onubad-paani-bihin-karakas

পানিবিহীন কারাকাস
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
অনুবাদ: আলম খোরশেদ

 

জুন ৬, ১৯৫৮

সকাল সাতটার রেডিও-সংবাদ শুনে, সান র্বেনার্দোর আবেনিদা কারাকাসের এক চিলেকোঠায় একাকী বসবাস করা জার্মান ইঞ্জিনিয়ার স্যামুয়েল বুরকাটর্, শেভ করবেন বলে পাড়ার দোকান থেকে এক বোতল পানি কিনতে যান। দিনটা ছিল ১৯৫৮ সালের ৬ই জুন। দশ বছর আগে স্যামুয়েল বুরকার্ট কারাকাসে আসার পর থেকে যে-কোনো দিনের চেয়ে এই দিনটা ছিল মৃত্যুর মতো শান্ত। পার্শ্ববর্তী আবেনিদা উর্দানেতা থেকে গাড়ি কিংবা স্কুটারের ইঞ্জিনের আওয়াজ আসছিল না কোনো। কারাকাসকে এক ভূতুড়ে নগরীর মতো মনে হচ্ছিল। সাম্প্রতিক দিনগুলোর গুমোট গরম কিছুটা কমের দিকে, কিন্তু ওপরে, গাঢ় নীলবর্ণ আকাশে, একটি মেঘেরও চলাচল ছিল না। অবকাশ-বাড়ির বাগানগুলোতে আর প্লাজা দে লা এস্ত্রেইয়ার ছোট্ট দ্বীপের ঝোপঝাড় সব শুকিয়ে যাচ্ছিল। বছরের এই দিনগুলোতে সাধারণভাবে লাল হলুদ ফুলে ঢাকা অ্যাভিনিউ জোড়া বৃক্ষেরা সব তাদের শুকনো, ন্যাড়া ডালপালা বাড়িয়ে দিচ্ছিল আকাশের দিকে।

স্যামুয়েল বুরকার্টকে দোকানের লাইনে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল, কেননা সেবাদানরত দুই পর্তুগিজ দোকানি তাদের ভীতসন্ত্রস্ত খদ্দেরদের সঙ্গে চল্লিশ দিনের পুরনো সেই একই বিষয় নিয়ে গল্প করছিল, যা সেদিনের সংবাদপত্র আর রেডিও থেকে নাটকীয় বিস্ফোরণের বেগে বেরিয়ে এসেছিল; কারাকাসের পানি ফুরিয়ে গেছে। এর আগের রাতে তারা, লা মারিপোসা জলাধারের শেষ এক লক্ষ লিটার পানি ব্যবহারের ওপর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অভ স্যানিটেশন ওয়ার্কস (আইনস) এর আরোপিত কড়া নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছিল। সেই সকাল থেকেই, গত ঊনাশি বছরের মধ্যে তীব্রতম গ্রীষ্মের পরিণামে, তারা পানি-সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। জনগণকে তৃষ্ণায় মরে যাবার হাত থেকে বাঁচাতে, সরকার গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে নানারকম আপৎকালীন চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। জনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তারা জরুরি ব্যবস্থাও নিয়েছিল কিছু, ছাত্র ও পেশাদারদের দ্বারা গঠিত বাহিনীগুলো যা প্রয়োগ ও পালন করছিল। কলেবর কমে চার পৃষ্ঠায় নেমে আসা সংবাদপত্রসমূহকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নাগরিকেরা আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে কীভাবে এই সংকটের মোকাবিলা করবে, সেইসব সরকারি নির্দেশনাবলি প্রচারের।

বুরকার্টের মাথায় এই ভাবনার উদয় হয়নি যে, তার প্রতিবেশীরা মিনারাল ওয়াটার দিয়ে কফি বানানোর উদ্দেশ্যে দোকানের সব পানি এক ঘণ্টার মধ্যে মজুদ করে ফেলবে। আগামী দিনগুলোতে কী ঘটতে পারে সেই কথা ভেবে, সাবধানতা হিসাবে তিনি ফলের জুস মজুদ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পর্তুগিজ দোকানি জানায়, ফলের জুস ও পানীয় কেনার ওপরও কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ সীমা আরোপ করেছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত, একজন ক্রেতা দৈনিক কেবল এক বোতল জুস ও এক শিশি সোডা ক্রয় করতে পারবে। বুরকার্ট এক বোতল কমলার রস কেনেন এবং শেভ করার জন্য এক শিশি লেমনেড কেনার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শেভ করার সময় দেখতে পান, লেমনেড তার সাবানকে দই বানিয়ে দেয়ার ফলে কোনো ফেনাই আর তৈরি হচ্ছে না। তাই তিনি নিশ্চিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, পিচফলের রস দিয়ে ক্ষৌরকর্ম সম্পন্ন করেন।

মহাবিপর্যয়ের প্রথম চিহ্ন বাগানে জলসিঞ্চনরত এক নারী তাঁর নিখুঁতরকম সোজাসাপ্টা জার্মান মগজ আর যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ স্যামুয়েল বুরকার্ট, যথাযথ পূর্বানুমানের সঙ্গেই হিসাব করতে জানতেন, এক টুকরো খবরের পরিণাম ঠিক কতদূর গড়াতে পারে। তিনি ঠিক সেটাই করেছিলেন, আজ থেকে তিনমাস আগে, মার্চের ২৮ তারিখে, যখন একটি কাগজে এই খবরটা পড়েছিলেন: “লা মারিপোসায় আর মাত্র চল্লিশ দিনের জল জমা আছে।”

লা মারিপোসা জলাধারের, যা কারাকাসের পানি সরবরাহ করে, স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতা ৯৫ লক্ষ লিটার। সেই দিনটিতে, আইনস কর্তৃক পানি খরচে মিতব্যয়ী হবার পুন:পুন পরামর্শ সত্ত্বেও, পানির স্তর নেমে এসেছিল ৫২ লক্ষ ২১ হাজার ৮ শত ৫৪ লিটারে। জনৈক আবহাওয়াবিদ এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে প্রচারমাধ্যমকে জানান যে, আগামী জুনের আগে বৃষ্টিপাতের কোনো সম্ভাবনা নেই। জনগণ একে খুব বেশি গুরুত্ব না দেওয়া সত্ত্বেও, কয়েক সপ্তাহ পরে পানিসরবরাহের পরিমাণ ইতোমধ্যেই উদ্বেগজনক অবস্থা থেকেও আরও কমিয়ে দেওয়া হয়, দৈনিক এক লক্ষ ত্রিশ হাজার লিটার।

কাজে যাওয়ার পথে স্যামুয়েল বুরকার্ট একজন প্রতিবেশীকে সম্ভাষণ জানান, যিনি সেই সকাল আটটা থেকেই তাঁর বাগানে বসে আছেন গাছে পানি দিতে। এক পর্যায়ে তিনি তাঁকে পানি সাশ্রয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। লাল ফুলঅলা রেশমি হাউসকোটপরা নারীটি তখন কাঁধ ঝাঁকান। “সংবাদপত্রগুলো আমাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য মিথ্যে কথা বলছে,” তিনি জবাব দেন। “যতক্ষণ পানি আছে, আমি আমার ফুলগাছে পানি দেবো।” জার্মান ভদ্রলোক একবার ভাবেন পুলিশকে খবর দেবেন, নিজের দেশে থাকলে যা তিনি করতেন, কিন্তু তাঁর সাহসে কুলোয় না, কারণ তিনি ভাবেন, বেনেসুয়েলীয়দের মানসিকতা হয়তো তাঁদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি একটা তথ্যে সবসময়ই চমৎকৃত হতেন যে, একমাত্র বেনেসুয়েলার মুদ্র্রাতেই তার মূল্যের কোনো উল্লেখ নেই, এবং ভাবতেন এটা হয়তো এমন এক যুক্তিবোধ থেকে করা, যাতে তাঁর মতো জার্মানের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এবিষয়ে তিনি নিজেকে আরও আশ্বস্ত করতে পারেন এই দেখে যে, শহরের অনেকগুলো ঝর্ণাই, তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, তখনও কাজ করছে, যখন কিনা সেই এপ্রিলেই পত্রিকাগুলো জানিয়েছিল, পানির স্থিতি প্রতিদিন দেড় লক্ষ লিটার করে কমছে। এর এক সপ্তাহ পরে এটা ঘোষণা করা হয় যে, কারাকাসের পানির সবচেয়ে শক্তিশালী উৎস টুই নদীর মুখে তারা কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের ব্যবস্থা করছে, যা কর্তৃপক্ষকে এক ধরনের আশাবাদ যোগায়। কিন্তু এপ্রিলের শেষেও কোনো বৃষ্টি হয় না। গরীব পাড়াগুলোকে পানি ছাড়াই চলতে হয়। আবাসিক এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহ দৈনিক এক ঘণ্টায় সংকুচিত করা হয়। অফিসে বসে, যেহেতু তাঁর কোনো কিছু করার ছিল না, তিনি সাইডরুল টেনে হিসাব করে দেখেন যে, এভাবে চললে আগামী বাইশে মে পর্যন্ত পানি পাওয়া যেতে পারে। তিনি ভুল প্রমাণিত হন, হয়তো বা পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের কোনো প্রমাদের কারণে। মে মাসের শেষেও পানির সরবরাহ সীমায়িত ছিল, কিন্তু তখনও কিছু গৃহবধূ তাদের গাছে পানি দেওয়ার ব্যাপারে অনড় থাকেন। একটি বাগানে, ঝোপের আড়ালে, তিনি ছোট্ট লুকনো একটি ঝরনা দেখেন, সেই এক ঘণ্টার সরবরাহের মধ্যেও বাগানে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে। তিনি যে-দালানে থাকতেন সেখানকার এক মহিলা দম্ভভরে জানান, এর মধ্যেও তিনি একদিনও তাঁর স্নান বাদ দেননি। প্রত্যেক সকালে তিনি সম্ভাব্য সবকটা পাত্রে জল ধরে রাখতেন। এখন, আকস্মিকভাবে যথাযথ সাবধানতার সঙ্গে ঘোষণা করা হলেও, খবরটি প্রতিটি সংবাদপত্রে বিস্ফোরণের মতো করে প্রকাশিত হয়। লা মারিপোসার জলাধারে আর কয়েক ঘণ্টার মতো পানি আছে মাত্র। স্যামুয়েল বুরকার্ট, যার দাড়ি কামানো নিয়ে সমস্যা আছে, দাঁত পর্যন্ত মাজতে পারেননি। তিনি অফিসে যান, এই কথা ভাবতে ভাবতে যে, যুদ্ধের সময়েও, এমনকি যখন তিনি আফ্রিকান কপ্র্স-এর সঙ্গে পিছু হটছিলেন মরুভূমির মাঝখান দিয়ে, তখনও তৃষ্ণার কারণে এতটা বিপন্ন বোধ করেননি তিনি। রাস্তাগুলোতে ইঁদুর মারা পড়ে জলতেষ্টায়। শান্ত থাকার কথা বলে সরকার।

দশ বছরের মধ্যে এই প্রথমবার, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত তাঁর অফিসে পায়ে হেঁটে যান তিনি। গাড়ি নিতে সাহস করেননি সেটা অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ার ভয়ে। কারাকাসের অন্যসব অধিবাসী তাঁর মতো এতটা সাবধান ছিল না। তিনি প্রথম যে-গ্যাস স্টেশনের পাশ দিয়ে গেলেন সেখানে গাড়ির লম্বা লাইন ছিল, এবং সর্বগ্রাসী ড্রাইভারেরা পাম্পের মালিকের সঙ্গে তর্ক করছিল খুব। তারা গাড়ি ভর্তি করে গ্যাস নিয়েছিল এমন প্রত্যাশায় যে, সঙ্গে যথেষ্ট পানিও পাবে স্বাভাবিক দিনগুলোর মতোই। কিন্তু কিচ্ছু করার ছিল না। কেননা এতগুলো গাড়িকে দেওয়ার মতোই পানিই যে ছিল না সেখানে। আবেনিদা উর্দানেতাকে চেনা যাচ্ছিল না: সকাল নয়টাতেও সেখানে দশটার বেশি গাড়ি ছিল না। রাস্তার মাঝখানে মালিক কর্তৃক পরিত্যক্ত কিছু অত্যুত্তপ্ত গাড়ি পড়ে ছিল। দোকানগুলোর ধাতব ঝাঁপের গায়ে লেখা ছিল, “পানির অভাবে বন্ধ।” সেই সকালে তারা ঘোষণা দিয়েছিল, দিনের ব্যস্ত সময়গুলোতে বাস চলবে। সকাল সাতটায় বাসস্টপগুলোতে লাইন ছিল কয়েক ব্লক লম্বা। অ্যাভিনিউয়ের বাকি অংশকে স্বাভাবিকই লাগছিল তার ফুটপাথসমেত, কিন্তু বিল্ডিংয়ের ভেতরে কেউ কাজ করছিল না। সবাই দাঁড়িয়ে ছিল জানালায়। বুরকার্ট একজন বেনেসুয়েলীয়কে জিজ্ঞাসা করে সবাই জানালায় দাঁড়িয়ে কী করছে, সে জবাব দেয়।

“তারা পানি-না-থাকার দিকে তাকিয়ে আছে।”

দুপুরে গরম যেন হামলে পড়ে কারাকাসের ওপর। আর ঠিক তখনই অস্বস্তিটি শুরু হয়। সারা সকাল, আইনসের ট্রাকগুলো, যাদের ধারণ ক্ষমতা প্রায় কুড়ি হাজার লিটারের মতো, আবাসিক এলাকাগুলোতে পানি দিয়ে গেছে। পেট্রোলিয়াম কোম্পানির ট্যাংকারগুলোকেই পানির ট্রাকে পাল্টে নিয়ে তারা তিনশটির মত গাড়ি বানিয়েছে রাজধানীতে জল সরবরাহের জন্য। প্রতিটি, সরকারি হিসাব মতে, দিনে সাতবার পানি বিতরণ করতে পারে। কিন্তু একটি অপ্রত্যাশিত সমস্যার কারণে প্রকল্পটি বিঘ্নিত হয়। সকাল দশটা থেকেই এলাকার প্রবেশপথগুলো জ্যামে আটকা ছিল। তৃষ্ণার্ত জনগণ, বিশেষ করে গরীব পাড়ায়, ট্যাংকারগুলোর গায়ে পদাঘাত করতে শুরু করলে সশস্ত্রবাহিনীর হস্তক্ষেপ দরকার হয়ে পড়ে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য। পাহাড়ের অধিবাসীরা, নিশ্চিত যে, জলের সরবরাহ তাদের বাড়ি অব্দি পৌঁছাবে না, মরিয়া হয়ে নিচে নেমে আসে জলের সন্ধানে। ছাত্রবাহিনীর পিকাপ ট্রাকগুলো তাদের লাউড স্পিকারসমূহ ব্যবহার করে আতঙ্ক কমিয়ে আনতে পারে কিছুটা। একমাত্র যার কার্যক্রমকে তখন পর্যন্ত সীমিত করা হয়নি, সেই রাদিও নাসিয়নালের বেতারপ্রবাহ কাজে লাগিয়ে, দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে গভর্নমেন্ট কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট তাঁর চার মিনিটের বক্তৃতায় জনগণকে শান্ত থাকতে বলেন। এর পরপরই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, ইউনিভার্সিটি ফ্রন্টের দলনেতা এবং প্যাট্রিয়টিক কাউন্সিলের প্রধান। বুরকার্ট, যিনি পাঁচ মাস আগে পেরেস হিমেনেথের বিরুদ্ধে জনগণের বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাঁর অভিজ্ঞতা বলে, কারাকাসের মানুষ বিশেষভাবে সুশৃঙ্খল। সবার ওপরে, রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা ও প্রচারপত্রের সমন্বিত প্রচারাভিযানের বিষয়ে তারা খুব স্পর্শকাতর। তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল না যে, এই লোকেরা জানে, জরুরি অবস্থায় কীভাবে সাড়া দিতে হয়। ফলে, এই মুহূর্তে আপাতত একটি বিষয়ই তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল, সেটা হচ্ছে জলপানের তৃষ্ণা। তিনি তাঁর অফিসটি যে-পুরনো দালানে অবস্থিত ছিল তার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন এবং ল্যান্ডিংয়ে একটি মৃত ইঁদুর দেখতে পান। তিনি এটা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবেন না। কিন্তু দুপুর দুটোয় তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া পানির ট্যাংকার কর্তৃক বিলি-করা লিটার খানেক পানি পান করে, সেই বিকালে একটু বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য তিনি যখন ব্যালকনিতে যান, তখন প্লাজা দেলা এস্ত্রেইয়াতে বেশ উত্তেজনা দেখতে পান। রাস্তায় ভিড়করা লোকেরা একটি ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখছে : তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বিড়াল, কুকুর, ইঁদুরজাতীয় প্রাণীরা সব পরিত্রাণের সন্ধানে দালান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসছে। সে-রাতে, দশটা নাগাদ, সরকার কার্ফু ঘোষণা করে। গুমোট গরমের মধ্যে, রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে তখন, অসাধারণ এক সেবাকর্মে রত ঝাড়–দারদের কাজের শব্দ শোনা যাচ্ছিল কেবল প্রথমে রাস্তা থেকে, তারপর দালানের অভ্যন্তর হতে, জলতৃষ্ণায় মৃত প্রাণীদের শবদেহ সংগ্রহ করে আনছিল তারা।

লস তেকেস এর দিকে পলায়নরত জনতার রৌদ্রদগ্ধ হয়ে মৃত্যুঃ

খরা তার চরমে পৌঁছানর আটচল্লিশ ঘণ্টা পর শহরটি পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পানামা থেকে পানির ড্রাম ভর্তি বিমানের বহর পাঠায়। বেনেসুয়েলার বিমানবাহিনী এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থগিত করে পানি পরিবহণের কাজে মন দেয়। মাইকেতিয়া ও লা কার্লোতা বিমানবন্দরও আন্তর্জাতিক বিমানচালনা বন্ধ করে দিয়ে সেই জরুরি কাজে আত্মনিয়োগ করে। কিন্তু তারা যখন শহরে পানি বিতরণ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়, তখন তার ত্রিশ শতাংশই বাষ্প হয়ে উবে যায় প্রখর উত্তাপের কারণে। লাস মের্সেদেস, সাবানা গ্রান্দে তে, ৭ই জুনের রাতে পুলিশ কয়েকটি ডাকাতি-করা ট্রাককে আটক করে, যারা বিশ বলিবারে এক লিটার দরে পানির চোরাকারবার করছিল গোপনে। সান আগুস্তিন দেল সুরে লোকেরা আরও দুটো সেরকম ট্রাক দেখতে পায় এবং তার অভ্যন্তরীণ রসদটুকু দারুণ শৃঙ্খলায় বাচ্চাদের কাছে বিতরণ করে দেয়। লোকদের শৃঙ্খলা ও সংহতিবোধের কল্যাণে, ৮ই জুনের রাতে কেউ মারা যায় না তৃষ্ণায়। কিন্তু সন্ধ্যার পর, একটা বোঁটকা গন্ধ শহরের রাস্তাগুলোকে গ্রাস করে। রাতের মধ্যেই এই গন্ধ অসহনীয় হয়ে ওঠে। রাত আটটায় স্যামুয়েল বুরকার্ট তাঁর বোতল হাতে নীচে নেমে আসেন এবং আধঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন, বয়স্কাউটদের চালানো পানির ট্রাক থেকে তাঁর বরাদ্দের এক লিটার পানি সংগ্রহের জন্য। তিনি একটি ব্যাপার লক্ষ করেন – তাঁর প্রতিবেশীরা, যারা কিছুকাল আগেও সবকিছু হালকা ভাবে নিয়ে এই সংকটকে এক ধরনের উৎসবে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল, তারাও ততক্ষণে গভীরভাবে আতঙ্কিত হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে গুজবগুলোর কারণে। দুপুরে শুরু হয়ে, ঠিক যখন সেই বাজে গন্ধটি পাওয়া যায়, একগুচ্ছ আতঙ্কজাগানো গুজব গোটা এলাকা সয়লাব করে দেয়। বলা হয় যে, শোচনীয় খরার কারণে কারাকাসের কাছের পাহাড়, পার্ক সব জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। আগুন লেগে যাওয়ার পরে তাদের আর কিছুই করার নেই। আর, দমকলবাহিনীরও এই আগুন নিবানোর কোনো সক্ষমতা নেই। এর পরের দিন, রাদিও নাসিয়নাল ঘোষণা করে, এখন থেকে আর কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হবে না। রেডিও স্টেশনগুলো প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার কারণে সারাদিনে কেবল তিনটি খবর বুলেটিন থাকবে। শহর তখন এমনিতেই গুজবের করুণায় চলে গিয়েছিল, অধিকাংশ সময়েই অজ্ঞাত উৎস হতে উৎপন্ন সেগুলো মূলত চাউর হচ্ছিল টেলিফোনের মাধ্যমে।

বুরকার্ট শুনেছেন যে, গোটা গোটা পরিবারই কারাকাস ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। যেহেতু কোনো বাহন ছিল না, সেহেতু এই বহির্গমন সংঘটিত হচ্ছিল পদব্রজে, বিশেষ করে মারাকায় এর দিকে একটি গুজবে শোনা যায় যে, বিকালের দিকে লস তেকেস যাওয়ার পুরনো পথে, পলায়নপর কারাকাসের এক ভীতসন্ত্রস্ত জনতা রৌদ্রদগ্ধ হয়ে মারা পড়েছে। খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা উন্মুক্ত শবদেহগুলোকেই এই বদগন্ধের উৎস বলা হয়। বুরকার্টের কাছে এই ব্যাখ্যাকে অতিরঞ্জিত মনে হয়, কিন্তু তিনি এটুকু লক্ষ করেন যে, অন্তত তার এলাকায় আতঙ্কের সূত্রপাত হয়ে গেছে।

ট্যাংকার ট্রাকগুলোর পাশে ছাত্রবাহিনীর একটি পিকআপ এসে দাঁড়ায়। জনতা তার দিকে দৌড়ে যায়, এই গুজবের সত্যতা আছে কিনা জানার জন্য। একটি ছাত্র গাড়ির ছাদে উঠে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে উদ্যত হয়। তার কথামতো, লস তেকেস এর পথে পড়ে থাকা শবদেহদের সংবাদ ডাহা মিথ্যে। তাছাড়া, এটা ভাবাটা অলীক যে, খারাপ গন্ধের উৎস সেটাই। চার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে লাশেরা সেভাবে পচে গলে যেতে পারে না। সে নিশ্চয়তা দেয় যে, বন ও পার্কগুলোকে টহল দেওয়া হচ্ছে দাবানল এড়ানোর জন্য, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে, জনসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে সহযোগিতা করছে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সারা দেশ থেকে কারাকাসের উদ্দেশে যথেষ্ট পরিমাণ পানির সরবরাহ হবে জনস্বাস্থ্যর নিশ্চয়তা দিতে। সে মানুষজনকে এই সংবাদ ফোনের মাধ্যমে প্রচার করতে অনুরোধ করে, এই সতর্কবাণী সহযোগে যে, এইসব গুজব প্রচার করা হচ্ছে পেরেস হিমেনেথের সমর্থকদের দ্বারা।

গভীর নীরবতায় অন্তিম প্রহরের পূর্বের এক মিনিটঃ

তাঁর বরাদ্দের এক লিটার পানি নিয়ে স্যামুয়েল বুরকার্ট পৌনে সাতটার দিকে বাড়ি যান, রাদিও নাসিয়নালের সাতটার সংবাদ শুনবেন বলে। ফেরার পথে তিনি তার সেই প্রতিবেশীর দেখা পান যিনি সেই এপ্রিল থেকে তার বাগানে পানি দিয়ে আসছিলেন। তিনি আইনসের ব্যাপারে খুব ক্রুদ্ধ ছিলেন এই অবস্থাটা আন্দাজ না করতে পারার জন্য। বুরকার্ট ভাবেন তার প্রতিবেশীর দায়িত্বহীনতার বুঝি কোনো সীমা নেই।

“আপনাদের মতো লোকদেরকেই দায়ী করা উচিত,” তিনি ক্ষেপে গিয়ে বলেন। “আইনস আমাদেরকে সুদিনে পানি সাশ্রয়ের উপদেশ দিয়েছিল। আপনি কোনো পাত্তা দেননি। আর তার জন্য মূল্য দিচ্ছি এখন আমরা।”

রাদিও নাসিয়নাল ছাত্রদের দেওয়া তথ্যেরই পুনরাবৃত্তি করে। বুরকার্ট অনুধাবন করেন, অবস্থা খুব মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। জনগণের মনোবল নষ্ট হয়ে যাওয়া ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এটা পরিষ্কার যে, পরিস্থিতি ততটা আশাসঞ্চারী নয় যতটা তারা উপস্থাপন করছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অর্থনীতিকে উপেক্ষা করা হচ্ছিল। গোটা শহর স্থবির হয়ে পড়েছিল। খাওয়ার বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আরও অপ্রতুল হয়ে যাবে। এই সংকটে হতভম্ব হয়ে যাওয়া জনগণের হাতে কোনো নগদ টাকাও ছিল না। দোকান, ব্যবসাপাট, ব্যাংক সব বন্ধ ছিল। সরবরাহের অভাবে মহল্লার দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল : তাদের হাতে যা ছিল সব বিক্রি হয়ে গেছে। বুরকার্ট যখন রেডিও বন্ধ করেন তখন বুঝতে পারেন, কারাকাস তার অন্তিম প্রহরে পৌঁছে যাচ্ছে দ্রুত।

রাত নটার মৃত্যুসম নীরবতায় তাপমাত্রা আরেক অসহনীয় ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছিল। বুরকার্ট দরজা জানালা খুলে দেন, কিন্তু পরিবেশের শুষ্কতা ও সেই ক্রমবর্ধমানভাবে কাবু করে দেওয়া গন্ধে স্থানুবৎ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর পানির সরবরাহটুকু ভালোমতো মেপে দেখেন এবং দুই আঙুলমতো পানি রেখে দেন পরদিনের ক্ষৌরকর্মের জন্য। তাঁর জন্য সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা – দৈনিক দাড়ি কামানো। শুকনো খাবারের পরে জেগে ওঠা তৃষ্ণা তাঁর শরীরে ধুন্ধুমার বাঁধাচ্ছিল। রাদিও নাসিয়নালের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি লবণাক্ত খাওয়া বাদ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, পরদিন থেকে তাঁর শরীরে দুর্বলতার চিহ্নসমূহ ফুটে উঠতে শুরু করবে। তিনি তাঁর সব পোশাক খুলে ফেলেন, এক আঁজলা পানি পান করেন, তারপর উত্তপ্ত শয্যায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে তাঁর দুই কানে নীরবতার প্রবল স্পন্দন অনুভব করতে থাকেন। মাঝেমধ্যে, দূরে কোথাও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে কার্ফুর শিথিল আলস্য ফালাফালা হয়ে যাচ্ছিল। বুরকার্ট চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখতে থাকেন যে, চকচকে উজ্জ্বল, শাদা রংয়ে রাঙানো মাস্তুলের একটি কালো নৌকো করে তিনি হামবুর্গ বন্দরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। নৌকো ঘাটে ভিড়লে তিনি দূরে বন্দরের উল্লাসধ্বনি শুনতে পান। তারপর চমকে জেগে উঠে দালানের প্রতিটি তলা থেকে মানুষজনের রাস্তায় বেরিয়ে আসার শব্দ শুনতে পান তিনি। উষ্ণ ও বিশুদ্ধ জলের ঝাপটা জানালা দিয়ে ভেতরে আসছে। কী ঘটছিল সেটা বুঝতে তাঁর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে – বৃষ্টি হচ্ছিল বাইরে।

এপ্রিল ১১, ১৯৫৮, মোমেন্তো, কারাকাস



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *