rannaghar-eso-boso-aahare

এসো বসো আহারে 
জয়তী রায়

ভাজা মাছ - গোলমরিচ আর রসুন

 

১৯৯৫ সালে শ্যামদেশ / সিয়ামদেশ তথা থাইল্যান্ড যাই। বেড়াতে নয় বসবাস করার জন্যে। থাইল্যান্ডের সৌন্দর্য, পথ ঘাট – মুগ্ধ করার মত প্রচুর উপকরণ থাকলেও আমার প্রধান কাজ তখন পরিবারের উদরপূর্তির ব্যবস্থা করা। দেরি না করে চিনতে শুরু করলাম বাজার। সে এক অভিজ্ঞতা! এত বছর পরে, থাই খাওয়ায় ওস্তাদ হয়ে যাওয়ার পরেও স্মৃতির দরজায় ধাক্কা দেয় একটা বোঁটকা গন্ধ! পৃথিবীর বহু দেশের বাজারে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে কিন্তু এমন বোঁটকা গন্ধ? নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছিল রবিনসন সুপারমার্কেটে ঢোকার সময়! গন্ধটা ফিস সস — নাম প্লা। পরে এমন অবস্থা হয়েছিল যে প্রিক নাম প্লা ছাড়া মুখে খাওয়া ঢুকত না। প্রিক হল ঝাল। ঝাল ঝাল মাছের সস ছাড়া স্বাদ পুরো আসবে না।

থাই জনগণ খাইয়ে জাত। পেট ভরানো শুধু নয় এই জাতের কাছে ফুড একটা শিল্প। বেঁচে থাকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। একটা মজার কথা শোনা যায়, শত্রুদেশ যদি থাইল্যান্ড জয় করে নিতে চায় তবে দুপুর বারোটায় আক্রমণ করলে অনায়াসে দখল করে নিতে পারবে। ওই সময় সারা থাইল্যান্ড নিজেদের লাঞ্চ করতে ব্যস্ত থাকে। অফিসের বস থেকে সাধারণ কর্মী, সেনানায়ক থেকে দোকানদার — হাতে খাবার নেবেই। ফুটপাথ জুড়ে অসংখ্য জ্বলন্ত উনুনে রান্না হয়েই চলেছে। আমাদের যেমন নির্দিষ্ট অফিসপাড়া বা ওইরকম কিছু জায়গায় খাবার পাওয়া যায়,  থাইল্যান্ডে এমন কোনো জায়গা নেই রান্না যেখানে হচ্ছে না! আশি শতাংশ দেশবাসী ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার বাইরেই করে বাড়িতে ঘুমোতে আসে! বাচ্চারাও তাদের  টিফিন বক্স ভরে নেয়। স্যালাড, সয়াবিন দুধ, মাছ ভাজা — গরম গরম টাটকা। সবজি, ফল ছাড়া খাবেই না। সংস্কৃতি, ধর্ম, প্রেম, পরিণয় এমন কি মৃত্যু পর্যন্ত উদযাপন হয় আহার দিয়ে।

অ্যাসপারাগাস - প্রিয় সবজি
বেগুনের কত যে গুণ ব্যাংকক গেলে বোঝা যায়
কাপ রাও কাই - কাই মানে চিকেন - তুলসিপাতা সহযোগে

 

আল্যায় আহান — ভালো খাবার — থাইল্যান্ডের মূল মন্ত্র। পুজোর ক্ষেত্রে কোনো নিরামিষ ব্যাপার নেই। শূকরের মাথা, ডিম – যাবতীয় কিছু থালায় সাজিয়ে ফুল ধুপকাঠি দিয়ে নিবেদন করা হয় দেবতার সামনে।  বেচারা দেবতার কপালে ফল আর সিন্নি শুধুমাত্র জোটে না।

জীবনের অনেকগুলি বছর থাইল্যান্ডে বসবাস করে বুঝেছি যে, রান্নার সব মশলার সেরা মশলা ভালবাসা। নিজের সমস্ত মনোযোগ উপুড় করে রান্নায় ঢেলে দেয় সেইসঙ্গে হরেকরকমের সস, মশলা আর দ্রুত খুন্তি চালানোর প্রক্রিয়া। ঝটাঝট ফটাফট করতে হবে। এই যে উল্টে দিচ্ছে পাল্টে দিচ্ছে এটার মধ্যে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের পরম্পরার জাদু। থাইল্যান্ড বাইরে যতই আধুনিক হোক প্রতিটি নাগরিক নিজের পরম্পরা মেনে চলে শ্রদ্ধার সঙ্গে। রান্না তার মধ্যে একটি। প্যাকেটজাত মশলা এসেছে বাজারে। ছুঁয়েও দেখবে না। বড় বড় হামানদিস্তায় কুটে নেওয়া হয় টাটকা মশলা। বিশেষকরে, রসুন আর কাঁচালঙ্কা।

স্টিকি রাইস উইথ ম্যাংগো
স্টিকি রাইস উইথ ম্যাংগো - 2

 

পদ অসংখ্য। আরশোলা, উচিংড়ে, সাপ, শামুক, অক্টোপাস — রকমারি কীট পতঙ্গ ভাজা খেয়ে চেহারার জেল্লা ফুটে ওঠে। ত্বক, চুল টানটান। লিখতে বসলে ইতিহাস লেখা হয়ে যায়। একটা কথা না বললেই নয়, ছিপছিপে চেহারার লোকজনের ভাত না হলে চলে না। এককথায় ভেতো। ভাতের কত রকম নাম। বাই – কা – প্রাও কাই — ঝাল ঝাল চিকেনের সঙ্গে ভাত। এটাকে কাপ রাও কাই বলা যায়। একটু বদলে দিলে পাল্টে যাবে পদ। যেমন — কাপ রাও কুং ( চিংড়ি) কাপ রাও মু( শূকর)। তুলসীপাতা দিয়ে রান্না। একবার খেলে মুখে লেগে থাকে। খাও পাত খাও — ডিম দিয়ে ভাত ভাজা। ফেনা ভাত রসুনের সঙ্গে। অমৃত। কাঁকড়া মাছের দুটো পদের কথা বলতেই হবে। ইয়েলো ক্রাব কারি আর রেড ক্র্যব কারি। দুটোতেই নারকেলের দুধ পড়ে। কিন্তু, স্বাদ সম্পূর্ণ আলাদা। টম ইয়াম, গ্রিন কারি, খাও সাই — যে মশলাগুলো দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো ওই দেশের একেবারে নিজস্ব। পৃথিবীর কোথাও এই মশলা পাওয়া যাবে না। মাছভাজা  একবার খেলে ভোলা যাবে না। প্লা অর্থ মাছ। প্লা সেজুয়ান, নুং মানাও প্লা ( লেবু, লঙ্কা, রসুন দিয়ে গোটা ভেটকি সিদ্ধ) রসুন আর গোল মরিচ দিয়ে ভাজা মাছ।

আরো অসংখ্য পদ আছে। সব লেখা সম্ভব নয়। সোম তাম — পেঁপের স্যালাড — না খেলে জীবন বৃথা। আর, শেষপাতে মিষ্টি — স্টিকি রাইস উইথ ম্যাংগো।

আনারস, ডাব, কাঁঠাল ( কাঁঠাল নয়, জুকিনি) কলা সমস্ত রকম ফল দিয়ে মিষ্টি তৈরি করে থাইল্যান্ড। কিন্তু, স্টিকি রাইস উইথ ম্যাঙ্গো — সবচেয়ে সেরা।

উপসংহারে বলি, বেড়ানোর জায়গা বা টুরিস্ট স্পট হিসেবে থাইল্যান্ড পৃথিবীর মানচিত্রে উপরের দিকেই আছে। অপূর্ব সাগর সৈকত, মন্দির, পুরোনো ইতিহাস, কেনাকাটা — তুলনা হবে না। কিন্তু শুধুমাত্র খাওয়ার জন্যেও একটা দেশ ভ্রমণ করা যায় — সেই দেশ থাইল্যান্ড — land of smile.




এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *