জঞ্জাল
অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য

– খোকন তোর ফিরতে এতো রাত হল?
– মা আজ মনে হচ্ছে জীবনে একটা বড় কাজ করলাম।
– কী কাজ খোকন?
– মা, বড় রাস্তার মোড়ে একটা চোর ধরা পড়েছে। আমি আর মান্তু বাড়ি ফিরছি তখন। আইসা ক্যালান ক্যালালাম না চোরটাকে।
– মেরে ফেলিস নিতো? কতো বয়েস চোরটার?
– মা তুমি অমনি কাঁপছ কেন?
– খোকন আগে আমার প্রশ্নের জবাব দে!
– বয়েস কী করে বলব, চোরটা কি পকেটে বার্থ সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরছিল নাকি? হবে ওই পঞ্চাশর মতো। তবে ব্যাটা বাঁচবে না।
– কেন, খোকন?
– সবাই লাঠি বেল্ট দিয়ে এতো মারছিল, তবু বলেকি আমি চোর নই।
– চোর তো নাও হতে পারে। তুই দেখেছিস ওকে চুরি করতে?
-এতগুলো লোক এমনি একটা লোককে ধরে পেটাবে? আমি শালার মাথায় একটা বোতল ভেঙেছি। আর কি রক্ত!
কথাটা বলে খোকনের কি হাসি। গুটকা খাওয়া দাঁতের হাসি দেখলে ভয় লাগে। দুই খোকনকে মেলানো যায় না। কুড়ি বছর আগে ভয়ে সিটিয়ে থাকা খোকন এমন হিংস্র ছিল না। পাঁচ বছরের ছেলেটার মুখে একটাই কথা ছিল – আমার বাবা চোর নয়।
সরমার রাতে ঘুম আসে না। বারবার খোকনকে বিরক্ত করে – কিরে বন্ধুদের একবার ফোন কর না। লোকটা যদি আর না বাঁচে? লোকটার ঘরে নিশ্চয়ই বউ বাচ্চা আছে। তাদের কীভাবে চলবে?
খোকন অঘোরে ঘুমচ্ছে। কোনো জবাব না পেয়ে সরমা উল্টোদিকে মুখ করে চুপ করে শুয়ে থাকে।বহুবছর আগের কথা মনে পড়ে।
ব্যাঙ্কের টাকা তছরুপের দায়ে দশ বছরের দক্ষ কর্মচারী থেকে চোর উপাধি নিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন খোকনের বাবা শিবেন ঘোষ। লাঠি, বেল্ট দিয়ে মার খাননি কিন্তু শব্দ বানে ক্ষতবিক্ষত মানুষটা পরিবারের কথা না ভেবেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
সরমা উঠে বসে। ছেলেকে এক ঠেলা দিয়ে আবার প্রশ্ন করে – যে লোকটাকে মেরে এলি ওর ঘরে কে কে আছে, রে খোকন?
মা তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? চোরের বাড়ির খবর নিতে যাব! তাছাড়া ক্লাবের রতন দা বলল তোরা এবার কেটে পর পুলিশে খবর দিয়েছি। চোরটা মরলে আবার খুনের দায়ে জেলে পুরবে। এই বয়েসে পুলিশের খাতায় নাম উঠলে কেউ চাকরি দেবে না।
সরমা চোখের জল মুছে বলে – সমাজের অনেক বড় উপকার করলি।
মা আমরাই তো সমাজের আবর্জনা দূর করব। সুকান্তের কবিতাটা মনে আছে? ‘তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ / প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল। ‘মা তুমি হাসছ?
খোকন, নিজেরাই যদি জঞ্জালের স্তুপ হয়ে যাস! তোর বাবাও সুকান্তের একটা কবিতা পড়তেন – অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি / জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভুমি।
রাত বাড়তে থাকে সরমার ঘুম আসে না। মনে হয় পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বাইরের দরজায় একটা কুকুর কাঁদছে। রান্নাঘরে ফেনা ভাত রাখা। কুকুরটাকে খেতে দিতেই চুপ করে গেল। খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। খাবার পেলে পশু পাখি, মানুষকে বিরক্ত করে না। কিন্তু মানুষের অন্তরে খিদের জ্বালা মিটে গেলেও রয়ে যায় পাহাড় সমান ঘৃণা। তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এমন মেঘ ভাঙা বৃষ্টি কবে আসবে!