আশুতোষ ভৌমিক: আত্মধ্বনিত কবি
আসিফ-আল-নূর

মরমিয়া ভাবে পূর্ণ মূলধারার কবিদের পরম্পরায় আশুতোষ ভৌমিকও একজন। ‘দেশ-কাল-সমাজ-রাজনীতির চেয়ে’ মানুষের ভেতরে অচিন মানুষই প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর কবিতানুরণনে। উঠে আসে তাই তাঁর কবিতায়: “মানুষ সে-ও তো মৃৎশিল্প/ কে বলে রে ‘আমি’/ কেউ ‘আমি’ নয়/ কেউ ‘আমি’ নই/ ‘আমি’ অন্তর্যামী।”, ‘মাটির কোলে মাটি ঘুমায়/ চলে যায় কে/ কার বাঁশি কে বাজায়/ যে জানে সে জানে’ প্রভৃতি অভিব্যক্তি। মানুষের আত্মিক ও কায়িক মুক্তিকামী ভাবনায় সিক্ত তাঁর প্রতিটি কবিতা। কলাকৈবল্যে বুঁদ তিনি হননি। কবিতার স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তিকে ধারণ করেছেন তাঁর অতীন্দ্রিয় রেটিনায়।
‘কবিতার নিজস্ব বলয়’ হতে তাঁকে বের হতে দেখা যায়নি। দেশ-সমাজ-কালের কথাও উত্থিত হয়েছে অন্তরতল হতে। তাই ‘রক্তের ভেতরে প্রাণ উষ্ণতার মরারক্তজালে/ স্বদেশের মুক্তরোদ খেলা করে পাতার আড়ালে’, ‘আন্তর্জাতিক প্রটোকল মানে না মেঘ’, ‘আপনারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন/ অর্থাৎ আপনারা আপনাদের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করছেন’ এরূপ পঙ্ক্তি পাই তাঁর কবিতায়।
কবিতা ভেতর থেকে উদ্গত হয়, বৃক্ষের শাখা-পল্লবের মতো। বই পড়ে পড়ে সম্ভব নয় তা, তাঁর পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে মিলে এ-সত্যতা। নিজকে পড়ার জানার এক তন্ময়তা ছিল তাঁর মাঝে। তাঁর ভাষ্য বলে, বিষয়ী দুঃখ-বেদনা তাঁর কবিতানির্মাণের অনুপ্রেরণা। দুঃখকে তিনি ঝিনুকরত্ন মুক্তোরূপে পরিণত করেছেন। বিষাদছাওয়া আঁধারে ফুটেছে ‘কবিতাচন্দ্রিমা’।
ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে জাতি-শ্রেণি-সম্প্রদায়, মানুষে মানুষে বা সর্বপ্রাণ-সৌহার্দময় এক স্বাপ্নিক দেশ গড়ে উঠুক চান একজন কবি। আশুতোষ ভৌমিকেও যার ব্যত্যয় ঘটেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ‘পাক-দোসরদের বিরুদ্ধে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা’ লড়েছিলেন তিনি। ‘মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মতো চাষীর চোখেও স্বাধীনতার স্বপ্ন’ দেখেছিলেন তিনি। ‘ফাল্গুনী-চোখের মতো’ একটি নদী চেয়েছিলেন তিনি।
রোমে কবিকে ভেইত (vates) বলা হতো। আবদ্ধ কোটি সংখ্যাকে তরানো তাঁদের দায়, বাঞ্ছা। তাঁদের শিল্পকৃতি তাই করছে যুগ যুগ ধরে, মায়িক পৃথিবীজুড়ে। ভেইত কালে, মহাকালে দুর্লভ। ‘সব বৃক্ষ বৃক্ষ নয়/বৃক্ষের লেবাস’। ‘নিভৃতচারী কবিরাই মূলত সৎ কবি।’ কবি আশুতোষ ভৌমিকে এ-অজর উক্তির শতভাগ পেয়েছি। যাঁর মগ্নতাপূর্ণ যাপন-চরাচর আসমুদ্রহিমাচলজুড়ে শুধু কবিতাই ছিল। ‘অন্তর হতে আহরি’ পঙ্ক্তিতে মেলে জীবনের আড়ালে থাকা জীবনের জ্যোতি। অপাঙ্ক্তেয় রয় যে-জ্যোতি জীবনে চড়নে, এই ডামাডোলের মনুষ্য-চরাচরে। নিজ অক্ষে আবর্তমান কবি চান মানুষ ফিরুক স্বগৃহে, স্বদেশে। গৃহে গৃহে গৃহীত বন্দি যাপনে, গাঢ় হেঁয়ালির আব্রুতে অদেখা উজ্জ্বল চিন্ময় আকাশ দেখান তিনি। কবিতায় কবিতায় সে-সত্যই বিভান্বিত।
বাতাসে সঞ্চিত শব্দপুঞ্জ ব্যক্ত হয় কবি কর্তৃক, সলিলকির মতো। কথা চলে তাঁর, অন্য কারো সাথে না, কেবল তাঁর সাথে। অনন্তকালের হৃদয়ভূমে পাখপাখালি, গাঙুর, বনতরুদের সাথে। চারপাশে উচ্চারিত যা আর কিছু না তাঁর কাছে, ‘শব্দের শব’। এ-কলরোল অপরা, মায়া কী জড়ে বদ্ধ জীবজীবনের। পরা সংগীত-লয়-ঐকতানচ্যুত, নিপতিত। এ-মঞ্চ যত আসুরিক কেওয়াজের। এ-আচ্ছাদন নাগ্নিকতা। “ন্যাংটারাই ‘সত্যমঃ শিবমঃ সুন্দরমঃ’ / আবরণে শ্লীলতা ঝরে”। কারো অভিব্যক্তিতে প্রতিক্রিয়া থাকে না তাঁর, মূক থাকেন। বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, মালায়লাম না; কবিতা কবির মাতৃভাষা। সেই এক ভাষায়ই বলে যান, নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে জপেন অজপা গায়ত্রী, যোগাযোগ রাখেন পৃথিবীর সাথে একজীবনজুড়ে। অব্যয়, নূতন, সতেজ তা আষাঢ়-শ্রাবণধৌত। সেকেলে কী বিগত হওয়ার জো থাকে না। অমৃতলোকে থেকেও তিনি গাইতে পারেন:
‘আমিও তো অকস্মাৎ নির্ঘাত নিষ্প্রাণ হবো জানি কোনো একদিন
তবুও কী যে পুলকতা! শব্দেরা কখনোই হয় না বিলীন
প্রয়াণের পরেও যখন-তখন জেগে উঠবে তোমাদের ঘরে ঘরে
আমার যত অমৃতশব্দবীণ’।
তাঁর ব্যক্তিজীবন পাঠে পাই নির্জনতার আধিক্য, কবিতায় নিজকে লীন করার অমোঘ প্রয়াস। সরবতা কেড়ে নেয় স্বরূপ-দ্যোতনা, তাঁর অনুভবে ছিল। প্রচারমুগ্ধতা তাঁকে পায়নি। জানতেন, কবিতা নিজেই সত্তা; যদি তা হয়ে ওঠে। সে নিজেই পাঠকের কাছে যাবে। এ-নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। আলোতে আপাতত যাদের অতি বিচরণ আলোচ্যূত তারা সবার আগে হবে। মরমি কবিদের কেউ এত চিনত না, তাঁদের কর্মসাধনা এখন উন্মীলিত হচ্ছে। কোলাহলে নদী ও কবিতা নাব্যতা হারায়।
থেকে যেতে যিনি আসেন তাঁর প্রস্থান নেই। স্বরূপকর্মে তিনি বেঁচে থাকেন। অশরীরী উপস্থিতিই দীর্ঘায়ু হয় আত্মধ্বনিত কবির। তাঁর লোক-আড়াল হওয়া আর কিছু নয়- জন্মলাভ।
কবির একটি কবিতা:
আসা-যাওয়া
আশুতোষ ভৌমিক
তুমি এলেই মইষাল মেঘেরা জোছনা হয়ে যায় / নৈঋতে ভূমিষ্ঠ হয় স্বতন্ত্র আকাশ – আকাশে। আকাশে খেলা করে চাঁদবদনি দিবসরজনী / শুক্ল নিবিড় শুভ্রতা
চলে গেলেই ভুলে যাওয়া ভুল হয়ে যায় / গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রে যায়
মৌবনে মৌ-দোলা দোলে না তো আর / ঢল-বিষ্টির মতো অঝরে ঝরে প্রজা ও প্রজাপতিগণ-
ঝিঁঝি ও জোনাকপোকারা / তুমি এলেই বুনোহুঙ্কারে ওঙ্কার বাজে
ব-দ্বীপেরা দীপ হয়ে যায় / সর্পিলা প্রহল্লাদ প্রকৃতিছায়ায় মরুদ্যান সাজে
তুমি চলে গেলেই ‘জবা’রা জবাই হয়ে যায় / শিশিরপরা মাঘের শরীর বন হয়ে যায়-
বিষকাঁটালির বন- / সাঁকোর নিচে আড়ি পাতে নীলার্দ্রিশয়ন
রাতের নাগর ডাগর হয়- / বাঁশির সুর বৃদ্ধপ্রণয়
ভাঙতে ভাঙতে ভাঙে শুধু ভাঙনেরই ক্ষয় / গড়গড় গড়ায় জল মরু সাহারায়
চলে গেলেই অন্ধতা বাড়ে / ঘরে ঘরে অন্ধকার জ্বলে আর
জাতিসঙ্ঘের মতো চোখ কচলায়- / পথিকই পথ নাকি পথই পথিক
রাজপথ-রক্তঝরা-মিছিল-স্লোগান যুদ্ধ হয়ে যায় / তুমি এলেই মাতাল হয় দীপ্রতর চন্দ্রসম্প্রপাত।