short-story-ek-minit-nirobota

এক মিনিট নীরবতা
অমর মিত্র

 

 সন্ধের পর বাইরে বেরিয়েছিল অচিন। এমনি। সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি হয়েছে। বিকেল থেকে ধরেছে আকাশ। এবার হয়তো শীত পড়তে পারে। নভেম্বরের শেষ। অচিন সিগারেট কিনবে আর একটু হেঁটে আসবে। সারাদিন ঘুমিয়েছে, পড়েছে, ইউটিউবে শর্ট ফিল্ম দেখেছে। আলস্যেরও এক ক্লান্তি আছে। সেই ক্লান্তি কাটাতে সে বাইরে এল। আজ রবিবার। সুমনা গেছে বিরাটি, বাপের বাড়ি। এমনি।

 ‘অনেকদিন যাইনি, মা ফোন করে বারবার, একটু ঘুরে আসি।’ 

  ছেলে দিল্লিতে পড়ে। এখন যা পড়ে লোকে। ম্যানেজমেন্ট। কোম্পানি চালাবে। বিদেশ যাবে। অনেক টাকা উপার্জন করবে। হয়তো বিদেশেই ঠিকানা হবে ওর। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সে থাকে পশ্চিমে। ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশের মোরেনো ভ্যালি। ছবি দেখেছে অচিন। পাহাড়ে ঘেরা এক অপূর্ব প্রকৃতি। অচিন খুব শীঘ্রই যাবে। শুনেছে কাছেই ঘন্টা দেড়েকের ড্রাইভে এক মরু অঞ্চল আছে। জশুয়া বৃক্ষের ন্যাশানাল পার্ক। আবার দেড় ঘন্টায় প্যাসিফিক, সান দিয়েগো। মেহিকোর সীমান্ত। কয়েক পা হেঁটে দাঁড়াল অচিন। দীপেন না? হ্যাঁ, দীপেন। সে এ পাড়ায় কেন? মেহিকো থেকে এসে পড়েছে যেন আমেরিকা মহাদেশে। দীপেন থাকে তো চেতলার বস্তিতে। আদি গঙ্গার ধারেই প্রায়। কত বছর আগে গিয়েছিল দীপেনের বাড়ি। দীপেন তখন লিখত। গল্প। এখনো কি লেখে? দেখতে পায় না তো। মনে আছে দীপেন একটা গল্প লিখেছিল, বস্তিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি। এখন না লিখে কী করে ঠিক জানে না অচিন। সে নিজে অধ্যাপনা করে। ছাত্র পড়ায়। ছাত্রী নিয়ে ঘোরে। তার গল্প হবে না, তাই লেখে না। এখন সাহিত্যের কোনো খোঁজই রাখে না। দীপেন এখন কি এদিকে চলে এসেছে? দক্ষিণ থেকে উত্তরে, দীপেন তুমি যে?

   শীর্ণকায় দীপেন অন্ধকারে অচিনকে দেখে থমকায়। গায়ে ময়লা সোয়েটার, গলায় একটি মাফলারও আছে। অচিনের গায়ে একটি শাল। পায়জামা পাঞ্জাবি। চোখে চশমা, পায়ে স্নিকার। মাথার চুলে পাক ধরেছে। অচিনের চোখে মুখে কেমন সৌম্যভাব এসেছে। নামী অধ্যাপক। দীপেন তাকে দেখে বিব্রত হয়েছে যেন, কোনো রকমে বলল, ও, তুমি এদিকে থাকো, অচিনদা?

   অচিন বলল, তুমি চেতলা থেকে চলে এসেছ?  

   না, চেতলাতেই আছি।

   এদিকে যে, আমার ফ্ল্যাট। চল। অচিন হাত ধরল দীপেনের, আমি এদিকে থাকি, জান না?

   দীপেন বলল, খুব জানি, কিন্তু বাড়িটা ভুলে গেছি, অচিনদা, ভালো আছ?

    তুমি কেমন আছ দীপেন, কোথায় চাকরি করছ, সেই নিউজ পেপারে?

   মাথা নাড়ে দীপেন, নাহ, কাগজ তো বন্ধ হয়ে গেছে।  

   তাহলে?

   দীপেন বলল, এক পাবলিকেশনে আছি, কলেজ স্ট্রিটে। 

   তারপর? অচিন নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল। 

   তার আর পর নেই, আছি! দীপেন হাসল কিংবা হাসতে চেষ্টা করল। অচিন লেখার কথা জানতে চেয়েছিল। থেমে যায় অচিন। কিছু বলতে পারে না প্রথমে। তারপর প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল, সেই বাড়ি এখন হাই রাইজ, আসবে ফ্ল্যাটে, এস, দেখা যখন হলো।  

    মাথা নাড়ে দীপেন, বলল, আমি একটা কাজে এসেছি, বাড়ি ফিরব, কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে কে জানে, খুব ভীড় হয়!

   কাজটা কী? না, অনাথবাবু লেনের কবিরাজ এস চক্রবর্তী, ধন্বন্তরীর কাছে ওষুধ নিতে আসে দীপেন। 

   ধন্বন্তরী, এস চক্রবর্তী? অচিন বলল, তেমন কেউ এদিকে থাকেন নাকি?

   হ্যাঁ, আমাকে মাসে দুবার আসতে হয়।

   কেন? অচিন জিজ্ঞেস করল, কার অসুখ, কবিরাজিতে সর্দি কাশি সারে, আর কিছু হয় কি না?

   দীপেন অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ছেলেটা খুব ভোগে, বাতাস নিতে পারে না, দম আটকে আসে, আমি যাই অচিনদা।’ ঘড়ি দেখল দীপেন, বাড়ি ফিরতে হবে তো, উত্তর থেকে দক্ষিণে। সে আর দাঁড়াল না। অচিন দাঁড়িয়ে থাকে কিছু সময়। তারপর সিগারেট কিনে পায়চারি করে ফ্ল্যাটে ফিরল। ফ্ল্যাট ফাঁকা। সুমনা থাকলে টিভি চলত। ফিরতে রাত হবে। গাড়ি নিয়ে গেছে। অচিন তার সাজানো ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। এই রাস্তা দিয়েই তো দীপেন ফিরবে, কিছুই জানা হলো না। দীপেনের বউ কি চাকরি করে? পাবলিকেশনে আছে, কেমন প্রকাশক? কত আর মাইনে দেয়। বাংলা বইয়ের প্রকাশক তো। বই কে পড়ে এখন? ক’জনের বই বিক্রি হয়? অচিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। লোক চলাচল করছে। গাড়ি আসছে যাচ্ছে। দীপেন ফিরবে এখান দিয়ে। কত সময় লাগবে ফিরতে? লাইনে দাঁড়াতে হয়। একটি সিগারেট শেষ করে ঘরে ফিরল অচিন। কম্পিউটার খুলল। ফেসবুক। সার্চ করল দীপেন সেন। সাতজন পায়। তাদের ভিতর একজন যেন এই দীপেন। ছবিটা চেনা লাগে। কম বয়সের ছবি দিয়েছে মনে হয়। কিন্তু টাইম লাইন দেখে কিছুই বোঝা যায় না। শুধু ঠাকুর দেবতার ছবি। অচিনের মনে হলো, এই প্রোফাইল দীপেনের নয়। দীপেন ফেসবুকে নেই তাহলে। থাকলে সে বন্ধু হতো।

   কী মনে হতে অচিন ফোন করল বিজনকে। বিজন সাংবাদিক। বিজন কি এখন দীপেনের খবর রাখে? বিজন বলল, আমি দিল্লিতে অচিনদা, দীপেন সেন তো, খারাপ লাগে ওর জন্য, কিছুই করতে পারল না, জীবন নিয়ে অত এক্সপেরিমেন্ট করলে কিছু হয়। 

      অচিন বলল, সকলে তো শেষ অবধি পারে না বিজন।

       বিজন বলল, ওর কথা থাক, অচিনদা, ওর বাস্তব জ্ঞান খুবই কম, চাকরি তো চলে গেছে।

       পত্রিকা বন্ধ হয়নি?

       হয়েছে, তারপর ওরা তো ওকে দিচ্ছিল ওদের ইংলিশ ডেইলিতে, আমি সেখানেই আছি, ওকে এলাহাবাদ যেতে হতো।

        গেল না?

        না যায়নি, কেন শুনবে? বিজন জড়ানো গলায় বলল। 

        অচিন জিজ্ঞেস করল, তুই এখন ফ্রি আছিস? 

         হ্যাঁ, ঝাড়া হাত পা, রণিতা কলকাতায়, আমি এখেনে একা, দুটো আর সি, নিয়েছি, বেশি খাই না, তুমি কী করছ অচিনদা?

         ছেড়ে দিয়েছি, লিভার ফাংশনিং খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।

         আমাকেও ডাক্তার বারণ করেছে, কিন্তু একেবারে বাদ দিতে পারি না।

          অচিনের লিভার সফট হয়ে গিয়েছিল। হাফ পেগ নেওয়াও একেবারে বারণ। কিন্তু এখন যেন সাধ হলো। বাড়িতে নেই। থাকে না। অচিন বলল, ছেড়ে দে বিজন, ডাক্তার বারণ করলে বন্ধ করে দে, ভয় করে না তোর? 

         বিজন বলল, আজই শেষ, আর একটা নেব, ব্যাস, এ জীবনে আর না। 

          হা হা হা করে হাসল অচিন। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণে কি চলে গেছে দীপেন? এদিকে কোন ধন্বন্তরী থাকে যে চেতলা থেকে আসতে হয়। অচিন জিজ্ঞেস করল, গেল না কেন দীপেন, কলকাতার বাইরে চাকরি করতে যাবে না?

         না, তা নয়, আসলে দুশো জনের টোয়েন্টি পারসেন্টকে এলাহাবাদ পাঠাচ্ছিল, বাকিদের চাকরি নট, ও বলল তা হয় না, ও বিট্রে করতে পারবে না, আমার মুখটা কোথায় গেল বলো দেখি অচিনদা।

         কেন, তোর এতে কী?

         ও তো প্রুফ রিডারের চাকরি করত, এমনিতে এখন প্রুফ রিডিংয়ের গুরুত্ব কমে গেছে, ওকে অ্যাকাউন্টসে চাকরি দিচ্ছিল, আমি রিকোয়েস্ট করতে হয়েছিল চাকরিটা, কিন্তু ও রিফিউজ করল, ঝান্ডা নিয়ে বসে পড়ল, আমার কথাটা ভাবল না। 

    অচিনের মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, তখন সে থাকত প্রতাপাদিত্য রোডে, দীপেন চেতলা, বিজন নিউ আলিপুর, বিকাশ মুদিয়ালি, তাদের পত্রিকা  ‘মৃত্তিকা’ তখন বেরিয়েছে, অচিন একটা স্কুলে ঢুকেছে। আর কেউ কিছু করে না। দীপেন ঠিক সেই সময়ে একটা চাকরি পেয়েছিল। ডালডা ফ্যাক্টরিতে। সুপারভাইজার। ভালো মাইনে। রোববার বিকেলে লেকের ধারে বসে জিজ্ঞেস করল, কী করি?

      কেন, চাকরি তো ভালই। অচিন বলেছিল। 

      সাঙ্ঘাতিক এক্সপ্লয়টার, তিরিশজনকে বসিয়ে দিয়েছে, তোরা কী বলছিস, ওখানে জয়েন করব, আমি তো লিখব।  

      আমরা সবাই কী বললাম? না। তা হয় না। ছেড়ে দে দীপেন। তুই লিখবি। ডালডা ফ্যাক্টরিতে লেখক কী করবে? পত্রিকায় করতে পারিস।

      দীপেন বলল, তোরা যা বলবি, তাইই করব আমি। অচিনের সব মনে পড়ল। সেই ডালডা কোম্পানি কি আছে বিজন, তুই তো সাংবাদিক। 

     বিজন বলল, আছে, হেভি ব্যবসা করে, এক্সপোর্ট করে মিডল ইস্টে।

     ওই চাকরি নিলে দীপেন বেঁচে যেত।

     বিজন হাসে, ধুর, ও কোথাও টিকত না।

     কেন, তোর পত্রিকায় তো কুড়ি বছরের উপর করেছে। অচিন বলে। 

     কয়েকবার চাকরি যেতে যেতে থেকেছে, ও একটা গল্প লিখেছিল মালিককে নিয়ে, তা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। বিজন বলল, আনগ্রেটফুল, তোকে যে ভাত দিচ্ছে, তার কেচ্ছা লিখে দিচ্ছিস। 

     কেমন লেখে এখন? অচিনের কৌতুহল কম নয়। 

     কেমন আবার, ৩০-৩৫ বছর আগে যেমন তেমনি, বদলায়নি। বিজনের গলায় বিরক্তি। 

     অচিন বলল, বিজন, হয়তো দীপেনের লেখার বিচার হবে পরে।

     তার মানে? বিজন প্রায় ক্রুদ্ধ গলায় বলল, অসফল মানুষ মৃত্যুর পর সফলতা পায়? 

     জীবিত কালে কত লেখক তার প্রাপ্য সম্মান পায় না। দীপেন বলল।

     হা হা করে হাসে বিজন, জীবনানন্দ দাশ?

     দীপেন হয়তো ওর লেখা বাক্স বন্দী করে রাখছে, একদিন ধন্য ধন্য পড়ে যাবে। 

     বিজন বলল, তুই তো নেশা করিসনি, করেছি আমি, ভাট বকছিস কেন, যে নিজেকে বদলাতে পারে না, সে কিছুই করতে পারে না।    

     অচিন চুপ করে থাকে। দীপেন এমনিতে নিরীহ, কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক রোখা, দুর্বিনীত। সেই তিরিশ বছর আগে যেমন ছিল তেমনি আছে। কিন্তু দীপেনের ছেলে অসুস্থ, তা কি জানে বিজন? বিজন বলল, শোনেনি কোনোদিন। ব্যালকনি থেকে অন্ধকার নির্জন রাস্তা দেখছিল অচিন। চলে গেছে দীপেন? নাকি এখনো বসে আছে ওষুধের জন্য?  

 

 

     সুমনা বলল, দেখা হলো, বাড়িতে ডাকলে না?

     দাঁড়ালই না, এড়িয়ে গেল যেন। অচিন বলল, ছেলের ওষুধ নিয়ে ফিরবে।  

     সুমনা জিজ্ঞেস করল, ফোন নম্বর আছে?

     নেই শুনে চুপ করে গেল সুমনা। তখন অচিন বিজনের কথা বলল। সুমনা বলল, বিজনদার কাছে নম্বর নেই?

     অচিন মিথ্যে বলল, নেই, জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন সুমনা বলল, সে দীপেন সেনের লেখা পড়েছে অনেক আগে। তেজ ছিল। কিন্তু তিনি যে অচিনের বন্ধু তা তো জানত না। সে বিড়বিড় করল, দারুণ আরম্ভ, তারপর কী হলো, আসলে লিটল ম্যাগাজিনের লেখা কি চোখে পড়ে!

     তুমি পড়েছ?

     হ্যাঁ, আমার বন্ধু অর্পিতার পিসতুতো দাদা, অর্পিতাই বইটি দিয়েছিল।

     অর্পিতার কাছে নম্বর পাবে। অচিন বলল।

      অর্পিতার নম্বর নেই আমার কাছে, আর ও বোধ হয় সিঙ্গাপুরে, শুনেছি তাই। 

     অচিন কলেজে গিয়ে কথায় কথায় তার কলিগ শুভ্রাংশুকে জিজ্ঞেস করল, দীপেন সেন কে জানো?

     শুভ্রাংশু একটা ম্যাগাজিন সম্পাদনা করে বছরে একবার। অচিনের চেয়ে বছর কুড়ির ছোট, কাঁধে ঝোলা নিয়ে কলেজ, কফিহাউস, প্রেস করে বেড়ায়। বলল, আপনি তাঁকে চিনলেন কী করে অচিনদা? 

     অচিন বলল, আমরা এক জায়গায় থাকতাম।

      চেতলা, আপনি তো বলেননি?

      বলার মতো কিছু?

      শুভ্রাংশু বলল, উনি এখন কোথায়, খুঁজে পাচ্ছি না, আমি একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেব দীপেন সেনের।

      কেন? অচিন জিজ্ঞেস করল। করেই মনে হলো ভুল করল। এতে তার অজ্ঞতা না ঈর্ষা প্রকাশ পেল তা সে নিজেই ধরতে পারল না।  

      দেখুন দাদা, ওঁর প্রথম বইটির জন্যই উনি বাংলা সাহিত্যে থেকে যাবেন, খুব ইমপরট্যান্ট লেখক।

      অচিন এবার কোনো মন্তব্য করল না। প্রথম বই আসলে দ্বিতীয়। তার আগের পুস্তিকায় ছিল দুটি গল্প। পুস্তিকার গল্প দুটির কথা কি জানে শুভ্রাংশু? গল্পদুটির কথা মনে পড়ল অচিনের। ত্র্যস্ত নীলিমা এবং শবযাত্রা। পুস্তিকাটি হাতে হাতে ঘুরেছিল। তারাই পুস্তিকা প্রকাশের খরচ দিয়েছিল। কী আবেগ সেই সময়! কতকাল আগের কথা। কিন্তু এখন মনে হয় ওসব ছেলেখেলা। কম বয়সের অপরিণত চিন্তা। পৃথিবীতে দুঃখ, কষ্ট, কখনো দূর হয়েছে? দারিদ্র সভ্যতার সঙ্গে আছে। সেই পশুপালনের যুগ থেকেই তার আরম্ভ। গুহামানবের ভিতরে হয়তো সাম্য ছিল। সবই নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মহাজ্ঞানীরা। তারপর সব যেমন ছিল তেমনি আছে। দীপেন কী এমন গল্প লিখেছিল! তারপর কী করতে পারল, কিছুই না। শুভ্রাংশু বলল, উনি চেতলার সেই বস্তি বাড়ি থেকে চলে গেছেন, আমি খোঁজ করেছিলাম, আপনি কি জানেন অচিনদা? 

   অচিন মাথা নাড়ে। তখন শুভ্রাংশু জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ যে তাঁর কথা বললেন?

   অচিন বলল, এমনি, মনে পড়ে গেল, অনেকেই লিখতে আসে, তারপর হারিয়ে যায়। 

   শুভ্রাংশু চুপ করে থাকে একটু সময়, তারপর বলল, গুণ থাকলে হারায় না দাদা, আবার ফিরে আসে। 

    অচিন আলোচনা থামিয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু শুভ্রাংশু থামে না, বলল, গোটা তিরিশ গল্প আর একটি উপন্যাস, আপনার কাছে আছে, অচিনদা? 

    অচিন বলল, নেই, যোগাযোগই নেই। 

    শুভ্রাংশু বলল, পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল, পাবলিকেশন আর কত মাইনে দেবে, উনি চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন শুনেছিলাম।

     অচিন বলল, এই বয়সে চাকরি হয়?  

     কিন্তু উনি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন শুনেছি, কিন্তু কেমন আড়ালে চলে গেছেন।

     না বোধ হয়, চাকরি ছাড়েনি।

     পাবলিকেশনে আমি গিয়েছিলাম, নামটা শুনেই বিরক্ত, বলল ঐ নামে কেউ নেই।

     শুভ্রাংশুর সঙ্গে এমনি কথা হতে হতে চুপ করে গেল দুজনেই। অচিন ভাবছিল একেবারে বেকার, কী করে চলে দীপেনের? ছেলে অসুস্থ। এরপর মাস দুই চুপচাপ। বিজন একদিন ফোন করেছিল। নেশাগ্রস্ত হয়েই বিজন ফোন করে। কিন্তু দীপেনের কথা হয় না। দীপেনের কথা কেউ উচ্চারণই করে না তারা। শুধু একদিন ফোন ছাড়ার আগে বিজন জিজ্ঞেস করল আচমকা, দেখা হয়েছিল আর? 

       কার সঙ্গে?

       বিজন বিদ্রূপের সুরে বলল, বিপ্লবী লেখকের সঙ্গে, লু সুন, অস্ত্রোভস্কির সন্তান, তোদের পাড়ায় ঢুকেছে, একদিন তোর ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে বড় বড় কথা বলবে।  

       তুই কি দীপেনের কথা বলছিস?

       অস্ত্রোভস্কি আবার কে হতে পারে, মাইরি সোভিয়েত ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো, চিন পুঁজির পুজো করছে, শালা ঝান্ডা নিয়ে বসে পড়ল উঠে যাওয়া অফিসের দরজায়, আমার মুখে চুন-কালি দিয়ে দিল!

       অচিন বলল, জীবন আর স্বপ্ন যে আলাদা তা ও জানত না, সেই যে সুপারভাইজারের চাকরি পেয়েছিল, ঐটা না করতে তো আমরাই বলেছিলাম, কিন্তু আমরা দ্রুত নিজেদের কেরিয়ার গড়ে নিলাম।   

       বিজন ফোন রেখে দিতে দিতে বলল, আমিই ওকে আমার পত্রিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।   

       তারপর এক সন্ধ্যায় আচমকা সুমনা বলল, তুমি কবিরাজের কাছে খোঁজ নাও না।

       বিরক্ত হলো অচিন, কবিরাজ কে, কোথায় থাকে, কী করে জানবে? কিন্তু এ পাড়ারই। সুতরাং ঐ যুক্তি খাটে না। সে লন্ড্রীর ডাকুকে জিজ্ঞেস করল কবিরাজের কথা। ডাকু জিজ্ঞেস করল, কবিরাজ, কার জন্য দাদা? 

       একজন পেশেন্টের খোঁজ নেব, এনে দিতে পারবে, সন অফ দীপেন সেন। 

       ডাকু চিরকুটে টুকে নিল। কয়েকদিন বাদে তাকে জিজ্ঞেস করল, উনি কে হন আপনার?

        কেন? অচিন বিব্রত হলো। 

        কবিরাজ বললেন, উনি মাস তিন আসেন না, ছেলেটার শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধে আছে, আসেন না কেন? ওষুধে তো কাজ হচ্ছিল ভালো। 

        অচিন খবর নিয়ে এল বাড়িতে। সুমনা শুনে বলল, উনি কী সুন্দর লিখতেন, অমন আর কেউ এখন লেখেন না।

       অচিনের কথা নেই। তার মনে হচ্ছিল দীপেন যে আসে না এ পাড়ায়, এক রকম ভালো। এলে দীপেনকে নিয়ে আসতে হবে তার ফ্ল্যাটে। দীপেন কিছুই না, কিন্তু অনেক কিছু। সুমনা দীপেনের গল্প মনে করে রেখেছে। দীপেনের না আসাই অনেক নিরাপদ। শুভ্রাংশু বলছে দীপেন সেনের খোঁজ পেলে সে তাঁকে কলেজে বাংলা বিভাগে নিয়ে আসবে। দীপেনের সব গল্প আর উপন্যাস নিয়ে একটা বই বের করবে। ওর দুটি সাক্ষাৎকার সে খুঁজে পেয়েছে নেটে, সব থাকবে সেই বইয়ে। দীপেন সেন আড়ালে থাকতে পারবেন না। অচিনের মনে হচ্ছিল শুভ্রাংশু থামুক। কিন্তু কথাটি তো বলা যায় না। সে চুপ করে থাকে। তার অস্বস্তি হয়। দীপেন সেনকে কলেজে আনবে শুভ্রাংশু। নেটে খোঁজ করছে। এমন কেউ কি থাকবে না যে বলতে পারবে ঠিকানা? অচিনের স্বস্তি গেল। শুভ্রাংশু ঠিক খুঁজে বের করবে প্রুফ রিডার দীপেনকে। প্রুফ রিডারই তো। না পেরে বিজনকে ফোন করল এক সন্ধ্যায়। সেদিনও সুমনা ছিল না বাড়ি। এক রবিবার। বিজন বলল, “তুই আর কী করবি, সেদিন কলেজ কামাই করিস, দীপেন খুব ধূর্ত, রাজনীতি করছে, ও নিজেই এসব করছে, তোর শুভ্রাংশু সব জানে, শোন, দীপেন আমার আন্ডারে কাজ করত দৈনিক প্রতিবেদনে। আমি ওকে তুমি বলতাম, ও আমাকে আপনি, প্রুফ রিডারের চাকরি তো আমার দেওয়া।” হা হা করে হাসতে লাগল। তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, “ওর নাম কেউ জানে না, দীপেন সেন নামে কোনো লেখক নেই”।  

     সুমনা এক রাতে তার গলা জড়িয়ে বলল, তুমিও লিখতে পারতে অচিন। 

      সবাই লিখলে পড়বে কে?

      সুমনা তাকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি পড়ব, যেমন পড়েছি দীপেন সেনকে, এক সময় আমার মনে হতো লেখকের ঘরণী হই।

       বেকার, সংসারে হাড়ি চড়ে না, ছেলে শ্বাস নিতে পারে না, তুমি জানো?

      সুমনা চুপ করে থাকে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর বলে, হ্যাঁ, ঠিকই তো, ওঁর কোনো খোঁজ পাওনি?

       না, আর আসে না এপাড়ায়। 

       সব লেখক তো অমন থাকে না অচিন, কত খ্যাতি কত টাকা! সুমনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। 

       অচিন বলল, যৌবনবেলায় অমন তেজ থাকে লেখকের। 

       তারপর বৃদ্ধ হয়ে যায়?

        অচিন বলল, হ্যাঁ।

        তাহলে দীপেন সেন বৃদ্ধ হননি? 

        অচিন চুপ করে থাকে। তাদের কথা ধীরে ধীরে থেমে যায়। অচিন টের পায় নিজের জীবন থেকে অনেক আগ্রহই কমে গেছে তার। শরীরে ভীড় করেছে অসুখ বিসুখ। যমদূত। মদ খায় না ভয়ে। মিষ্টি খায় না, মশলা খায় না। কিছুই করল না এ জীবনে। একটি কবিতা একটি গল্পও না, কিন্তু অনেক অসুখ ধরে এনেছে নিজের আশ্রয়ে। 

    খবর এল। শুভ্রাংশুই খবর আনল। ইন্টারনেটের ফেসবুকে তাকে একজন জানিয়েছে লেখক দীপেন সেন চার মাস আগে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর নিজেরও কঠিন অসুখ ছিল। অন্ত্রে কর্কট রোগ। বলতে বলতে শুভ্রাংশু মাথা নামায়। বিড়বিড় করল, কাউকে না জানিয়েই চলে গেছেন, স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন, কাউকে খবর না দিতে, কেউ যেন না জানে। 

   অচিন হিসেব করে, চার মাস আগেই দেখা হয়েছিল সন্ধ্যায়। তারপর! শুভ্রাংশু তোমরা স্মরণ সভা করবে, নাকি স্মরণ সংখ্যা?

   সংখ্যা করব, কিন্তু তা স্মরণ সংখ্যা নয়, উনি তো কাউকে জানাতে চাননি, আমরাও জানাব না, বেঁচে থাকুন দীপেন, আমি কল্পিত এক সাক্ষাৎকার লিখব, দেখি পারি কি না। 

   কথা রাখল অচিন, মৃত্যু সংবাদ জানাল না সুমনাকে। বিজনকেও না। বরং বলল, কবিরাজ বলেছে এবার এলে ঠিকানা চেয়ে রাখবে, ফোন নম্বরও, ডাকুই খবর আনবে।   

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *