মেয়ে লেখকদের কলমে যৌনতা
কাকলি দেবনাথ

‘রিরংসা’ শব্দটি একটু খটমট লাগলেও ‘যৌনতা’ শব্দটির সঙ্গে কিন্তু আমরা সকলে পরিচিত। এই একটিমাত্র শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক আড়াল – আবডাল, লজ্জা – আনন্দ, ভালোলাগা – ভালোবাসা, প্রণয়- বিচ্ছেদ। সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শব্দটি যৌনতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তা হল সৃষ্টি। সমগ্র জীবজগতের সৃষ্টি কিন্তু এই ছোট্ট শব্দটিকে আঁকড়ে ধরেই। সুতরাং এমন একটি মূল্যবান শব্দ নিয়ে সাহিত্য জগতে আলোড়ন হবে না, তা কি হয়?
অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সাহিত্যে এই বিষয় নিয়ে বহু শাস্ত্র লেখা হয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে প্রথম কামশাস্ত্র অনুশীলনের কথা বলা হয়েছে। খ্রীষ্টের জন্মের বহু পূর্বেই আমাদের দেশেই বাৎসায়ন লিখেছিলেন কামসূত্র। পরবর্তী সময়ে এই কামসূত্রকে অবলম্বন করে অনেক শাস্ত্র রচিত হয়েছে।
তবে যৌনতাকে বিষয় করে গল্প উপন্যাস কবিতা লেখার ক্ষেত্রে পুরুষ লেখকের কলম যতটা সোচ্চার হয়েছে, মহিলা লেখকরা কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে কলম তোলার ক্ষেত্রে প্রথমদিকে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন না।
এই বিষয়টি নিয়ে নবনীতা দেবসেনের একটি লেখা পড়েছিলাম – “সমরেশ বসু একটি শারদীয় সংখ্যায় লিখলেন পঞ্চাশোর্ধ পুরুষের সঙ্গে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রীর এক মধুর প্রেমের কাহিনী। সেইটে পড়ে আমার মনে হল, বাহ, পুরুষমানুষ বলে বুঝি যা খুশি তাই লিখতে পারা যায়? আমিও তা হলে লিখি না কেন? ফারাকটা একটু কমিয়ে চল্লিশোর্ধ একজন মেয়ের সঙ্গে দ্বাদশ শ্রেণীর কোনও ছাত্রের প্রেমকথা! দেখি পাঠক কী বলে?
কিন্তু খাবার টেবিলে কথাটা পাড়তেই ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হল। ‘সে কী! তুই কী বলছিস কী? তোর কী মাথা খারাপ হল? মা হতভম্ব হয়ে বলে উঠলেন। ‘ওইসব লিখবি, ছাপাবি, তারপরেও মা- বাপেরা তোদের কাছে কলেজে ছেলেপুলেদের পড়তে পাঠাবে ভেবেছিস? তোকে তো ডাইনি মনে করবে!’ মেয়ে তো দেখি প্রায় কেঁদেই ফেলেছে – তার শিক্ষিকারা, তার বন্ধুরা – সব্বাই ওর মাকে কী মনে করবে? সে আর মুখই দেখাতে পারবে না! ‘না, মা, তুমি ওসব কক্ষণও লিখবে না।’
এই ঘটনাটির উল্লেখ করলাম এইটুকু বোঝানোর জন্য যে, এই ধরনের বিষয় নিয়ে মহিলা লেখকরা যখন কবিতা, গদ্য, কিংবা উপন্যাস লেখেন তখন ঘরে বাইরে কী ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
আবার এটাও সত্যি যে যতই প্রতিকূল পরিস্থিতি আসুক না কেন সব বাঁধা ভেঙে না এগোলে, এগিয়ে চলার পথ সঙ্কীর্ণ হতে হতে একসময় বন্ধ হয়ে যায়। মহিলা লেখকরাও তাই থেমে থাকেননি। তাদের বলিষ্ঠ লেখনী দিয়ে রচনা করেছেন যৌনতা বিষয়ক অনেক কবিতা, গল্প, উপন্যাস।
কবি যশোধরা রায়চৌধুরীর মতে, “মেয়েরা যখন লেখেন, তাঁর কাছে সমস্ত কবিতাই আসলে মানুষের কবিতা, একই সঙ্গে সেই কবিতার একেবারে ভেতরে থেকে হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠে এমন সব মেয়েমানুষের কথা, মেয়ে শরীরের কথা, মানুষ হিসেবে অস্বীকৃত হয়ে অপমানিত বিক্ষুব্ধ মেয়ের মনের কথা, এমন সব সত্য হঠাৎ করে ভেসে ওঠে কবিতার মধ্যে, যে আমরা স্তম্ভিত হই, স্পৃষ্ট হই, ঋদ্ধ হই। ঠিক যেভাবে এক পুরুষ কবির কলম অনবরতই লিখে চলে পুরুষজমিন, এক নারী লেখেন নারী অঞ্চলের কথাই, সে অঞ্চল বাত্যাবিক্ষুদ্ধ হোক বা শান্ত, সেই ভূগোলটার খবর আমরা পেতে পারি তাঁর লেখায়, নিরবচ্ছিন্নভাবে!”
মানুষের শরীরে ক্ষুধা, তৃষ্ণার মতই পাশাপাশি আছে যৌন কামনাও। ফ্রয়েড বর্ণিত লিবিডো বা যৌন কামনার কথা বাংলা সাহিত্যে মহিলা কবিদের কলমে যতদূর সম্ভব প্রথম দেখা যায় উমা দেবীর (১৯০৪-১৯৩১) কবিতায়। এই কবির বলিষ্ঠ কলমে উঠে আসে
“স্নান করো বিম্ববতী
এ দুপুর বড়ই নির্জন—
এই ঘর নির্জন এখন।
একে একে আবরণ উন্মোচন করো—
শাড়ি সায়া চোলি ও পট্টিকা
দূর করো অঙ্গ থেকে –
স্নান করো বিম্ববতী।
আবার লিখেছেন…
“জল ঢালো নিম্নদরে ত্রিবলী-প্রাকারে—
ক্রমশ উপরে ওঠো।
নাভি ও নিতম্ব কূপে। শ্রোণীর ফলকে
ঢালো পুণ্য জলধারা।
ঊর্ধ অঙ্গ ক্রমশ উদার – স্তব্ধ
বাহুকূপ স্কন্ধ গ্রীবা পৃষ্ঠ বক্ষদেশ
সুবৃত্ত-যুগল
চন্দ্রদেব সুরক্ষিত রাখুন সর্বদা।”
এ তো গেল প্রথম মহিলা লেখকের কলমে যৌনতার কথা। অতি আধুনিক অন্তর্জালের যুগে কবি ও পাঠক উভয়েই বড় নিঃসঙ্গ। শবরী ঘোষ তাঁর “পুরুষ- কিম্পুরুষ” কবিতায় লিখেছেন—
“এক্ষুণি একজন পুরুষ চাই আমার
রাত্রি যেভাবে সূর্যের সঙ্গে মেলে
সে রকম সম্পূর্ণ মিলনের জন্য চাই
এখনই একজন যথার্থ পুরুষ চাই আমার
আমি তো প্রস্তুত হয়েই আছি।”
আবার কবি তসলিমা নাসরিন লিখেছেন—
“আমার বর্ষার জলে
শরীরে বর্ষাতি নিয়ে অনার্য পুরুষ তুমি
চতুর ডুবুরী হও, যতো হও জলজ শরীর
এতোটুকু তবু তোমাকে ছোবে না জল
আমাতে প্রথিত হও, সঠিক নিমগ্ন হও
বিবর্ণ খোলস খুলে ফেলে
আমার আগুনে আজ শরীর তাপাও।
আরও অনেক মহিলা কবি এই বিষয়টি নিয়ে কলম ধরেছেন কিন্তু এই স্বল্প পরিসরে সকলকে নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয় আমি কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরলাম মাত্র।
এবার আসি গদ্য সাহিত্যে যৌনতা প্রসঙ্গে। আর্নেস্ট ফিসার বলেছেন – “যৌনতা থেকেই মানব সভ্যতার ইতিহাস!”
একবার এক সাক্ষাৎকারে ঔপন্যাসিক শোভা দে বলেছিলেন- “আমার উপন্যাসে যৌনতার বিষয়টি অবধারিত ভাবে উপস্থিত! আমার লেখায় যৌনতা নিয়ে কেন খোলামেলাভাবে আলোচনা করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা আমি দেব না। কারণ, একজন পুরুষ লেখক যখন কাহিনীতে যৌনতাকে উপস্থাপন করেন, তখন তাঁকে জবাবদিহি করতে হয় না! গল্প, উপন্যাস লেখার সময় যৌন বিষয় ব্যবহার করা যাবে বা কতটা যাবে না এমন কোন সংবিধি আছে কি?”
এই প্রবন্ধে আমি পুরুষ লেখকদের নয় শুধু নারী লেখকদের কলমে যৌনতা বিষয়টি কীভাবে উঠে এসেছে তাই নিয়েই আলোচনা করব। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ বড় ব্যস্ত। এই ব্যস্ত জীবনে প্রেম করার মত বা নিজের সঙ্গির সঙ্গে সময় কাটানোর মত সময় নেই কারো হাতে। সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত তরুণ-তরুণীরা নিজের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নির্বাহ অথবা আগামীর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে ব্যস্ত। এখন তারা সমাজ মাধ্যমেই তাদের প্রেম পর্ব সারে। দেখা করে অফিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টের মত। একবিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় মহিলা লেখক সুচিত্রা ভট্টাচার্য (১৯৫০—২০১৫) তাঁর ‘রূপকথা নয়’ উপন্যাসে এই বিষয়টি খুব সুন্দর তুলে ধরেছেন। গল্পের নায়িকা চিকুর এক স্বাধীনচেতা মেয়ে। ভালোবাসার বিয়ে টেকেনি। অফিসের বস ব্যবসার কাজে চিকুরকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে দুবার না ভেবে চিকুর চাকরিতে রেজিগনেশন দেয়। সেই চিকুরই মাত্র একদিনের পরিচিত মল্লারকে নিয়ে দিঘা বেড়াতে চলে যায়। সেখানে মল্লার হাজির হলে নির্দ্ধিধায় সে একঝটকায় কাছে টেনে নেয় মল্লারকে – “মল্লারের মাথা চেপে ধরল চিকুর। ফিসফিস করে বলল, এবার সমুদ্র হও মল্লার। মল্লারের শরীর জুড়ে মাতনের দ্রিমিদ্রিমি। বালিমাখা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মায়াবিনীকে নিয়ে। চিকুরের আঁচড়ে মল্লার ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, মল্লারের দেহ আছড়ে আছড়ে পড়ছে চিকুরে। তীক্ষ্ণ এক কামধ্বনি বাজছিল চিকুরের কণ্ঠে। আদিম সৌরভে ভরে যাচ্ছিল ঝাউবন।”
সুচিত্রার উপন্যাসে প্রস্তুতিহীন এই বর্ণনা কিন্তু আরোপিত মনে হয় না কারণ চিকুর চরিত্রটিকে লেখক এমন ভাবেই সৃষ্টি করেছেন যাতে তার কাছ থেকে এমন ব্যবহারই স্বাভাবিক।
এই প্রসঙ্গে সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “প্যান্টি” উপন্যাসের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই উপন্যাসে ‘আমি’র রাত্রিবেলা হঠাৎ পিরিয়ড শুরু হওয়ায় বাধ্য হয়ে ওয়ার্ডরোবে রাখা এক মৃত মেয়ের প্যান্টি পরতে হয়। আর তারপর থেকে রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায়। বেডরুমে কেউ ছিল না। ঘরের দেওয়ালে থেকে শব্দ আসছিল। নানান আশ্লেষের ধ্বনি। চুম্বনের শব্দ, আদরের শব্দ, উন্মাদের মত মিলনের শব্দ, শীৎকারের শব্দ, হাঁপানোর শব্দ। বিরামহীনভাবে চলে এরকম। ঘন্টার পর ঘন্টা। বেডরুমের গাঢ় বাদামি রঙের বেমানান দেয়ালে “নগ্ন, সঙ্গমরত, প্রলাপরত, ক্রন্দনরত ওরা।”
যৌনতাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যের পালা বদলের ইতিহাসে এই উপন্যাসটি অলৌকিক যৌনবিভ্রমের আখ্যান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
সায়ন্তনী পুততুণ্ডর ‘নন্দিনী’ উপন্যাসে যৌনতাকে তুলে ধরা হয়েছে অন্য আঙ্গিকে। এখানে আলো চরিত্রটি পেশায় সাংবাদিক। অজয়ের সঙ্গে বহুদিনের সম্পর্ক তার। কিন্তু বিয়ের সময় দাবি করে জুয়েলারি, ফার্নিচার …। আলো তা দিতে রাজি না হওয়ায় প্রেম ভালোবাসা উবে যায়। অজয় মোবাইলে নির্লজ্জ থ্রেট করতে থাকে আলোকে। বাধ্য হয়ে আলো পুলিশের সাহায্য নেয় এবং অ্যারেস্ট হতে হয় অজয়কে।
কিন্তু বেল পেয়ে যায় অজয়। ছাড়া পেয়েই অজয় আলোকে আক্রমণ করে। গলায় ছুড়ি ধরে গণধর্ষণ করা হয় আলোকে। এই উপন্যাসে লেখক যৌনতার নগ্ন অহঙ্কার, অথবা বলা যেতে পারে অপদার্থ পুরুষের নপুংসকতাকেই তুলে ধরেছেন।
অহনা বিশ্বাসের ‘অসতী জীবন’ উপন্যাসে যৌনতা নারীর সৌন্দর্যের এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। যেখানে লেখকের কেন্দ্র চরিত্র অনু সুন্দরী নয়। উটকপালি, নরুনচোরা চোখ, চাপা ঠোঁট, ছাইয়ের মত পায়ের রঙ। যে বিছানায় স্বামীর কাছে প্রতিদিন ধর্ষিত হয়। সেই অনুই যখন একদিন বলাই সাধুর সঙ্গে জোর করে মিলিত হয় তখন সে বুঝতে পারে তার অনেক কিছু খারাপ হলেও শরীরটি সুগঠিত এবং সেই শরীরকে কাজে লাগিয়ে সে ধীরে ধীরে সব পায়। এমনকি চির আকাঙ্খিত প্রেমও একদিন তার জীবনে আসে।
তৃষ্ণা বসাক তাঁর ‘আদর’ গল্পে যৌনতাকে এনেছেন একটি বিশেষ মুহূর্তের অনুভূতি হিসাবে। যেখানে একটি নারী সমকামী না হয়েও কোনও বিশেষ মুহূর্তে অপর নারীর প্রতি আকর্ষিত হতে পারে।
উত্তম পুরুষে লেখা ‘আদর’ গল্পটিতে – কোচি থেকে চেন্নাই ত্রিবান্দ্রম এক্সপ্রেসে লেখিকা যাত্রা করছিলেন। ওই কামরায় তিনটি ছেলেমেয়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একটি মেয়েকে দেখে চমকে উঠেছিলেন লেখিকা। খুব চেনা মনে হয়েছিল। পরে মনে পড়েছিল মেয়েটিকে অনেকবার তিনি দেখেছেন, দক্ষিণ ভারতীয় নীল ছবিতে। লেখিকা দেখেন তাঁর স্বামী মেয়েটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, স্বামীর মধ্যে কাম ভাবের উদ্রেক হতে দেখে লেখিকা স্বামীকে তো নিবৃত্ত করেন, কিন্তু মেয়েটির আকর্ষণে নিজে কেমন যেন বিবশ হয়ে পড়েন। “হঠাৎ মেয়েটি উঠে দাঁড়াল, ওঠার ভঙ্গিতে ইচ্ছাকৃত নূব্জ্যতা ছিল। যাতে ওর স্তন, বইয়ের পাতায় রাখা আমার হাত ছুঁয়ে যায়। কী ছিল সে স্পর্শে, আমার শরীর কেঁপে উঠল। আমি আমার দু পায়ের ফাঁকে সেই উল্লাস টের পেলাম, যা সুজন রাতের পর রাত অগণন নীল ছবি দেখিয়েও আনতে পারেনি।”
মেয়েদের কলমে যৌনতা বিষয়ে লিখতে গিয়ে যাঁর কথা সবার আগে মনে পড়েছিল তিনি হলেন তিলোত্তমা মজুমদার। এ ক্ষেত্রে তাঁর দুটি উপন্যাসের কথা উল্লেখ করব। যেই উপন্যাস দুটিতে উনি যৌনতাকে ব্যাভিচার হিসেবে তুলে ধরেছেন। ‘প্রহান’ উপন্যাসে, বাবা – মেয়ের সম্পর্ক। যেখানে শেষ পর্যন্ত বাবা বাধ্য হন তার মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যাভিচারি মেয়েকে হত্যা করতে।
‘রাজপাট’ উপন্যাসে নিঃসন্তান অধ্যাপক পত্নী যাকে হারাধন ‘মা’ বলে ডাকে অর্থাৎ মাতা- পুত্রের সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন। হারাধন তার যৌনক্ষুধা নিবারণের জন্য একটি নারী শরীর চেয়েছিল। সেই কামনা চরিতার্থ করার জন্য বিয়েও করেছিল। কিন্তু বিয়ের পরও সে নিয়মিত চলে আসত তার মুখ বলা ‘মা’ এর কাছে। এসে আক্ষেপ করে বলত, বিয়ের পর তার সব আনন্দ শেষ হয়ে গেছে। “মা মৌসুমি বুকে চেপে ধরেন তার মুখ তখন। সে ওই পরিচিত গন্ধে বুকে নাক ঘষে ঘষে বৃন্তে ঠোঁট চেপে ধরে ব্লাউজের উপর দিয়েই প্রথমে। বস্তুটি চিনতে বুঝতে খুঁজে নিতে অসুবিধা হয় না তার, কারণ সে ছোঁয়া মাত্রই বৃন্তগুলো ব্লাউজের ওপর দিয়ে ফুটে ওঠে, যেন ছিঁড়ে বেরোতে চায় বস্ত্র -আবরণ।”
স্বাভাবিকভাবেই হারাধনের মুখ বলা মা আর স্ত্রী একে অপরকে সহ্য করতে পারে না। ঘটনাচক্রে মা চড় কষায় হারাধনের স্ত্রীকে। স্ত্রীও চড় কষায় স্বামীর পাতানো মাকে। ফলে পুত্রের পেটে মাথা রেখে ভেঙে পড়েন মা। এখানে তিলোত্তমা লিখেছেন, “সেই ভেঙে পড়া মুখ মাথা পেট থেকে ক্রমশ নেমে এসে থামল উপস্থ বিন্দুভাগে। কান্নার আবেগে, অপমানে যন্ত্রণায় মৌসুমির তা খেয়ালই রইল না। খেয়ালই রইল না স্ফীত হয়ে উঠছে জাদুদন্ড। সেখানে প্রবল স্ফীতির যন্ত্রণা বোধ করছিল হারাধন। সে মৌসুমির দুই বাহুমূলে হাত দিয়ে বলল – চল মা। শোবে চল…
তার হাত, কাঁপা হাত, মৌসুমির কপাল, বুক, পেট, নাভি হয়ে নেমে আসে পায়ের পাতা পর্যন্ত। উঠে যায়। নেমে আসে। উঠে যায়। মৌসুমি এক ঝটকায় পাশ ফেরেন। শাড়ির প্রান্ত উঠে আসে আরও। আবার চিত সাঁতারের মত ভেসে ওঠেন তিনি। বড় খোলামেলা এ শরীর এখন! বড় মোহ! বড় মাদকতা! হারাধন অশান্ত হয়ে ওঠে! অস্থির! একটানে ছিঁড়ে দেয় বুক-ঢাকা জামাটির হুক। বন্ধনী না থাকায় নির্বাধ হয়ে যায় স্তন। নির্বাধ হয়ে যায় সকল মুহূর্ত। সকল আবেশ। ঊরুসন্ধিতে হাত রাখে সে। টের পায় উষ্ণতা। টের পায় ইচ্ছুক থরোথরো পেশীগুলি। এই প্রথম। এই স্পর্শ। কী নরম! কী উন্মাদ! কী অপার! তখন ঝাঁপিয়ে পড়েন মৌসুমি তার উপর। বিকারগ্রস্তের মতো বলেন — তুই আমার। তুই আমার! হারাধন তোকে আমি আর কার হাতে কেন দিলাম! কী করলাম আমি! কী করলাম! অনাবৃত হয় পুরুষের বুক কাঁধ পিঠ। অনাবৃত হয় মাংসল পেট। উন্মুখ লিঙ্গ ছেড়ে নেমে আসে পোশাক। মধ্য চল্লিশ নারীর তাপে ঝাঁপ দেয়। মুঠিতে তুলে নেয় রতি সুখ। মৌসুমি আর্তনাদ করেন – নে নে নে।
পিচ্ছিলতায় মাখামাখি হয়ে যায় অপমান। গ্লানি। মিথ্যাচার। সততা দাম্পত্য। প্রেম। তখন পাড়ের মাটি ভেঙে পড়ে ঝুরঝুর করে। অন্তঃস্থ মাটি সব গলে গলে যায়। ভূ ত্বকে জেগে ওঠে ফাটলে ফাটল। ভূমির চেয়েও যা ভারী, তার চাপে ধরণীর নাভিশ্বাস ওঠে। মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে মরে নদী। মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে উন্মাদিনী নাশের তরে প্রবাহিতা হয়। মাতৃডাক—পৃথিবীর পবিত্রতম আহ্বানের মা – মা – মা ধ্বনি ঝাঁপ দেয় গঙ্গাগর্ভে। ভেসে যায়, ভেসে যায়”
যদিও লেখিকা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পুরাণের আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি পাঠককে আদিম যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, মা- ছেলের যৌন সম্পর্ক যে একসময় অবাধ ছিল তা স্মরণ করিয়ে দেন। তবুও এমন উপন্যাস লেখার জন্য তিলোত্তমাকে বহুবার বহু সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।
হয়ত একজন মহিলা লেখকের কলম থেকে যৌনতা বিষয়ক লেখা একবিংশ শতাব্দীর পাঠক এখনও মেনে নিতে পারে না। আজও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর হাতে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়। পুরুষতন্ত্র মানে পুরুষের আধিপত্য। নারীর অধীনতা। এই বিভাজন সমাজের সর্বস্তরে। সাহিত্য তার বাইরে নয়। এই শৃঙ্খল ভেঙে কিছু মহিলা লেখকের কলমে বেরিয়ে আসছে শব্দের স্ফুলিঙ্গ। ভবিষ্যতে আরও অনেক মহিলা লেখকের কলমে রাখঢাক না করেই যৌনতা থেকে জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতার সত্যতা উঠে আসবে এই আশা রাখি। ১৮৩৯ সালে ইংরেজ লেখক এডওয়ার্ড বুলওয়ার-লিটন লিখেছিলেন, “দ্যা পেন ইজ মাইটার দেন দ্যা সোর্ড”- কলম তরবারির চেয়েও শক্তিশালী। কিন্তু কোথাও এমন কথা লেখা নেই যে, সেই তরবারি শুধু মাত্র পুরুষ লেখকের হাতেই ঝলসে উঠবে।