জনক
সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়

রবিবার মানে আনন্দের দিন, খুশির দিন। আমার ক্ষেত্রে ঠিক বিপরীত। রবিবার যত এগিয়ে আসে বিষণ্ণতা, অসন্তুষ্টি গ্রাস করে আমাকে। কারণ রবিবার বিদিশা, মানে আমার বউ তার ছেলেকে নিয়ে আসে এ বাড়িতে। বিদিশার ছেলের বায়োলজিক্যাল বাবা আমি। ব্যস ওইটুকুই, এ ছাড়া বিল্টুকে আমার নিজের মনে হয় না। বিল্টু অটিস্টিক বাচ্চা। প্রথম দিকে ব্যাপারটা আমরা কেউই টের পাইনি। আমি, বাবা, মা, বিদিশা, কেউ না। ধুমধাম করে বিল্টুর অন্নপ্রাশন হয়েছে ছ’মাসে। টাকা, কলম, সোনার আংটি, বই, আঁকার তুলি থালায় করে ওর সামনে দেওয়া হয়েছিল। বিল্টু তুলেছিল কলম। সবাই হইহই করে উঠল, ছেলে লেখক হবে। আমি এসব বিশ্বাস করি না। তবু কথাটা শুনে মনের মধ্যে একটু বুঝি খুশি খুশি ভাব এসেছিল। তখন বিল্টু দিব্যি বসতে টসতে পারে। হামাগুড়ি দেয়। ফুটফুটে বাচ্চা। আমার গম্ভীর বাবা নাতি আসার পর কেমন যেন বদলে গিয়েছিল। কোলছাড়া করত না নাতিকে। ছেলে মানুষের মতো খেলত নাতির সঙ্গে। বিল্টু সময়ের আগেই হাঁটা শিখে গেল। কিন্তু কথা ফুটছিল না মুখে। মা বলল, ওটা কোনও ব্যাপার না। কিছু বাচ্চার কথা বলতে একটু দেরি হয়। আর সেই সব বাচ্চারা বড় হয়ে প্রচুর কথা বলে।…দু’বছর নাগাদ বিল্টুর মুখ থেকে একটাই শব্দ বের হল ‘গাড়ি’। খেলনা গাড়ি খুব পছন্দ বিল্টুর। সারাক্ষণ গাড়ি নিয়ে খেলে যাচ্ছে। সার করে দাঁড় করাচ্ছে গাড়িগুলো। কেউ বাধা দিলে ক্ষেপে যায়। আর আঁকতে খুব ভালবাসে বিল্টু। আঁকার খাতায় প্যাস্টেল কালার বুলিয়ে এক মনে এঁকে যায়। তবে কী আঁকছে, কোনও ঠিক নেই। মেঘ দেখে যেমন মানুষ কোনও ফিগারের কল্পনা করে, সেরকম ভাবেই বিল্টুর আঁকা বুঝে নিতে হয়। ছোট থেকেই বিল্টু জল ঘাঁটে খুব। মানা করলে শোনে না। ঘুরেও তাকায় না। তখন আমার সন্দেহ হয় ও বোধহয় কানে কম শুনছে। বাড়ির বাকিদের বললাম আমার অনুমানের কথা। সকলে সম্মত হল। আমি, বিদিশা একজন ই.এন.টি-র কাছে নিয়ে গেলাম বিল্টুকে। তিনি সব দেখে শুনে বললেন, কানে তো কোনও সমস্যা দেখছি না। হয়তো ওর কোনও বিহেভিরিয়াল প্রবলেম আছে। আপনারা চাইল্ড স্পেশালিষ্টের সঙ্গে কনসাল্ট করুন।
কথাটা শোনার পরই মনে কু ডেকেছিল আমার। বিদিশাকে কিছু বলিনি। নামী এক চাইল্ড স্পেশালিষ্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বিদিশাকে বলি, চলো, বিল্টুকে দেখিয়ে আনি।
বিদিশা রাজি হয়নি। বলেছিল, বেকার যাওয়া হবে। বিল্টুর মধ্যে কোনও বিহেভিরিয়াল প্রবলেম নেই। কিছু বাচ্চা এরকম হয়। নিজের মনে থাকে। ডাকলে সহজে সাড়া দেয় না।… বুঝতে পারছিলাম আমি যে আশংকায় ভুগছি, বিদিশাও তেমনই কিছু অনুমান করে বিষয়টা মেনে নিতে চাইছে না। এর মাঝে আবার বিল্টু এক-দুটো কথা বলতে শুরু করল, দাদু, দিদা, জল, পিসি। কাজের মেয়েটাকে বলত পিসি। মা বা বাবা কখনই বলত না। বিদিশাকে বললাম, এটা কীরকম ব্যাপার হচ্ছে?
বিদিশা বলল, এত অধৈর্য হও কেন? আজ না হয় কাল বলবে বাবা, মা।
আজ অবধি বলেনি। বিল্টু যে অটিজিমের শিকার তা ধরা পড়ল তিন বছরের মাথায় এসে। ততদিনে যে দু-চারখানা সম্বোধনসূচক কথা বলত সে, সব ভুলেছে। শুধু রিডিং পড়ানোর সময় যা উচ্চারণ করা হয়, সেটা সে ঠিকঠাক বলে। তবে দিন দিন ভীষণ চঞ্চল আর জেদী হয়ে উঠছিল। কোনও বারণ শুনত না। জল নিয়ে খেলে যাচ্ছে তো খেলেই যাচ্ছে। আমি বিদিশাকে বলেছিলাম, লক্ষণ কিন্তু ভাল ঠেকছে না। চলো বড় কোনও ডাক্তারের কাছে যাই।
আমার কথা কানে নিল না বিদিশা। বলেছিল, কেন ছটফট করছ! বাচ্চারা যত বড় হয় তাদের আচরণ পাল্টাতে থাকে।
বাবা, মা আমার আশংকায় সহমত হল। বাবা বলল, না, ভাল কোনও চাইল্ড স্পেশালিষ্টকে দেখা। আমারও মনে হচ্ছে ছেলেটার মধ্যে অ্যাবনরম্যালিটি আছে। আগে কেমন ঝাঁপিয়ে আসত আমার কোলে, এখন ফিরেও তাকায় না। আমি যে ওর আশপাশে আছি, সেটাও টের পায় না বোধহয়। যতদিন যাচ্ছে সিমটমগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। এখনই ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া ভাল।
বাবার কথাগুলো বিদিশাকে বললাম। বিদিশা বলল, বিল্টুকে নিয়ে তুমি আর বাবা যাও ডাক্তারের কাছে। যতই হোক ও তোমাদের বংশের ছেলে। তোমাদের এভরি রাইট আছে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার। আমি কিন্তু যাব না।
–তা আবার হয় নাকি! মা ছাড়া বাচ্চাকে হয়তো ডাক্তার দেখবেই না। বলেছিলাম আমি।
উত্তরে বিদিশা বলেছিল, আমি মনে করি না বিল্টুর মধ্যে কোনও অ্যাবনরমালিটি আছে।
তখনকার মতো আমি আর জোর করিনি বিদিশাকে। যতই হোক ও মা, ছেলের প্রতি অন্ধ স্নেহ তো একটু থাকবেই। আর ক’টাদিন যাক বিদিশা নিজেই টের পাবে বিল্টুর অসংগতিগুলো।
খুব দ্রুত এমন একটা ঘটনা ঘটল, বিল্টুকে নিয়ে যেতে হল চাইল্ড স্পেশালিষ্টের কাছে। সেদিন ছিল শনিবার। আইটি কোম্পানিতে উঁচু পদে কাজ করি আমি। সপ্তাহে শনি রবি ছুটি। বিদিশা সরকারি স্কুলের টিচার, শনিবার হাফ ছুটি। বিকেলে বাড়ির সবাই মিলে চা খাচ্ছিলাম ডাইনিং-এ বসে। বিল্টু গেছে আমাদের দুটো বাড়ি পরে অন্তরার কাছে পড়তে। শেফালি দিয়ে এসেছে। শেফালি আমাদের কাজের মেয়ে। আমাদের চা খাওয়ার মাঝে ফোন এল বিদিশার। ওপ্রান্তের কথা শুনে বিদিশা শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, আমি এখনই যাচ্ছি।
কাপের চা শেষ না করেই উঠে গিয়েছিল বিদিশা। শেফালিকে বলল, ছেঁড়া শাড়িটাড়ি কিছু নে তো। আর আমার সঙ্গে চল।
আমি বিদিশাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? কে ফোন করেছিল?
বিদিশা বলল, অন্তরা। বিল্টু প্যান্টে পটি করে ফেলেছে।
–সে কী! ওর যে পটি পেয়েছে অন্তরাকে বলেনি? বলেছিলাম আমি।
উত্তর না দিয়ে শেফালিকে নিয়ে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গিয়েছিল বিদিশা।
লজ্জা, সংকোচে গুটিয়ে গেলাম। অন্তরা এবং ওর বাড়ির লোক নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হচ্ছে। আর হয়তো বিল্টুকে পড়াবে না অন্তরা। নতুন টিচার খুঁজতে হবে।
বেশ খানিকক্ষণ পর বিল্টুকে নিয়ে ফিরল বিদিশা। পিছনে শেফালি। বিদিশার মুখে বিষণ্ণতা। বিল্টু আছে নিজের মুডে, যেন কিছুই হয়নি। কৃতকর্মের কোনও অনুশোচনা নেই ওর মুখে। বিল্টুর উপর রাগ হচ্ছিল খুব। বিদিশাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওর কি পেটখারাপ? পটি পেয়েছে বলেনি কেন অন্তরাকে?
উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বিদিশা, তার আগেই শেফালি বলে উঠল, বিল্টু তো হাগু পেলে বলে না। বাড়িতেও এরকম করে।
ভীষণ অবাক হলাম। এই ব্যাপারটা তো আমাকে বলেনি বিদিশা। সম্পূর্ণ চেপে গেছে। শেফালির সামনে বিদিশাকে কিছু বলিনি। রাতে শুতে যাওয়ার সময় বললাম, এ ভাবে তুমি ছেলের অস্বাভাবিকতা কতদিন লুকোবে? প্রকাশ হয়ে যাবেই। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বিল্টুকে ডাক্তার দেখানো উচিত। অল্পবয়সে চিকিৎসা হলে হয়তো রিকভার করে যাবে। বড় হয়ে গেলে আর কিছু করার থাকবে না।
অবশেষে বিল্টুকে ডাক্তার দেখাতে সম্মত হল বিদিশা। আমি খোঁজখবর করে কলকাতার এক নাম করা চাইল্ড স্পেশালিষ্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলাম। ডেট পড়েছিল দিনদশেক বাদে। পার্কস্ট্রিটের নামী এক প্রাইভেট হসপিটালে বসেন সেই ডাক্তার। নাম, পল্লব বসু। আরও অনেক জায়গাতেই বসেন। আমাদের টালিগঞ্জ থেকে পার্কস্ট্রিট সুবিধে।
বিল্টুকে নিয়ে ডা. পল্লব বসুর কাছে গেলাম আমি, বিদিশা। ডাক্তার বিল্টুকে পরীক্ষা করে বললেন, হ্যাঁ, আপনাদের ছেলের অটিজিমের লক্ষণ আছে। তবে বর্ডার লাইন কেস। ঠিক মতো ট্রেনিং পেলে একটি স্বাভাবিক বাচ্চার সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য থাকবে না।
আমি বলেছিলাম, তারমানে ও সবসময় একটা নরমাল বাচ্চার থেকে পিছিয়ে থাকবে।
ডাক্তারবাবু বললেন, হ্যাঁ।
এই কঠিন সত্যটা জানার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে আসার শব্দ পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল পাহাড়টার নীচে দাঁড়িয়ে আছি আমি। যে আমি চিরকাল এগিয়ে থাকতে চেয়েছি। স্কুল লেভেলে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েছি। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়েছি যাদবপুরে। চাকরির প্রথম একবছর কাটিয়েছি বিদেশে। আমার ছেলে কিনা পিছিয়ে থাকবে সব ব্যাপারে!
মেট্রো করে বাড়ি ফেরার সময় আমি একটা কথাও বলিনি বিদিশার সঙ্গে। বলতে ইচ্ছে করছিল না। বিদিশাও ছিল চুপচাপ। ধরে বসেছিল বিল্টুকে।
বাড়িতে বাবা, মা প্রবল অ্যাঞ্জাইটি নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কী খবর আসবে, কে জানে! আমাদের ভাঙা চেহারা দেখে ফলাফল বুঝতে অসুবিধে হয়নি। তাই হয়তো বাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করেনি বাবা, মা। বাইরে হাতমুখ ধুয়ে এসে বাবার কাছে গিয়েছিলাম। মা-ও চলে এল। বললাম সব। দুজনের মুখে অন্ধকার নেমে এল।
রাতে ঘুম আসছিল না। জেগেছিল বিদিশাও। ওকে বলছিলাম, আমাদের প্রেমের মধ্যে কোথাও কি কোনও মিথ্যে ছিল? নয়তো একটা ভালবাসার এমন পরিণতি হবে কেন?
আরও কী সব বলেছিলাম তখন। বিদিশা আমাদের পাশের পাড়ায় থকত। খুবই সুন্দরী। পড়ালেখায় ততটাই ভাল। ওর পিছনে লাগাতার দু’বছর ঘুরে বিশেষ সম্পর্কে রাজি করাতে পেরেছিলাম। পাঁচবছর কোর্টশিপের পর বিয়ে। আমাদের ভালবাসায় কোনও ফাঁকি ছিল না। পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলাম আমরা। আজও আছি। তা হলে কেন ভগবান আমাদের এই শাস্তি দিলেন?…এই সব প্রলাপ অনেকক্ষণ সহ্য করে বিদিশা বলে উঠেছিল, কেন এত সেন্টিমেন্টাল, ইমোশনাল কথাবার্তা বলছ? কোনও লজিক নেই! বিল্টুর এরকম হওয়াটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। এরকম অনেক দম্পতিরই হয়। বিষয়টা যখন আমাদের হাতে নেই, অ্যকসেপ্ট করতেই হবে।
ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল বিদিশা। আমার ঘুম আসেনি। ঘুম থেকে উঠে বিদিশা সংসারে ওর নির্ধারিত কাজগুলো করে স্কুল চলে গিয়েছিল। আমিও গেলাম অফিসে। সেখানে আমার ক্লোজফ্রেন্ড সায়ন্তনকে বিল্টুর ব্যাপারে ডাক্তার যা বলেছেন, সব বললাম। বিল্টুকে নিয়ে আমার আশংকা ওকে আগেও বলেছি। আমার থেকে ডাক্তারের মতামত জেনে সায়ন্তন বলেছিল, এত ভাবছিস কেন? ডাক্তার তো বলেছে এক্সট্রিম কিছু নয়। বর্ডার লাইন কেস। ভাল ট্রেনার রেখে ছেলেকে ট্রেনিং দেওয়া। ও বড় হলে একটা ঝুটঝামেলাহীন দোকান করে দিস। ঠিক চালাতে পারবে। যেমন জেরক্সের দোকান আর কি।
গালে যেন ঠাস করে চড় মেরেছিল সায়ন্তন। আমার হাবাগোবা ছেলে জেরক্সের দোকান চালাবে। কাস্টমার ঠকিয়ে চলে যাবে ওকে!…চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এসেছিল আমার। সায়ন্তন পিঠে হাত রেখে বলেছিল, এ ভাবে ভেঙে পড়িস না। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নে নিজেকে।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মিটিঙে বসলাম আমরা। বিষয়, বিল্টুর ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়? বিদিশা শুরু করল প্রথমে। বলেছিল, শুধুমাত্র বিল্টুর জন্য একটা আলাদা কাজের মেয়ে রাখতে হবে। আমি স্কুল থেকে ফিরলে তার ছুটি। এর সঙ্গে একজন ভাল ট্রেনারের খোঁজ করতে হবে। যিনি রোজ এক-দুঘণ্টা ট্রেনিং দিয়ে যাবেন বিল্টুকে এবং বিল্টুর জন্য রাখা মেয়েটিকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন কেমন ভাবে পরিচর্যা করতে হবে এই ধরনের বাচ্চাদের।
উত্তরে বাবা বলেছিল, বিল্টুর কথা ভেবেই আমি একবার ট্রেনারের খোঁজ করেছিলাম। তখন জানলাম ভাল ট্রেনারের প্রচুর ডিমান্ড। তারা রোজ ক্লাস করাতে আসতে পারবে না। সপ্তাহে বড় জোর দু’দিন। বাড়ির লোককে বুঝিয়ে দিয়ে যাবে কী ভাবে বাচ্চাকে দেখাশোনা করতে হবে।
বিদিশা বলেছিল, অসুবিধে কী আছে! তেমন ভাবেই চলুক তা হলে।
মা বলল, না, এ ভাবে চলবে না। বিল্টুর জন্য কাজের মেয়ে রাখলেও সে পুরো দায়িত্ব নেবে না। যখনই সামলাতে পারবে না বিল্টুকে, আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে। আমাদেরও তো বয়স হচ্ছে, কতদিন আর ঝক্কি নিতে পারব!
মায়ের কথার পর চারজনই চুপ করে বসেছিলাম। ভাবছিলাম সমস্যার সুরাহা কী ভাবে করা যায়? আমার মাথায় একটা আইডিয়া এল। বললাম, বিল্টুকে কোনও অটিস্টিকদের হোম-এ রাখলে কেমন হয়? চব্বিশ ঘণ্টা প্রশিক্ষিত কর্মীদের নজরে থাকবে। তৎক্ষণাৎ ডাইনিং-এর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল বিদিশা। বেশ জোরের সঙ্গে বলেছিল, না, বিল্টুকে আমি হোমে রাখতে দেব না। তোমাদের যখন এতই অসুবিধে ওকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাব।
আর ওখানে দাঁড়ায়নি বিদিশা। ঘরে চলে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম রাগের মাথায় যে সিদ্ধান্ত নিল বিদিশা, মাথা ঠাণ্ডা হলে আমাদের প্রস্তাবে সায় দেবে!
তা কিন্তু হল না। ভোররাত থেকেই ব্যাগপত্র গোছাতে থাকল বিদিশা। আমি বলেছিলাম, তুমি সত্যিই ও বাড়ি চলে যাচ্ছ! তোমার বাবা, মায়ের তো বয়স হয়েছে। ওঁদের পক্ষেও তো বিল্টুকে চোখে চোখে রাখা চাপ হয়ে যাবে! তোমার দাদা, বউদি চাকরি করে। বিল্টু ওখানে গিয়ে থাকলে তাদেরও বিশ্রামের ব্যাঘাত হবে।
আমার বাড়ি নিয়ে তোমাকে এত ভাবতে হবে না। তুমি তোমার বাড়ি নিয়ে ভাবো, বলেছিল বিদিশা। ব্যাগপত্র সমেত বিল্টুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরনোর আগে মা, বাবাকে প্রণাম করে বলেছিল, আমি প্রত্যেক শনিবার বিকেলে বিল্টুকে নিয়ে আসব। একরাত কাটিয়ে রবিবার সন্ধেবেলা ফিরে যাব। আমি চাই না বিল্টু তার বাবার দিকটা ভুলে যাক।
তেমন ভাবেই চলছিল। এবাড়িতে বিল্টুর প্রচুর খেলনা। ছেলেকে খেলনা দিয়ে বসিয়ে রেখে বাবা, মা-র সঙ্গে গল্প করতে বসত বিদিশা। কখনও কখনও রান্নাঘরে ঢুকত নতুন শেখা কোনও পদ রাঁধতে। যতদূর সম্ভব হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করত সে। বাবা, মা কিন্তু সহজ হতে পারত না। মুখ দেখে বোঝা যেত এই ব্যবস্থা তারা মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। বিল্টুর কোনও হেলদোল নেই। সে বোধহয় তফাত করতে পারে না দুই বাড়ির মধ্যে। আপন মনে খেলা করে যায়। ছবি আঁকে। বিল্টুর জন্য ট্রেনার জোগাড় করেছিল বিদিশা। কাজের মেয়েও রাখা আছে। বাবার বাড়ির লোক বিল্টুকে নিয়ে যেন কোনও বিড়ম্বনায় না পড়ে সেদিকে সতর্ক নজর রেখেছে বিদিশা। সপ্তাহের মাঝে আমি কোনও একটা দিন ওবাড়ি যেতাম। বিদিশার বাড়ির লোক আমার সঙ্গে প্রায় কথাই বলত না। যেন বিদিশা বাবার বাড়ি ফিরে আসার জন্য আমিই দায়ী। বিষয়টা বিদিশাকে বললাম। সে বলল, তোমার এখানে আসার দরকার নেই। বিল্টুকে নিয়ে আমি তো দু’দিন থাকছি ওবাড়িতে। ছেলে, বউয়ের সঙ্গ পেতে ওই সময়টা যথেষ্ট।
আমি তো আর বিদিশাকে বলতে পারি না, ছেলে-বউয়ের জন্য আমি আসি না। আসি একটা অপরাধ বোধ থেকে। নিজের ছেলে-বউকে ঘরে রাখতে পারিনি তাই।
বিদিশাদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিলাম আমি। বিদিশার দাদা, বাবার ‘কেন আসছ না’ বলে কোনও ফোন এলো না। বিদিশা কিন্তু উইদাউট ফেল এবাড়িতে ওর কথা মতো দু’দিন আসতে থাকল। ওই দু’দিন খুব একটা খারাপ কাটত না আমার। বাড়িটাকে পরিপূর্ণ সংসার মনে হত। শুধু রাতটাকে নিয়ে সমস্যা হত। বিদিশা যখনই শারীরিক ভাবে ঘনিষ্ট হতে চাইত, আমি আড়ষ্ট হয়ে পড়তাম। দায়সারা ভাবে বিদিশার আদরের উত্তর দিতাম আমি। কিছুতেই পুরোপুরি সম্পৃক্ত হতে পারতাম না। বেশ কিছুদিন লক্ষ্য করার পর বিদিশা প্রসঙ্গটা তুলল। জানতে চেয়েছিল, তোমার সমস্যাটা কি হচ্ছে বলো তো? ইন্টিমেট হতে চাইছ না কেন?
বলেছিলাম, আমার ভয় করে ইন্টিমেট হতে। যদি আবার বিল্টুর মতো কেউ এসে পড়ে।
বিদিশা বলেছিল, কেন আসতে দেব? প্রোটেকশন নেব আমরা।
প্রোটেকশনের উপরেও আর ভরসা হয় না বিদিশা, বলেছিলাম আমি। মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে আমাকে অনেক বোঝাল বিদিশা। বলেছিল, বিল্টুর ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নাও। ধরে নাও এটাই ছিল আমাদের ভবিতব্য। বিল্টুর কারণে নিজেকে মানসিক ভাবে অসুস্থ করে ফেল না। আমাদের জীবন তো শুধু ছেলেকে ঘিরে নয়। আরও কত দিক আছে। আমরা কেন সে সব নিয়ে মেতে উঠব না?
এই কথাগুলোই রোজ রাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলত বিদিশা। তবু আড়ষ্টতা কাটত না আমার। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করার পর বিদিশা এক রবিবার বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় বাবাকে বলে গেল, এবার থেকে আমি শুধু রবিবারটাতেই আসব। খাতা দেখার এত চাপ বেড়েছে, দু’দিন আসতে গিয়ে বেশ সমস্যা হচ্ছে।
বাবার বলার মতো কিছু ছিল না। কেননা, যে ব্যবস্থা চলছিল, সেটা বিদিশার একতরফা সিদ্ধান্ত। ও যদি তাতে কিছু বদল আনতে চায়, আনবে। রাতে খেতে বসে বাবা শুধু বলেছিল, বউমার খাতা দেখার ব্যাপারটা অজুহাত। অন্য কোনও কারণ আছে এ বাড়িতে থাকার সময়টা কমিয়ে ফেলার।
গত ছ’মাস এমন রুটিনই চলছে। বিদিশা বিল্টুকে নিয়ে চলে আসে সকালে। সন্ধেবেলা চলে যায়। আজ রবিবার। একটু পরেই বিদিশা, বিল্টু এসে পড়বে। আমি সকালে বেরিয়ে বাজার করে এনেছি। এখন ডাইনিং-এর চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ার ভান করে কান পেতে রেখেছি বাড়ির গেটে, অপেক্ষা করছি বিদিশার। আজ ওকে একটা গুরুতর কথা বলার আছে। গত বুধ, নাকি বৃহস্পতিবার আমি অফিস থেকে ফিরে টিভি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছি, বাবা বসে আছে পাশের সোফাটায়, মা ঘরে ঢুকে আমাকে বলল, এবার তুই বিদিশার থেকে ডিভোর্স চেয়ে নে। তোদের মধ্যে এখন যে সম্পর্ক আছে, তা না থাকারই সমান।
বাবা পাশ থেকে বলে উঠেছিল, তোর মা ঠিকই বলছে। কেন যে বিদিশা লোক দেখানো সম্পর্কটা রেখে দিয়েছে, কে জানে! পাড়া প্রতিবেশিরা মজা পায় বিদিশার কয়েক ঘণ্টার সংসার করা দেখে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আমাদের নিয়ে।
জানতে চেয়েছিলাম, এ সব খবর তোমাদের কানে আসে কী ভাবে?
মা বলেছিল, কাজের লোকের মাধ্যমে। ওরা তো এ বাড়ির খবর ও বাড়িতে দিয়ে বেড়ায়।
আমার পরের প্রশ্ন ছিল, ডিভোর্স হলে সুবিধাটা কী হবে?
নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে পারবি তুই। আবার বিয়ে করবি। বাচ্চাকাচ্চা হবে। এবার নিশ্চয়ই সুস্থই হবে। নাতি-নাতনি নিয়ে আমরাও বাকি জীবনটা আনন্দে কাটাতে পারব। বিদিশা আমাদের উপর দোষারোপ করতে পারবে না। আমরা যেভাবে বিল্টুকে বড় করতে চেয়েছিলাম, তাতে ও সায় দেয়নি। বিল্টুর সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। বলেছিল মা।
একটু ভেবে নিয়ে বলেছিলাম, ডিভোর্সের কথা আমি বলতেই পারি। তাতে আমরা যেমন একটা সমস্যা থেকে মুক্তি পাব। বিদিশাও পাবে। চক্ষুলজ্জার খাতিরে ও বোধহয় সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে, কাচ্চাবাচ্চা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা আগে থেকে জেনে রাখো।
মা বলেছিল, ঠিক আছে, সে সব নিয়ে এখন ভাবতে হবে না। তুই ডিভোর্সের কথাটাই বল আগে।
বাবা বলেছিল, আমার মনে হয় না সহজে রাজি হবে। বিদিশা যেহেতু চাকরি করে খোরপোশ চাইতে পারবে না। কিন্তু ছেলে তো ওর একার নয়, ছেলের ভাগ বাপের কাছে চাইবেই।
বাবার যুক্তিতে মায়ের অভিব্যক্তিতে হতাশার ছাপ পড়ল। মা-কে চাঙা করতে বাবা বলে উঠেছিল, এখনই এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই। ডিভোর্সের কথাটা তো আগে বলা হোক। দেখা যাক না ও কী বলে।
গতকাল রাতে খাবার টেবিলে মা আমাকে বলেছে, কী রে, ডিভোর্সের কথাটা বলবি তো বিদিশাকে? নাকি সিদ্ধান্ত পাল্টালি?
মা-কে বলেছিলাম, বলব। চিন্তা করো না।
বলব তো বটেই। কিন্তু প্রসঙ্গটা কখন, কী ভাবে তুলব বুঝে উঠতে পারছি না।
বাইরে গেট খোলার আওয়াজ। নির্ঘাত বিদিশা। ওর গেট খোলার আওয়াজ আমি চিনি। প্রত্যেক মানুষের গেট খোলার আওয়াজ আলাদা।
বসার ঘর পেরিয়ে বিল্টুকে নিয়ে ডাইনিং-এ এল বিদিশা। কাঁধে যেমন একটা ব্যাগ থাকে, সেটা আছে। হাতে ছোট বাজারের ছোট ঝোলা। মুখটা বেশ খুশি খুশি। আমাকে আগাপাস্তালা জরিপ করে রান্নাঘরের দিকে এগোল। সেখানে এখন মা আর শেফালি। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বিদিশা বলছে, মা আজ একটা নতুন রান্না করব। বাদশাহী ভেটকি। ইউটিউব থেকে শিখলাম। আসার পথে মাছ কিনে এনেছি।
মা বিদিশার কথার কোনও উত্তর করল না। শেফালিকে বলল, বউদি এসে গেছে। এবার লুচিগুলো ভেজে ফেল।
বিল্টু বিদিশার কুর্তি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাছের ঝোলাটা আপাতত ফ্রিজে রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল বিদিশা। বিল্টুকে বলল, যাও, ঘরে গিয়ে খেলা করো।
বিল্টু সিঁড়ি ধরে উঠতে লাগল। দোতলায় আমাদের বেডরুম। ওখানেই যাবে বিল্টু। বিদিশা না বললেও যেত। বিদিশা মনে হয় আমাকে দেখাতে চাইল বিল্টু এখন নির্দেশ পালন করছে। উন্নতি হচ্ছে ছেলের। বেডরুমে খাটের নীচে বিল্টুর খেলনাপাতি, আঁকার সরঞ্জাম। সেগুলো বার করে খেলায় বুঁদ হয়ে থাকবে বিল্টু।
বিদিশা আমার সামনের চেয়ারটায় বসল। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, চা খাবে নাকি একটু? তুমি খেলে আমি জোর পাব চাইতে।
এখনই তো জলখাবার খাব। তার আগে চা! বললাম আমি।
বিদিশা বলল, তোমাদের খাওয়া হলে তারপর তো আমি খাব। এদিকে ভীষণ মাথা ধরেছে।
আমি বলতে যাচ্ছিলাম ‘ঠিক আছে, বলো’। বাবা বসার ঘর থেকে চলে এল এ ঘরে। বিদিশা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, চা খাবেন বাবা?
চায়ে বাবার কখনও ‘না’ নেই। বলল, খেলেই হয়।
বিদিশা উঠে গেল। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, শেফালি, বাবা চা খাবে। সঙ্গে আমাকেও একটু দিস।
মা বলে উঠল, এখন চা হবে না। জলখাবার বাড়ছি।
প্লিজ, মা। বলল বিদিশা…এত স্বাভাবিক সাংসারিক পরিবেশের মধ্যে ওই কঠিন কথাটা কী করে বলব, বুঝে উঠতে পারছি না। বাবা যে বসার ঘর থেকে উঠে এল, ওই প্রসঙ্গটা উঠবে ভেবেই।
২
বিকেল ফুরিয়ে এল। এখনও কথাটা বলতে পারিনি বিদিশাকে। অন্য রবিবারের তুলনায় আজ যেন ও একটু বেশিই প্রগলভ। কারণটা ধরতে পারছি না। বাদশাহী ভেটকিটা দারুণ বানিয়েছে। খাবার টেবিলে আজ একটু বেশিই কথা বলছিল। খোঁজ নিচ্ছিল বাবা, মায়ের শরীর-স্বাস্থ্যের। প্রসঙ্গটা তোলার মতো সিচুয়েশন পাইনি। খাবার টেবিলে মা একবার চোখে ইশারায় আমাকে তাড়া দিয়েছিল কথাটা বলার জন্য। বলতে পারিনি।
আমাদের খাওয়ার আগেই বিল্টুকে খাইয়ে দোতলার ঘরের বিছানায় শুইয়ে এসেছিল বিদিশা। খাওয়ার পর নিজে শুতে গেল। ভেবেছিলাম তখন তুলব কথাটা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট খেয়ে এসে দেখি সে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। বেডরুমে একটা সোফা আছে। প্রতি রবিবারের মতো ছোট একটা দিবানিদ্রা দিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি মেঝেতে খেলনাগুলো নিয়ে খেলছে বিল্টু। মুখে গাড়ি চলার আওয়াজ করছে। ওর মা ঘরে নেই। জানি উত্তর পাব না। তবু বিল্টুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোর মা কোথায়, রে?
যথারীতি উত্তর পেলাম না। তবে ঘুরে একবার তাকাল। তা হলে কি উন্নতি হয়েছে সামান্য? আগে তো ডাকলে কোনও সাড়া দিত না। বিল্টু খেলনা ছেড়ে ড্রয়িং বোর্ড টেনে নিয়েছিল। আমি নীচের তলায় গেলাম। রবিবার এ সময় আমরা চা খাই।
মা, আমি, বাবা, বিদিশা এখন চা খাচ্ছি ডাইনিং টেবিলে। চা খাওয়া হলেই বিদিশা বিল্টুকে নিয়ে ফিরে যাবে। কথাটা বলে ফেলতে হবে এইটুকু সময়ের মধ্যেই। মা, বাবার সামনে না বলে বিদিশাকে আলাদা বলতে পারলে ভাল হত।
চা খেতে খেতে মা হঠাৎ বলে উঠল, হ্যাঁ রে বাবু, বিদিশাকে কথাটা বলেছিস?
কী কথা? আমার কাছে জানতে চায় বিদিশা।
প্রসঙ্গটা আচমকা এসে পড়াতে আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছি। কথা গোছাচ্ছি মনে মনে। আমার থেকে উত্তর আসছে না দেখে বিদিশা মাকে-ই বলে, আপনি বলুন না কী কথা?
না, বাবু নিজের মুখেই বলুক।
এখনও কথা গোছাতে পারিনি আমি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে বাবা বলে ওঠে, দ্যাখো বিদিশা, ক’দিন ধরে আমরা অনেক আলোচনা করে যা বুঝলাম, তোমাদের সপ্তাহে এই যে ছ’সাত ঘণ্টার দাম্পত্য সম্পর্ক, এর কোনও মানে হয় না। এটা থাকা না থাকা প্রায় সমান।
কথাটা শুনে বিদিশার হতভম্ব অবস্থা। পর্যায়ক্রমে আমাদের তিনজনের মুখের দিকে তাকায়। মা বলে ওঠে, পাড়ার লোক, আত্মীয়স্বজন তোমাদের সম্পর্কটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। কখনও কখনও আমাকে জিজ্ঞেস করে, কী খবর? বউমা আজ এসেছিল? বুঝতে পারি মজা পেতেই প্রশ্নটা করেছে। বড় অপমানিত লাগে।
মা থামতেই বিদিশা আমার কাছে জানতে চায়, তোমারও কি এই একই মত?
ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝাই। বিদিশা এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, তা হলে তাই হোক। আপনারা তো ভুল কিছু বলছেন না। আসলে আমি দুটো কারণে রিলেশনটা কন্টিনিউ করে যাচ্ছিলাম, এক, ট্রেনিং পেয়ে বিল্টু ক্রমশ উন্নতি করছে। আর একটু বড় হয়ে ও তো বাবাকে খুঁজবে, তখন আমি ওকে কী বলব? দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে, আপনার ছেলে যত বড়ই চাকরি করুক, কোম্পানিটা তো প্রাইভেট। তার উপর আবার আইটি সেক্টর। যখন তখন চাকরি চলে যায়। পরের চাকরিটা পেতে যদি বেশ কয়েক মাস সময় লাগে, ওই গ্যাপটায় আমার স্যালারি থেকে এবাড়ির সংসার খরচ চালাব। তবে এ সবের প্রয়োজন যখন নেই আপনাদের, আমি রাজি ডিভোর্সে। নোটিশ পাঠিয়ে দিও।
শেষ বাক্যটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল বিদিশা। চেয়ার থেকে উঠে পড়ে গলা তুলল, বিল্টু চলে আয়। এবার আমরা যাব।
মুখ তুলে দেখি বিল্টু দোতলার বেডরুম থেকে বেরিয়ে এল। ডাক কানে যাচ্ছে, নির্দেশও মানছে। ও কি সত্যিই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে?
নীচে নেমে এসেছে বিল্টু। বিদিশা ঘরের কর্নার টেবিল থেকে নিজের কাঁধব্যাগটা নিয়ে ‘চলি’ বলে বাইরের ঘরের দিকে পা বাড়াল। বিল্টু পিছন ফিরে আমাদের দেখল না। তারমানে আগের মতোই আছে। এতটুকু স্বাভাবিক হয়নি।
গেটের আওয়াজ শুনে যখন বোঝা গেল মা, ছেলে চলে গেছে, মা জোড়হাত ঠেকাল কপালে। ভগবানকে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। বাবা গেল সদর দরজা দিতে।
ভেবেছিলাম বিদিশারা চলে গেলে একটু হলেও মনখারাপ করবে আমার। এতটুকু করছে না। শরীরের ওজন যেন হঠাৎ করে দশ-পনেরো কেজি কমে গেছে। প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। বিল্টুর খেলনাগুলো মেঝে থেকে তুলে রাখতে হবে এবং এটাই শেষবার।
ঘরে ঢুকে উবু হয়ে বসে খেলনাগুলো গোছাচ্ছি, চোখ গেল বিল্টুর ড্রয়িং বোর্ডের উপর। কেঁপে উঠল গোটা শরীর, বোর্ডে লাগানো ড্রয়িং সিটে লাল প্যাস্টেলে অপটু হাতে লেখা ‘বাবা’!…নিজেকে একটা গাছ মনে হচ্ছে আমার। কে যেন ডাল ধরে বার বার টানছে। কিছু বলতে চাইছে, মুখে কথা ফুটছে না।
এতদিন ধরে বৃষ্টি ধারণ করা গাছ, নাকি কান্না জমানো আমি, কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছি না। প্রাণপণ চেষ্টা করছি জল থেকে ‘বাবা’ লেখাটাকে বাঁচাতে।