Short Story – Silencia

সাইলেন্সিয়া

(ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত )

এক

কলকাতার দক্ষিণ শহরতলীর এক্কেবারে একটেরে এলাকা। শহর ক্রমশ বাড়তে বাড়তে কোথায় ছড়িয়ে গেছে। মেট্রো রেলের লাইন গেছে পিলারের ওপর দিয়ে, নিচে ইএম বাইপাস। ক্রমেই এলাকা সরগরম হচ্ছে। জনবসতি বাড়ছে। সবুজ কমছে। অথচ যখন এখানে জমি কিনেছিলেন সত্যসুন্দরবাবু, জলের দরে জমি পাওয়া গেছিল। অনেকটা জমি নিয়ে বাড়ি, বাগান, হাঁস মুরগী, ডেয়ারি ইত্যাদি করার কথা ভেবেছিলেন তিনি।

সেসব অত করা যায়নি। স্ত্রীর আপত্তি ছিল এখানে আসার। তাঁর পড়াশুনো, বড় হওয়া সবই উত্তর কলকাতায়। হাতিবাগানে বাপের বাড়ি। কর্তার জেদাজেদিতে এখানে এলেও মন বসাতে পারেননি কোনওদিনই। প্রায়ই চলে যেতেন বাপের বাড়ি আর ভাইবোনদের কাছে। আসলে সত্যসুন্দরের শ্বশুরবাড়ির সেই বিশাল বনেদি কাঠামো ভেঙ্গে যখন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠলো, গিন্নীর ভাগে কিছু টাকা আর একটা আড়াই কামরার ফ্ল্যাট জুটে গেল। সেখান থেকে এক চিলতে আকাশ কেবল দেখতে পাওয়া যায়। হাওয়া পাক খায় সময়ে সময়ে, বইতে পারে না। গাড়ির শব্দে আর বাজারের হট্টগোলে টেকা দায়। কিন্তু নয়নতারার কাছে সেই স্থানই একান্ত প্রিয়।

নয়নতারা সেখানেই থেকে গেলেন, মাঝে মাঝে আসেন বটে, কিন্তু মন বসে না। সত্যসুন্দর হাতিবাগানে গেলে হাঁপিয়ে ওঠেন। বাস-ট্রাম-যানবাহনের একটানা আওয়াজে ঘুম আসে না।

দুজনের তাই দেখা হয় অন্যত্র। মাঝামাঝি কোন স্থানে। ঢাকুরিয়া লেক। হাজরা পার্ক। রবীন্দ্রসদনের সিঁড়ি।

এই রকম কথাবার্তা হয়।

কতক্ষণ এসেছ?

কুড়ি মিনিট।

কী করছিলে?

কী আর করব, লোক দেখছিলাম। বিশেষত মহিলা।

কেন?

দেখছিলাম তুমি আসছ কিনা।

ও।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনেই। তারপর আবার কথা।

কত বছর বিয়ে হল আমাদের?

প্রায় চল্লিশ বছর।

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল দুজনের নিঃশ্বাস থেকে।

কী সব দিন ছিল।

সত্যি, কী সব দিন।

চিনেবাদাম ছিল, খোসা শুদ্ধ। আলাদা শুকনো লঙ্কা আর নুনের পাউডার।

এখনও আছে। খোসা ছাড়ানো।

আমি খোসা সমেত চাই।

তাও পাবে।

কোথায়, কোথায়?

বাবুঘাটে পাওয়া যায়। যাবে?

না, থাক।

কেন?

অত হাঁটতে পারবো না।

বাস?

উঠতে পারবো না। মেট্রো  রেলে এখানে আসি কোনরকমে। সারা শরীরে ব্যথা। মেয়েদের হাড় তাড়াতাড়ি নরম হয়ে যায়।

ট্যাক্সি?

যেতে পারি।

সমস্ত বাবুঘাট মিলেনিয়াম পার্ক চষা হয়ে গেল। কোথাও খোসাওয়ালা বাদাম পাওয়া গেল না। সত্যসুন্দর অদম্য। কিন্তু নয়নতারার শরীর আর দিচ্ছিল না।

দুজনেই বসলেন জলের ধারে একটা বেঞ্চিতে।

সত্যি সে বাদামের কী স্বাদ। খোসা ভেঙে ভেঙে মুখে ফেলে চিবোলেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেত। মিহি মণ্ড গলা দিয়ে নামত, যেন অনির্বচনীয় সুধা।

তার সঙ্গে লঙ্কার ঝাল ঝাল আর লবণের আস্বাদ।

দুজনেই সেই না পাওয়া বাদামের স্বাদ মনে মনে পেতে লাগলেন।

কারও মুখে কথা নেই। দুজনের মনেই তখন বিগত দিন।

দুই

একবার পাহারাওলা কনস্টেবল এসে খোঁজ নিয়ে গেল। বেশি রাত পর্যন্ত এখানে থাকা যাবে না। উঠতেই হবে।

ওঠার মুখেই ঘটনাটা ঘটল। দূর থেকে বিদ্যাসাগর সেতুর ওপারটায় একটা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো কী যেন একটা দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল। সেতুর তলা দিয়ে প্রবল গতিতে একটা জলযান নাকি অ্যাম্ফিবিয়ান শকট সামনে এসে পৌছল। তারপরেই ডাঙ্গায় উঠে একেবারে সত্যসুন্দর আর নয়নতারার পায়ের কাছে শূন্যে দুলতে লাগল।

দুয়েকবার হোভারক্র্যাফট দেখেছেন সত্যসুন্দর। প্রবল গতিতে ছোটে। জলে স্থলে সর্বত্র অবাধ গমন। অনেকগুলো ছিদ্র দিয়ে যানটির তলা থেকে হাওয়া বেরোতে থাকে। ফলে একটি এয়ার কুশন তৈরি হয়ে যায়। যেহেতু যানটির নিচে প্রবল বায়ুচাপ সৃষ্টি হয় এবং ওপরে নিম্নচাপ, সে কারণেই যানটি মাটি ছেড়ে শূন্যে নিরালম্ব হয়ে যায়। কঠিন পদার্থের সঙ্গে ঘর্ষণের সম্ভাবনা শূন্য- অতএব প্রচণ্ড গতিতে একে চালনা করা যায়। এই চালনা এক বিমান চালনার মতই। ভারতবর্ষে কিছু হোভারক্র্যাফট আছে। গঙ্গাবক্ষে এর বিচরণ তিনি আগেও দেখেছেন। সত্যসুন্দর তাই মোটেই বিচলিত হলেন না। বিদেশে হোভারক্র্যাফটের চল আরও বেশি। যুদ্ধ, স্বরাষ্ট্র, রিলিফ, নজরদারি, দ্রুতগামী জনপরিবহন- নানাকাজে হোভারক্র্যাফট যথেষ্ট জনপ্রিয় একটি যান। জল আর স্থল তো বটেই, সামান্য এবড়োখেবড়ো ভূতল, কাদা, বরফ সবকিছুর ওপর দিয়েই চলতে পারে এই হোভারক্র্যাফট টি

কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, হালকা নীলাভ এক দ্যুতি ছাড়া হোভারক্র্যাফটির কোথাও কোন তীব্র আলো নেই। হেড  লাইটও জ্বলছে না।

কারণটা পরিষ্কার হল একটু পরেই।

হোভারক্র্যাফটের দরজা খুলে স্যুটেড বুটেড যে মানুষটি নামলেন, নিজের নাম বললেন মাকানাকা। বললেন পরিষ্কার বাংলাতেই। চেহারাও বাঙালিদের মতো। দোহারা। স্ট্রিট লাইটের আলোয় দেখা গেল, গায়ের রংটাও বেশ ময়লা।

একগাল হেসে বললেন, আসুন স্যার- ম্যাডাম।

যাব! কোথায়? কেন? দুজনেই সমস্বরে বলে উঠলেন।

কোন ভয় নেই। আপনাদের কোন ক্ষতি আমরা করব না।

সত্যসুন্দরের উপস্থিত বুদ্ধি প্রখর। ট্রামে বাসে ছোটখাটো পকেটমারি যে তাঁর কোনদিন হয়নি, এমন নয়। কিন্তু কোনদিনই চোর-ডাকাত ছিনতাইবাজের পাল্লায় পড়েননি। এভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে কোন সাধারণ ক্রিমিনাল ছিনতাই করতে আসবে না। ব্যাপারটা বেশ গভীর।

দেখাই যাক না কী হয়।

তিন

বাইরে থেকে হাল্কা নীল আলো দেখা গেলেও, হোভারক্র্যাফটের ভেতরটা যথেষ্ট আলোকিত এবং জায়গাও অনেকটা। ভেতরে ঢুকতেই ডালাটা বন্ধ হয়ে গেল। লাল ভেলভেট পাতা সিঁড়ি, স্টিলের রেলিং ঝকঝক করছে। চমৎকার সোফা। বসলেই আরামে চোখ বুজে আসে। মোটা রঙ্গিন কাচের মধ্য দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে। পাহারাওলাটা আবার এসেছে। মোটা লাঠিটা ঠুকঠুক করে হোভারক্র্যাফটের বডিটা বাজিয়ে দেখছে। এমন কোন যান আগে কখনও সে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। সত্যসুন্দর ধন্দে পড়ে গেলেন। এটা হোভারক্র্যাফট তো, নাকি অন্য কিছু।

ভাবতে না ভাবতেই, বিকট গর্জন করে যানটা চালু হয়ে গেল। সোজা তীব্র গতিতে মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে গেল। নাহ্‌ এটা কখনোই হোভারক্র্যাফট নয়। সত্যসুন্দর বুঝে গেলেন- এটি একটি মহাকাশ যান- তার রকেট ইঞ্জিন চালু হল। খুবই অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। লঞ্চিং প্ল্যাটফর্ম লাগে না।  যে কোন স্থান থেকে এক্কেবারে সোজা নব্বই ডিগ্রি কোণে অর্থাৎ পারপেন্ডিকুলার অবস্থায় আকাশে উঠে যেতে পারে। আলো ধোঁয়া কিচ্ছু নেই। কমপ্রেসড এয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে, আন্দাজ করলেন। এক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব পাহারাওলার মুখটা দেখা গেল- পরের মুহূর্তে কলকাতা শহর- আলো- তারপরেই কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা পৃথিবীটা নজরে পড়ল জানালা দিয়ে।

ইতিমধ্যে মাকানাকার নির্দেশে নয়নতারা এবং তিনি, দুজনেই সিটবেল্ট পরে নিয়েছেন। সামনে মাকানাকা বসেছেন অন্য সোফায়। অবশ্য সিটবেল্ট পরার দরকার ছিল না। একটুও ঝাঁকুনি নেই। একপাশে কফি মেশিন থেকে কফি ঢেলে নিয়ে এসেছেন মাকানাকা।

আমাদের গ্রহে অবশ্য, কফি টফির চল নেই। কিসের যে চল আছে, বলা মুশকিল। তবে আমরা এই যান এবং নিজেদের পৃথিবীর মতো করে বানিয়ে নিয়েছি। নইলে আপনাদের মতো মানুষদের সঙ্গে কথা বলবো কী করে।

মাকানাকার কথায় সত্যসুন্দর বিষম খেতে গিয়েও খেলেন না। শকড্‌ হওয়াটা তার ধাতে নেই। কিন্তু নয়নতারা সেই যানে ওঠার পর থেকে এখনও পর্যন্ত একটি কথাও বলে উঠতে পারেননি। এক্কেবারে পপড আই যাকে বলে। মাঝে একবার সত্যসুন্দরকে চিমটি কেটে দেখলেন, তিনি সামান্য উহ্‌ করে উঠলেন। নিজেকেও চিমটি কেটে দেখলেন, এটা স্বপ্ন নয়।

নিজেদেরকে পৃথিবীর মতো বানিয়ে নিয়েছেন মানে?

নয়নতারার প্রশ্নে মাকানাকা বললেন, ব্যাপারটা খুব সিম্পল। আমাদের গ্রহে প্রাণ বস্তুটি একটি ধারাবাহিক একতা মাত্র।

কীরকম, কীরকম?

মানে আমাদের গ্রহে প্রাণ বলে যা আছে সেটা হলো একটিই প্রাণ- তার নাম মহাপ্রাণ। আমি মাকানাকা, আর দুজন ক্রু-মেম্বার কানাবাচা আর সিমিতিমি, যাদের আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না, কারণ তারা অন্য ঘরে আছে – সবাই কিন্তু সেই মহাপ্রাণের অংশ মাত্র। আমরা খণ্ডপ্রাণ নামেই অভিহিত।   

কী যে বলেন! এমন হয় নাকি?

হয়।

কিরকম।

ব্যাপারটা এই রকম যে, মহাপ্রাণ আসলে একটি বিরাট জীবিত পাল্প বা মণ্ড। এটার একদিক থেকে বিকাশ, বিস্তৃতি ঘটছে, আবার অন্যদিক থেকে বিলীনতা ঘটছে। বাতাসের উপস্থিতিতে জীবদেহে পচন ঘটে। পৃথিবীর মতোই আপনারা আমাদের গ্রহে নিঃশ্বাস নিতে পারবেন, তবুও কোন মৃত মহাপ্রাণের অংশে কোন পচন ধরবে না সেখানে। সম্ভবত আমাদের শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী মৌলগুলো প্রথম থেকেই নেই। জৈবিক, যৌগিক- কোন প্রক্রিয়াতেই পচন ধরার সম্ভাবনা নেই। মৃত্যু নয়, বিলীনতা। মানে মহাপ্রাণের অংশ সম্পূর্ণ মাটিতে রূপান্তরিত হয় এবং মিশে যায়।

কী বলছেন?

ঠিক তাই। পাল্প বা মণ্ডাকৃতি হবার সুবিধে হল এই যে, মহাপ্রাণ থেকে ইচ্ছে মতো অংশ নিয়ে তাঁকে ইচ্ছে মতো আকৃতি ও গুণাবলী দিয়ে খণ্ডপ্রাণ সৃষ্টি করা যায়। আমরা এগুলি সৃষ্টি করি প্রয়োজনভিত্তিক। এই আর্থ মিশন ওয়ান- যাতে আমরা তিনজন খণ্ডপ্রাণ ক্রু-মেম্বার নিয়োজিত হয়েছি পৃথিবী থেকে আপনাদের নিয়ে আসার জন্য, তার জন্য মহাপ্রাণের পাল্প থেকে অংশ নিয়ে আমাদের তিনজনকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের শরীরের আদলে ও গুণাবলি একত্রিত করে। এ এক জটিল জৈববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। আমাদের বিশেষ গবেষণাগারে এই কাজ সম্পন্ন করা হয়।

এত বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থাকতে হঠাৎ মানুষের আদল কেন? পৃথিবীর দিকেই বা নজর কেন। নয়নতারা প্রশ্ন করেন।

চার

এই সময়ে সিমিতিমি ঘরে ঢোকে। পরনে সোনালী সুতোর কাজ করা সিল্কি ব্ল্যাক গাউন। বলে, পৃথিবী আমাদের আদর্শ। এত বৈচিত্র্য। নানা প্রাণী, মানুষ, দেশ, খাদ্য, গাছপালা প্রকৃতি। আমরা যেহেতু নমনীয়, অতএব আমাদের স্বাধীনতা আছে নিজেদের ইচ্ছে মতো ছাঁচে ফেলার আর গড়ে তোলার। আমরা পৃথিবীর ছাঁচটাই গ্রহণ করতে চাই।  

মাকানাকা বলে ওঠেন, সিমিতিমি ঠিকই বলেছে। তবে আমাদের একটা সুবিধে আছে। আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, প্রত্যেকেই মহাপ্রাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা এই যে নানা কথা বলছি, আমাদের কথা বলাচ্ছে কিন্তু মহাপ্রাণ। এই মিশনের জন্য আমাদের সৃষ্টি, গ্রহে ফিরে যাবার পর কিন্তু আমাদের আলাদা অস্তিত্ব আর থাকবে না। আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে মহাপ্রাণের শরীরের লাগোয়া এক ফ্যাক্টরিতে। সেখানে আমরা পাল্পে পরিণত হব নানা প্রক্রিয়ায়। আমাদেরকে মিশিয়ে ফেলা হবে মহাপ্রাণের শরীরে।

আর ঠিক ছ’ঘণ্টা বাদে আমারা ল্যান্ড করব আমাদের গ্রহ সাইলেন্সিয়াতে। কানাবাচা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে।

কথাবার্তা কানে আসছিল। আড্ডা মারার লোভ সামলাতে পারলাম না। অটোপাইলটে রাখা আছে যানকে। চিন্তা নেই। নিখুঁত প্রোগ্রামিং। ল্যান্ডিংএর ঠিক ঘণ্টা দুয়েক আগে ককপিটে ফিরলেই হবে। যা কিছু শব্দ তো এখানেই। সাইলেন্সিয়াতে অক্সিজেন আছে, বাতাসপ্রবাহ নেই। কম্পন আছে কিন্তু তরঙ্গ নেই। কথা বলি আমরা, কিন্তু কেউ শুনতে পাই না। স্পর্শ দিয়ে কম্পন অনুভব করি।

সবই তো বুঝলাম। কিন্তু হঠাৎ আমাদের কেন স্মরণ করলে তোমরা! মেরে ফেলবে না তো।

কী যে বলেন! মৃত্যু বলে কিছু হয় না সাইলেন্সিয়াতে। আগেই বলেছি আমাদের কোন পচন নেই- কাজেই সে অর্থে মৃত্যুও নেই। আমাদের কেবল আছে রূপান্তর। বলে সিমিতিমি।

মিশন শেষে মহাপ্রাণে মিশে গেলেও আমাদের এই মিশন আর প্রতিটি সংলাপ কিন্তু থেকে যাবে মহাস্মৃতিতে, যা ইচ্ছে মতো পুনরুদ্ধার করা যাবে। মাকানাকা বলে ওঠে।

বেশ। আমাদের নিয়ে কী পরিকল্পনা তবে? মহাপ্রাণে মিশিয়ে দেবে?

ঠিক তাই। পৃথিবীর একটি প্রাজ্ঞ দম্পতিকে যদি আমরা মহাপ্রাণের অংশ হিসেবে পেতে পারি তবে আমাদের বিশ্বজ্ঞান সম্পূর্ণ হবে। তিন এলিয়েন- ভিনগ্রহী একসঙ্গে কথা বলে ওঠে।  

নয়নতারা ছকটা ধরে ফেলেন এবার। সন্তান সন্ততি আত্মীয় স্বজনদের কথা মনে পড়ে যায়। ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।

সত্যসুন্দর কিন্তু মুচকি মুচকি হাসেন। প্রকাশ্যে নয়। মনে মনে। তাঁর ইতিকর্তব্য তিনি স্থির করে ফেলেছেন। তাঁদের কোনরকম ক্ষতি করা তো দূরের কথা, বাপ বাপ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না মহাপ্রাণের।

মুখে কিছু প্রকাশ করেন না। কেবল আলগোছে হাত রাখেন নয়নতারার পিঠে। বলেন, কাঁদছো কেন। আমার ওপর ভরসা রাখো।

সিমিতিমিও কাছে আসে। নয়নতারার হাতটা ধরে সান্ত্বনা দেয়। পকেট থেকে বের করে এক ঠোঙ্গা খোসাসুদ্ধ চিনেবাদাম। গরম। ভাপ উঠছে।

পাঁচ

উল্টোদিকে রকেট চালিয়ে যানের গতি স্লথ করা হয়। তবুও ল্যান্ডিংএর সময় একটু ঝাঁকুনি লাগে।

এই গ্রহের তাপমাত্রা জলবায়ু সমস্তই প্রাণ ধারণের উপযোগী। কিন্তু কী এক আশ্চর্য রসায়নে সৃষ্টি হয়েছে মহাপ্রাণ! একীভূত জীবন কিন্তু ইচ্ছামতো বৈচিত্র্যমণ্ডিত করা যায় তাকে।

মহাপ্রাণ সমস্ত জীবনের সমষ্টিও বটে কেন্দ্রবিন্দুও বটে। মহাপ্রাণ শাসক। মহাপ্রাণ শোষিত। তিনি রাজা, প্রজাও তিনি। একটা বিশাল কাচের প্রাসাদে মহাপ্রাণের অধিষ্ঠান। কিছুটা সাইলেন্সিয়ার মাটির ওপরে। কিছুটা মাটির তলায়। কত শত একর জুড়ে বিশাল প্রাসাদ সেটা। যেটুকু দেখা যায় সেটা কেবল ভাসমান শৈলচূড়ার মতো। সামান্যই প্রকাশিত, অধিকাংশই সমাহিত-  নিহিত গ্রহের ভেতরে।

সে এক বিশাল মণ্ড। সর্বদা আলোড়িত হচ্ছে তার অদৃশ্য হৃদপিণ্ড।

এই গ্রহে কোন কোলাহল কানে আসে না। বিচিত্র আকারের প্রাণ আর যানবাহন ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাছপালাও তথৈবচ। কিছু কিছু চেনা চেনা লাগছে, কিছু অচেনা। মহাপ্রাণের নানা বিভাগ। আলাদা আলাদা ঘর সব। সাইনবোর্ড, পথনির্দেশ। অনেকটাই  পৃথিবীর মতো। প্রতি মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে, সংগৃহীত হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই পাল্টা নির্দেশ দিচ্ছেন মহাপ্রাণ। সে নির্দেশ পালিত হচ্ছে এক্সিকিউশন রুমে। এক একটি মিশন শেষে ফিরে আসছে খণ্ডপ্রাণেরা। মহাপ্রাণের নির্দেশ গ্রহণ করছে। নিজেদের সমস্ত ঘটনা আর স্মৃতি সমর্পণ করছে মহাপ্রাণের কাছে। সমস্ত নিঃশেষ করে তারা মণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে মিশে যাচ্ছে মহাপ্রাণের শরীরে। অপেক্ষায় থাকছে আবার কখন নতুন দেহ ধারণ করে এই ব্রহ্মাণ্ডের কোন সুদূরে আবার কোন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হতে হবে তাদের।

কালবিলম্ব না করে একটি ঘরে সপার্ষদ ঢুকে গেলেন মাকানাকা। ইশারায় ডেকে নিলেন সত্যসুন্দর আর নয়নতারাকে।

অনতিবিলম্বেই ডাক পড়ল তিনজনের। অটোম্যাটিক ট্রানস্লেটরের মাধ্যমে কথাবার্তা ভেসে এল হেডফোনে। মহাপ্রাণ বনাম মাকানাকা।

হে মহাপ্রাণ! মহাশক্তি, মহাজীবন! আরব্ধ কর্ম করিয়াছি সমাপন!

কই ডাকো তাদের।

গুটিগুটি পায়ে মহাপ্রাণের সামনে দাঁড়ান সত্যসুন্দর। মহাপ্রাণের পুরো শরীর দেখা যায় না। সামান্য একফালি কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে তাঁর পর্যায়ক্রমে প্রসারণশীল এবং সংকোচনশীল শরীরের অংশবিশেষ। হৃৎপিণ্ডের লাবডুব শুনতে পাচ্ছেন তিনি।

আপনারা তো জানেন, কি উদ্দেশ্যে আপনারা এখানে আনিত হয়েছেন। অব্যবহিত পরেই আপনাদের বিলীন হয়ে যেতে হবে আমার শরীরে। সে এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা হবে। আমরা উভয়পক্ষই সমৃদ্ধ হব তার ফলে।  এই বিশাল গ্রহ আর এর অনন্ত প্রাণের শরিক হয়ে যাবেন আপনারা নশ্বর মানুষ। আপনাদের শরীর আগের মত থাকবে না বটে, কিন্তু আপনাদের সম্পূর্ণ সত্তা বিরাজিত হবে মহাপ্রাণে। কি। আপত্তি আছে কোন?

আপত্তি? না আপত্তি থাকবে কেন। কিন্তু সেখানেই তো অশান্তি হয়ে যাবে, মহামহিম।

কেন? কী হবে?

আজ্ঞে হুজুর, পৃথিবীর নানা অসুখ। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ অসুস্থ। এ ওর হাতের ছোঁয়া খেতে চায় না। সে তাকে দেখলেই হত্যা করে অকারণে। গ্রামের পর গ্রাম, জ্বালিয়ে দেয়। ধর্মস্থান পুড়িয়ে দেয় জ্বালিয়ে দেয়। উগ্রপন্থীরা বোমা মেরে, গাড়ি চাপা দিয়ে নিরীহদের মেরে ফেলে। রাস্তায়, খালে বিলে যত্রতত্র পরে থাকে নারী আর বালিকার লাশ। আর হুজুর, মানুষ পারলে বাপকেও বেচে দেয়। বেচে দেয় জলাভূমি জমি খনি বালি মাটি খাদান বাবা বৌ মেয়ে বোন- সব কিছু। নিজেরাই নিজেদের এমনভাবে মারে, মানুষ ছাড়া দ্বিতীয় কোন জাত পাবেন না তুলনা করার।

বলেন কী? এতটা তো জানতাম না। আমরা তো মানুষকেই আদর্শ মনে করে আপনাদের গ্রহণ করব বলে ভেবেছিলাম।

ক্ষ্যামা দ্যান প্রভু। আমাদের আর গ্রহণ করতে হবে না। আমরা এই যে কত্তা গিন্নি সিনিয়র সিটিজেন, আজ পর্যন্ত নিজেরাই একসঙ্গে থাকতে পারলাম না। এতটুকু সমঝোতা নেই। দুজনে এই বৃদ্ধ বয়েসে আলাদা আলাদা থাকি।

সত্যিই ভাবালেন তো। আপনাদের নিয়ে আমাদের তো লাভ হবে না কোন। বিভাজনে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে সাইলেন্সিয়া। না বাপু, দরকার নেই। ওরে কে আছিস?  মাকানাকা—-।

হুজুর!

যা এঁদের রেখে দিয়ে আয় যেখান থেকে এনেছিলি সেখানে।

যাচ্ছি হুজুর। একটা আর্জি ছিল।

কী?

আমাদেরও পৃথিবীতে থাকতে হুকুম দিন।

কেন?

আমরা সেখানকার হালচাল দেখব আর রিপোর্টিং করবো।

বুঝেছি, তোদের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছে হয়েছে! না না আমার কোন রিপোর্টিং দরকার নেই। তোরা যেতে চাস যা, আমি ত্যাজ্য করলাম, ওখানেই থাক, আর ফিরিস না।

-সমাপ্ত-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *