আগুনের ফুলকি
দীপান্বিতা রায়

বউমা, আনন্দনাড়ুগুলো আলাদা বয়েমে ভরে রেখেছো তো?
বসার ঘর থেকে শাশুড়ির গলা শুনে নিজের মনেই জিভ কাটে বিনতা। পাশেই কাঠের বারকোশের ওপর রাখা আছে নাড়ুগুলো। চিনামাটির বয়েমটাও নামিয়ে এনেছে ঠাকুরঘর থেকে। কিন্তু তারপর আর তুলে রাখা হয়নি। মাথা থেকে বেরিয়েই গেছে কথাটা। আসলে মাথারও পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। সেই দুপুর থেকেই তো নাটা-ঝামটা চলছে। আনন্দনাড়ু নামিয়েই নারকেলের কড়া বসাতে হয়েছে। তারমধ্যে তিলগুলো ঝেড়ে-বেছে গুছিয়ে রাখার কাজও ছিল। ঝাড়া-বাছার কাজটা যদিও তোলা কাজের লোক মানদা করে দিয়েছে, কিন্তু নজর তো রাখতে হয়েছে বিনতাকেই। আর নারকেলের পাক তো একবার উনুনে বসালে আর তার পাশ থেকে ওঠার জো নেই। বিনতা তাই গলা তুলে বলল, – করে দিচ্ছি মা। এই নারকেলের পাকটা হয়ে এসেছে। নামিয়েই নাড়ুগুলো তুলে রাখব। আর সেই ফাঁকে নারকেলটা জুড়িয়ে যাবে। গরম গরম না পাকালে কি আর নাড়ু
ঠিকঠাক হয়…
বিরক্ত হয়ে নিচু গলায় গজগজ করলেন সরমাদেবী। আনন্দনাড়ুগুলো বানানো হয়েছে অন্তত ঘণ্টাদুয়েক আগে। এবার পুজো একেবারে আশ্বিনের গোড়ার দিকে। তাই এখনও মেঘ-বাদলা চলছেই। বেশিক্ষণ নাড়ু বাইরে থাকলে ভসকা হয়ে যাবে, স্বাদ থাকবে না। বড়বউমার যদি কোনও কাণ্ডজ্ঞান থাকে। এতবছর বিয়ে হল এখনও একটা কাজ গুছিয়ে করতে পারে না। আসলে বুদ্ধি-শুদ্ধি তেমন নেই তো। সেনবাড়ির বউ হলে যে সব দিকে নজর রেখে চলতে হয় সেটা এতদিনেও বুঝে উঠতে পারল না…
কথাগুলো সরমাদেবীর মনের মধ্যে বুড়বুড়ি কাটলেও চোখ কিন্তু নড়ছিল না। টেলিভিশনে ‘মিষ্টিমউ’ চলছে। এই সিরিয়ালটা না দেখলে তাঁর ভাত হজম হয় না। এরপরে আবার দিন বদলের পালা আছে। তখনও ওঠা যাবে না। বসার ঘরেরই একপাশে টেবিলে বসে ল্যাপটপে একমনে কাজ করছে ছোটবউ সুচেতা। অফিসেরই কাজ নিশ্চয়। সারাদিন খেটেখুটে এসে আবার বসেছে কাজ নিয়ে। ডাকা উচিত নয়। তাও একটু দোনোমোনো করে সরমা বললেন, সুচেতা আনন্দনাড়ুগুলো তো এখনও বাইরে পড়ে আছে। একটু বয়ামে ভরে ঠাকুরঘরে তুলে রেখে আসবে নাকি!
আমি এখন পারব না, মা। এই রিপোর্টটা আজ রাতেই জমা দিতে হবে। অফিসেই কাজটা শেষ করে আসতে পারতাম। কিন্তু মিতুলকে কোচিং থেকে আনতে হবে বলে তাড়াতাড়ি বেরোতে হল। আপনার ছেলের তো আজ মিটিং আছে, ফিরতে দশটা বাজবে।
সরমা কিছু না বলে আবার টিভির পর্দায় মন দিলেন। যদিও খচখচ একটা লাগছে। ঠাকুরের নাড়ু বলে কথা। তাই পারমিতাকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখে আর একবার ওই নাড়ু তুলে রাখার কথাটা না বলে পারলেন না। যদিও লাভ হল না কিছুই। সরমার এই মেজবউটি খুবই স্বাস্থ্য সচেতন। আটটার মধ্যে ডিনার না করে নিলে তার মাথা ধরে। আরও নানারকম শারীরিক অসুবিধা হয়। তবে সুচেতার মতো সরাসরি না, পারমিতা বলল না। খেয়ে উঠে তুলে দেব মা। দিদি আমার খাবারটা ডাইনিং টেবিলে দিয়ে দেবে একটু।
আমার হাতজোড়া, পারো। তুই বেড়ে নে, লক্ষ্মীটি। ফ্রিজে সকালে রান্না করা চিকেন আছে, গরম করে নিস।
বাড়ির সকলের খাবার টেবিলে দুবেলা বিনতাই গুছিয়ে বেড়ে দেবে, এমনটাই নিয়ম। পারমিতা তাই খুবই বিরক্ত মুখে খেতে বসল। সে ভালোবাসে বলে, বড় জা রোজ একটু স্যালাড কেটে দেয়। সেটাও আজ নেই। শসা-টোম্যাটো সবই বাড়িতে আছে। কিন্তু কাটতে ইচ্ছে হল না। ফ্রিজ থেকে চিকেনটা শুধু বার করে মাইক্রোওয়েভে ঢোকালো।
সরমা জানেন পারমিতা এখন ধীরেসুস্থে চিবিয়ে পুরো খাবারটা খাবে। তারপর দশ মিনিট অপেক্ষা করে জল খেয়ে উঠবে। তারমানে আরও অন্তত আধঘণ্টা। তখন হয়তো আনন্দনাড়ু বয়ামে উঠতে পারে। কিন্তু কিছু করার নেই। পারমিতা চাকরি ছাড়াও ভালো নাটক করে। বেশ নামডাক আছে। তাই তার শরীরটা ঠিক রাখা জরুরি। টিভি দেখতে দেখতেই বড়বউমার ওপর বিরক্তিটা ক্রমশ বাড়ছিল সরমার। ওরা তো ব্যস্ত মানুষ। ঘরে-বাইরে নানারকম কাজ করে। তোমার তো বাপু সারাদিন বাড়ি বসে এই সংসার দেখা ছাড়া আর কোনও দায়িত্ব নেই। তা সেটুকুও কি ঠিক করে করা যায় না!
মা আনন্দনাড়ু তুলে রেখে এসেছি। নারকেল নাড়ুও পাকানো হয়ে গেছে….
শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে দাঁড়িয়েছে বিনতা। সরমা একবার চোখ তুলে তাকালেন। বড়বউমার মুখে ঘাম, শাড়ি অগোছালো….বাকি দুজন কেমন সবসময় ফিটফাট হয়ে থাকে। বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। বিনতাও আর কিছু না বলে স্নান করতে চলে গেল। গুমোট গরম রয়েছে। স্নান না করলে গা-হাত-পা চিটচিট করবে। শাশুড়ির আচরণ নিয়ে মাথা ঘামাল না। ওসবে তার অভ্যাস আছে।
আসলে এই সেনবাড়িতে তাকে যে একটু নিচু চোখে দেখা হয় সেটা সে প্রথম থেকেই জানে। বিনতা বাড়ির বড়বউ। বড়ছেলে ভবতোষ পেশায় ডাক্তার। চিরকালই ভালো ছাত্র ছিল। দেখতে-শুনতেও ভালো। বিনতার মতো সাধারণ ঘরের, অল্প শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার কথাই নয়। অবশ্য বিনতাকে দেখতে খারাপ বলা যাবে না। মুখখানা ভারি মিষ্টি। লম্বাটে গড়ন। চেহারার বাঁধুনিও সুন্দর। আর পড়াশোনাতেও সে কিছু খারাপ ছিল না। নিম্নমধ্যবিত্ত স্কুলমাস্টার বাবা যত্ন করেই মেয়েকে পড়িয়েছিলেন। অত ভালো সম্বন্ধ আসায় বিএ পরীক্ষা দেওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেল আর সেইসঙ্গে পড়াশোনাতেও ইতি। তবে তাই দিয়ে তো আর সেনবাড়ির বউ হওয়া যায় না। কিন্তু তবু হল। কারণ ভবতোষের হাত দেখে এক জ্যোতিষী বলেছিলেন তিরিশ বছর বয়সে নাকি ছেলের খুব বড় ফাঁড়া আছে। কোষ্ঠী মিলিয়ে, সুলক্ষণা কন্যার সঙ্গে বিয়ে দিলে সেই ফাঁড়া কাটবে। ওদের বাবার আবার সেই জ্যোতিষীর ওপর খুব বিশ্বাস। কোষ্ঠী মিলিয়ে রাজযোটক হল এই বিনতার সঙ্গে। তাই বিয়েটা হয়ে গেল। ছেলের প্রাণ নিয়ে ব্যাপার। তাই সরমা তখন আপত্তি করেননি। তবে ভবতোষ সুস্থভাবে তিরিশ পার করে দেওয়ার পর বড় বউমা সম্বন্ধে বিরক্তিটা তাঁর বাড়ছে।
যদিও তারমানে নয় যে বাড়িতে বিনতার ওপর কোনও অত্যাচার হয়, সে কম খেতে পায় কিংবা ছেঁড়া শাড়ি পরে থাকে। এমনটা মোটেই নয়। সেনদের মতো উচ্চশিক্ষিত, প্রগতিশীল বাড়িতে এরকম কথা ভাবাই যায় না। বিনতা নাহয় মফঃস্বলের মেয়ে, পড়াশোনাও খুব বেশি করেনি। কিন্তু মেজ আর ছোট দুই ছেলেই নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। দুই বউ উচ্চশিক্ষিত, চাকরি করে। নিজেদের খুশিমত সাজগোজ করে বাইরে বেরোয়, বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যায়। তা নিয়ে সরমা কিংবা ওদের শ্বশুরমশাই কেউই কোনওদিন কোনও আপত্তি করেন না। বিনতার তো সেরকম বন্ধু-বান্ধব কলকাতায় নেই। তাই তার বেরোনর দরকার হয় না। রাস্তা-ঘাটও ভালো চেনে না। তাই ভব সঙ্গে না গেলে বিনতাকে একা ছাড়তে চান না সরমা। তাছাড়া সংসারের দায়িত্বও তো তারই। তাই দুমদাম বেরিয়ে গেলে বাড়ির অন্যদের অসুবিধা হয়। তাছাড়া বড়বউমা নিজেও যে বাইরে বেরোতে খুব ভালোবাসে তাও তো নয়। সরমা বুঝতে পারেন ওই হাঁড়ি-হেঁশেল নিয়ে থাকাই তার পছন্দ।
সেনবাড়ির নিয়ম হল সাংসারিক যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত সবাই মিলে বসে নেয়। আগে তিন ছেলে আর তাদের বাবাই বসে সব ঠিক করত। সরমা তার ভিতরে খুব একটা ঢুকতেন না। কিন্তু পরে যখন দেখলেন ছেলেরা চাইছে তাদের বউরাও আলোচনায় অংশ নিক, মতামত জানাক, তখন নিজেকে আর বাদ রাখতে ইচ্ছে হল না। ছেলেরা বলতে অবশ্য মেজ আর ছোট। ভব এরকম কোনও ইচ্ছার কথা জানায়নি। তার বউয়ের যে মতামত দেওয়ার ক্ষমতা নেই, সেকথা সে ভালোমতই জানে। এই ধরনের পারিবারিক মিটিং-এ তাই সাধারণত বিনতাকে ডাকাও হয় না। প্রথমদিকে পারমিতা দু-একবার কথাটা তুলেছে। কিন্তু ভবতোষই সরাসরি বলেছেন, ছেড়ে দাও। ওকে ডাকার কোনও দরকার নেই। ওর তো এসব বিষয়ে কোনও ধারণা নেই, তাই মতামত দিতে পারবে না।
তারপর থেকে আর ডাকা হয় না। বিনতাও মনে হয় না এসব নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায় বলে। সে বরং তখন বাড়ি কুচোকাচাদের জুটিয়ে বসে গল্প বলে। সরমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বুদ্ধি কম বলেই হয়তো বাড়ির ছোট ছেলেপুলেদের বড়মাকে খুব পছন্দ। তাদের খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে গল্প বলা, খেলাধুলো, এমনকি স্কুলের ক্রাফট বানিয়ে দেওয়া পর্যন্ত বড়মার দায়িত্ব। সবকটা কুচোকে পাড়ার কিংবা স্কুলের ফাংশানের জন্য সাজিয়ে-গুছিয়ে তৈরি করে দেয় বিনতা। তাদের মা-দের সময় হয় না। তবে বিনতা যে কী করে কাজটা করে সরমা বুঝতে পারেন না। বিনতার নিজের মেয়ে ফুলকিও ছোটবেলায় এই দলেই ছিল। নাতনি কেমন মানুষ হবে তাই নিয়ে সরমার যথেষ্ট আশঙ্কাও ছিল সেজন্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুলকিও ক্রমশ ঠাকুমা-কাকিমাদের দলেই ঢুকে পড়ছে। নাতনির কথাবার্তায় ইদানীং মায়ের প্রতি একধরনের হালকা তাচ্ছিল্যের আভাস সরমাকে আশ্বস্ত করে। আনন্দনাড়ু হয়ে গেছে। দু’ধরনের নারকেল নাড়ুও বানিয়ে বয়ামে তুলে রেখেছে বিনতা। এছাড়া ঠাকুরের নৈবেদ্যির জন্য ঘরে আর যা যা বানাতে হবে সেসব বড়বউকে গুছিয়ে বলে দিয়েছেন সরমা। বাড়ির লোক কিংবা অতিথি অভ্যাগতদের জন্য পাড়ার মিষ্টির দোকানে প্রতিবছরের মতোই অর্ডার দেওয়া হয়েছে। পুজোর আর বেশি দেরি নেই। সরমার শ্বশুরের ঠাকুর্দার আমল থেকে সেনবাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। চকমিলানো বাড়ির সামনেই মস্ত নাটমন্দির। সেখানেই প্রতিমা বসে। পুজোর কদিন বাড়ি একেবারে জমজমাট হয়ে ওঠে। আত্মীয়-স্বজনরা তো বটেই, ছেলে-বউমাদের বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই আসে পুজো দেখতে। আড়ম্বর যে সাংঘাতিক কিছু হয় তা নয়। তবে সবরকম নিয়ম মেনে, নিষ্ঠাভরে পুজোর আয়োজন করা হয়। সন্ধের সময় সামনের দরদালানে গান-গল্প-কবিতা পাঠের আসর বসে। অনেক নামী-দামী-গুণী মানুষজনও আছেন। শুধু বনেদিয়ানা নয়, শিক্ষা আর সংস্কৃতিতেও এই বাড়ির মানুষরা যে অগ্রগণ্য সেকথা জানে এলাকার বাসিন্দারা।
ষষ্ঠীতে বোধন। সকাল থেকেই নাটমন্দিরে ব্যস্ততা চলছে। সরমার সঙ্গে হাতে হাতে পুজোর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছে বিনতা আর পারমিতা। সুচেতাকে আজও অফিস যেতে হয়েছে। তার ছুটি সপ্তমী থেকে। এমন সময় বাড়ির কর্তা মনোতোষ সেন আর দুই ছোট ছেলেকে মুখ অন্ধকার করে আসতে দেখে সরমা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
কী হয়েছে? কোনও খারাপ খবর এসেছে নাকি?
খুব খারাপ খবর, মা। নিতাই ঢাকি আসতে পারেনি। সে নাকি পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। তাই ঢাক বাজানোর জন্য ওর দুই চ্যালা আর দুই মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছে……
মেয়েদের পাঠিয়েছে ঢাক বাজাতে!
নাহলে আর বলছি কী?
রাগে প্রায় গর্জন করে ওঠেন মনোতোষবাবু। ছোটকু ফোনে ধরেছিল, তাতে নাকি সে আবার বলেছে দুই মেয়ে তার আশপাশের সাত গ্রামের মধ্যে সেরা ঢাকি। সব কম্পিটিশনে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে……
আমি বললাম, কাকা তোমার ছেলে আর বড় নাতিটাকে তো পাঠাতে পারতে। তা বলে কিনা ওরা তো ভালো করে ঢাক ধরতেই জানে না, ছোটদা। চাষের কাজ করে। কী বলব বলো?
দুগ্গা পুজোর ঢাক মেয়েমানুষে বাজাবে! না না এ আবার কী ধরনের অসৈরণ কাণ্ড। তাছাড়া আরতির সময় টানা দেড়-দু ঘণ্টা ঢাক বাজে। নেচে নেচে বাজাতে হয়। দম লাগে, হাতের জোর লাগে কতখানি। মেয়েরা পারবে কেন? ওসব বাজে কথায় কান দিও না। তুমি অন্য ঢাকি দ্যাখো।
সরমার কথা শুনে মাথা নাড়েন মনোতোষ, খুব ঝামেলা বুঝলে। আজ ষষ্ঠী। ঢাকি যারা এসেছিল জেলা থেকে তাদের সবার তো বায়না হয়ে গেছে। এখন পাওয়াই খুব মুশকিল। পেলেও ডবল দর হাঁকবে। তাও দেখতে তো হবেই…..মায়ের পুজো বলে কথা।
পারমিতা আর বিনতাও উঠে এসে আলোচনা শুনছিল। ইতিমধ্যে চারটে ছেলে-মেয়ে ঢাক কাঁধে নিয়ে দরদালানে ঢুকে একপাশে বসেছে। মেয়েদুটো বেশ লম্বা, স্বাস্থ্যও ভালোই। তাদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বিনতা বলে ফ্যালে, –
চেহারাপত্তর তো ভালোই মনে হচ্ছে, মা। আজ নাহয় একবার বাজাতে দিয়ে দেখুন না পারে কিনা। অতদূর থেকে ট্রেনভাড়া দিয়ে এসেছে। তাছাড়া নিতাইকাকা যখন বলেছেন…..
রাগে-বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে যায় সরমার। পারমিতা মুখ টিপে হাসে। ছোট দেওর আর সহ্য করতে না পারে খেঁকিয়ে ওঠে, তুমি থামো তো বউদি। যা জানো না, বোঝো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। সেনবাড়ির পুজোয় ওই কেলে-কুষ্ঠি মেয়েদুটো ঢাক বাজিয়ে নাচবে! কী করে যে এমনসব কথা তোমার মাথায় আসে…..
ওটাই তো দোষ। আজও হ্রস্বি-দীঘ্যি জ্ঞান হল না……
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সরমা,
দুগগাপুজোর আরতিতে যে মেয়েদের ঢাক বাজানো চলে না, সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধিও যে নেই। কী করবি বল্, ভবর যেমন ভাগ্য।
নতুন দুজন ঢাকি নিয়ে আসা হবে এমনটাই আলোচনায় সাব্যস্ত হয়। তবে মনোতোষ বলেন যে, মেয়েদুটোকে চলে যেতে বলার কোনও দরকার নেই। প্রথমত ওরা হয়তো একলা যেতে পারবে না। রাস্তায় কোনও ঝামেলায় পড়লে সেনবাড়ির দোষ হবে। তার চেয়ে থেকে যাক। চারটে দিন দুটো মানুষের খাই খরচা আর কতটুকু। তবে বাজাতে দেওয়া চলবে না। নতুন দুজন ঢাকি আর নিতাইয়ের দুই চ্যালা বাজাবে।
রাতে খাবার টেবিলেই সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে যায়। সেখানে অবশ্য আরও একবার বিনতার নির্বুদ্ধিতার কথা ওঠে। মজা করেই বউদিকে চোখা চোখা বাক্যবাণে বিদ্ধ করে দুই দেওর। দুই জা এবং শাশুড়ি মুখ টিপে হাসে। বিনতার স্বামী আর শ্বশুরমশাই নির্লিপ্ত মুখে বড়বউয়ের রাঁধা পায়েসের বাটিতে চামচ ডোবান। এরকমটা নতুন নয়। এর আগেও অনেকবার হয়েছে। কিন্তু আজ কেন যেন বিনতার চোখের কোণ দুটো জ্বালা করে। জল পড়ে না যদিও। মনে হয় যেন দুটো আগুনের বিন্দু আটকে গেছে চোখের কোণে।
সন্ধিপুজো শেষ হয়েছে। অনেকক্ষণ বাজানোর পর ক্লান্ত হয় চারজন ঢাকি দালানের এক কোণে বসে আছে। নিতাইয়ের মেয়েদুটোও শুকনো মুখে বসে আছে ওদের পাশে। আজ অষ্টমী হয়ে গেল। এখনও পর্যন্ত ওদের ঢাক বাজাতে ডাকেনি কেউ। টাকা-পয়সাও যা কথা হয়েছিল দেবে কিনা কে জানে। আর দিলেও বাবার চ্যালা পরাণ এরমধ্যেই শুনিয়ে রেখেছে,
তুরা তো আর ঢাকে কাঠি ছোঁয়াস নাই, তাই টাকার ভাগও তুদের নাই। জ্যাঠাকে কত্ত করে বললম, মেয়েছিল্যাকে পুজাবাড়িতে ঢাকা বাজাইতে পাঠায়ো না। কলকাতার লোক বাজাতে দিবে না। তা কে শুনে কার কথা, মেয়েরা নাকি ব্যাটাছেলের থিকেও ভালো বাজনদার। এখন বুঝ ঠ্যালা…..
সন্ধিপুজো দেখতে অতিথি এসেছিলেন অনেক। তাঁরা সব দরদালানে চেয়ার পেতে বসে গল্পগুজব করছেন। হাতে হাতে প্রসাদ বিলি হচ্ছে। এইসময় নাটমন্দিরে, মায়ের মূর্তির ঠিক সামনে এসে দাঁড়াল বিনতা। তারপর হঠাৎ হাততালি দিয়ে বলে উঠল, সবাই একটু শুনবেন…..আমার একটা কথা আছে…..
ঘটনাটা এত অভাবনীয় এবং আকস্মিক যে সবাই একদম চমকে উঠে তাকিয়েছে। বাড়ির লোকজন সত্যি কথা বলতে কী ঘাবড়েই গেছে খানিকটা। বিনতা কিন্তু খুব সপ্রতিভভাবে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে, –
আসলে আমার অনেকদিনের ইচ্ছে সন্ধিপুজোর দিন ধুনুচি নিয়ে মায়ের আরতি করব। ঢাকের তালে তালে নেচে প্রণাম জানাব মাকে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সব ইচ্ছে তো আর সবসময় প্রকাশ করা যায় না। নানারকম সংকোচ কাজ করে। মেয়েদের তো বাধাও থাকে অনেক। সেসব আমারও ছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত এবছর ঠিক করলাম করবই। বয়স বাড়ছে, হঠাৎ যদি একদিন টুপ করে মরে যাই তো মনের ইচ্ছা মনে রেখেই মরতে হবে…..
বড় বউমার মাথাটা নির্ঘাৎ খারাপ হয়ে গেছে, রে…..
কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে প্রতিমার পাশে বসে পড়েছেন সরমা। দুই দেওর রাগে, লজ্জায় দাঁত কিড়মিড় করছে। মনোতোষ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। ভবতোষ বুঝতে পারছেন স্ত্রীকে এখনই মনের ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু তারও আগে দরকারওকে থামানো। সেই কথাটা অবশ্য পারমিতাও বুঝেছে। তাই হাতের ইশারায় ফুলকিকে ডেকে বলে,
তোর মাকে যেমন করে হোক ধরে ঘরে নিয়ে যা ফুলকি। নাহলে কেলেঙ্কারির আর শেষ থাকবে না…..
এদিকে দর্শকরা কিন্তু কিছুই বোঝেনি। ভবতোষের স্ত্রী বলে এবং মিষ্টি স্বভাবের জন্য বিনতাকে সবাই চেনে এবং পছন্দও করে। আর পুজোর দিনে প্রতিমার সামনে ধুনুচি নাচ তো কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, তাই তারা খুবই উৎসাহিত। ফুলকি আর থাকতে না পেরে মায়ের কাছে গিয়ে নিচু গলায় বলে,
কী পাগলামি করছ….ঘরে চলো।
তোর ওড়নাটা দে তো ফুলকি, ব’লে বিনতা মেয়ের গা থেকে লাল ওড়নাটা টেনে নিয়ে সাধারণ করে পরা লালপাড় গরদের শাড়ির সঙ্গে সেটি কোমরে বেঁধে নেয়। চুলের শক্ত করে বাঁধা খোঁপায় একগোছা জুঁইয়ের মালা জড়িয়ে নিয়েছিল আগেই। তারপর মেয়েকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে, ফের দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলে,
মা নাচবে, এই ভেবেই ফুলকি ভয় পাচ্ছে। মনে করছে কী না কী বেতালে পা ফেলব। ও তো জানে না স্কুলে পড়ার সময় মন দিয়ে পাঁচবছর কথ্থক শিখেছি। নেহাৎ বিয়েটা হয়ে গেল তাই। বিয়ের পর অবশ্য আর সুযোগ হয়নি। তবে মনে হয় পুরোটা ভুলিনি।
না বউদি….কিচ্ছু ভোলেননি আপনি….শুরু করুন…..ঠিক পারবেন…..
দর্শকদের উৎসাহ ততক্ষণে তুঙ্গে।
ঠাকুরমশাই আমাকে ধুনুচি দুটো দিন…..
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা পুরোহিত ঠাকুর ধুনুচি দুটো এগিয়ে দেন। বিনতা দুহাতে দুটো ধুনুচি নিয়ে ডাক দেয়…..
বিমলা আর ললিতা এদিকে আয়। আমার সঙ্গে তোরা ঢাক বাজাবি……
আবার একটা সাংঘতিক চমক লাগে সেন পরিবারের সকলের। ওদিকে মেয়েদুটোর কালো মুখে মুহূর্তে যেন আলো জ্বলে ওঠে। ঢাক পিঠে তুলে নিয়ে শক্ত পায়ে বিনতার দুপাশে এসে দাঁড়ায় দুজন। ঠাকুরের দিকে মুখ করে ধীরলয়ে নাচ শুরু করে বিনতা। একটু একটু করে পায়ের গতি বাড়তে থাকে। সঙ্গে নিখুঁত ছন্দে বাজছে ঢাক। নাচছে বিমলা আর ললিতাও। ক্রমশ তুঙ্গে ওঠে বাজনা। ধুনুচি থেকে ছিটকে পড়ে আগুনের টুকরো। আত্মমগ্ন বিনতা খেয়াল করে না। ফুলকি ছুটে এসে পা দিয়ে আগুন নিভিয়ে সরিয়ে দেয় খসে পড়া ছোবড়া। বিভোর হয়ে নাচছে বিনতা, যেন কোনও ঐশ্বরিক শক্তি ভর করেছে তার ওপর। ঠিকঠাক সঙ্গত করছে জোড়া ঢাক। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে দর্শকরা। সরমা বুঝতে পারছেন তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ভবতোষের চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি। পারমিতা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সুচেতাকে। হাত জোড় করে অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দুই ভাই আর তাদের বাবা। প্রায় এক ঘণ্টা কেটে যায় চোখের পলকে। কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে বিনতার। ধীরে ধীরে কমে আসে পায়ের গতি। একসময় ধীরলয়ে শেষ হয় বাজনা। ধুনুচি মাটিতে নামিয়ে রাখে বিনতা। ঢাক থামে। মৃণ্ময়ী মূর্তির সামনে প্রণত হয় তিন শিল্পী। হাততালির শব্দে যেন ভেসে যাচ্ছে সেনবাড়ির ঠাকুরদালান। এগিয়ে এসে মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ফুলকি।