short-story-malaichaki

মালাইচাকি
জয়ন্ত দে

 

থানার বাইরে উচাটন হয়ে রঘুবীর আর শ্যামলাল। এরা পুলিসের লোক, আবার নয়। ট্রেন লাইনের এ-ধার শ্যামলাল, ও-ধার রঘুবীরের জিম্মায়। সারা তল্লাটের লোক এদের চেনে, এরা থানার হয়ে অনেক কাজ করে। কাজ বলতে, সেটিং করা, টাকা তোলা। সপ্তাহে শেষে সে টাকা জমা দেয়।  

থানা থেকে বলে দেওয়া আছে— কোনও কমপ্লেন যেন না আসে। যে টাকা দিতে চাইবে না, ঝামেলা করবে, তার নামটা শুধু নোট করিয়ে দেবে। তাকে টাইট করার দায়িত্ব থানার।

থানায় কারও নাম জমা মানে সে হপ্তা দেয়নি। নাম জমা হলে থানা খোঁজ নেবে, সে কেন হপ্তা দিল না?

এটাও একটা তদন্ত। রিপোর্ট একটাই ব্যবসা চালু না বন্ধ। আর কোনও কিছুই দেখা হয় না।

শ্যামলাল দু হপ্তা ধরে বৃন্দাবনের নাম দিচ্ছে। থানার খাতায় নোট করিয়ে দিচ্ছে।

মেজবাবু আজ জনার্দনকে বলল, একটা নাম ক হপ্তা ধরে আসছে। বৃন্দাবন দাস— স্টেশন রোড। পাত্তা লাগান তো— কে ঢ্যামনামি করছে? কার লোক? শ্যামলাল রিপোর্ট করেছে।

বৃন্দাবনের নাম শুনে জনার্দন নড়ে বসল।

বৃন্দাবন মানে মালাইচাকি বৃন্দাবন! শালা খুব হারামি। সব সময় ছক করে।

স্টেশন রোডের মোড়ের মাথায় বৃন্দাবনের দোকান। সেখানে মোবাইলের কভার, স্ক্রিন গার্ড, হেড ফোন থেকে, ওয়াইফাইওয়ালা ছোট ছোট সাউন্ড বক্স, এলইডি রিং লাইট, ট্রাইপড কত কী পাওয়া যায়। বহুত চালু দোকান।

জনার্দন আর বৃন্দাবন এক স্কুলের। জনার্দন এক ক্লাস নীচে পড়ত। পাড়াও পাশাপাশি। বৃন্দাবন ব্যাক, জনার্দন ফরোয়ার্ডে খেলত, স্ট্রাইকার। মাঠে দুজনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ছিল। পরের দিকে জনার্দন এগলেই বৃন্দাবন বলত, ‘আজ তোর মালাইচাকি খুলে নেব। কোন শালা বাঁচাবে!’ সত্যিই দু চারজনের তাই অবস্থা করেছে। ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে। খেলার মাঠে গুন্ডামি করত বৃন্দাবন। ভয় দেখিয়ে বৃন্দাবন ওকে এগতে দিত না। মাটি ধরিয়ে দিত। এখন জনার্দন স্টেশন রোডের দিকে গেলেই বৃন্দাবনের দোকানে ঢুঁ মারে। কিছুটা হুমকির মতো। পুলিশ!

সেদিনই জনার্দন গিয়ে দাঁড়াল বৃন্দাবনের দোকানে। তখনই বৃন্দাবন বলল, হেড ফোনটা চলছে—?

এই কথার একটা গূঢ় অর্থ আছে। যে বোঝার সে ঠিক বুঝবে। কথাটা জনার্দনের আঁতে লাগল। সে একটা হেড ফোন নিয়েছে বৃন্দাবনের দোকান থেকে। নিয়েছে মানে, কানে দিয়ে গান শুনতে শুনতে চলে গিয়েছিল। বৃন্দাবন কায়দা করে সেই হেড ফোনের কথা তুলল।

জনার্দন চোয়াল শক্ত করল, বেশ করেছে নিয়েছে, বেআইনি দোকান বসাবে— পুলিশ নেবে না তো কে নেবে?

জনার্দন বলল, ‘খবর হয়েছে— তোর কাছে সব নকল মাল।’

‘একশো টাকা দিয়ে ব্র্যান্ডেড মাল চাই? অরিজিনাল কোম্পানির মাল হলে অরিজিনাল দাম দিতে হবে।’ বৃন্দাবন বলেছিল।

‘সে সব থানায় গিয়ে বোঝাবি। রিপোর্ট হয়েছে, সাবধান হয়ে যা—।’

‘আমাকে রিপোর্ট দেখাস না। আমি যদি রিপোর্ট করি থানা শুনবে? গরিবের কথা থানা শোনে না। আর বেশিদিন নেই— এই দোকান আমি তুলে দেব। এই যন্তরটা সবার সর্বনাশ করছে।’

তুইও তো অনেক মানুষের সর্বনাশ করেছিস, কাকে ল্যাংড়া, কাকে খোঁড়া বানিয়েছিস, কতজনকে যে মাঠছাড়া করিয়েছিস— কথাটা বলতে গিয়ে জনার্দন বলল না। পুরনো কথা। একথা তুললে বৃন্দাবন আনন্দ পাবে। গর্বে টান টান হয়ে দাঁড়াবে। জনার্দন বলল, ‘থানার রিপোর্ট আছে— নাম কাটিয়ে দোকান বিক্রি করবি, নইলে পুলিশকে জানিস তো— তোকে ঠিক খুঁজে নেবে। গলায় আঙুল দিয়ে টাকা বের করবে।’

‘পুলিশ আমাকে খুঁজতে যাবে কেন, আমি কি ক্রিমিনাল? আমি এই দোকানেই থাকব—।’

‘ও গণেশ ওলটাবি? সে তোর পাঁঠা কীভাবে কাটবি তুই ঠিক কর। আমি ইনকোয়ারিতে এসেছি— শ্যামলালের সঙ্গে কথা বলে নিবি। ওর হপ্তার টাকা ওকে দিয়ে দিবি। ঝামেলা বাড়াস না।’

‘শালা পুলিশ ক্রিমিনাল হয়ে গেছে— হপ্তার টাকার জন্য ঝামেলা করছে। ভয় দেখাচ্ছে। আমাকে ওদের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে!’

‘কী বললি?’

‘যা বলেছি, ঠিক বলেছি। যা গিয়ে তুই রিপোর্ট দে— আমি পালাইনি, আছি—’

জনার্দন মেজবাবুকে রিপোর্ট দিল। বলল, ‘কড়কে দিয়েছি স্যার, মালটা ছোটবেলা থেকেই শয়তান, খুব মারকুটে একটা। হপ্তা না দিলে লকআপে ঢুকিয়ে ঠ্যাং ভেঙে দিন। মেরে ওর মালাইচাকি ভেঙে দিলে ঠিক হবে—’

কিন্তু পরের শনিবারই শ্যামলাল ফিসফিস করে বলল— ‘এ হপ্তাতেও দিল না। যেতেই বলল, আমার বন্ধু আছে— ছোটবেলার বন্ধু— এক স্কুলের জনার্দন। ও এসেছিল— ওকে যা বলার বলে দিয়েছি।’

শুনে মটকা গরম হয়ে গেল জনার্দনের। ‘এবার ওকে ছাড়ব না, আমি ওর বন্ধু!’

স্টেশন রোডের মোড়ে এসে দাঁড়াল জনার্দন। এখন সাড়ে চারটে। রাস্তাটা ফাঁকা। বৃন্দাবনের দোকানটার পজিশনটা বেশ। জনার্দন এগিয়ে এল, বলল, ‘একটা কথা বলি শোন, তোর সঙ্গে আমার পুরনো সম্পর্ক। তুই একদিন আমাকে একটা হেডফোন গিফট করেছিলি, আমার মনে আছে। আমি তোকে হেল্প করতে চাই, বৃন্দাবন। তোর নামে শ্যামলাল রিপোর্ট করেছে। তুই হপ্তা দিচ্ছিস না। দু হপ্তা হয়ে তিন হপ্তায় পড়েছে। তোর দেড় হাজার টাকা বাকি?’

বৃন্দাবন শুকনো মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। 

জনার্দন বলল, ‘টাকাটা তোকে দিতে হবে বৃন্দাবন, এটা ফুটবল মাঠ পাসনি, ভয় দেখিয়ে পার পেয়ে যাবি। মেজবাবু খুব ছ্যাঁচড়া লোক, বন্ধু বান্ধব, সুবিধে অসুবিধে বোঝে না, আইনে চলে। হপ্তা না পেলে কোনদিন তোর দোকান রাতের বেলাই এসে সাফ করে দেবে। তোরই মালাইচাকি খুলে নেবে।’

‘আমি খুব বিপদে পড়েছি—।’ পা চালানোর মতো করে বলল বৃন্দাবন।

‘সরকার ওসব শোনে না। টাকা তোকে দিতেই হবে বৃন্দাবন। সরকারি টাকা মেরে বেরিয়ে যাবি, অত সহজ না!’

বৃন্দাবন মাথা নীচু করে থাকল। জনার্দনের মনে হল সে ভাঁজ মেরে ফেলে দিয়েছে বৃন্দাবনকে। এবার বলটা নিয়ে গোলের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বলল, ‘মেজবাবু টাকা না পেলে— লকআপ করিয়ে দেবে। নকল মালের কেস মারাত্মক। জেল জরিমানা— বড় বড় কোম্পানি সব। তোকে ফাঁসির আসামী বানিয়ে দেবে—’

তখনই বৃন্দাবন যেন ওকে ব্লক করে দাঁড়াল, বলল, ‘আমার পুলিশে ভরসা নেই, তোকে ভরসা করি— তোর খুব বুদ্ধি, যা বিদ্যুতের মতো ভাঁজ মারতিস। দেখ না একটু বুদ্ধি করে, কিছু যদি হয়— টাকা আমি দিয়ে দেব। তুই আমার মেয়েকে বাঁচা। কেসটা তুই কর ভাই—’

বৃন্দাবন তখন গড়গড় করে মেয়ের কথা বলে গেল।

 

 

 

মেজবাবু বলল, ‘ওই বৃন্দাবন হপ্তা দেয় না। এখন কেস দিচ্ছে। আপনার এত প্যাঁয়তাড়া কেন জনার্দনবাবু? থানায় এসে কোনও রিপোর্ট লেখায়নি, আপনাকে কানে কানে বলল, আর তাই শুনে আপনি ধেই ধেই করে নাচছেন।’

‘না, স্যার। আমার মেয়ের মতো—’ জনার্দন ঠান্ডা ঠান্ডা গলায় বলল।

‘চোপ! মেয়ের মতো মানে? বন্ধুর বউয়ের সঙ্গে আপনার লটঘট আছে? যে ছেলের নামে কেস দিচ্ছেন— ওই ছেলেটা সাজু মণ্ডল আমাদের থানা এলাকার ছেলে নয়, তার ওপর পার্টি করে।’

জনার্দন বুঝল, থানা কিছু করবে না। লাইনের ওধারে, মদনপুর। অন্য থানা। 

রঘুবীর বলল, ‘এলাকায় গিয়ে ছেলেটাকে তুলে আনা যাবে না। পার্টির ছেলে, হাঙ্গামা মাচিয়ে দেবে।’

জনার্দন বুঝল, যা করার তাকেই করতে হবে। সে রঘুবীরকে বলল, ‘আমরা মাঠের বন্ধু, রে। ও জানে আমি কেমন প্লেয়ার ছিলাম। একবার গেঁথে ফেলতে পারলে আমিই ওই সাজু মণ্ডলকে নাঙ্গা ডান্স করিয়ে ছবি তুলে রাখতাম। মেয়েটার ভিডিও শো করিয়ে কুড়ি হাজার টাকা নিয়েছে। আরও চাইছে। ভিডিওটা যেভাবেই হোক ডিলিট করাতে হবে।’

‘এমন বোকা কাজ কেউ করে, স্যার? এই মেয়েগুলোর দোষ, সব এমন প্রেমের চক্করে পড়ে—’ রঘুবীর মাথা চুলকাল।

‘বাবার দোকানে ফোকাস রিং লাইট এসেছে। সেটাই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে নেচেছে। ভিডিও করে বয়ফ্রেন্ডকে পাঠিয়েছে। মেয়েটা এখন বলছে, কী করে যেন সব খারাপ সিন হয়ে চলে গেছে।’

‘কিচ্ছু চলে যায়নি‌, স্যার, ওই মেয়েটাই পাঠিয়েছে, স্যার। আপনাকে বুদ্ধু বানাচ্ছে। মেয়েরা লভ হলে খারাপ সিন পাঠিয়ে দেয়। খারাপ সিনে এক্সটা মজা— ভালো মন্দ বোঝে না।’

‘ঘরের মেয়ে ভুল করেছে, তাকে উদ্ধার করতে হবে, রঘু। ছেলেটা ব্ল্যাকমেল করছে। সাজু মণ্ডলকে দিয়ে ভিডিও ডিলিট করতে হবে। যেভাবেই হোক।’

‘খুব মুশকিলের কাজ, স্যার।’

‘মুশকিল আসান করতে হবে। আমি ভাবছি।’

ক’দিন পরে জনার্দন ডাকে রঘুবীরকে।

‘রঘুবীর কোনও লোকাল কানেকশন ধর, লোভ দেখা। সাজুকে অফার দে— বল, এখানে জামতাড়া ইউনিট খুলছে। জামতাড়া কায়দায় কাজ হবে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। থানার সঙ্গে ফিফটি ফিফটি। থানা নম্বর পাঠাবে। বাইরের লোক কাজ করবে। থানা প্রোটেকশন দেবে।’

‘যদি না বলে, রাজি না হয়?’

‘না, বলবে না। তুই থানার লোক, সবাই চেনে বিশ্বাস করে যাবে। টাকার লোভ বড় লোভ— সাজু মণ্ডলকে গাঁথতেই হবে।’

রঘুবীর গিয়েছিল। সাজু না বলেছে। বলেছে— আমার কম্পিটার নেই।

‘তুই আবার যা রঘুবীর, বল, ল্যাপটপ দেব— ঘণ্টা চারেকের কাজ। দেদার টাকা। লোভ দেখা। লোভ! লোভ!’

রঘুবীর গিয়েছিল। সাজু মণ্ডলকে রাজি করিয়ে এসেছে। ঘণ্টা খানেকের ট্রেনিং।

জনার্দন একটা হোটেলের ঘর ব্যবস্থা করে রেখেছে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা সব হাইব্রিড বাচ্চা। এক ঘণ্টার ট্রেনিং-এ ঝটপট ধরে নিল।

দ্বিতীয় দিনেই জনার্দন বলল, একটা টাটকা নম্বর আছে। রিস্ক কম, দেখবে নাকি ট্রাই করে? বলবে, থানা থেকে বলছি— ট্রেড লাইসেন্স-এর গোলমালের জন্য কাল দুপুরে থানায় গিয়েছিলেন ডায়েরি করতে? ওটা হয়ে যাবে, ওর জন্য এক হাজার টাকা দিতে হবে। অনলাইন।’

‘বিশ্বাস করবে?’

‘করাতে হবে— ওর ট্রেক লাইসেন্সের কপি— ওর হাতে লেখা অ্যাপ্লিকেশন— সব থানায় জমা দিয়েছিল। সেগুলো পাঠিয়ে দাও। আপসে বিশ্বাস করবে।’

তবু সাজু মণ্ডল নাক সিঁটকালো— মাত্র একহাজার, স্যার?

জর্নাদন হাসল, বলল, ‘ও যখন একহাজার দেবে, আমি তখন এই ল্যাপটপে ওর পুরো মোবাইল স্ক্রিনটা দেখতে পাব। ওর পাসওয়ার্ডও পেয়ে যাব। কালই আমি অর্ধেক কাজ করে রেখেছি। তারপর আজ রাতে যখন ঘুমবে তখন ওর লক্ষ্মী চঞ্চলা হয়ে ব্যাঙ্ক ফাঁকা করে চলে যাবে।’

সাজু মণ্ডল রাজি। পয়লা অপারেশন।

সাজু ফোন করল। যে ধরল সে জনার্দনের খাস লোক শ্যামলাল। শ্যামলালের সঙ্গে সব কথা শেখানো পড়ানো ছিল। কথামত সে প্রথমে প্রমাণ চাইল। থানার জমা দেওয়া কাগজপত্র দেখে সঙ্গে সঙ্গে একহাজার টাকা পাঠিয়ে দিল।

সাজুর মুখে গর্বের হাসি— সাকসেস, স্যার। প্রথম শটেই গোল। তাহলে আমি আসি, স্যার।

জনার্দন বলল, ‘তুমি গেলে কী করে হবে? তোমার ফোনটা লাগবে। তুমি থেকে যাও। তোমার ফোনে একহাজার টাকা ঢুকেছে তুমি তো কেস খেয়ে যাবে। সেটা সাফ করতে হবে। যদি পুলিশ কেস হয়। তুমি পরিষ্কার ফোনটা দেখিয়ে দেবে। তুমি নির্দোষ। তোমার মোবাইলে একহাজার টাকা এসেছে, আননোন অ্যাকাউন্ট, তুমি সেই টাকা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছ।’

‘সেটা এখন হবে না?’

‘না। তাহলে ওর মনে প্রশ্ন জাগবে— টাকা নিল, আবার ফেরত দিল কেন? থানায় যাবে খোঁজ নিতে। যা হবে তা সব রাত বারোটা নাগাদ। তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। নয় ফোনটা রেখে সব পাসওয়ার্ড দিয়ে যেতে হবে। তোমার আর ফোন নেই? একটা ফোনেই সব কিছু থাকে?’

‘হ্যাঁ, স্যার, আমার একটাই ফোন, সেখানেই সব থাকে।’

‘ঠিক আছে কাল তোমাকে আরও দুটো ফোন কিনে দেব। সিম কার্ডও পেয়ে যাবে।’

সাজু মণ্ডল ফোন ছাড়ল না, রাতে থেকে গেল।

রাত বারোটা বাজার একটু আগে জনার্দন ল্যাপটপ অন করল। কিছুক্ষণ দেখে বলল, ‘কেন কানেক্ট হচ্ছে না, বুঝতে পারছি না। তোমার ফোনটা দাও।’

সাজু ফোনটা দিল। জনার্দন ফোন থেকে সব ডাটা মুহূর্তে ল্যাপটপে ডাউনলোড করে নিল। ভিডিও শূন্য। সব ছবি ফেলে দিল। এবার দ্বিতীয় কাজ, ছেলেটার অ্যাকাউন্টে দেখল পঁচিশ হাজার টাকা আছে। এর মধ্যে কুড়ি হাজার টাকা বৃন্দাবনের থেকে মেয়ের ভিডিও বাবদ নেওয়া। একহাজার শ্যামলালের। সে কুড়ি হাজার টাকা বৃন্দাবনের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিল। একহাজার শ্যামলালের। বলল, ‘একহাজার যেটা এসেছিল সেটা রিটার্ন করলাম।’

সাজু বলল, ‘আর আমাদের কী এল?’

‘কুড়ি হাজার।’

‘আমার তাহলে দশ হাজার?’ বলে সাজু হাসল।

ওরা সবাই উঠে পড়ল।

রঘুবীর বলল, ‘সাবধানের মার নেই। সাজু তোমার ফোনটা দাও।’ রঘুবীর ফোনটা নিয়ে সেটা দ্রুত ভেঙে জলের মগে ঢুকিয়ে দিল। বলল, ‘কাল তোমার দুটো ফোন আসবে—’

ছেলেটা বিমর্ষ মুখে বলল, ‘স্যার, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল, ওতে অনেক ফোটো, ভিডিও ছিল।’

‘কী ছিল, ব্ল্যাকমেল করার মতো কিছু!’

‘না, স্যার, পুরনো হিসেব। একজনের কিডনি জমা রেখেছিলাম।’

জনার্দন হাসল।

 

 

 

সকালে জনার্দন এসে দাঁড়াল বৃন্দাবনের সামনে, বলল, ‘কাল সাজুর ফোন থেকে সব ছবি ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছি। ওর মোবাইলই ভেঙে দিয়েছি। তারপর সেটা জলে ফেলে দিয়েছি। তোর মেয়ের আর কোনও ভয় নেই। আর শোন, সাজুর অ্যাকাউন্ট থেকে কুড়ি হাজার টাকা কাল তোর অ্যাকাউন্টে পড়েছে। পেয়েছিস তো?’

বৃন্দাবন হাসল। বলল, ‘ওর অ্যাকাউন্ট থেকে কুড়ি হাজার টাকা মেরে দিলি!’

‘মারব কেন? ওটা তোর টাকা, তোকেই ফেরত দিলাম।’

বৃন্দাবন তুচ্ছ একটা হাসি হাসল। ‘ও আমার কী টাকা মারবে! কোনও টাকা আমি ওকে দিইনি। ওটা ফলস। কেসটা হেভি করার জন্য বলেছিলাম। নইলে কেসটা দাঁড়াত না, তাই তোকে বলেছি। হ্যাঁ, আমার মেয়ের কিছু ছবি ভিডিও ওর কাছে ছিল। ওদের প্রেম-পিরিত আমি ছুটিয়ে দিয়েছি।’

কথাটা বলার সময় বৃন্দাবন দাঁত কিড়মিড় করল। বলল, ‘ওই সাজু মণ্ডল কার ছেলে জানিস? সাজু হল সেই বিষাণ মণ্ডলের ছেলে। সেই বিষাণ, যার ফার্স্ট ডিভিশনে খেলা বাঁধা। আমার এক লাথিতে মালাইচাকি দু টুকরো—’

জনার্দন ঠক ঠক করে কাঁপছে। কী বলছে বৃন্দাবন!

বৃন্দাবন হাসছে, ‘ওই ছেলেকে যখন বললাম, তোমাদের প্রেমের কাঁথায় আগুন! আমি তোমাদের প্রেম টেম মানি না। এদিকে দেখলে তোমার বাপের মতো তোমার ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেব। মালাইচাকি দু টুকরো করে দেব। আমার মেয়ের ছবি ভিডিও সব ফেলে বিদায় হও। কী ডায়লগ দিল জানিস? গলা উঁচিয়ে বলল, আপনার মেয়ের কোনও ক্ষতি করব না, ওকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু সব ছবি ভিডিও রেখে দিলাম। আপনি আমার বাবার মালাইচাকি নিয়েছেন, আমি আপনার কিডনি জমা রেখে দিলাম। ওই সাজু মণ্ডল ওর বাপের বদলা নিল! আমার সঙ্গে পাঁয়তাড়া। আজ তোকে দিয়ে আমি সাজু মণ্ডলের খেলাও শেষ করে দিলাম। খুব ভালো খেলেছিস জনার্দন। এ তো হ্যাটট্রিক!’

জনার্দনের কাঁপুনি আর কমে না। ও কি বলতে পারে, ওরে মালাইচাকি বৃন্দাবন তোর কিডনি এখন আমার ল্যাপটপে। আমি ইচ্ছে করলে— না, না, নিজের মেয়ে ভেবেই সে কাজটা করেছে। এখন যেভাবেই হোক ছেলেটাকে টাকাটা ফেরাতে হবে।

জনার্দন বাঁশি শুনল। লাইন্সম্যানের ফ্ল্যাগ নাচছে।

শেষ গোলটা অফসাইড! হ্যাটট্রিক নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *