bibidho-rimjhim-bristi

রিমঝিম বৃষ্টি
স্মৃতিচারণা
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

 

“আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে।”

পুরনো কলকাতার গলিতে বৃষ্টি নেমেছে। এই বাড়ি থেকে সামান্য দূরেই গঙ্গা। দুটো সরু গলির ফাঁকে গাঢ় কমলা রংয়ের শিব মন্দির। তারই ফাঁক দিয়ে দেখা যায় গঙ্গার মুখ। কয়েকদিন ধরেই আকাশের মনখারাপ চলছে। তারই অনুসঙ্গে সূর্যের সঙ্গে সে আড়ি করে রেখেছে, তাই বুঝি কেমন এক রকম ম্লান আলো মেখে সকালগুলো আসছে এখন।

পুপুর শ্বশুরবাড়ি তিনতলা। তিন শরীকের বাড়ি। তিন ভাইয়ের নামে বাড়ি তিন-ভাগ হয়েছে। পুপুর ভাগে পড়েছে দোতলার পশ্চিমের কোণে পাশাপাশি অ্যাটাচড্ বাথরুমসহ দুটো ঘর। পুবদিকে টানা বারান্দার একদিকে কাঠের জাফরির পার্টিশনে তৈরি হয়েছে তার একফালি রাঁধাবাড়ার জায়গা। সেখান থেকেই কী ভাগ্যে একটা বিশেষ অ্যাঙ্গেলে বহতা গঙ্গার রূপ দেখা যায়! অথচ এ বাড়ির আর কোথা থেকেও গঙ্গা চোখে পড়ে না! বারান্দাটুকুতে দিনের রোদ আসে বলে দু’পাশে সারি সারি টব রেখে শখের বাগান করেছে পুপু। রান্নাঘরের একপাশে একটা খুব ছোট্ট বেতের গোল-টেবিল আর মোড়া রেখেছে পুপু। ওটাই এ বাড়িতে তার ফেভারিট কর্নার।

এখন ওখানেই বসেছিল সে আনমনা হয়ে। ভেজা আর স্যাঁতসেতে কাপড়গুলোকে একটু আগে বারান্দা থেকে তুলে এনে ঘরের ভেতরে রাখা কাপড় শুকানোর স্টিলের স্ট্যান্ডে মেলে দিয়ে ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে এসেছে সে। বেতের টেবিলের উপর পুপুর আইপ্যাডে এখন বাজছে কিশোরের বিখ্যাত সেই বর্ষার গানটা, “রিমঝিম গিরে শাবন্, সুলগ সুলগ যায়ে মন্!” গুমোট ভাবটা কাটাতে ঘরে একটু কর্পূর জ্বেলে দিয়ে পুপু বারান্দায় উঠে এসে দাঁড়াল। তার হাতে চায়ের পেয়ালা। সে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পেয়ালাটা একটু সামনের দিকে এগিয়ে দিল, যাতে বৃষ্টির খানিকটা জল মিশে যায় তার চায়ে। আজ তার মন কেমনের দিন।

পুপুর স্মৃতি কখন যেন পিছন দিকে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। এমনই একটা দিন। পুপু আর ওর বোন টুটু যথারীতি হেঁটে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। পুপুর পরনে সাদা শার্ট আর আকাশি স্কার্ট। পুপুর ক্লাস সেভেন। বোনের ক্লাস ফাইভ। দুজনের পিঠেই স্কুল ব্যাগ। স্লেট-রঙা আকাশ থেকে ঝরে চলেছে বারিধারা। পুপু হঠাৎ বলল, “আয় আজকে আমরা দুজন বৃষ্টিতে ভিজব!” টুটু এই আমোদে দারুণ খুশি হয়ে সাড়া দিল। ব্যাস! পাঁচ মিনিটের ভেতরে ছাতা বন্ধ করতেই তারা দুজনে ভিজে একেবারে একসা হয়ে গেল। বড় বড় জলের ফোঁটা এসে ভিজিয়ে দিয়েছে তাদের স্কুলের ভারী ব্যাগ দুটোকেও। ভেজার উত্তেজনায় কারোরই মনে ছিল না ব্যাগের কথাটা, এখন কী হবে? ওরা দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে গভীর অর্থবহ ভঙ্গীতে হাসলো। এই হাসি আসলে সর্বনাশের হাসি। বাড়িতে ফিরলে মা ওদের আস্ত রাখবে না! সব জেনেও, তবু মনের এই সুপ্ত সাধটুকু আজ ওরা মিটিয়ে নিয়েছে। আসলে খুব ছোট ওদের দু’কামরার সরকারী দফতরের আবাসনটা। বারান্দার খোপ থেকে ভাল করে আকাশটাও ধরা পড়ে না! তার উপর তাদের একফালি বারান্দায় এই বর্ষাতে সবসময় মেলা থাকে রাশি রাশি ভেজা জামাকাপড়। ঘোলাটে আকাশের দিকে চেয়ে পুপু নেমে আসা জলের ফোঁটাগুলোর উৎস খুঁজে নিতে চাইল। ওর মনে হল নেমে আসতে আসতে ওদের উৎস ওরা কখন যেন হারিয়ে ফেলেছে! ঠিক এখন যেমন চল্লিশোর্ধ পুপু!

জলছবি সরে গিয়ে ফিরে এসেছে নতুন একটা জলরঙের চিত্রপট। পুপুর এখন ক্লাস নাইন। ওদের আবাসন ছেড়ে ওরা এবার অনেকটা দূরে চলে যাবে। তাদের নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। পুপুর পরনে আকাশি শাড়ি আর সাদা কলার দেওয়া ব্লাউজ। আকাশি ফিতে দিয়ে দুই বিনুনীতে চুল বাঁধা। এই শাড়িতে ফর্সা ছিপছিপে পুপুকে আশ্চর্য সুন্দর লাগে দেখতে। স্কুল ছুটির পর একস্ট্রা ক্লাস করে বেশ দেরি করে বেরিয়েছে সেদিন পুপু। টুটু সেদিন স্কুলে আসেনি। সে চেয়ে দেখল, মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছে। স্কুলের গেটের বাইরে জনপ্রাণী নেই। হঠাৎ গেটের বাইরে গাছতলাতে ও কে ওখানে? ‘গার্জিয়ান’ না? হ্যাঁ তাই তো! কিন্তু ‘গার্জিয়ানও’ কি জানে পুপুরা আগামী সপ্তাহে ওদের আবাসন থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে? তাই কি এতদূরে পুপুর স্কুলে এভাবে ছুটে এসেছে ও? পুপুর বুকটা ধক করে উঠল। গেটের বাইরে রোজকার মতো ছেলেটা ওর সেই ঠাকুরদাদার কালো ছাতাটা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ও রোজ ওর স্কুল থেকে ফেরার সময় গার্জিয়ানের মতো বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকে বলে, মনে মনে পুপু ওর নাম রেখেছে ‘গার্জিয়ান’। বেশ বড় বড় চোখদুটো ছেলেটার। পুপু ওর নাম জানে না! কখনও কথাও বলেনি ওর সঙ্গে। দিনের পর দিন ধরে ওর এমন আশ্চর্য নিষ্ঠা দেখে সে অবাক হয়ে যায়! পুপু হাঁটা শুরু করতেই ছেলেটাও হাঁটতে লাগল। নির্দিষ্ট দূরত্ব বরাবর বজায় রেখে চলেছে সে। পুপু একবার দেখে নিল মিঃ এক্স কি এখনও পেছনে আসছে? হ্যাঁ, সে ঠিক নীরবে দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। তীব্র জোরে জলকনা ছিটকে যাচ্ছে কালো পিচ রাস্তার উপর দিয়ে। পুপুর সাদা কেডস্ ভিজে সপসপ করছে। পুপুর হঠাৎ মনে হতে লাগল সমস্ত পৃথিবীতে কেউ কোত্থাও নেই! যেন হঠাৎ জনশূন্য হয়ে গেছে এই গোটা জগতটা। এই মহাবিশ্বে সে আর নাম না জানা তাদের আবাসনের কে-ব্লকে থাকা ছেলেটা শুধু বেঁচে আছে, আর বেঁচে আছে কেবল মুহূর্তটা! আর কিছু নেই! সব ভোজবাজির মতো উধাও!

নাহ্! পাড়া ছেড়ে চলে আসার আগে পুপু কখনও কথা বলেনি ওর সঙ্গে। তবে কেন যেন তার স্মৃতিতে গেঁথে আছে ছেলেটার মুখটা আর ওর ভাসা ভাসা নীরব দু’চোখ! এতদিন পরে পুপুর বয়স বেড়ে গেলেও ছেলেটার বয়স সেই কৈশোরেই থমকে আছে!

“ম্যাহফিল মে ক্যায়সে ক্যাহ দে কিসি সে, দিল বনধ্ রাহা হ্যায় কিসি আজনবি সে!” পুপুর বয়স সতেরো। সে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। বেলঘরিয়ায় এক অখ্যাত গলির ভেতর এক বাড়িতে কেমিস্ট্রি পড়তে আসে পুপু। তাদের নতুন বাড়ি থেকে এই জায়গাটা কাছাকাছি। ব্যাচের কয়েকটা ছেলের মধ্যে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা একটু আনস্মার্ট ছেলেটাকে কেন যেন ভাল লাগে পুপুর। ওর বাড়ি পুরুলিয়ার আদ্রায়। এখানে পিসির বাড়িতে থেকে ও পড়াশুনো করে। কথাবার্তায় বেশি পটু, চালাক চতুর ছেলেদের পুপু বরাবর এড়িয়ে চলে। পুপু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝেছে ওর ছেলেটার প্রতি এই বিশেষ আগ্রহ একপাক্ষিক নয়। ছেলেটার নাম শান্তনু। শান্তনু মুখার্জী। শান্তনু নানাভাবে পুপুকে সাহায্য করে। পুপুর ইংরাজির টিউটর নেই জেনেই, ওর সমস্ত নোটসের খাতাগুলো পুপুকে দেখতে দিয়েছে শান্তনু। ওদের দুজনেরই তীব্র বইপড়ার নেশা। বই নিয়ে মাঝে মাঝে গল্প করে ওরা। সুমন বা নচিকেতার গান নিয়েও আলোচনা হয় ওদের। কিন্তু দুজনেই ভালবাসার কথাটা কেউ কাউকে বলতে পারে না ওরা।  

সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। তবে সপ্তাহে একটা মাত্র দিনেই শান্তনুকে দেখতে পায়, বলে পুপু ভিজে ভিজেই পড়তে চলে এসেছে। এসে সে দেখলো, শান্তনুও এসেছে। কোচিংয়ে তারা দুজন ছাড়া আর কেউ এই জলকাদায় আসেনি। বেলঘরিয়ার পাওয়ার হাউসের গলি সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যায়, স্যার তাড়তাড়ি ওদের ছুটি দিয়ে দিলেন, বললেন, – এরপরে বাড়ি ফিরতে পারবে না। ওরা দু’জনে গলির দুপাশ ধরে চলেছে ছাতা মাথায় দিয়ে। ছাইরঙা আকাশে দিনেরবেলাতেও আলো যেন নিভে এসেছে। গলিটা একটা ছোটখাটো পুকুরে পরিণত হয়ে গেছে। একটা গর্তে পা পড়তেই পুপু আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে শান্তনু তার হাতটা বাড়িয়ে দিল পুপুর দিকে। পুপু চেয়ে দেখল, ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে ঘোলা জল বয়ে চলেছে গলি দিয়ে। ওর হাতটা ধরার আগেই পুপুর ভয় কেটে গেল, আর ওর মন এক অপূর্ব ভাললাগায় ভরে গেল। তার মনে হল এমন একটা হাত পাশে থাকলে সে জীবনে কখনও ভয় পাবে না!  

এরপর ওরা জীবনের পথ ধরে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গেছে, তবে বরাবর ওরা এগিয়েছে দুজন সরলরেখার মতো। তারপর হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেছে ওরা যে যার গন্তব্যে। ওদের আর দেখা হয়নি।

 



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “bibidho-rimjhim-bristi

  1. দারুণ নন্দিতা দিদি!!!!❤️ পড়ে আরাম….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *