(১)
সরকারবাড়ির ছাদে রোজ দুপুরে শীতের উত্তুরে হাওয়া বয়ে যায় আধভিজে রংচটা কমলা পুরীর গামছাটার গায়ে হাত বুলিয়ে, কখনও বা তেল হলুদের ছোপ লাগা মেটে রঙের সুতির ছাপাটার আঁচল খানিক ছুঁয়ে যায়। কালো সায়ার নীচে লুকিয়ে শুকোতে দেওয়া সাদা অন্তর্বাসকে কখনও বেআব্রু করে দেয় জোরে ছুটে গিয়ে, কখনও বা দুটো প্লাস্টিকের ক্লিপের ভরসায় ঝুলতে থাকা ছেঁড়া ফুটোওয়ালা আণ্ডারপ্যান্টকে সেলাম ঠুকে পালায়। নীল জিন্সের পকেটে ঘাপটি মেরে থাকা সিগারেটের গন্ধকে উড়িয়ে দেয় কখনও, কখনও আবার গোলাপী চুড়িদারের ওড়নাটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে পাশের মিত্তিরবাড়ির ছাদের সবজে স্প্যাগেটি টপ-টার পাশে। তবে দামাল উত্তুরে বাতাস ভারি জব্দ হয় যখন পথ হারায় একগাদা কাঁথাকানির মাঝে জনসন পাউডারের গন্ধমাখা অলিগলিতে।
ঠিক এমন সময়ই সরকারবাড়ির একতলার পুবকোণের বুড়ো সরকারকত্তার ঘরের গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকটা পুরুষসিংহের মত গর্জে ওঠে ‘ঢং ঢং ঢং’। চাঁপার মা এক বগলে দুটো নাইলনের মাদুর আর অন্যবগলে চাড্ডি কাঁথা বালিশ নিয়ে থুম্বোর মত টলটল করতে করতে চার বারং আটচল্লিশ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসে দোতলার ছাদে। ঠিক মেপে মেপে দক্ষিণ পশ্চিম কোণটা করে মাদুর বিছোয়, নইলে আবার ঘন্টা পোয়াতে না পোয়াতেই মিত্তিরদের চিলেকোঠার ঘরটা সব রোদ্দুরটুকুন চুরি করে নেবে সরকারদের ছাদ থেকে। সরকারবাড়ির বড়গিন্নীমা কোঁথ পেড়ে পেড়ে কোনওমতে হাঁটু মাজা বাঁকিয়ে এক কিম্ভুতচালে উঠে এলেন ছাদে। ওঁকে দেখে চাঁপার মায়ের মনে পড়ল পানের বাটা আনতে ভুলেছে। ফের চার বারং আটচল্লিশ সিঁড়ির ধাক্কা।
বড়গিন্নীমা চাঁপার মা-কে সিঁড়ির দিকে যেতে দেখে বলে ওঠেন,
-“সদর ঘরের খিলটা খুলে একটু বসিস খানিক। সব এলে ‘পরে তবে বন্ধ করে উঠবি।”
চাঁপার মা ঘাড় হেলিয়ে নীচে চলে যায়। বড়গিন্নী কোনওমতে ঝুঁকে, রোদ খেয়ে পেটমোটা বালিশে হেলান দিয়ে, অপেক্ষায় বসেন। বাঁশকাঠি চালের ভাত, সোনামুগের ডাল, আলু পোস্ত, কাঁটা চচ্চড়ি, খেয়ে শীতের দুপুরে মেয়েমহলের আড্ডা বসে সরকারবাড়ির ছাদে। সরকারদের বড়গিন্নী বিনতা, মেজগিন্নী রমলা, ছোটোগিন্নী সৌরজা, তারপর বাঁয়ে মিত্তিরবাড়ি টপকে ওপাশের বোসেদের বড়বউ পদ্মা, চারফুটের কমন প্যাসেজের ওপারের লাহাদের আইবুড়ো বয়স্থা মেয়ে সরলা। সরকারবাড়ির ডাইনে মুখার্জ্জীদের বুড়িকাকীও আসে মাঝেমধ্যে বাড়ির বউদের নিন্দেমন্দ করতে। বিকেলে সাড়ে পাঁচটার ‘মনের মানুষ’ শুরু হওয়ার আগেই যে যার বাড়ি ফিরে রিমোট হাতে ঠাণ্ডা গ্যাসে ফের আগুন জ্বালায়, চা পাতা দিয়ে সসপ্যানে জল ফোটায়।
(২)
ছাদের পূবমুখো দরজাটা থেকে হাঁক পাড়ে সরলা,
“বড়গিন্নী বাতের ব্যথাটা বুঝি বেড়েছে? কাল অমাবস্যে ছিল, ক্যালেন্ডারে দেখনি বুঝি?”
বিনতা পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের রোদে পিঠে কোমরছাপানো কাঁচাপাকা চুলের গোছা মেলে বসেছিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
“আয় আয় সরলা, আয় বোস। বাংলা ক্যালেন্ডার কোথায় আর পাই বল দিকিনি। এ বছর পয়লা বোশেখে ক’টা এনেছিল মেজ ঠাকুরপো, আমাদের হীরেন। নাতনীটা এত দুরন্ত সবক’টাকে ছিঁড়েছে। ওইটুকুন একরত্তি মেয়ে তার কী তেজ! হাতে পায়ে কথা কয় যেন! সব মা বাপের আদিখ্যেতা। নাতি হ’লে তাও নয় বুঝতুম। কত করে বললুম খোকাকে আরেকটা নে। চাকরিওয়ালা বৌমা বললে একটিই যথেষ্ট।
বুড়ো বয়সে কে দেখবে শুনি? মরবি যখন তখন মুখে আগুনটা কে দেবে? যাকগে মরুকগে। আমার আর কী!”
সরলা বিনতার পাশটিতে এসে বসে, হাতের মুঠোয় করে ভাজা মৌরি এগিয়ে ধরে বলে,
“আমার কাছে রয়েছে খানকয়। কাল এনে দোবখন..”
“আনতে হবে না রে সরলা। একটা বাঁচিয়ে রেখেছি। ঐ নগেন মুদীর দোকানেরটা, কী সুন্দর মা দুগ্গার দশ অবতারের ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডারটা। ওইটে আমি বাঁধিয়ে রাখব ঠাকুরঘরে।”
“তা তোমার বুড়ি শাউড়ি তোমায় ঠাকুরঘরের দখল ছাড়লে তো পট সাজাবেগো বিনতাদিদি।”
“সে আর বলতে পদ্মদি। আমি তো বড়দিভাইকে কতবার বলেছি। ও বুড়ি শকুনের মত সব আগলে পড়ে থাকবে। আমরা পটল তুলব তবু উনি এতটুকুও টসকাবেন না।”
কথা বলতে বলতে মাদুরে এসে বসে বোসেদের বড়বউ পদ্মা আর বিনতার মেজ জা রমলা। রমলা নিজের কথার জের টেনে বলতে থাকে,
“জানো পদ্মদি সেই যে কত যুগ আগে ওপার বাংলা থেকে বুড়ি তিন ছেলে নিয়ে বরের হাত ধরে পালিয়ে এসেছিল পুঁটুলি বগলে নিয়ে, সেই পুঁটুলি আগলে রাখা স্বভাব এই ঘাটে ওঠার বয়েসেও গেল না।”
“পেটেও তো একটা পুঁটুলি ছিল, বল মেজ। পরেশ ঠাকুরপো। তাকে যে বুড়ো কত্তা কেন বিদেয় করলেন!”
বলে ওঠে বিনতাও।
“করো কী বড়দি! ওর নাম নেওয়াও যে বারণ এ বাড়িতে।”
হাঁ হাঁ করে ওঠে রমলা।
“কার নাম নেওয়া বারণ লো?
মুখার্জ্জীদের বুড়ি পিসি সূতির চাদরটা গায়ে বেশটি করে জড়িয়ে নিয়ে উঠে আসে ছাদে।
“পরেশের কতা হচ্চে বুজি? অমন সোনার টুকরো ছেলেটাকে সরকার কত্তা যে কেন ত্যাজ্য করলে! ওই পাপেই ম’ল বুড়ো।”
দীর্ঘশ্বাস পড়ে মুকুজ্জে বুড়ির।
(৩)
কথা গড়ায় জলের মত, কথা ওড়ে বাতাসের দোলায়, কথা উবেও যায় মরা রোদের তাতে। সরকারবাড়ির ছাদে হাসি, দীর্ঘশ্বাস, ঠাট্টা, ঠেস, আদিরস, ঈর্ষা সব মিশিয়ে একটা পাঁচফোড়ন তেলে খরানোর আচার আচার গন্ধ ওঠে।
“ও মেজদি! টুসু এমন বেটাইমে কলেজ থেকে কেমন মুখ ভার করে ফিরল গো। জিগ্গেস করলাম কিছু খাবি কী না… কোনও উত্তর না দিয়ে, চান করতে ঢুকল কেন কী জানি এই শীতের দুপুরে। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে বসে রইল। একবার দেখো না গিয়ে।”
সৌরজা ততক্ষণে ওপরে উঠে এসেছে, একটু চিন্তান্বিত মুখে জানায় রমলাকে।
“ও মেজ, যা না একবার। যা দেখ দিকিনি কী হ’ল আবার মেয়েটার। সোমত্থ মেয়ে সব কী যে ঘটে বাইরে বেরোলে ‘পরে সবসময় যেন আতঙ্ক, বাড়ির লোকের মনে।”
বিনতা একটু ব্যগ্র হয়ে নড়েচড়ে ওঠেন।
বিরক্ত মুখে নীচে নেমে আসেন রমলা। এই এক জ্বালা হয়েছে মেয়েটাকে নিয়ে। কেমন ধরনের হয়েছে যেন মেয়েটা, বড্ড চাপা স্বভাবের। গায়ের রংটা কালো বলে ছোটো থেকে সবার মুখে ‘এ মেয়ের কী করে বিয়ে হবে!’ শুনে শুনে মেয়েটা যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রমলা আর হীরেন মনেপ্রাণে চায় মেয়েটা পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াক। বড় ভাসুর রূপেন আর জা বিনতার একটাই ছেলে রীতেন্দু, পড়াশোনায় ভালো না হ’লেও ভালোই একটা সরকারী চাকরি জুটিয়েছে। ওর বউ নীলিমাও প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। টুসুটা যদি জাঠতুতো বৌদির মত একটা চাকরি জোটাতে পারে তাহলেই চিন্তা ঘোচে। নীলিমার গায়ের রং ও টুসুরই মতন, চোখ নাকও টুসুর মত অত সুন্দর কাটাকাটা নয়, তবু তো চাকরির জোরে দিব্যি বরের ঘর করছে মাথা তুলে। নাহ্ টুসুর বাবাকে বলতেই হবে যা টাকা লাগে লাগুক ওকে এ বছর বি. এ. ফাইনাল পরীক্ষাটা হয়ে গেলে ওই রাইস না মাইস কীসব আছে, তাইতে ভর্তি করে দেবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মেয়ের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে একটা গলা কানে আসে,
“কী হয়েসে রে টুসু তর? এমন মুখখান শুকনা ক্যান করছস? কলেজে কুনো পোলাডায় কিসু কইসে তর লগ্যে? ক’ আমারে ক’ টুসু। অ টুসু!”
অনেকদিন পর শাশুড়িকে এরকম করে কথা বলতে শুনল রমলা। বুড়ো শ্বশুরমশাই গেল বছর গত হওয়ার পর থেকে বুড়ি যেন কেমন চুপ মেরে গেছিল। সারা দিনমান ওই কোণের বুড়ো কত্তার ঘরটায় পড়ে থাকত। মাঝে মাঝে পরেশের বন্ধ ঘরটা খুলে ঝাড়পোঁছ করত। কেন যে শ্বশুর অমন ছেলেটাকে তাড়াল কে জানে! তারপর থেকেই শাশুড়ির মাথাটা যেন কেমন হয়ে গেছিল। বুড়ো কত্তা মরতে একেবারে ষোলো আনা পূর্ণ হয়েছে মাথা খারাপের। সারাদিন শুধু সংসারের চাবি আর ঠাকুরঘর আগলে পড়ে থাকে বুড়ি। থাক নাতনীর সাথে বকবক করুক একটু। দু’জনেরই যদি মাথা ঠিক হয় তাতে!
(৪)
মেয়ের ঘরে আর ঢুকলনা রমলা, ছাদের দিকেও গেল না। গেলেই তো এখন কৈফিয়ৎ দিতে বসতে হবে। নিজের ঘরের দিকে চলে গেল রমলা, অনেকদিন ধরে একটা সোয়েটার আধবোনা পড়ে আছে। বাবুসোনা মানে সৌরজার ছেলের স্কুলের ড্রেসের রঙের সাথে ম্যাচিং একটা সবুজ রঙের ফুলহাতা সোয়েটার বুনতে শুরু করেছে। নতুন স্কুলে ভর্তি হবে এবার উঁচু ক্লাসে, আগের স্কুলে নীল ড্রেস ছিল। সেবারেও একটা নীল সোয়েটার বুনে দিয়েছিল রমলা। রীতেন্দু আর নীলিমার মেয়েটার জন্যও উলের একটা ফ্রক বুনতে শুরু করেছে, ওটাও শেষ করতে হবে।
এককালে কত সেলাই ফোঁড়াই করত রমলা, টাইপিং শর্টহ্যান্ড সব শিখেছিল। শর্টহ্যান্ডে একশ ষাট আর টাইপিং-এ পঁচাত্তর স্পিড ছিল। একটা মার্চেন্ট অফিসে পি. এ.-র চাকরিও পেয়েছিল গ্র্যাজুয়েশনের পর। বাবা করতে দিল না, তারপর তো এই সরকারবাড়ির মেজবউ হয়ে জীবনের এতগুলো বছর আরও কেটে গিয়ে এখন ও প্রৌঢ়া। টাইপ শর্টহ্যান্ড সব প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিক্ষা হয়ে গেছে, এখন কম্পিউটারের যুগ। টুসু কয়েকবার কম্পিউটার মোবাইলে ফেসবুক হোয়াটসাপ না কীসব যেন শেখানোর চেষ্টা করেছিল। এখন হাল ছেড়ে দিয়ে বলে,
-“মা তুমি রিমোটই চালাও বরং। মন দিয়ে ‘মনের মানুষ’ দেখো ‘গে।”
আচমকা একটা গাড়ির হর্নে চমক ভাঙে রমলার। মিত্তিরদের বাড়ির বড়বউটা বেরলো মনে হয়, হ্যাঁ সাড়ে তিনটে বাজে তো ঘড়িটায়। কোন চুলোয় ঢলাতে যায় কে’জানে সমাজসেবার নামে। বড্ড অহংকার মিত্তিরবাড়ির লোকগুলোর। বড়ছেলে সীতাংশু বিশাল মাল্টিন্যাশনালের ডিরেক্টর নাকি। তার বউ ঊর্মি কোন মর্নিং কলেজে পড়ায় আর সমাজসেবা করে বেড়ায়। একটাও ছেলেপিলে হ’ল না আজ প্রায় এতগুলো বছর হ’ল বিয়ে হয়ে এসেছে। ছোটোছেলে প্রিয়াংশু বিদেশে থাকে, কেজানে সে চুলোয় মেম বিয়ে করে বসে আছে নাকি। এ বছর দুর্গাপুজোয় এল তো একটা সাদা চামড়ার উছেলে, একটা গুজরাটি আর একটা মারাঠি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। ছোটো বোন কৌশানী টুসুরই বয়সী, তবে টুসুর কলেজে পড়েনা, যাদবপুরে পড়ে। টুসুর সাথে ছোটোবেলায় খেলত, বড় হয়ে দেমাক বেড়েছে, মেশে না আর। ছাদে নিশ্চয়ই এবার সব আলোচনার মোড় ঊর্মির দিকে ঘুরে গেছে। প্রতিদিনই সাড়ে তিনটের সময় কিছুটা চর্চা বরাদ্দ থাকে ওকে নিয়ে। রমলা মনে মনে ঈর্ষা বোধ করে, তাই আরও বেশি করে চর্চা করে। লুকোনো কাঁটাটা ঠিক আসল জায়গায় খোঁচা মেরে মনে করায় প্রয়োজনটা। একটা ছোটোখাটো চাকরি, একটু স্বাধীনতা… শুধু সরকারবাড়ির মেজবউ হয়ে জীবনটা কেটে গেল।
(৫)
রোজ এই এক কাণ্ড, গলির মুখটা এত সরু যে গাড়ি বার করতে গিয়ে কিছু না কিছু ঝামেলা বাঁধবেই। ঊর্মি হাতের আই-ফোনটা থেকে চোখ সরিয়ে গলাটা একটু তুলে বলে,
“আলম হর্ন দাও না গোটা কয়। জানলা খুলোনা, বিশ্রী গন্ধ আসবে এক্ষুনি।”
“বৌদিমণি কী করি বলুন তো। এই ব্যাটা ময়লা ফেলার লোকগুলো ঘন্টা বাজিয়ে ঠিক এই তিনটে চারটের সময়ই আসবে শালারা… অ্যাল্!”
মুখ ফসকে গালি বেরিয়ে যেতে কালী ঠাকুরের মত একহাত লম্বা জিভ কাটে আলম।
ঊর্মি বিরক্ত মুখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। ঐ সরকারবাড়ির কাজের মেয়েটা ময়লাভর্তি প্যাকেট দু’হাতে নিয়ে ফেলতে এসেছে ময়লা-তোলা হাতগাড়িটাতে। ভ্রু কুঁচকে একবার বাড়িটার ছাদের দিকে চোখ তুলে চায় ঊর্মি, নির্ঘাৎ রোজ দুপুরের মত ছাদে মজলিশ বসেছে। অবাক লাগে এদের দেখলে ঊর্মির, সারাদিন শুধু রান্নাবান্না, বর বাচ্ছার টিফিন, সিরিয়াল আর পরনিন্দা পরচর্চা ছাড়া জীবনে আর কিছু নেই! ঊর্মি নিজে সকালের কলেজ সামলে সংসার সামলে ফের আবার এন. জি. ও.-র কাজে চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। এই স্বভাবের জন্যই মেয়েরা পুরুষদের সমকক্ষ হয়েও সেই সম্মানটুকু পায়না।
একটা দীর্ঘশ্বাস নিজের অজান্তেই বেরিয়ে পড়ে ঊর্মির বুকের ভেতর থেকে। সম্মান কি তাকেও করে সীতাংশু? হ্যাঁ করত একটা সময়। ঊর্মির মেধা, স্বাবলম্বী মনোভাব, সামাজিক দ্বায়িত্ববোধ, এই সমস্তকে। কিন্তু একটার পর একটা বছর পেরতে থাকে, ঊর্মির কোল ফাঁকাই থেকে যায়। অনেক ডাক্তার কনসাল্ট করেও লাভ হয়নি, দু’জনেই সক্ষম, কোনও শারীরিক ত্রুটি নেই, তাও…
শুধু এই একটা জায়গায় ঊর্মি কি হেরে গেল তবে? সরকার বাড়ির পরনিন্দা পরচর্চা করতে থাকা বউগুলোর কাছে? ময়লা ফেলতে আসা ওই কাজের মেয়েটা, কী যেন নাম, হ্যাঁ! চাঁপার মা… ওর কাছেও? এই যে একটু পরেই অনাথ আশ্রমে গিয়ে বাচ্চাগুলোর মুখে ‘মা’ ডাক শুনবে, দুটো লজেন্স আর গরম জামার বিনিময়ে, সেটা কী শুধুই লোকদেখানো? সোসাইটিতে নিজেকে মহৎপ্রাণা প্রমাণ করার জন্য? সীতাংশু, ওর বাড়ির লোক, পাড়ার লোক, সবাই-ই হয়ত তাই-ই ভাবে। আইফোনের স্ক্রিনটা একটু ঝাপসা লাগে। ধূসর তসরের মেরুন পাড়ওয়ালা আঁচলটায় ফোনটা উল্টে ঘষে নেয়। নোনা জলের দাগটা মুছে যায় কিন্তু যেখান থেকে মুক্তোকণাটার জন্ম হয়েছিল সেই উৎসস্থলের ক্ষত কি একটুও জুড়োয়?
হুঁশ ফেরে আলমের কণ্ঠস্বরে।
“বৌদিমণি আজ দেরী হয়ে গেল একটু। বাচ্চাগুলো বসে থাকবে আপনার অপেক্ষায়। জানেন বৌদিমণি আমি আপনার কথা আমার জুবিনাকে বলি। কত বড় মন আপনার। বড়লোক তো অনেকে হয় বৌদিমণি, কিন্তু সবাই আপনার মত হয়না।”
(৬)
“হ্যাঁরে ছোটো, একবার দেখনা গিয়ে টুসুটার কী হ’ল।”
একটু উদ্বিগ্নস্বরে ফের বলেন বিনতা।
“কী আবার হবে বড়দি। এই বয়সের মেয়ে, দেখ ‘গে কলেজে প্রেম-টেম কিছু করছে। বয়ফ্রেণ্ডের সাথে মন কষাকষি হয়েছে হয়ত। বারবার ওঠানামা করতে পারিনে বাপু। চারটের সময় বাবুসোনার ভ্যানগাড়ি আসবে, একেবারে নামব’খন তখন।”
সৌরজা জামাকাপড় ক’টা ভাঁজ করতে করতে বলে। সৌরজা ধীরেনের খানিক বেশি বয়সে বিয়ে করা কচি বৌ, তায় ছেলের মা। একটু তাই বেশিই খাতির আর মেজাজ ওর।
মুকুজ্জে বুড়ি ঝিমোচ্ছিল এতক্ষণ। প্রেমটেম শুনে নড়ে চড়ে বসলো।
“হ্যাঁরে সল্লা, এত বয়েস হ’ল একটা পুরুষমানুষ জোটাতে পারলিনি? শরীলের তাপ যে জুড়িয়ে জল হয়ে গ্যালো সব। আর কেউ ফিরেও চাইবেনি অমন সব ঝুলে যাওয়া জিনিসপত্তরের দিকে।”
সরলা খেঁকিয়ে ওঠে,
“দূর! চুপ মারো মুকুজ্জে বুড়ি। খালি অশৈলী কথা সবসময়। যত বয়েস বাড়ছে তুমি তত ছুঁড়ি হচ্ছ নাকি।”
সৌরজাও বলে,
“মুকুজ্জেবুড়ি সরলা ঠাকুরঝি বিয়ে করেনি বেঁচে গেছে। এই বর বাচ্চা নিয়ে যা ভোগান্তি, তোমার মত বয়স হওয়ার অনেক আগেই আমাদের সব ঝুলে যাবে। এই দ্যাখোনা বাবুসোনাকে বড় স্কুলে দেব ঠিক করেছি, ইন্টারভিউ দিতে হবে ছেলে মা বাবা তিনজনকেই। ছেলে যা না পড়ছে তার থেকে বেশি আমরা পড়ছি, না জানি কীসব প্রশ্ন করবে। আর শুধু কী তাই, ওর বাবা তো সব এফ. ডি. ভেঙে টাকার বন্দোবস্ত করছে। যা টানাটানি, যা জিনিসের দাম, আজকালকার দিনে কী আর একার রোজগারে সংসার চালানো যায়!”
বলতে বলতে আড়চোখে চেয়ে নেয় একবার বড় জা বিনতার দিকে। সদ্য সদ্য বাড়ি মেরামতির জন্য বড় ভাসুর রূপেন, মেজভাই হীরেন আর ছোটোভাই ধীরেনের থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে চেয়েছেন কী না। বড় জা এর মুখটা একটু থতমতমার্কা দেখে উৎসাহে ফের বলতে শুরু করে সৌরজা,
“বুঝলে সরলা ঠাকুরঝি, মাঝে মাঝে আমাদের নীলিমাকে দেখি আর ভাবি তাই। রীতেন্দুর সাথে সাথে কেমন রোজগার করছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেখো। টাকার অভাব জীবনেও হবেনা!”
এবারে মৌনব্রত ভেঙে বলে ওঠে বিনতা,
“হ্যাঁ টাকাটাই দেখলি ছোটো। অতটুকু নাতনীটাকে যে এর ওর তার দোরে ফেলে রেখে ড্যাং ড্যাং করে চাকরি করতে যায় সেটা দেখলি না? এভাবে বাচ্চা মানুষ হয়? আমরাও যদি ওভাবে বাচ্চা মানুষ করতুম তবে রীতেন্দুকে টুসুকে আর মানুষ হতে হ’ত না।”
সৌরজাও হাজিরজবাবি, বলে ওঠে,
“এর তার দোর কেন হবে বড়দি। নীলিমা তো স্কুল যাওয়ার পথে বাপের বাড়িতে ওর মায়ের কাছেই মেয়েকে রেখে যায়। তাও তো তুমি বললে গাঁটে ব্যথা নিয়ে বাচ্চা সামলাতে পারবে না, তখনই তো এই ব্যবস্থা করল ওরা।”
বড়গিন্নীর চোয়ালটা একটু শক্ত হয়, নাকের পাটাটা একটু ফোলে,
“তা আর কী করব বল ছোটো, এই সরকারবাড়িতে বিয়ে হয়ে এসে ইস্তক তো আর আরাম করিনি। তোদের তো সেদিন বিয়ে হ’ল। ভরাভর্তি গুছোনো সংসারে এসে বসেছিস সব। তোলা উনুনে গুষ্টির রান্না, শ্বশুরের মেজাজ, শাশুড়ির শুচিবাই আর পুজোবাতিক, হীরেন ধীরেনের খেয়াল রাখা…”
পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে আড্ডা প্রায় ভাঙতে যায় দেখে বোসবাড়ির পদ্মাবৌদি বলে ওঠে,
“যাকগে বাদ দাও দিকিনি ওসব… অ্যাই সরলা, তোদের বাড়িতে ইনভার্টার আছে না? কালকের ‘মনের মানুষ’-এ কী হ’ল বল দেখি। আমাদের তো কারেন্ট চলে গেল, দেখতেই পেলাম না। আজও রিপিটটা দেখতে ভুলেছি। ঐ বদমাইশ ললিতাটা রাহুলের কাছে নিশ্চয়ই আলোর নামে বানিয়ে বানিয়ে সব বলল?”
সরলাও প্রবল উৎসাহে শুরু করে,
“আর বোলোনা পদ্মবৌদি! কী শয়তানিটাই না করছে ললিতা। বিয়ে হওয়া ছেলেটার পেছনে এরকম নির্লজ্জর মত পড়ে আছে, বলিহারী বাবা! আর বেচারী আলোর মুখের দিকে তো তাকানোই যায়না গো। আহা গো কী কষ্টটাই না পাচ্ছে অমন ভালো মেয়েটা…”
সরকারবাড়ির ছাদের আড্ডায়, মেগাসিরিয়ালের কুশীলবরা রূপোলী পর্দা থেকে বেরিয়ে, একে একে এসে যোগ দেয়। বাবু হয় বসে তাদের গল্পের ঝাঁপি খোলে।