micro-story-ardhangini

অর্ধাঙ্গিনী
সুমেধা চট্টোপাধ্যায়

 

সুটকেস থেকে গমরঙা জামদানিটা বার করল অনুশ্রী। আজকের এই গল্পপাঠের অনুষ্ঠানটা অনুশ্রীর জীবনের অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল। সঙ্গে অনেকবার বলেছিল আকাশকে আসতে, কিন্তু দুর্ভাগ্য! ওর কলেজের একটা ছোট অ্যাসেসমেন্ট পড়ে গেল। আকাশ ছাড়া অনুশ্রীর এখন আর তেমন বন্ধু নেই। এই একটাই কাজ জীবনে অনুশ্রী করতে পেরেছে। একমাত্র ছেলের বন্ধু হয়েছে। ফ্লাইটে ওঠার আগে সি-অফের সময়ে আকাশ জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “কোনও অসুবিধা হবে না, মা৷ ইউ উইল রক! ওখানে গিয়ে আমাকে নিয়ে ভাববে না একদম। ‘মি টাইম’ কাটাবে। আমি ঠিক থাকব।” কথাগুলো গল্পপাঠে যাওয়ার আগে মনে পড়ছিল অনুশ্রীর। ‘আমাকে নিয়ে ভাববে না, একদম’। এই কথাটাই কানে বাজছিল। ছেলেকে নিয়ে ভেবে ভেবেই কত যে সন্ধে নষ্ট হয়েছে অনুশ্রীর। এমনকী গৌতমের সঙ্গে আশান্তির সূত্রপাতও তো এই আকাশকে নিয়ে ওভারথিংকিং থেকেই। সারাক্ষণ আকাশের পড়াশুনো নিয়ে ভাবত অনুশ্রী। নিজেদের সম্পর্কে কোনও সময় দিত না। আকাশ ব্রিলিয়ান্ট হল বটে তবে গৌতমের সঙ্গে সম্পর্কটা অনুশ্রীর আর টিকল না। ছেলের তখনও সাবালকত্ব আসেনি, বিনা লড়াইয়ে ওরা আলাদা হয়েছিল। অনুশ্রী এক কাপড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অনুশ্রীর বিশাল প্রাপ্তি হয়েছিল, আঠারো বছর হলে আকাশ যখন মা-এর কাছেই থাকবে ঠিক করল, বন্ধুত্ব তখন থেকেই শুরু। গৌতম যতই ছেলের সামনে অনুশ্রীকে অপমান করুক বা পাগল বলে নিজের কাছে রেখে দিক প্রাপ্তবয়সকালে নিজের যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বিচার করে মায়ের কাছেই থাকতে চেয়েছে আকাশ৷ দু’জনকে ডেকে পাশাপাশি বসিয়ে আকাশ বলেছিল, “অনেক লড়াই হল। এবার তোমরা এক হলেই আমি খুশি হতাম সবচেয়ে বেশি৷ দেখো যদি কোনওদিন হয়। বাপি, অনেকবছর তোমার কাছে থাকলাম, মা একবারও আসেনি, যেহেতু তুমি বলে দিয়েছিলে আমার কাছে না আসতে। বরং আমি গিয়ে দেখেছি মা একা কী পরিমাণ স্ট্রাগল করছে, চাকরি ও নতুন থাকার জায়গা নিয়ে। তাই বাকি জীবনটা মায়ের কাছেই থাকব ঠিক করলাম। তোমার সঙ্গে দেখা অবশ্যই হবে, বাপি। কিন্তু এখন অ্যাডভান্টেজ, মা।” নিজের অজান্তেই অঝোরে চোখ দিয়ে জল পড়েছিল অনুশ্রীর। গৌতম কোনও কথা বলেনি। আজ সেইদিনটা পরিষ্কার মনে পড়ল। কেন কে জানে! মনে হাজার রাগ থাকলেও অনুশ্রী মারাত্মকভাবে মিস করে গৌতমকে, সেটা সে নিজেও জানে৷ তাও কেউ কাউকে মনে না করার ভান করে। এটা বড় অদ্ভুত জিনিস। আর এটা খুব ভালোভাবে বোঝে আকাশ। মা’কে আগলে রাখে। অভিমান বড় বিষম বস্তু। মানাতে দেয় না। 

এই জামদানিটা গৌতমেরই দেওয়া, আবার ডানহাতে কনুইয়ের নীচে যে কাটা দাগ ওটাও গৌতমেরই দেওয়া। কিভাবে আঘাতটা লেগেছিল মনে পড়ে না আর অনুশ্রীর। আকাশ বলে দিয়েছে, ‘মা, ফেসবুক লাইভটা অন করে বসবে কিন্তু। ঐ সময়টা আমি ফ্রি রেখেছি৷ ” 

কুঁচিতে সেফটিপিন আর দিতে লাগে না অনুশ্রীর৷ ওটা প্রথম প্রথম গৌতম লাগিয়ে দিত। এখন শুধু আঁচলেরটাই দেয়৷ একটা এক-ছড়া মুক্তোর মালা আর কানে একটা ছোট্ট টপ পরল। সঙ্গে একটা লম্বা টিপ। ওটা অনুশ্রীর সিগনেচার। 

  নিজের কথা লিখেই একটা অণুগল্পের সিরিজ করেছিল অনুশ্রী। সাহস করে পাঠিয়েছিল একটা নামী পত্রিকায়। তারা ছেপেছিল। তারপর থেকেই মোটামুটি নামী পত্রপত্রিকাগুলি লেখা চায়। অফিসে কাজের চাপ সামলে যতটুকু পারে করে অনুশ্রী। অনেক ক্ষেত্রেই না বলে। একদম নতুন লেখা একটা গল্প আজ পড়বে সে। 

  অচেনা জায়গা, ততোধিক অচেনা লোকজন। উদ্যোক্তা মেয়েটি চেনা, আমন্ত্রণ সূত্রে। স্টেজে ওঠার আগে পা’টা সামান্য কাঁপল কী! বিদেশের মাটি বলে! নাকি আজ বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে প্রথম প্রথম সাহিত্যসভায় গেলে হাতটা এসে ধরত ছোট্ট আকাশ। আজ তো সে আসেনি! 

  এতক্ষণ অন্যমনস্ক থাকায় খেয়াল করেনি অনুশ্রী। স্টেজে যে ভদ্রলোক সঞ্চালনায় আছে তার আদ্যোপান্ত অনুশ্রীর চেনা। এক লহমায় সে বুঝে গেল আমন্ত্রণের ব্যাপারটা পুরোপুরি সাজানো। আকাশের মুখেই শুনেছিল সে যে গৌতম কিছু বিদেশী পত্রিকার হয়ে ডিজাইনিং-এর কাজ করে। নিজে কাজে এসেছে, আকাশও নিজের কাজ সেরেছে। এত দুষ্টু হয়েছে ছেলেটা! গল্প পড়া শুরুর আগে একটা জলের বোতল এসে রেখে গেল একটি মেয়ে পাশে…নীচে একটি চিরকুট৷ লেখা “সিদ্ধার্থের জীবনে এবার আর অর্ধাঙ্গিনী নয়, বন্ধু হয়ে নতুনভাবে শুরু করা যায় কী? গৌতম তো সিদ্ধার্থেরই আর এক নাম, জানো তো!” 

গল্পপাঠ শুরু করলেন গৌতমের অর্ধাঙ্গিনী।

 



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *