পাখিয়াল
মঈনুল হাসান
মঈনুল হাসান
এক
কে? কে ওখানে? দীপেন নাকি?
মল্লিকবাড়ির পেছনের উঠানে যেদিকটায় পানাপচা পুকুর আর তার শ্যাওলাবিছানো ঘাটে একটা জলপাই রঙের ঘুম আয়েশ করে জেঁকে বসেছিল সেদিক থেকেই শব্দটা হেঁটে হেঁটে এলো। একটা সতর্ক চাপা আওয়াজ পেছনের ঝুল বারান্দার অন্ধকার কোণে এসে থেমে গেল হঠাৎ। খচমচ শব্দটা সেদিক থেকেই আসছিল। একটু পর পর থেমে থেমে। আর তা রমেন মল্লিকের নিস্পন্দ অনুভূতিতে এসে লাগলে তিনি অস্বস্তি নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসেন। এদিকে ঘরের ভেতরে রমেন মল্লিকের গলার স্বর চড়া হতেই বাইরের খচমচ শব্দ থেমে যায়। তবু তিনি ঘাড় উঁচিয়ে পর্দার প্রান্ত টেনে ধরে আবার হাঁকলেন।
দীপেন নাকি? কথা বলছিস না কেন?
অবশেষে কোনো প্রত্যুত্তর না শুনে রমেন মল্লিক উঠে দাঁড়ালেন। জানালার সাদা পর্দা সরিয়ে বারান্দার কাছে আবছামতো একটা অবয়ব তিনি প্রথমে দেখেছিলেন। কেউ নয় ভেবে আবার যখন বেতের সোফায় বসতে গেলেন মনে হলো কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এ তার বিভ্রম নয় তো!
মাত্র কয়েক হাত দূরে একটি অল্পবয়সী ছেলে দাঁড়ানো। ছেলেটি কোত্থেকে এলো কে জানে! সতেরো-আঠারো বছরের হবে। মাথা ভর্তি শণের মতো উশকো খুশকো চুল। হালকা তিরতিরে হাওয়ায় কাকের বাসার মতো চুলগুলো কাঁপছিল স্বভাবমতো; ঠিক যেমন ভেতরের সাদা পর্দা দুলছে পাখার বাতাসের ঘায়ে আলতো করে। ফ্যাকাশে লাল রঙের কোঁকড়ানো চুল নিয়ে কেমন লক্ষ্মীছাড়া চেহারা ছিল তার।
রমেন মল্লিক প্রথমে ব্যাপারটি খেয়াল করেননি। আর না করবারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। আজন্ম বেখেয়ালি এ মানুষটি সংসারের প্রতিও যত্নবান হতে পারেননি ঠিকমতো । আর এর মধ্যেই স্ত্রী বিয়োগের কারণে ঠিকমতো শোক সামলে উঠতে পারেননি। তার দৈনন্দিন দিনযাপনে একাকীত্বের চাইতেও হঠাৎ যে ছন্দপতন হলো সেটা ভেবেই এখন একেবারে দিশাহীন জীবনযাপন করছেন হালভাঙা নাবিকের মতো।
শামসুন নাহার, স্বামীর এ ধারার সাথে পরিচিতি ছিলেন। তাই নিজে একাই সামলেছেন পুরো সংসার। কিন্তু, সেই ফাঁকে ঠিক কবে থেকে স্বামী-সন্তানের মতো প্রাণঘাতী রোগের সাথেও বসবাস করে যাচ্ছিলেন একেবারে তা ধরতে পারেননি। শেষকালে রমেন মল্লিকের যখন খেয়াল হলো ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। বুকে ব্যথা আর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিনদিন ঠাণ্ডা ও নিউমোনিয়ায় ভুগে ফুসফুসে পানি জমিয়ে সংসার থেকে চিরতরে ছুটি নিয়েছেন শামসুন নাহার।
স্ত্রী বিয়োগের শোক সামলাতে না পেরে তিনি কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছেন কয়েক মাস হলো। একমাত্র ছেলেটা একটা চাকুরি নিয়ে শহরে থাকে। রমেন মল্লিক সেই থেকে একা। একদম একা।
রমেন মল্লিক অন্যমনস্ক ছিলেন। তাই বারান্দার অন্ধকারে মাত্র কয়েক হাত দূরের ছেলেটিকেও ঠিকমতো দেখতে পেলেন না। অথবা, তাকে দীপেনই ভেবেছিলেন- বয়সটা তার কাছাকাছিই হবে। জানালার লোহার গ্রিলের এপার থেকে আশ্চর্য চোখে তিনি খুঁটে খুঁটে দেখছিলেন তার মুখ। গোধূলির পড়ন্ত আলোর তেজ কমে যাওয়ায় আর সে আলোর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকায় একটা কমলারঙা আদুরে আলো নেমে এসেছিলো তার গাল বেয়ে।
কীরে? নাম কী? এখানে কী কাজ তোর?
ছেলেটি উত্তর না দিয়ে কেমন ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে থাকে। অমন বিষণ্ণ আলোতেও রোমেন মল্লিক স্পষ্ট দেখতে পেলেন কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ কালো চোখজোড়া এক ঝুড়ি কথার দ্যুতি নিয়ে জ্বলজ্বল করছে। ঠিক যেন মায়াভরা টলটলে স্বচ্ছ জলের পুকুর। মুখটা শ্যামল রঙের। পেন্সিল দিয়ে চিকন করে আঁকা ধনুকের মতো ভ্রু। গায়ের ময়লা গেঞ্জিটা সিঁদুরে লাল। ওদিকে পরনের সবুজ লুঙ্গির বেড় কম হওয়ায় কেমন অগোছালো করে আঁটসাঁট করে বাঁধা। পরিপাটিহীন একটা বুনো ছেলে । তবে তার দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে রমেন মল্লিকের মায়া হলো ভীষণ।
কথা বলছিস না কেন? তুই কি দীপেনের কাছে এসেছিস? ওর আত্মীয় কোনো?
না। মুখ ফুটে কিছু না বললেও ঘাড় নাড়িয়ে এবার জবাব দেয় সে।
তবে? আর এখানে ঢুকলিই বা কেমন করে? অমন উঁচু পাঁচিল ডিঙিয়ে ।
আগের মতোই নিরুত্তর ছেলেটা । রমেন মল্লিক নিজেই বিড়বিড় করে ওঠে, কী আশ্চর্য! দীপেন চলে গেছে সেই কখন। গেট তো আমিই লাগিয়ে দিয়ে আসলাম। অমন ভারী লোহার গেট!
দুই
রমেন মল্লিকের ঘর লাগোয়া বারান্দাটা সাবেকি আমলের। প্রশস্ত টানা বারান্দার একধারে একটা আলিশান হেলানো চেয়ার। যেখানে প্রায়দিন বিকালে তিনি আয়েশ করে বসে একাকী সময় কাটাতেন। কিন্তু, কয়েকমাস ধরে সে রুটিনে বিঘ্ন ঘটছে। স্ত্রীর অবর্তমানে বাইরের গোটা পৃথিবীর নিকষ অন্ধকারটা এখন তার বারান্দায় জেঁকে বসে আছে। সেখান থেকে তার চোখে। চোখের তারায় আলো প্রতিফলিত হলেই তো কেবল দর্শন অনুভূতি হয়। তিনি তার সকল অনুভূতি হারিয়ে নিঃসাড় স্তব্ধতায় বসে এসব কিছুই ভাবেন আজকাল।
জমাট অন্ধকার এড়িয়ে যেতে চান বলেই দিনে দিনে বারান্দার চেয়ারে ধুলো জমেছে । তাছাড়া প্রায়শ শরীর ভালো না থাকায় তিনি মাঝে মাঝে কেবল সন্ধ্যার দিকে বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। আকাশটা তখন ভীষণরকম স্বপ্নালু হয়ে থাকে। নানান রঙের ছটা। ঠিক স্বপ্নের মতো। সে চেহারা দেখে একটা মোহাবিষ্ট ভাবালুতা হানা দিয়ে যায় তার মনে। বারান্দা থেকে সোজা নদী দেখা যায়। নদীর নামটা ঠিক এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। হয়তো বিশেষ কোনো নামও নেই। নদীটার জীবনও তার মতো বিশীর্ণপ্রায়। ছন্দ হারিয়ে চলতে ভুলে গেছে।
পাঁচিল টপকে আসা ছেলেটিকে খেয়াল না করার আরও কারণ থাকতে পারে। কারণ, তিনি এখন চট করে অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না। আর সাথে সাথে মনে করার চেষ্টা করলেও কিছুতেই নাম মনে আনতে পারেন না। হয়তো মাথায় আসছে কিন্তু মাথা আর কাজ করছে না কিংবা তার বার্তা যথাস্থানে প্রেরণ করতে পারছে না।
মল্লিকবাড়ির পেছনের উঁচু পাঁচিলঘেরা উঠানের কাছে ঝোপালো বন। কিছু সুপ্রাচীন গাছের ফাঁকে ফাঁকে বাহারি লতা-গুল্ম ঝোপও আছে। একসময় বেশ যত্ন-আত্তি করে গাছগুলো লাগানো হয়েছিল বোঝা যায়। কিন্তু এখন শ্রীহীন অপরিচিত বুনো ঝোপ-জঙ্গলই বেশি। বারান্দা সোজা একটা প্রকান্ড শিমুল গাছ ওদিক দিয়ে ডালপালা মেলে দিয়েছে পাঁচিল ছাড়িয়ে বাইরে নদীর দিকে। ছেলেটা হাত উঁচিয়ে ওদিকটায় না দেখালেও এতক্ষণ পরে রমেন মল্লিক ধরে নিয়েছেন। শিমুলের ডাল ধরেই ছেলেটা ভেতরে ঢুকেছে। ওদিকটায় পাঁচিল হেলে গিয়ে অনধিকার প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে সবার জন্যে। আবারও একবার নাম জিজ্ঞাসা করায় এবার সাহস করে ঘাড় নাড়িয়ে কাঁচুমাচু কণ্ঠে বলে, শালুক ।
কী? শালুক? রমেন মল্লিক যেন আত্মহারা হয়ে উঠলেন। উচ্চকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, বেশ নাম তো তোর।
তা, দীপেন তোর কী হয় রে? তাকে খুঁজতে খুঁজতে বুঝি এদিকে…
না, কিছু হয় না। এমনি মাঠের ও-ধার থেকে এসেছি ।
মাঠের ও-ধার থেকে? তাও এই ভর সন্ধ্যাবেলায়? উদ্দেশ্য কী তোর?
রমেন মল্লিক তখনও ঘরের এ পাশ থেকে জানালার পুরানো গরাদের ফাঁক দিয়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন অনর্গল। এবার ভেতরের সবুজ কাঠের দরজার ছিটকিনি আলগা করে বেরিয়ে গেলেন বারান্দায়। ভারী দরজার গায়ে হঠাৎ দলছুট বাতাসের একটা ঝাপটা ধাক্কা খেয়ে গেল। বাতাসটা হুহু করে ঘরে ঢোকার মুখে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল রমেন মল্লিকের শরীরে। তারপর নিয়মমতো ঢুকে গেল ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে- দমবন্ধ গুমোট ভাবটা তাড়িয়ে নিয়ে গেল এক নিমিষে।
সূর্য ডুবে গিয়ে একটা মানানসই নরম আলো বারান্দা জুড়ে খেলা করছিল তখন । রমেন মল্লিক এতক্ষণে খেয়াল করলেন, শালুকের ডান হাতটা পেছনে আড়াল করে রাখা আর বাম হাতের কনুইয়ের কাছে ছড়ে গেছে ।
ইস… এমন কীভাবে হলো?
পাঁচিলের ওপর উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছিলাম। একটু ব্যথাও পেয়েছি।
আরেক হাতে কী? মুঠোতে কী ধরে আছিস?
শালুক আবার মাথা নিচু করে মুখ আড়াল করে ফেলে । নিশ্চুপ সন্ধ্যার মতো আবারও নিরুত্তর সে।
তিন
শালুক কোত্থেকে যেন একটা ময়না নিয়ে এসেছে। মল্লিকবাড়ির পাঁচিল টপকে বা প্রধান ফটক ধরে সে আগেও কয়েকবার এসেছে। এ বাড়ির গণ্ডি তার কাছে অচেনা নয়। আগে প্রতিবারই সে কিছু না কিছু কুড়িয়ে নিয়ে যেতো। আমের দিনে আম, কুলের সময়ে কুল, আতা, পেয়ারা এমন মৌসুমী ফল। তাছাড়া বাড়ির সৌখিন বাগান থেকে ফুল চুরি করেও নিয়ে গিয়েছে দত্ত বাড়িতে ফরমাশ পেয়ে। হয়তো পূজার কাজে। কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদে এমন চমৎকার তথ্য পাওয়া গেছে ওর মুখ থেকে। এ পাঁচিল ডিঙানো কিংবা উঠান মাড়িয়ে বারান্দায় প্রবেশ মোটেও নতুন নয় তার কাছে।
মা বাড়ি নেই?
কে মা? কোথায় মা? যেন হৃৎপাখির ডাকে হঠাৎ চমকে ওঠেন মল্লিকবাড়ির কর্তা।
বা রে… এখানে যিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলতেন আমার সাথে। মাঝে মাঝে দুপুরে ভাতও মেখে খাওয়াতেন। তেল দিয়ে মাথার চুল আঁচড়ে সিঁথি কেটে যত্ন করে সাজিয়ে দিতেন । সে-ই মা নেই আজ?
রমেন মল্লিক হাঁ করে চেয়ে থাকেন শালুকের দিকে। সন্ধ্যার এমন সময়ে এমন একটি কিশোর ছেলের কাছ থেকে তিনি যা শুনছেন তা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই কিশোর ছেলের মুখ থেকে তিনি তার সদ্যপ্রয়াত স্ত্রী সম্পর্কে যে অজানা বিষয়গুলো শুনছেন তা যেন অবিশ্বাস্য। নাহার ও শালুকের মধ্যকার এমন দুরন্ত সখ্য তার কাছে নতুন করে ঊন্মোচিত হলো আজ।
শামসুন নাহার বাড়িতে একা একাই থাকতেন। সাংসারিক কাজ গোছানোর পর একটা সমস্ত দিন তার সামনে পড়ে থাকতো। এমন পূর্ণদৈর্ঘ্য দিনের মাত্র কয়েক প্রস্থজুড়ে শালুক আনন্দের সঙ্গী হয়ে চলে আসতো তার কাছে। ওদিকে রমেন মল্লিক কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা লেগে যেতো। তার আগেই হয়তো দিনের কোনো নিস্তব্ধ প্রহরে তাদের দুজনের এমন সখ্য গড়ে উঠেছিল দিনের পর দিন।
সন্ধ্যার ফুরফুরে হাওয়া কোথা থেকে যেন একখন্ড বিষণ্ণ কালো মেঘ তাড়িয়ে নিয়ে এল রমেন মল্লিকের মনের কোণে। স্ত্রীর সাথে এতদিনের গাঁটছড়া বেঁধে সংসার করা, অথচ তিনি যেন কত অজানা তার কাছে। খুব আফসোস হচ্ছে এই ভেবে যে, বাইরের জগতে অবিরাম ব্যস্ত থেকে তিনি নিজেও কতটা যত্নহীন এবং খোঁজ-খবরবিহীন হয়ে পড়েছিলেন সংসারের দিকে, বিশেষত স্ত্রীর দিকে। অথচ তার সে অনুপস্থিতি, ধারাবাহিক শূন্যতা পূরণ করে একটি অচেনা বালক কী পরম মায়ায় এ বাড়ির নিঃসঙ্গ মানুষটির সাথে একটি অসম মায়ার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কতটা বেখেয়ালি হলে এমন হয় যে যার বিন্দুবিসর্গ তিনি আগে জানতে পারেননি। এদিকে শালুক এ বাড়ির সব পথ চেনে, সবকিছুই জানে।
তা তোর হাতে ময়না কেন? কোত্থেকে নিয়ে এলি এটা?
শেষবার যখন মায়ের কাছে এসেছিলাম, মা আমাকে আদর করে কত কী খাইয়েছিলেন। মুরগির মাংস দিয়ে ডাল-ভাত আর দুটো কাঁচা লঙ্কা। খাওয়াশেষে এক বাটি নলেন গুড়ের পায়েস। আহা, স্বাদ যেন এখনও মুখে লেগে আছে। আর কয়েকটা টাকাও গুঁজে দিয়েছিলেন পকেটে, বাঁশি কিনব বলে। তিনিই তো আনতে বললেন।
তা তো বুঝলাম। তবে ঘরে বসে যা।
আমি তো ঘরে যাব না। এ বারান্দাটায় আমার ঘর । এখানে মায়ের সাথে কাটাতাম। অনেকদিন আসতে পারিনি । মাকে একবার ডাকুন। সেই কতদূর থেকে এসেছি।
তোর মাকে দেখার জন্যেই তো ভেতরে ডাকছি। ভেতরে আয় একবার।
না কর্তামশায়, ভেতরে যাব না। আপনি ডাকুন।
রমেন মল্লিক শালুকের মুখ থেকে সব কথা শুনে হতবুদ্ধি হয়ে চুপ করে থাকে। ওর মুখে আবার কথার খই ফোটে যেন। মা আমাকে বলেছিলেন, তিনি খুব দুখী। তাই একটা কথা বলা ময়না এনে দিলে তার ভালো সময় কাটবে। মা তো সারাদিন একা থাকতেন তাই।
এটা বুঝি সেই ময়না?
হ্যাঁ । আমি একে দু মাস ধরে কথা শিখিয়েছি।
সে এখন কথা বলতে পারে?
পারে তো!
আর তখনই ময়নাটা চেঁচিয়ে উঠল, শালুক… শালুক।
যেন সে শুধু কথাই বলতে পারে না, মানুষের সব কথা বোঝেও।
আমি তো এমন কথা বলা ময়না দেখিনি কোনোদিন। তোর মাও তো আমাকে জানায়নি কোনোদিন তোর কথা।
একটু আক্ষেপ, বুকভরা চাপা অভিমান থেকেই কথাটা বললেন রমেন মল্লিক ।
আমি তো তাই নিয়ে এলাম–সেই কতদূর থেকে। সারাদিন হয়রান হয়ে খুঁজে খুঁজে। মাকে একদম চমকে দেব বলে । মা কোথায়?
রমেন মল্লিক বারান্দা ছেড়ে এবার ঘরমুখো ধীর পায়ে এগোতে থাকেন। শালুকের হাতের ময়না মিষ্টি কণ্ঠে বলতেই থাকে শালুক… শালুক।
চার
মল্লিকবাড়ির চারপাশ জুড়ে ঘোর সন্ধ্যা নেমে গেছে। চিরিৎ চিরিৎ ঝিঁঝিঁর ডাকসহ আরও অজানা অচেনা শব্দ সম্মিলিত কোরাস তুলে যাচ্ছে বাইরে। হালকা বাতাসের দপদপানি বাগানের গণ্ডি ছাড়িয়ে বারান্দায় এসেও হানা দিয়ে যাচ্ছে। নদীর দিকে দু একটি আলো জ্বলছে। মানুষের দু একটি কথা ফুটছে জোনাকির মতো। মল্লিকবাড়ির স্যাঁতসেঁতে উঠানে সন্ধ্যা তার স্বভাবমতো নিজেকে সাজিয়ে আনছিল প্রতিদিনের মতো । ঘরের ভেতরে তখনও আলো জ্বালানো হয়নি।
রমেন মল্লিক ঘরে ঢুকে জেঁকে বসা অন্ধকারকে তরল করতে আলো জ্বেলে দেন। তার পেছনে গুটি গুটি পায়ে পাখি হাতে শালুক। তিনি শ্যামল মুখের বুনো ছেলেটিকে নাহারের নিজ হাতে সাজানো অবস্থায় কল্পনা করতে চাইলেন। চোখের সামনে দেখতে পেলেন, দারুণ পরিপাটি এক মায়াভরা মুখ কেমন কালো ময়না হাতে হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
এ যে নাহারের আদরের শালুক। ততক্ষণে শালুক নাহারের বিশাল ছবিখানার সামনে। মাসখানেক আগেই রমেন মল্লিক যত্ন করে বাঁধিয়ে দেয়ালে টানিয়েছিলেন স্ত্রীর ছবিটা। সেদিকে তাকিয়ে থাকে শালুকের মায়াভরা দুটো টলটলে চোখ, যেন রাজ্যের জমানো কথার, কুড়ানো শব্দের টলটলে এক দীঘি।