travel-australian-sambalpur

মহানদীর তীরে সম্বলপুর
মঞ্জিলা চক্রবর্তী

এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ হীরাকুঁদ

উড়িষ্যার অন্যতম প্রধান একটি শহর হল সম্বলপুর। সম্বলপুর অঞ্চল প্রাচীনকালে হিরাখণ্ড নামে পরিচিত ছিল। সম্বলপুর ভ্রমণের পূর্বে এত কিছু সত্যি জানা ছিল না! টলেমি এই অঞ্চলটিকে ‘সাম্বালাকা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ফরাসি পর্যটক জিন-ব্যাপটিস্ট ট্যাভার্নিয়ার এবং ইংরেজ ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবনের মতে, প্রাচীনকালে এই সম্বলপুর থেকে রোমে হীরা রপ্তানি করা হত। তার থেকেই হিরাখন্ড নামটি এসেছে।

মহানদীর তীরে গড়ে উঠা প্রাচীন এই শহরটিতে রয়েছে অসংখ্য মন্দির। এর মধ্যে অন্যতম হল মাতা সমলেশ্বরী দেবীর মন্দির। আর মাতা ‘সমলেশ্বরী’র নাম থেকেই পরবর্তী কালে সম্বলপুর নামটি হয়েছে। এই সম্বলপুরেই রয়েছে মহানদীর উপর নির্মিত পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ হীরাকুঁদ। এছাড়া সম্বলপুরী শাড়ির আঁতুড়ঘর হওয়ায় শহরটি ‘হ্যান্ডলুম সিটি’ নামেও পরিচিত। চলুন তাহলে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই শহরটি থেকে ঘুরে আসা যাক।

কলকাতা থেকে নিজস্ব বাহনে বেরিয়ে পড়েছিলাম। যাত্রাপথে কেওনঝড়ে একরাত্রি কাটিয়ে পরদিন সকাল সকাল রওনা দিলাম সম্বলপুরের উদ্দেশে। কেওনঝড় থেকে সম্বলপুর ২১৫ কিমির মতো। সময় লাগবে প্রায় পাঁচ ঘন্টা। আজ দেশ জুড়ে রঙের উৎসব। তাই জাফরানি ঢাকাইয়ে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। কেওনঝড়ের বসন্তের প্রকৃতি উদযাপন করতে করতে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু কিছুটা এগিয়েই ফেঁসে গেলাম কেওনঝড়ের খনি অঞ্চলের ট্রাকের লাইনে। যাকে বলে একেবারে হাসফাঁস অবস্থা! চার কিমির মধ্যে দুটি লৌহ আকরিকের খনি। বেরতে আর পারি না। ‘যাত্রাপথ’ এর কথা মনে পড়ে গেল।

বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করে এর থেকে মুক্তি পেয়ে বোম্বে হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চলেছি দ্রুত গতিতে। দু’পাশে মন মাতানো বসন্তের প্রকৃতি। ঘন জঙ্গলের ধারে ধারে কোথাও কোথাও এলিফ্যান্ট করিডর নজরে পড়ছে। কোন জনবসতি নেই। রাস্তার ধারে কোন দোকানপাটও নেই। কোন বৈদ্যুতিক পোস্টও নজরে পড়ছে না। রাস্তা মাখনের মত মসৃণ ও নির্জন। আরও কিছুটা এগিয়ে এক আধটা ঠিকা দোকানের দেখা মিলল রাস্তার ধারে। তারাও সন্ধের আগেই ঝাঁপ ফেলে গ্রামে ফিরে যায়। পাহাড়ি এই অংশে তাই সন্ধের পর যাত্রা না করাই শ্রেয়। এমনকি এই ঘাঁটি এলাকায় শুনেছি সন্ধের পর ট্রাক চালকেরাও স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। কিন্তু জানেন, আমার মন বড় টানছিল, রাতে এ পথে যাত্রা করার। এক অন্যরকম রোমাঞ্চ অনুভব করা যেত! ভ্রমণের অর্ধেক অভিজ্ঞতা তো পথেই, তাই না!

গান্ধী মিনার থেকে

যাক, সে সব অদ্ভুতুড়ে ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে আপতত পাহাড়ি পথ পেরিয়ে নেমে পড়েছি সমতলে। মাঝেমধ্যে জঙ্গলের ধারে চোখে পড়ছে ছোট ছোট ছাউনি। আদিবাসী মহিলারা মহুয়া, হাড়িয়া বিক্রি করছে হাড়ি ভরে। উৎসবের আনন্দে তা ছেলে বুড়ো সব আকন্ঠ পান করছে। এরই মধ্যে এক অন্যরকম দৃশ্য দেখে মন ভাল হয়ে গেল। ট্রাকবাহকরা সারি সারি ট্রাক দাঁড় করিয়ে একে অপরকে রাঙিয়ে দিচ্ছে রঙে। ঘর-পরিবার থেকে দূরে থাকা এই মানুষগুলোর জীবনের মূল্যবান সময়গুলো রাস্তায় বয়ে যায়। তারাও অপরিচিত জনেদের আপন করে নিয়ে রঙের উৎসবে মাতোয়ারা। অনাত্মীয়কে সহজেই আপন করে নিতে জানে, এটাই আমার দেশ – ভারতবর্ষ!

সম্বলপুর যাওয়ার পথে বারকোট নামে একটি স্থানে ব্রাহ্মণী নদীর উপর রয়েছে দীর্ঘ সেতু। একপাশে পাহাড়ের কোল দিয়ে বয়ে গেছে নদীটি। নদীর পাড়ে পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট একটি মন্দির। সেতু পেরিয়ে নদীটির দুপাশে বিস্তৃত সবুজ চর। সেখানে মনের সুখে চরে বেড়াচ্ছে গবাদিপশুর দল। আর এমন মনোহারি প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রতভাবে মিশে রয়েছে উদ্ভুত এক বিষণ্ণতা ও নির্জনতা। তার সঙ্গ পেতে নেমে পড়লাম। এমন প্রকৃতি পেলে মন ভাল না হয়ে পারে না। আর দেশ দেখার এমন সব টুকরো টুকরো সুখানুভূতিগুলো কুড়িয়ে নেওয়ার জন্যই নিজস্ব বাহনে যাত্রা করা।

এখানে খানিক সময় কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। আরও কিছুটা এগিয়ে দেওঘর থেকে শহরটাকে ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। কেউনঝড় থেকে পাহাড়ি রেঞ্জটা পেরিয়ে সম্বলপুর পর্যন্ত দুপাশে সবুজ বনভূমি ও নির্জন জনমানবহীন রাস্তায় সফর এত আরামদায়ক ও সুখকর তা সত্যি বলে বোঝানোর মতো নয়! এ কেবল রোড ট্টিপেই সম্ভব। এ পথের বেশ কিছুটা অংশ যেতে হবে বদ্রমা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারীর গহীন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে। এও এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা! যাত্রাপথে উপরি পাওনা বলতে পারেন। আর জঙ্গল পেরিয়ে রাস্তার ধারেই দেখা মিলবে একটি প্রাচীন দুর্গা মন্দিরের। মন্দিরটি উড়িষ্যার নিজস্ব গঠনশৈলীতে নির্মিত। পুজোর উপকরণের জন্য মন্দিরের উল্টো দিকে কিছু দোকানও রয়েছে। ভাবলাম এমন পাণ্ডববর্জিত স্থানে কারাইবা পুজো দিতে আসেন! যাক, মন্দির দর্শন সেরে এগিয়ে চললাম। আরও কিছুটা পথ অতিক্রম করে অবশেষে পৌঁছে গেলাম সম্বলপুর শহরে।

ঘূর্ণায়মান গান্ধী মিনার

সম্বলপুর শহরে আমাদের প্রথম গন্তব্য পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ হীরাকুঁদ। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু প্রথম ব্যাচের কংক্রিট স্থাপনের মধ্যে দিয়ে হিরাকুদ বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১২ই এপ্রিল, ১৯৪৮ তারিখে। সম্বলপুর থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে মহানদীর উপর ১৯৫৬ সালে নির্মিত বিশ্ব-বিখ্যাত হিরাকুদ বাঁধটি শহরের একটি প্রধান আকর্ষণ। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম বাঁধগুলির মধ্যে একটি, যার দৈর্ঘ্য প্রায় 26 কিমি। এছাড়া এটি এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদও।

বছর আটেক আগের কথা। সেবার উড়িষ্যার অঙ্গুলে অবস্থিত সাতকোশিয়া ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানেই আলাপ এক পরিবারের সঙ্গে। কথায় কথায় জানতে পারি তারা সাতকোশিয়ার সঙ্গে জুড়ে নিয়েছেন সম্বলপুর। তখনও দক্ষ ভবঘুরে হয়ে উঠিনি আরকি! কৌতূহলী হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, ‘ওখানে দেখার মত কী আছে?’ খুব অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেন? হীরাকুঁদ, পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ!’ সেদিনই মনে মনে একপ্রকার ঠিক করে নিয়েছিলাম সুযোগ পেলেই একবার হীরাকুঁদ দেখতে যাব।

আপাতত এগিয়ে চলেছি শৈশবে ভূগোল বইয়ে পড়া সেই বিশ্বখ্যাত বাঁধটিকে চাক্ষুষ দর্শন করব বলে। পৌঁছে গেছি জহর উদ্যানের সামনে। এটি জহওরলাল নেহেরুর নামাঙ্কিত সাজানো গোছানো একটি বাগান। এর মধ্যে রয়েছে রোপওয়ে স্টেশন। এখান থেকে রোপওয়ের মাধ্যমে পৌঁছন যায় গান্ধী মিনারে। গান্ধী মিনারটি আসলে একটা পাহাড়ি টিলার উপর অবস্থিত একটা নজর মিনার( ওয়াচ-টাওয়ার)। যেখান থেকে পাখির চোখে দেখে নেওয়া যায় সমগ্র হীরাকুঁদ বাঁধ, জলাধার এবং সম্বলপুর শহরটিকে। অথবা গাড়িতে করেও সরাসরি গান্ধী মিনার পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে। প্রতিটি স্থানেই পৃথক পৃথক প্রবেশ মূল্য প্রয়োজন।

আমরা রোপওয়েতে না গিয়ে গাড়িতেই পৌঁছে গেলাম গান্ধী মিনারের পাদদেশে। এখানেও নজর মিনারটির সামনে রয়েছে সাজানো গোছানো ছোট একটি বাগান। বাগান অতিক্রম করে বেশ কিছু সিঁড়ি চড়ে একেবারে গান্ধী মিনারের উপরে উঠলাম। নজরের সামনে তখন টানা লম্বা পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ। আর বাঁধের বুক জুড়ে ধু ধু অসীম নীল জলরাশি। প্রথম দর্শনে মুগ্ধ হলাম! বেলা হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে তাপ বাড়তে থাকে, জলরাশির বুকে অভিমানের কুয়াশা জমে দৃষ্টি অস্বচ্ছ করে তুলেছে। জলাধারের মাঝে মাঝে জেগে রয়েছে ছোট ছোট দ্বীপ। তার চারপাশে ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড় শ্রেণী। এ-ই সমস্ত কিছু যখন দেখতে ব্যস্ত তখন হঠাৎ খেয়াল হল আরে…নজর মিনারটি তো ঘুরছে! অর্থাৎ এটি একটি ঘূর্ণায়মান নজর মিনার। আপনি স্থির থাকবেন। নজর মিনারটি নিজে নিজেই ১৮০° ঘুরতে থাকবে গোল হয়ে। মিনারের বাতায়নে শুধু দৃষ্টি মেলে দাঁড়াতে হবে। আর সমগ্র হীরাকুঁদ ড্যাম, জলাধার এবং সম্বলপুর শহর ধরে পড়বে দৃষ্টি পথে। দেশজুড়ে বহু নজর মিনারে চড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে তবে এ এক চমৎকার অভিজ্ঞতা!

পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ

এই বাঁধের অপর প্রান্তে রয়েছে আরও একটি নজর মিনার, নাম জহর মিনার। সেখান থেকেও একইরকম দৃশ্য দেখা যায়। শীতকালে হীরাকুঁদের বুকে শতসহস্র পরিযায়ী পাখিরা আশ্রয় নেয়। সুতরাং শীতকালে এখানে এলে এক সুখকর অভিজ্ঞতা হবে বইকি! হীরাকুঁদ বাঁধ ঘুরে হোটেলের পথ ধরলাম। ফিরে দুপুরের আহার সেরে নিলাম। খানিক বিশ্রাম নিয়ে সন্ধের দিকে বের হলাম সম্বলপুর শহরের বিখ্যাত সমলেশ্বরী মায়ের মন্দির দর্শনের উদ্দেশে।

সমলেশ্বরী মন্দিরটি শহর থেকে মাত্র ৫- ৬ কিমি. দূরে। ষোলশো শতকে রাজা বলরাম দেব মহানদীর পাড়ে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেবী সমলেশ্বরী স্থানীয়দের কাছে ঘরের মেয়ে ‘মা সমলেই’ নামেও পরিচিত। মাতা সমলেশ্বরীকে প্রাচীন কাল থেকে জগৎজননী, আদিশক্তি, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী হিসেবে পূজা করা হয় এবং তিনি হলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মা। প্রভু জগন্নাথের পরে, তিনিই উড়িষ্যার একমাত্র দেবী যিনি সম্পূর্ণ পশ্চিম ওড়িশা, ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশ এবং ছত্তিশগড়সহ এত বড় অঞ্চলের প্রধান দেবী।

মন্দিরে ঢুকতে ঢুকতে চারিদিকে আঁধার নেমে এল। মহানদীর শীতল ফুরফুরে বাতাস বইছে। মন্দিরে ঢুকে মনটা ভাল হয়ে গেল। মূল মন্দিরের চারপাশের অংশ বহু অর্থ ব্যয়ে সদ্য সংস্কার করা হয়েছে। ফলে চারিপাশটা পরিপাটি করে সাজানো গোছানো এবং রঙিন আলো দ্বারা সুসজ্জিত। আর সন্ধের সময় এই মন্দিরটিতে লাইট এন্ড সাউন্ড শোয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। যাইহোক, এই সব দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে মূল মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম। মূল মন্দিরটি সাদা রঙের ও বর্গাকার গঠনযুক্ত। শ্রীশ্রী সমলেই দেবীর মূর্তিটি গ্রানাইট শিলার একটি বৃহৎ খণ্ড নিয়ে গঠিত। ঘাটশিলাতে রঙ্কিণী মায়ের মূর্তি বা বাংরোপসিতে দুয়ারশিনি মায়ের মূর্তির সঙ্গে অনেকখানি মিল রয়েছে। ভেতরে ঢুকে দেখি লম্বা লাইন। সেই লাইন ঠেলে যখন সম্বলেশ্বরী মায়ের সামনে হাজির হলাম কী যেন এক অলৌকিক শক্তিতে টানছিল! মুহূর্তের জন্য এক অন্যরকম অনুভূতি হল! দর্শন সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কী এক অমোঘ টানে পুনরায় তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পুনরায় একইরকম ম্যাজিকাল অনুভূতি হল!

উদ্ভূত অলৌকিক এক অনুভূতি নিয়ে মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। ঘড়িতে তখন রাত ন’টা। ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে চড়বড়িয়ে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টিস্নাত হয়ে পুনরায় মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম। এ যেন মায়ের আশীর্বাদ। খানিক পরে বৃষ্টি ধরলে বেরিয়ে পড়লাম। রাত বেড়েছে, আরও একটু এগিয়ে আমরা আটকে পড়লাম রেল ক্রসিং এ। এখানে পাঠক বন্ধুদের জন্য বলে রাখি, সম্বলপুর স্টেশন থেকে মাত্র তিন কিমি দূরে রয়েছে ডিয়ার পার্ক বা সম্বলপুর চিড়িয়াখানা। এখানে দেখতে পাবেন নানা প্রজাতির হরিণ, ভাল্লুক, চিতা, নীলগাই প্রভৃতি প্রাণী। এই কথার ফাঁকে ঝমঝম করে বেরিয়ে গেল রাতের দুরপাল্লার ট্রেনটি। আমরাও এগোলাম। পেট পুজো সেরে রাত ঠিকানায় ফিরব।

Port Macquarie Beach

তবে ফেরার আগে দুঃখের কথাটা বলেই যাই। মন্দির থেকে বেরিয়ে সম্বলপুরের ঐতিহ্যবাহী হ্যান্ডলুম শাড়ি কেনার কথা ছিল। আর সম্বলপুরী শাড়ির বাজারটিও নিকটেই। কিন্তু মন্দিরে দেরি হওয়া আর হঠাৎ বৃষ্টি, সব তালগোল পাকিয়ে দিল। পরদিনও সম্ভব হবে কিনা জানি না! তবে সম্বলপুরে এসে সম্বলপুরী শাড়ি সম্পর্কে তো দু’চার কথা নিশ্চয়ই বলব। সম্বলপুরী শাড়ি একটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা শাড়ি। যাতে তাঁত এবং বুননের আগে টাই-রঙ করা হয়। এটি উড়িষ্যার সম্বলপুর, বালাঙ্গির, বারগড়, সোনপুর প্রভৃতি জেলায় তৈরী হয়। শাড়িগুলিতে শঙ্খ, চক্র, ফুল এবং বিভিন্ন আকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়। লাল, কালো এবং সাদা যে রং ব্যবহার করা হয় তাও অর্থবহ। এগুলো ভগবান জগন্নাথের মুখের রঙ। এই শাড়িগুলোতে ব্যবহৃত প্রতীক ও রং উড়িষ্যার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। পাঠক বন্ধুদের আরও একটা কথা বলব, সম্বলপুরী শাড়ি আজ এত জনপ্রিয় হল কিভাবে জানেন? মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সম্বলপুরী শাড়ি ভীষণ পছন্দ করতেন। তাঁর ব্যবহারের ফলে সারা দেশে সম্বলপুরী শাড়ি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

পরদিন। সকাল সকাল উঠে পড়েছি। আজকের গন্তব্য ছত্রিশগড়ের একটি শৈল শহর। তার আগে শহরের আরও দু’একটা মন্দির দর্শনের ইচ্ছা রয়েছে। বিশেষত মা ঘণ্টেশ্বরীর মন্দির ও হুমা মন্দির। মা ঘণ্টেশ্বরীর মন্দিরটি শহর থেকে ৩০ কিমি দূরে অবস্থিত। তাঁর নাম অনুসারে এই মন্দিরের সর্বত্র ঘণ্টা দেখতে পাওয়া যায়। ভক্তদের মনস্কামনা পূরণের পরে তারা দেবী ঘন্টেশ্বরীকে ঘন্টা উৎসর্গ করেন। রাজ্য জুড়ে বহু তীর্থযাত্রী এ মন্দিরে আসেন। এটি ‘আলো ছাড়া বাতিঘর’ নামেও পরিচিত। এটি প্রাচীন নাবিকদের দ্বারা নির্মিত। প্রচন্ড ঝড়ো বাতাসে যে ঘন্টাধ্বনি হত তা নাবিকদের কাছে সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করত। তাদের কাছে মা ঘন্টেশ্বরী হলেন রক্ষাকারী দেবী। আর শহর থেকে ২৩ কিমি দূরে মহানদীর পাড়ে রয়েছে হুমা মন্দির। এটি আসলে একটি হেলান শিব মন্দির। তবে হেলা যাওয়ার সঠিক কারণ জানা যায়নি। মহাদেব এ মন্দিরে ভগবান বিমলেশ্বর নামে পূজিত হন।

রাতের মন্দির প্রাঙ্গণ

তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়েছি। ডান হাতে মহানদীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছি সমলেশ্বরী মন্দিরের দিকে। কাল রাতের অন্ধকারে মহানদীর রূপ দর্শন হয়নি ঠিক মতো। সমলেশ্বরী মন্দিরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে সে। এই শান্ত স্নিগ্ধ সকালে তার সঙ্গ বড়ই মধুময়। ভাবছেন আবার সমলেশ্বরী মন্দিরে কেন?

কাল মন্দির থেকে ফেরা ইস্তক কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমরা। কে যেন চুম্বকের মত টানছিল আমাদের। সেই টানেই পুনরায় মায়ের দর্শনের জন্য বেরিয়ে পড়েছি। পৌঁছে দেখি হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া মন্দির চত্বর একেবারে ফাঁকা। ভক্তরা এখনও এসে পৌঁছয়নি আরকি। সোজা গিয়ে মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। শান্ত ও নির্জন পরিবেশে পুনরায় মায়ের দর্শন সারলাম। একইরকম ম্যাজিক্যাল অনুভূতি! দেহ – মনে অপার শান্তি ও ভাললাগা নিয়ে এগিয়ে চলেছি পরবর্তী গন্তব্যের দিকে…

সমলেশ্বরী মায়ের মন্দির



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *