মহাকাব্য – একটি উদ্যত ভল্ল
পালেল-যুদ্ধ – প্রবাহ: ৩১
সুধীর দত্ত
যদি আসত স্বপ্নগুলি যে পথে ভেবেছি আমরা সেই পথ ধরে
এবং যেখান থেকে তোমার আসার কথা, সফলতা,
তুমি আসতে সেই দিক থেকে
তাহলে কি হেরফের, পিচ্ছিলতা ঘটে যেত কিছু?
হয়ত-বা সেরকম —
হয়ত-বা সেরকম নয়। তবু ঘটে, পরিভাষা অঘটন তার,
মানুষ নিজের মতো দেখতে চায় সবকিছু বলে।
আমিও কি চেয়েছি কিছু সেরকম?
সব কার্যের হেতু আছে?
কোন ব্যক্তিগত পাপে এত তাত, দগ্ধে দগ্ধে পুড়তে হয়েছিল বনে তাঁকে?
তাঁরও কি জানা ছিল, সোনার হরিণ কেন এসেছিল পাতার কুটির আশপাশ?
তোমাদের এই প্রেত, মৃত মানুষটি সেদিন
এই প্রশ্ন খুঁড়ে খুঁড়ে দেখেছিল ভিতর-বাহির। শুধু
রক্ত আর রক্ত দিতে হবে, — বলে
মুহূর্তে উধাও হয়ে গিয়েছিল, কিংবা এক প্রতিধ্বনি
জেগে উঠেছিল,
নাই থাক মর্টার, বিধ্বংসী ট্যাঙ্ক অথবা কামান,
নাশকতা, অন্তর্ঘাত আমাদের ভারী অস্ত্র হোক।
উপত্যকা মায়ু আমাদের, রাতুরিও এগিয়ে চলেছেন,
সরীসৃপদের মতো বুকে ভর, পিঠে বোঝা, ছোট ছোট দল,
দুর্গম পাহাড়, নদী, বন-জঙ্গল; তাউনগুপ কত দূর? মিউহাউং?
ভয়ংকর শীতের কামড়, মশা, ম্যালেরিয়া; দুর্গম পাহাড়, নদী, বন-জঙ্গল;
এয়ার কাভার নেই, সঙ্কুল এই অভিযানে
কলিজা নিঙড়ানো রক্ত, দুরন্ত পা-জোড়া, হে গভীর অরণ্য আরাকান
জয় দিয়ো, মৃত্যু দিয়ো, অগ্নির জীবন।
সেটারিন ও তাউং বাজার,
অদূরেই লেনাকট, ফোর্ট হোয়াইট, সেই সঙ্গে কেনেডি পিক পায়ের তলায়!
গুপ্তচর, সংবাদ-বাহক, শত্রুদের নড়াচড়া, টের পাওয়া যাচ্ছে কি আগাম?
সামনেই ব্রহ্মপুত্র, আগুনে সেঁকছে হাত বারুদঠাসা
গোটা বাংলাদেশ;
শুনেছি, কীভাবে তোমরা আক্রমণ শানিয়েছ, সুঁড়ি পথে, ঝোপে ও জঙ্গলে, অন্ধকারে।
চারদিকে কাঁটাতার —দূর্ভেদ্য, গুঁড়ি মেরে ঝাঁপ দিয়েছ সঙ্গীন উঁচিয়ে পরিখায়।
কিংকর্তব্যবিমুঢ় গুর্খারা
মাথার উপর হাত —সারেন্ডার; বধ করনি খালসা শিখ –সৎ শ্রী আকাল।
মুহূর্তে পিল-বক্স থেকে এক হলকা সশব্দ আগুন
অতর্কিতে ছুটে এলে
শব্দভেদী একটি নাগা-বর্শা উড়ে যায়।
এ-ফোঁড় ও-ফোড় বুক কেঁপে ওঠে অন্ধকার, পালেলের এয়ার-স্ট্রিপ, বোমারু, ফাইটার।
ছিন্নভিন্ন শত্রুব্যূহ, য়াপু পাহাড়ের চূড়া, নিশ্চিন্ত শত্রুঘাঁটি।
হায় দেশ, আমার স্বদেশ,
সর্পভ্রমের মতো রজ্জুতে দেখছ নিপ্পন! আর
সুখী গৃহকোণ ছেড়ে —দুধভাত, ঘরের ছেলেরা
মুখে রক্ত তুলতে তুলতে
কপালে আঁকছে রক্ত, কখনও-বা নদীপারে চন্দনাভ মাটির তিলক।
এই তো দূরে পাকদণ্ডী সরু রাস্তা, প্রকান্ড পিঙ্কোডা গাছ, ভাঙা ফুঙ্গি চঙ,
ঝুলে-থাকা পাথরখণ্ডে আংগ্রেশু পাহাড়চূড়ায়
একটি সংকেত-চিতা জ্বলছে দাউদাউ।
ব্রাভো সাথীগণ,
বিয়ার বা পর্ক নয়, হে ঈশ্বর, তুমি আছ, শক্তির উৎস ও আগুন ,
যদি চাও আরও রক্ত, আমরা প্রস্তুত,
এই তো মাথার ওপর
শিস দিতে দিতে ছুটছে কামানের গোলা, দিগবিদিক, দূরে
কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া, জনপদগুলি ধ্বংস —
শস্য, শ্যামলতা, চারদিকে
পোড়ো জমি, ছিন্নভিন্ন দেহাংশগুলি, কার্পেট বম্বিং, প্যালেল
বিমানঘাঁটি আমাদের,আক্রমণের জন্য কোনও বিমান নেই, মাথার উপর
ছাদ –আকাশপথ খোলা,
তুমুল লড়াই চলছে প্রশান্ত সাগরে, নিপ্পন জুঝছে একা, কে জানে, কোনদিকে মেষপালক
তাড়িয়ে নিয়ে চলেছেন, এঁদো গলি, সিধে পথ, বাঁকাচোরা পাহাড়ের খাঁজে
কোথায় কী লুকোনো আছে, ভবিতব্য কালের
পুঁথিতে।