকে লালন সাঁইকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে।’ হুকুম তামিল হল। তার পরের দিন বিকালে ঐ সাপমুখো লাঠির মালিক বৃদ্ধ লালন সাঁই ফকির এলেন রবিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। সৌমমূর্তি বৃদ্ধ মরমি কবি, মুখে লম্বা পাকা দাড়ি, হাতে সুন্দর একটি একতারা, যেন দেবর্ষি নারদ এলেন বীণা—যন্ত্রটি হাতে করে রাজার সভায় নিমন্ত্রিত হয়ে। লালনের সঙ্গে এলেন তাঁর একজন প্রিয় শিষ্য। পল্লীকবি লালন সাঁইজির সঙ্গে বরীন্দ্রনাথের আলাপ—পরিচয় জমে উঠল। জমিদার রবীন্দ্রনাথ নিমেষে কবি রবীন্দ্রনাথে পরিবর্তিত হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ আলাপ—আলোচনার পর সাঁইজি একতারা বাজিয়ে গাইলেন-
‘আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ির কাছে আরসি নগর, তাতে এক পড়শি বসত করে।’৩
লালন সাঁইজির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে প্রচ্ছন্ন প্রমাণ এখানে এটুকু বিশ্বাস করতে সহায়তা করে যে রবীন্দ্রনাথ ও লালনের মধ্যে মুখোমুখি সাক্ষাৎ নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে তা অনেকাংশেই অযাচিত এবং অহেতুক। কিন্তু এই বইয়ের পরের এক সংস্করণে শচীন্দ্রনাথ এই মত ফিরিয়ে নিয়ে পাদটীকায় মন্তব্য করেন, এই সাক্ষাৎ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সেজোদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। এ বিষয়ে তিনি এক চিঠিতে (৪/১১/১৯৭০) লালন গবেষক ড.আবুল আহসান চৌধুরীকে জানান-
‘লালন ফকিরের সম্বন্ধে ‘পল্লীর মানুষ রবীন্দ্রনাথ’—এ যে ফুটনোট আছে, তা সত্যি। উপেনবাবু তাঁর ‘বাংলার বাউল ও বাউলগান’—এ বলেছেন যে, লালনের মৃত্যু ১৮৯০ খ্রি. ১৭ই অক্টোবর ১১৬ বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথ ঐ সময়ে জমিদারীর ভার পাননি; তাই সাক্ষাৎ হয়নি ধরা যেতে পারে। তবে আমার ঐ কাহিনি অসত্য নয়, কারণ যার কাছে শোনা… সে ছেঁউড়েরই বুড়ো, সে বাজে কথা বলার লোক নয়। রবীন্দ্রনাথের স্থানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হবেন, কারণ ঐ সময়ে জ্যোতিবাবু ঘনঘন শিলাইদহ যেতেন ও থাকতেন। তাঁকেই প্রজারা ‘বাবুমশাই’ বলত।’
অপরদিকে লালন সাইঁজির প্রথম জীবনীকার বসন্তকুমার পাল—এর ‘মহাত্মা লালন ফকির’ বইয়ে ‘প্রকাশকের নিবেদন’—এ অজিতকুমার স্মৃতিরত্ন উল্লেখ করেছেন-নিরক্ষর পল্লীবাসী হইতে আরম্ভ করিয়া আমরা শুনিয়াছি জ্ঞানবৃদ্ধ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ফকিরের সহিত ধম্মর্ালাপ করিয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছেন। শিলাইদহে মহাকবি রবীন্দ্রনাথের সহিত প্রথম যেদিন তাঁহার ভাবের বিনিময় হয় তাহা জাহ্নবী—যমুনা মহামিলনের ন্যায় রসোচ্ছ্বাসের সঙ্গমতীর্থ রচনা করে।’
রবীন্দ্রনাথ জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে আসার পূর্বে বিলেতে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য, এ তথ্য হয়তো কারো অজানা নয়, অর্থাৎ কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত পরিবারে জন্ম ও শৈশব পেরিয়ে যৌবনে বিলেতের অতি আধুনিক পরিবেশের স্বাদ ও সান্নিধ্য পেয়েও হাল সংস্কৃতির রবীন্দ্রনাথ চলে আসেন কুষ্টিয়াতে পারিবারিক নির্দেশে এবং জমিদারীর দায়িত্ব পালনের উদ্দেশে। তিনি তাঁর জীবনের প্রায় বিশ বছর পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, শাহজাদপুর এবং পতিসরে অতিবাহিত করেন। এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের চেতনার জগতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়। হাল সংস্কৃতিতে লালিত কবি রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে রবীন্দ্র—বাউলে পরিণত হন। প্রেম ও প্রকৃতির কবি ধীরে ধীরে ঈশ্বর কেন্দ্রিক এবং সবশেষে মানবকেন্দ্রিক হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের এই বাউলদর্শন ও রবীন্দ্রনাথের পারস্পরিক বোধ লেনদেনের সম্পর্ককে এক কথায় এভাবে বলা যায় – ফকির লালন সাঁইজি বাউলদর্শনের সূচনা করেছিলেন মানুষ-ভজনা দিয়ে আর রবীন্দ্রনাথ সেই মানুষে এসেই থেমেছেন। লালন সাঁইজির বাউলদর্শন রবীন্দ্রনাথের চেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ‘হারামণি’র ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ১৩৩৪ সালে বিষয়টি এভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন:
‘আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সবর্দাই দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হ’ত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগ রাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হ’য়ে মিশে গেছে।’ [মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন (সম্পাদিত); হারামণি, ৫ম খণ্ড; ‘আশীর্বাদ’ পৃ. ক]
একটি কথা নির্জলা সত্য যে, রবীন্দ্রজীবনের বিশ বছরের এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের সব ধরনের রচনা, গান, কবিতা, গল্প, নাটক সবই বাউল-দর্শন এবং বাউল-ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত। এই কথা সর্বজন বিদিত যে রবীন্দ্রনাথের সুবিস্মৃত সাহিত্যকর্মের এক উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁর গান। এই গানের অধিকাংশ বাউল দর্শন এবং বাউল গানের কথা ও সুরের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে পড়েছে। তাঁর প্রায় ৬৬টি গান বাউল সুরের আঙ্গিকে রচিত। স্বদেশি যুগে রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিও বাউল গান, গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে / আমার মনের মানুষ যে রে’—এর হুবহু সুরে রচিত।
ফকির লালন সাঁইজির বাণীতত্ত্বের ভাব—দর্শন গ্রাম—বাংলার অনেক লেখক—কবিকেই আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ এসবের বাইরে ছিলেন না। তিনি লালনদর্শন ও সংগীতের বাইরের বলয়েই বিচরণ করেননি শুধু, নিশাচরের মতো গোপনে তার অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছেন, শুষে নিয়েছেন ‘আত্মনিধি’র সবটুকু সুর। লালন সাঁইজির বোধ—ধ্যানকে আপন সত্তায় ধারণ করে নিজেকে ধন্য করেছেন। তাঁর এই প্রেরণা আর লালন তথা বাউলদর্শনের মিলন ছিল একই সুতোয় গাঁথা। তাই হয়তো লালন সাঁইজির ‘মনের মানুষ’ তত্ত্বের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’র মিল সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। লালন সাঁইজির বাণীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জগৎচিন্তা, মানববাদী জীবনচেতনাকে অনুভব করেছিলেন, খুঁজে পেয়েছিলেন। বাউলের গান আর সহজ—সাধনার ভাব একসময়ে রবীন্দ্রমানসে নিবিড়ভাবে মিশে গিয়েছিল। বাউলের এই যে ভাবধারা যা রবীন্দ্রনাথ নিজের অন্তরে ধারণ করেছিলেন। এসবের কেন্দ্রেই ছিলেন ফকির লালন সাঁই। এই মরমি, আধ্যাত্মিক সাধকের প্রভাব রবীন্দ্রমানসে ও লেখায় গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।
মানবগোষ্ঠী যে এক ও অখণ্ড, তারই আভাস দিয়েছেন লালন সাঁই অনেক গানেই। তৎকালে লালন সাঁইজির আচার—আচরণ ও কথাবার্তা দেখে—শুনে সমকালীন মানুষ ধাঁধায় পড়েছিল তাঁর জাতিত্ব নিয়ে, এমন প্রমাণ মেলে বিদ্বদজনের লেখায়। জাতগর্বী সেই মানুষগুলোর কাছে জাতি পরিচয়ই ছিল মানুষের বড়। লালন সাঁইজি বহুবার নিজের জাত নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন বিভিন্নভাবে। সাম্প্রদায়িক জাতিতত্ত্বে অবিশ্বাসী লালন সাঁই পাল্টা প্রশ্নও ছুঁড়ে দিয়েছেন প্রশ্নকর্তার দিকে। তাঁর এই জীবনদর্শনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লালন সাঁইজির জীবনদর্শনে একাত্ম হয়েছিলেন। জমিদার, কবি রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্র—বাউল। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে রূপান্তরিত করেছিলেন লালনদর্শনের আরেক প্রতিমূর্তি রূপে। লালন সাঁইজির বাণীর মতো এতটা নিগূঢ় না হলেও রবীন্দ্রনাথের গানও এক সময় দেহজরিপের গানের খুব ঘনিষ্ঠজন হয়ে আত্মতত্ত্বের খোঁজে আকূল আকুতি হয়ে ধরা পড়েছিল। রবীন্দ্র—ভাবনায় আরো উজ্জ্বল হয়ে প্রকাশ হয়েছে লালন সাঁইজির অন্তর্দৃষ্টি, অন্তর্দর্শন। আপন দেহের ভেতর স্রষ্টা-অন্বেষণের ব্যাকুলতা।
বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর নন কেননা অন্যান্য সবার মতই তাঁর সাহিত্যও কারো না কারো সৃষ্টিশীল কর্ম দ্বারা কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত এই কথা নির্জলা সত্য এবং এই কথা অস্বীকার করার কোন পথ কারো নেই। শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রেই নয় এই কথাটি সকল সাহিত্যিক শিল্পী তথা সকল ক্ষেত্রে সৃজনশীল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। একটি বিষয় খুব সহজভাবে মেনে নেওয়া উচিত যে প্রভাবমুক্ত কোন সাহিত্য কোনদিন কখনো কোনকালেই সৃষ্টি হয়নি। হতে পারে সেই প্রভাব পরোক্ষভাবে সময়ের, সমাজের, মরমীবাদের, আধ্যাত্মবাদের, নৈরাজ্যবাদের। পৃথিবীর সকল সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই কারো না কারো দ্বারা প্রভাবিত। অপরদিকে লালন ফকির তো মৃত্তিকাবর্তি মানুষের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যিনি তাঁর সমগ্র জীবনে গেয়ে যাওয়া গানগুলোর ভেতর কেবল প্রশ্নই করে গেছেন, কেবল গূঢ়তাত্ত্বিক দর্শনই দিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর যাপিত জীবনের জাতিভেদ, তাঁর সময়ের সামাজিক বৈষম্য এসব নিয়েই রচনা করেছেন শত শত গান। সঙ্গে যুক্ত করেছেন মরমীবাদ, আধ্যাত্ম্যবাদ। তাঁর চিন্তা, তাঁর দর্শন আজও বোধসম্পন্ন মানুষের ভেতর চরম আঘাত করে যায় সময় এবং সভ্যতার প্রয়োজনে।
বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার অনিবার্য এই দুই প্রবাদপুরুষ তাদের রচনা দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের আঙিনা।সময় এবং সভ্যতার শ্রেষ্ঠচিন্তক হিসেবে লালন সাঁই এবং রবীন্দ্রনাথ বাংলাসাহিত্য আঙিনায় দুই আলোকবর্তিকা।
তথ্যসূত্র:
১.ডক্টর মতিলাল দাশ [ফেব্রুয়ারি ২০০৮], ‘লালন ফকিরের গান’, লালনসমগ্র, [আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত], পাঠক সমাবেশ, ঢাকা। পৃ ৭৪১
২.আবুল আহসান চৌধুরী [২০০৭], লালন সাঁইয়ের সন্ধানে, পলল প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ:৭৩
৩.শচীন্দ্রনাথ অধিকারী [জানুয়ারি ১৯৬৪], ‘শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ’, জিজ্ঞাসা, কলকাতা। পৃ:১৬৬—১৬৭
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন