হিলুয়াছড়া ও বৃষ্টির সংহরণ
পাপড়ি রহমান
পাপড়ি রহমান
এক
বৃষ্টির নামগন্ধ দূরে থাকুক,আসমানের কোথাও তখনো মেঘের চিহ্নমাত্র নাই। অস্বস্তিকর ভ্যাপসা গরমের তীব্রতায় ওই শহর একেবারে নেতিয়েপেতিয়ে রয়েছে। যেন বা মোরগফুলের মতো লাল টুকটুকে সূর্য ঝুলে রয়েছে তার মাথার ওপর। মাথার উপর সূর্য ঝুলছিল ঠিকই, কিন্তু তার রঙ অতটা চড়তা ছিল না। অবশ্য সূর্যের সঠিক রঙ তাদের দুজনের কেউই ধরতে পারছিল না। পারার কথাও নয়। এরকম না-সকাল না-দুপুরের বিদঘুটে সময়ে সূর্য কেমন যেন ভাব ধরে থাকে! আলোর ডালপালাতে কিছু আঁব ঢেলে দিয়ে খামাখাই নিজেকে রহস্যময় করে তোলে। তখন সূর্যের দিকে ভালো করে তাকানো যায় না। তাকালেও চক্ষুদ্বয় আপনাআপনিই বুজে আসে।
বাইকের দ্রুতগতিকে বেমালুম গায়েব করে দিয়ে সূর্য বা মেঘ বা আসমানের ছিটেফোঁটা দেখার সুযোগ তাদের ছিল না। কারণ তারা ছিল আপনাতে মগ্ন। নিবিড় প্রশান্তিতে ভরপুর কোনো হংসমিথুন! পালকে পালক লাগিয়ে নিজেদের স্পর্শের ভেতর সমর্পিত। তবে স্পর্শ বলতেও ততটুকু–শুধুমাত্র গায়ে গা লাগিয়ে বসা। পুরুষটির কোমর পেঁচিয়ে ধরেছে নারীটির দুইবাহু–যেন কোনো স্বর্ণলতা জড়িয়ে আছে পুরুষ্ঠ বৃক্ষের কাণ্ড! ভালো করে জড়িয়ে রাখার বাসনায় দুইহাতের দশ আঙুল শক্ত করে গেঁথে গেছে একে অপরের ভেতর।
সাঁ সাঁ শব্দে বাইক ছুটে চলেছে বাতাসের আগে আগে। যেন কোনো পঙ্খীরাজ আজ পরিযায়ী পাখিদের উড়াল পেয়েছে। ফলে তার গতি হয়েছে দুর্বার। মুহুর্তে পেরিয়ে যাচ্ছে চেনা-শহর, শহরের কোলাহল, মসৃণ পথঘাট আর নাগরিক আলোর গোলকধাঁধা। যত পিছুটান সব পেছনে ফেলে সে আজ উদ্দাম ছুটে চলেছে। আর কিছুক্ষণ বাদেই যেন তেপান্তরের মাঠঘাঠ পেরিয়ে যাবে। পেরোবে সাতসমুদ্দুর তেরোনদী! আর পৌঁছে যাবে কোনো অচেনা মুলুকে। যে মুলুকে তাদের চেনাপরিচিত কোনো জনমানুষ নাই। যে মুলুকের চারধারে জলকল্লোল। সেখানে ঢেউয়ের অবিরাম দীর্ঘশ্বাস আর গাঙকলার জলনৃত্য! পথ ভুল করে করে কচুরিপানার ঠেক ভেসে যাচ্ছে কোন দূরদেশে! যে জলভূমে পদ্ম ফোটে অবিরাম। আর তার পাতায় পাতায় নেচে বেড়ায় জলময়ূরী আর ময়ূরের দল।
তাদের সদ্যোজাত ছানাপোনারা জলে ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠে। সরু সরু ঠ্যাং নিয়ে আলতো করে পদ্মপাতার ওপর পদচিহ্ন এঁকে যায়।
এরকম কোনো জলাধারের পাশে পঙ্খীরাজ থেমে পড়লে তারা ঘরে ফেরার কথা বেমালুম ভুলে যাবে। অবশ্য ঘরে ফেরার কথা তারা ভুলে যেতেই চায়। তাদের দুজনের সাকিন আলাদা। ঘর সম্পূর্ণ আলাদা। সে ঘরে একে অপরের প্রবেশাধিকার কোনোকালেই হবে না। হবার সম্ভাবনাও নাই। তবুও যেন তারা সহজিয়া।তবুও তারা ছায়াসঙ্গী। তবুও তারা পথ চলে। হোক না সে পথ ভুল, কন্টকাকীর্ণ। ভুল পথেই কখনো ফুটে ওঠে প্রকৃত কুসুম। এই কুসুম ফোটে লোকচক্ষুর অন্তরালে। একেবারে নিভৃতে ফুটে থাকে সে! সৌরভ বিলিয়ে ফের নিভৃতেই ঝরে যায়। কেই বা চেনে তাকে? কেই বা মনে রাখে? কেইবা জানে তার ঝরে যাবার ইতিবৃত্ত? তবুও অনাদিকাল ধরে প্রকৃত কুসুম ফোটে নিজেদের গরজেই। ফোটে আপনাআপনিই।
পঙ্খীরাজ বাইক ছুটতে ছুটতে কোনো সুবর্ণ জলাধারের সন্ধান না পেলেও সন্ধান পায় এক সবুজ পারাবারের। বিস্তীর্ণ সবুজ যেখানে লুটিয়ে রয়েছে। কী অপরূপ শান্ত শ্যামলিমা! টিলার পর টিলা সবুজ মখমলের আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছে। চা বাগানের মাঝ দিয়ে চলে গেছে সর্পিল গতির পথ। ঠিক পথও নয়, ইটসুরকির কদাকার নগ্ন হাসি। আর গাঢ় বাদামি মাটির বাঁকা ইশারা! কোথাও কোথাও মাটি লালচে হয়ে ফিক করে হেসে ফেলেছে। কোথাও-বা এবড়োথেবড়ো পথের ফাঁদ। খুব দক্ষ হাতে বাইকার সামলে নেয় এইসব পথের গোলকধাঁধা। জল জমে থাকা পিচ্ছিল সরু-পথে বাইকের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখে তার সমর্থ কব্জি। চাবাগানের পথঘাট বন্ধুর,কিছুদূর এগোলেই মারাত্মক ফাঁদের হাতছানি–এটা সে আগেভাগেই জানে। তার না জানার কথাও নয়। কারণ এই পথ ধরে তার যাতায়াত কম নয়। হপ্তায় বা মাসে দু-একবার সে বা তারা আসে। হিলুয়াছড়া চাবাগানের শেডট্রির শাখায়-পাতায় রোদ্দুর ঝুলন্ত থাকতেই থাকতেই আসে। কারণ রাত নেমে এলে এখানে পথ বড় শংকুল। পথ চেনা বড় দুস্কর। অথচ পথ ভুল করা বড় অনায়াস। বড় সহজ। ফলে সাঁঝের কুটিল চক্র চাবাগানকে গ্রাস করার পূর্বেই তারা আসে। সে বা তার দুই-একজন নিকট-বন্ধু।আসে দিলীপ গুঞ্জর দোকানে। দোকান বলতে পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালের ওপর টালি ছাওয়া ঘর। তারা যখন আসে তখন দোকান জুড়ে সান্ধ্য আরতির ধূপের সুঘ্রাণ। খানিক বাদেই ধূপের গন্ধের সঙ্গে মদের গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। অন্যদের চাইতে গুঞ্জর দোকানে কাস্টমারের ভীড় বেশি। কারণ গুঞ্জ লিকার দেয় ভালো। গুঞ্জর দোকানের লিকারে ভেজাল-ফ্যাসাদ কমই থাকে। সেভেন্টির সাথে টিউবলের বিশুদ্ধ জল পরিমিত মিশিয়ে লিকারের স্বাদ অপরিবর্তিত রাখে। চাট হিসেবে প্লেটে ঢেলে দেয় বুট-বাদাম, চানাচুর-পেঁয়াজু। গুঞ্জ লিকারের দাম দুম করে বাড়িয়েও দেয় না।বরাবরই সে লিটার প্রতি দেড়শ টাকা করে নেয়। অবশ্য বছর কয়েক আগে গুঞ্জ এর অর্ধেক দামেই লিকার বিকাতো। এখন আক্রার বাজার বলে তাকে দাম কিছুটা বাড়াতে হয়েছে। গুঞ্জর দোকানের লিকারের কারণে হোক বা চা বাগানের মনোরম ঘোরগ্রস্ততার জন্য হোক, বাইকার পুরুষটি হিলুয়াছড়ার পথঘাটের হদিস ভালোই জানে।
কিন্তু আজ যেন কোন ভুলভুলাইয়া তাকে সহসা পথ ভুলিয়ে দেয়। বাতাসের আগে আগে বাইক ছুটিয়েও সে সঠিক পথের নিশানা খুঁজে পায়না। এ পথ থেকে সে পথে উড়ে চলে তারা। এ টিলা থেকে ওই টিলা। টিলার গা বেয়ে চা গাছের সুচারু সারি। আর কালচে সবুজের মায়াময় হাতছানি। পুরুষটি যে ভুল পথে উড়ে চলেছে তাতে নারীটির বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নাই। বরং সে উপভোগের নেশায় মজে আছে। দুপুরের কড়কড়ে রোদ্দুর দ্রুত শেডট্রির শাখা-পাতায় মিয়ম্রাণ হয়ে যাচ্ছে। আর ধীরে ধীরে খর্বকায় চা গাছের ভেতরে ঢুকে পড়ছে সরু-সোনালি-ঢেউ নিয়ে! সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য তাকে রীতিমত মোহিত করে রেখেছে। বাইকের শ্লথ চলার সঙ্গে কিছুটা সবুজ ভক্ করে ঢুকে পড়ছে তার নাসারন্ধ্রে। নারীটি ভালো করেই জানে, বন-বনানীর একধরণের বুনো-সবুজ গন্ধ আছে। আর অরণ্যের আছে একেবারে আলাদা সঙ্গীত। যে সঙ্গীত পাতার মর্মরে গেঁথে থাকে। অরণ্যের সঙ্গীত লেখা থাকে গাছেদের শাখায়-পাতায়-ছায়ায়। লেখা থাকে পাখিদের কণ্ঠে। যখন ঝিরিঝিরি হাওয়া বয়, তখন সেই সঙ্গীত ধ্বনিত হয় মৃদু লয়ে। যেন কোনো দূর নির্ঝরিনী খুব সঙ্গোপন বারতা পাঠিয়ে দিচ্ছে তার গোপন প্রেমিকের কাছে, বাতাসের ডানায় ভর করে।
অরণ্যের সঙ্গীত লোকালয়ের জন্য নয়।নাগরিক কোনও মানুষের জন্য নয়। যার বুকের ভেতর গোপন কোনো মায়াবৃক্ষ বেড়ে ওঠে কেবল সেই তা শুনতে পায়। এবং এই মহুর্তে নারীটি শোনে সেই গান। পত্র-পল্লবে, মর্মরে যে গানের স্বরলিপি লেখা আছে। শোনে সেই বিষাদিত সুর, যা ইতোপূর্বে সে আর কোনোদিন শোনেনি। যেন কেউ খুব করুণ সুরে ভায়োলিন বাজিয়ে চলেছে। যেন এই বনভূমি নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। যে কান্নায় ঝরে পড়ছে পৃথিবীর বিষাদিত সব ইতিহাস! অরণ্যের গান শুনতে শুনতে তার দুই চক্ষু ঘুমে বুজে আসে। যেন সে এক্ষুণি ঢলে পড়বে কোনো মায়াময় গাঢ় নিদ্রার হাতছানিতে।
দুইপাশের উঁচা উঁচা টিলাগুলি চাগাছের গালিচায় ঢেকে আছে। নারীটি দেখে–ধীরে,অতিধীরে সে বিস্তীর্ণ এক সবুজ-সমুদ্দুর পেরিয়ে যাচ্ছে। শেডট্রির অদূরে দুই-একটা বনস্পতি আকাশের ঠিকানা আড়াল করে রেখেছে। তারা দুইজন যেন পৃথিবীর সেই আদিম মানব আর মানবী। আদম আর ঈভ। সদ্যই যারা এই পৃথিবীতে অবতরণ করেছে। নারীটি ক্ষণকাল এমন ঘোরের মাঝে নিমজ্জিত হতে হতে জোরে আকড়ে ধরে তার সঙ্গীটিকে। বাইকার প্রস্তুত ছিলনা। কৌশলে পতন ঠেকাতে গিয়ে হাতের স্টিয়ারিং ফসকে যায়। আর সে চাগাছের শাখা-পত্রদের আহত করে ফেলে। মুহুর্তেই সামলে নিয়ে ফের তাদের পংখীরাজ উড়াল দেয়। নারীটি ভাবে, এই সেই মোক্ষম সময়, যখন পৃথিবীর চরম ও পরম অথচ তীব্র বেদনার কথাটি বলে ফেলা যায়। নারীটি পুরুষের কোমর ছেড়ে দিয়ে দুইহাত দুইদিকে প্রসারিত করে বলে–আমি তোমাকে ভালোবাসি…।
ভালোবাসা প্রতিধ্বনিত হয়ে পুনরায় তাদের কাছে ফিরে এলে নারীটি পুরুষটির কাঁধে মুখ রেখে চিৎকার করে বলে–আমি তোমাকে ভালোবাসি, জান। আমি তোমাকে ভালোবাসি,পাখি!
বাইকারের দৃষ্টি বরাবর সামনে। বাগানের বন্ধুর পথে টাল খেলে পতন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আজ তারও যেন কী হয়েছে? সবুজ কোনো ডাইনী তাকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে।গুঞ্জর দোকানটা আজ কোথায় যেন লুকিয়ে রয়েছে। বহুবার এই পথে আসা সত্তেও সে কেন আজ খুঁজে পাচ্ছে না সেই পরিচিত ঠিকানা?
দুই
চা বাগানের রঙ যখন কোমল অথচ গাঢ়-কালচে হয়ে ওঠে তখন তারা দুইজন দিলীপ গুঞ্জর দেখা পায়। গুঞ্জর দোকানের শাটার দিবারাত্রি চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা রাখে। খোলা না রেখে তার উপায়ই বা কী? টিলার মাঝখান দিয়ে পথগুলি বেঁকে যেতে যেতে এই দোকানের প্রান্তে এসেই ফুরিয়ে যায়। যারা বেভুলো পথিক তাদের বিভ্রান্তি থেকে বাঁচাতেই যেন গুঞ্জর দোকান সাজিয়ে বসা!
বাইকার আর তার সঙ্গিনী ততক্ষণে তৃষ্ণায় ব্যাকুল। বিস্তীর্ণ সবুজ-সমুদ্দুর পাড়ি দিয়ে এসে দীর্ঘ চুম্বনের হাহাকার তাদের বিদীর্ণ করে তুলেছে। গুঞ্জর প্রায়ান্ধকার দোকানের ভেতরে দুই-তিনটা বেঞ্চ পাতা। এই বেঞ্চে বসেই সেভেন্টির লিকারে চুমুক দেয় আঁধারের গ্রন্থিকেরা। দোকানের দেয়ালের চুনকামে সবুজাভ শ্যাওলা জমে আছে। যেন বহুকাল পূর্বে এখানে কেউ মনের ভুলে চাবাগানের ছায়া ফেলে গেছে। দোকানের ছোট্ট জানালায় পর্দার বালাই নাই। খোলা জানালার বাইরে টিলার পাঁচিলের আড়াল।শুধুমাত্র দোকানের বাইরের খোলা বারান্দা থেকে ভেতরটা আলাদা করবার জন্য একটা রঙ-মলিন পর্দা ঝুলছে।
যে আদিম নারী ও পুরুষটি কিছুক্ষণ পূর্বে অরণ্যের সঙ্গীতে মর্মরিত ছিল, নিমজ্জিত ছিল–তাদের শরীরে এখন আলিঙ্গনের হিল্লোল। গরম আর ঘামের অস্বস্তি ছাড়িয়ে ধেয়ে আসা কাম তাদের বিহ্বল করে তুলেছে। লিকারের সঙ্গে টিউবলের বিশুদ্ধ জলের পরিমিত মিকচারে গুঞ্জ তাদের আরেকটু বেসামাল করে দিলে অচেনা দৃশ্যের বিভ্রান্তিতে পড়ে তারা। দেয়ালের শ্যাওলার রঙ গাঢ় থেকে ক্রমশ গাঢ়তর হয়ে ওঠে, ঠিক চাগাছের তলায় শুয়ে থাকা মাটির রঙ যেমন! দোকানের ভেতরের বেঞ্চগুলিতে আরও কিছু অন্ধকার জেঁকে বসে। যেন হঠাৎ করে বাইরের দিনের আলো কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে! অথবা অদেখা কোনো ডাইনী যাদুর মন্ত্রে তুকতাক চালান করে দিয়েছে। জমে থাকা থকথকে অন্ধকারের ভেতর সদ্য তোলা চাপাতার মৃদু-ঝাঁজালো গন্ধ নারীটির যোনিদেশ কোমল করে তোলে। তখন পুরুষটির দুইবাহু প্রসারিত হয়,জিভ তৎপর হয়। যেন কোনো সূতানলি সাপ হঠাৎ ঝাঁপি থেকে পরিত্রাণ পেয়ে ফণা তুলেছে। নারীটির অনাবৃত হলুদাভ স্তনে বাদামি আঙুরের আভা দেখে তার ছোবল ওতেই স্থির হয়। যেন এই আদিম পুরুষ এমন অমৃতের স্বাদ কোনোদিন পায়নি। দীর্ঘ চুম্বনের নেশা তাদের আলিঙ্গনকে প্রলম্বিত করে তোলে। তারা একে অপরকে নিবীড়ভাবে আঁকড়ে ধরে। যেভাবে বনস্পতির কাণ্ডে পরগাছারা আঁকড়ে থাকে। আর জীবনের নির্যাস তুলে নেয়।
নিজেদের পিষ্ট করতে করতে, চুম্বনে মদির হতে হতে তারা ভুলে যায়, সাকিন ভিন্ন হলেও তাদের ফিরে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে লোকালয়ে। ফিরতে হবে জীবনের প্রয়োজনে, বেদনা-জর্জর আলাদা আলাদা সংসারে। ঘর বা সাকিন ভিন্ন হলেও তাদের স্বাধীনতা ততটুকুই,যা তাদের স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে!
জানালার বাইরে স্তব্ধ টিলার গাছলতারা ততক্ষণে অরণ্যের সঙ্গীতে মুখরিত হয়। তারা গাইতে থাকে পৃথিবীর সবচাইতে বিষাদিত কোনো সুর। বাজাতে থাকে করুণ রাগে ভায়োলিন। পাতারা ঝরতে শুরু করে। ঝরাপাতাদের হাহাকারে শেডট্রিরা মাটির দিকে নুয়ে পড়তে চায়। যেন যেখান থেকে তাদের জন্ম হয়েছিল, সেই মাটির কন্দরেই তারা ফিরে যেতে চায়। মিশে যেতে চায় জননীর উদরে। বিলীন করে দিতে চায় নিজেদের অস্তিত্ব। হঠাৎ করে শোঁ শোঁ শব্দে দামাল হাওয়া ছুটে আসে। ঝরাপাতারা ইতিউতি উড়তে শুরু করে। মর্মরে ভরে যায় বনভূমি। আর আকাশের পশ্চিমকোণে মেঘ জমে ওঠে। মেঘেদের বড় বড় চাঙারি ঢেকে দেয় অপরাহ্ণের ম্লান সূর্যের মুখচ্ছবি।
তিন
বাইক যখন স্টার্ট নিল হিলুয়াছড়া চা বাগান তখন দিনের অন্তিম সময়ের ফিকে আলোতে গা ধুয়ে নিচ্ছে। এই আলো অনেকটা শিশুভোরের মতন। যখন আসসালাতু খাইরুম মিনার নাউম ধ্বনিত হয়, আর কিছু অন্ধকার তখনো কালোচিতার মতো হামগুড়ি দিয়ে চলতে শুরু করে। সেই প্রগাঢ় অন্ধকারে পড়ে থাকা সিকি-আধুলির মতো সামান্য সামান্য আলোরা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। দুই-একটা দোয়েল ভৈরবী গেয়ে ওঠে আর চড়াইয়ের দল আড়মোড়া ভেঙে লাগাতার ঝগড়ার প্রস্তুতি নেয়।
হিলুয়াছড়াতে আজ অন্যান্য দিনের চাইতে কিছুটা কম আলো। আকাশ ভরা মেঘের ঘনঘটায় আলো যাই যাই করেও মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে নিচ্ছে। আজ সাজিয়ে রাখা পসরা গুটিয়ে নিতে দিনের শরীরে যেন ক্লান্তির ঢল নেমেছে। দিন হয়তো ভাবছে, ফিরে গিয়ে লাভ কি? আগামীকাল ভোর ফোটাতে আবার তো তাকে ফিরে আসতেই হবে। আসতে হবে একই পথ ধরে।
বাইকার আর নারীটি জানে, এরকম নিশ্চয়তা তাদের জীবনে নাই। এমনকি তাদের মিলনেও নাই। তারা একে অপরের কাছে ফিরতেও পারে, আবার নাও ফিরে আসতে পারে।
তাদের প্রতিটা মিটিং এমন অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে বন্দী। এমনই ভাসমান। নোনা জলের তোড়ে তাদের যূথবদ্ধ প্রণয় মুহূর্তে ভেসে যেতে পারে। এ জীবনে তাদের আর একাত্ম হবার সম্ভবনা নাও আসতে পারে। এসব জেনেও তারা বারংবার আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়। তাদের তীব্র চুম্বন স্পৃহা এতে বিন্দুমাত্র প্রশমিত হয়না। শঙ্খলাগা জীবনের প্রতি তাদের এই নিষিদ্ধ আকর্ষণ কোনোভাবেই টাল খায় না। আজও তারা বিযুক্ত হতে অনিচ্ছুক ছিল। কিন্তু গুঞ্জর দোকানের বেঞ্চগুলি চূড়ান্ত কোনোকিছুর জন্য নিবেদিত নয়। দোকানের বারান্দায় আরো কিছু কাস্টমার সেভেন্টির সঙ্গে টিউবলের বিশুদ্ধ জলের মিকচারের জন্য তৃষ্ণার্ত ছিল। ফলে তারা তাদের বিদায়ী চুম্বন দীর্ঘায়িত হতে দেয় নাই। বরং আলিঙ্গনাবদ্ধ বাহুজোড়াকে দ্রুত শিথিল করে দিয়েছিল।
বাইক পথের বাঁকের একটা টিলাকে অতিক্রম করতেই ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। তাদের দুজনের কারো কাছেই বর্ষাতি নাই। তারা এসেছিল ভিন্ন ভিন্ন নিবাস থেকে। একটা চমৎকার রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন দেখে দুজনেই যাত্রা শুরু করেছিল। ফলে তারা বৃষ্টি বা মেঘের কথা একদম ভাবে নাই। যেমন তারা ভাবে না, তাদের অনন্ত বিরহের কথা। ভাবে না, অলৌকিক মিলনের কথাও। তারা আদতে কিছুই ভাবে না। সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে এক একটা মিটিং নিমিষেই যেন ফুরিয়ে যায়। মূহুর্তে নিঃশেষ হয়ে যায়। তাদের মনে হয়, তারা যেন বা সদ্য কয়েকটা চোখের পলক ফেলল মাত্র!একটা মেঘের চাঙারি ছিট্টিছান হয়ে যেতে যতটুকু সময় লাগে, ঠিক ততটুকুই সময় যেন তারা কাছকাছি ছিল! অতঃপর তীব্র হাহাকারে, বিষাদে ডুবতে ডুবতে তারা ঘরে ফেরে। তাদের মন ভেঙেচুরে যায়, দেহ অবসন্ন ঠেকে–তবুও তারা কেউ কারো কাছে ফিরতে পারে না। কাছাকছি থাকতে পারে না।
প্রতিবার বিদায় জানানোর প্রাক্কালে পুরুষটি হঠাৎ করে এ পথে সে পথে খামাখাই ঘুরে মরে। নানা ছলে সময় দীর্ঘায়িত করতে চায়। আর নারীটি চোখের জল লুকাতে লুকাতে ভাবে–আহা! যদি তাদের নিয়ে এই শহর এখুনি প্রচণ্ড ভূমিকম্পে তলিয়ে যেত। চিরকালের মতন হারিয়ে যেত ভূগর্ভে! হরপ্পা বা মহেঞ্জোদারোর সকল রহস্য নিয়ে এই শহরটাও এক্ষুনি যদি হাওয়া হয়ে যেত।
সিন্ধুনদের পাশেই একদার নিখুঁত নগরী ছিল মহেঞ্জোদারো–যার অধিবাসীরা হয়তো তাদের মতোই প্রেমার্ত ছিল, বিষাদিত ছিল। মিলন-ব্যাকুল ছিল। খাদ্য জোটাতে তারা গম আর যব চাষ করতো। মটরের বিস্তীর্ণ সবুজ জমিন ছিল তাদেরও। তারাও হয়তো নাড়ার আগুনে মটর পুড়িয়ে খেত। আর তাদের ছিল বিশাল এক স্নানাগার। তাতে স্নান করতে আসতো পূণ্যার্থীরা। তারা ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে জল ছুঁয়ে চুপ করে বসে থাকতো। আহা! সব থেকেও সেই নগরী একদিন জনমানবহীন হয়ে গেল! খাঁ খাঁ বিরান প্রান্তর হয়ে গেল! প্রেতপুরীর মতো শুনশান হয়ে গেল!
নারীটি ভাবে, আরেকটা মহেঞ্জোদারোর ইতিহাস এই মুহুর্তে সৃষ্টি হলে কি এমন ক্ষতি হয়? যদি তারা এই মুহূর্তে ভূগর্ভের নিচে চলে যায় ,তাহলে তার চাইতে সুখী আর কে হতে পারে? এ এক বিষম জ্বালা–তার জীবনের ভার বয়ে নিয়ে যায় যে পুরুষটি–তার সাথে এ জন্মে স্থায়ী কোনো বসবাস প্রায় অসম্ভব। তার সাথে কেন এত দূরত্ব রেখে এ জীবনের যাপন? কেন এমন অসহ বিচ্ছেদে তাকে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হতে হয়? আর তাকে ফিরে যেতে হয় বিষে ভরা এক পুরাতন সংসারে?
ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দামাল হাওয়া যোগ হলে জলের তোড় বেড়ে যায়। বাইকার আর নারীটি কি করবে এখন? গুঞ্জর দোকানে ফিরে যাবে? নাকি শহরের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাবে? যেদিকেই তারা যাক, কাকভেজা হওয়া থেকে, জলের হাত থেকে নিজেদের কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না। অতপর তাদের সিদ্ধান্ত–আপাতত জলে ভিজে চপচপে হওয়া যাক।
খানিক বাদে বৃষ্টি আরও ঝেঁপে নামলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের জন্ম হয়। চা বাগানে বৃষ্টিপাত নারীটি এই প্রথম দেখে। অবিশ্রাম জলধারা ঝরে পড়ছে সবুজ সমুদ্দুরের ওপর। আর চা গাছগুলিতে কেমন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। তারা খলবল করে হেসে উঠছে পলকেই। একে অপরকে কাছে টেনে নিচ্ছে। শাখা-পাতা ছুঁয়ে আদর করে দিচ্ছে। যেন অভয় দিয়ে বলছে–ভেবো না তো। এই তো আমি আছি তোমারই কাছাকছি।
বৃষ্টি ক্রমশ আরও ঘন হয়ে উঠলে তাদের দুজনের চোখ শুধু সবুজের ঢেউ দেখে। তাদের চারপাশে যেন আর কোনও রঙ নাই। সব রঙ পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে গেছে। সবকিছু বৃক্ষদের পত্র-পল্লবে ঢাকা পড়ে গেছে। শেডট্রির উঁচা উঁচা মাথা থেকে শোনা যায় অরণ্যের গান। চায়ের নাতিদীর্ঘ গাছগুলি থেকে সবুজ রঙের ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠে মুহূর্তে চারপাশ ঢেকে দিচ্ছে। বুনো-সবুজ ছায়া আর সুগন্ধের ভিতর দুই আদিম মানব-মানবী ক্রমে ক্রমে আচ্ছণ্ণ হয়ে পড়ে!
বাইকার অতি সাবধানেই পথ পেরোতে থাকে। লালামাটির উঁচানিচা পথ, কিছু্টা বাদামী আর কালো মাটির বন্ধুর পথ। কিন্তু এত মুষল বৃষ্টিতে ঠিক পথ ধরে এগোনো মুশকিল বটে। ফলে তারা পুনরায় বেপথু হয়। নিজেদের অজান্তেই হয়তো কোনো ভুলভুলাইয়ায় ঢুকে পড়ে। কিংবা চা বাগানের গোলকধাঁধার আবর্তে পড়ে যায়।অথবা কোনো সবুজ ডাইনীর মায়াতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
হঠাৎ বাইকের চাকা শূণ্যে লাফিয়ে ওঠে। ফের দড়াম করে আছড়ে পড়ে ভূমিতে।টিলার গায়ে ধাক্কা লেগে বাইকের মানুষ দুইজন জল-কাদায় গড়িয়ে পড়ে। ঠিক যেন কোনো সিনেমায় দেখা দৃশ্য! নায়ক আর নায়িকা জড়াজড়ি করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে! তারা নামছে তো নামছেই। গতি নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য দুজনেই যেন হারিয়ে ফেলেছে! জলকাদায় মাখামাখি হয়ে যখন তারা উঠে দাঁড়ায়, তখন বৃষ্টি কিছুটা মন্থর গতি পেয়েছে।বিকেলের বিদায়ী আয়োজন মেঘমুক্ত আকাশকে ধীরে ধীরে কালো শামিয়ানায় ঢেকে ফেলছে। আচানক দুজনেই চমকে ওঠে–বাদামী-হলদেটে-খয়েরি-কালো- শাদা ছোপের কোনো সরিসৃপ তাদের দিকে সবুজ দৃষ্টি মেলে অপলক তাকিয়ে আছে।দেখতে-না-দেখতেই সেই চক্রাবক্রার গোলাপি মস্তকের বিশাল মুখ হা হয়ে খুলে যায়। পুরুষটি বিস্ফোরিত চোখে সেই হায়ের দিকে তাকিয়ে সামান্য পিছু হটতে থাকে।হয়তো নারীটিকে আড়াল করার শেষ চেষ্টা চালায়। আদিম পুরুষের আলিঙ্গনের চাপে পিষ্ট হতে হতে নারীটি দেখে–অতিকায় এক অজগরের গোলাপি-কালোফোঁটা-জিভ সামান্য অদূরেই লকলক করছে। দ্রুত লেজ আছড়েপাছড়ে সাপটি তাদের দিকেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
নারীটির ঠোঁটে রহস্যময় অথচ বিষাদিত হাসির চিহ্ন দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়।চরাচর জুড়ে তখন সবুজ-আলোর ঢল নেমেছে। ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে হিলুয়াছড়া চাবাগান পুনরায় সবুজ-সমুদ্দুর হয়ে উঠেছে…।
এক কথায় অনবদ্য। যখনি পাপড়ি রহমানের গল্প বা উপন্যাস পড়ি মনে হয় নিটোল কোমল কোন কবিতা পড়ছি।সাবলিল ভঙ্গি ,প্রতিটি লাইনই যেন চিত্রকল্প ।লাইনের পর লাইনে দৃশ্য বদলের মত।গল্পটিতে দারুণ মুন্সিয়ানার সাথে তিনি আমাদের অতি স্বাভাবিক বাস্তবতার মুখামুখি করেন আবার টেনে নিয়ে যান হরপ্পা সভ্যতার নর- নারীর কাছে।প্রাকঐতিহাসিক কাল থেকেই নর- নারীর প্রেমের সংজ্ঞা এক ও অকৃত্রিম ।শব্দ ব্যবহারেও সাহসী তিনি।
দুহু কোরে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া…..
ধরিয়া যুগল করে বাঁধিয়া ছান্দন
ডোরে বাঁধে রানী নবনী লাগিয়া…….(চন্ডিদাস)
প্রতি অঙ্গেই যেন হৃদয়ের উপক্রমণিকা।উন্মাদনার বিভ্রান্তি নেই,কামনার বিহ্বলতায় অসচেতনা নেই। কিন্তু সৌরভ ও ও সমৃদ্ধিতে আনন্দের উপঢৌকন আছে।স্পর্শের উষ্ণতার সমৃদ্ধি আছে।গাছের পাতায় বৃষ্টির মত,শীতল অবগাহনের মতো সব ইচ্ছের জাগরণ যেন লেখককে কম্পিত করে।তার ভাষা আমাকে বরাবরই স্পর্শ করে।একটি ব্যঞ্জনাময় গল্প যা কিনা পরিছন্ন,পরিপূরক আকাঙ্খায় আমাদের আনন্দিত করে।
রবীন্দ্রনাথের সেই শেষ হয়েও হইলো না শেষ।গল্পের শেষে নায়ক নায়িকা যেন সেই প্রাগঐতিহাসিক যুগের দুই নর-নারী বৃষ্টি কাদায় মাখামাখি, হিংস্র সরীসৃপ ধেয়ে আসছে তাদের দিকে,নরটি চেষ্টা করছে নরীটিকে আড়াল করার, বাচাঁবার।কারণ নারী হচ্ছে সমৃদ্ধির প্রতীক ।শস্য- সম্পদে পৃথিবীকে সুশোভিত করে।তাকে বাঁচতে হবে। তারপর……