শব্দদের গায়ে দেখি মিথ্যে লেগে আছে। কিছুতেই থিতু হতে দেবে না, ভালোবেসে খুলে দিচ্ছ এক একটি খোঁদল, গর্তমুখ, থুবড়ে পড়ছি, বলছ —যেতে হবে। যাব —- নিশ্চিত ভাবেই যাব, বিষম খাড়াই পথ,ভিজে যাচ্ছি রক্তস্বেদে, ভালোবাসা, তুমি অন্তিম নিগ্রহ, দ্যাখো আদ্যন্ত শরীরে দাগ, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছি, ক্রুশকাঠ কাঁধে। ? কোনও বাঁকে যখন দেখেছি দূর থেকে জলসত্র, হয়ত-বা পান্থশালা,একটুখানি জিরিয়ে নেব, পিঠে এঁকে দিচ্ছ উল্কি, আহো চাবুকের বাড়ি তোমাকে প্রণাম করি, ক্ষমা করো, যদি-বা ককিয়ে উঠি কভু। অন্তরিক্ষলোক থেকে ‘কভু’ এই প্রাচীন শব্দটি উড়ে এল, এই যে ব্যথা আর্কিটাইপাল, এই যে বিদ্যুৎ ও মেঘ ধুয়ে দেবে করতল, পা’জোড়ায় লেগে থাকা পেরেকের ক্ষত, এই যে খুলে দিচ্ছ সামনে আলোকিত ল্যম্পপোস্টটির নীচে কত-না আঁধার, গলি,বাইলেন, চোরা পথ,প্রভু সজোরে নাড়িয়ে দিচ্ছ, যখন থিতিয়ে পড়ি, দাঁড়াই ক্ষণিক, পান্থপাদপের নীচে।
যতদূর হাঁটি, পাকেচক্রে নিজেকে অন্য প্রাণী মনে হয়। মানুষের সমস্ত শাখায় ঈশ্বরের নির্বোধ জন্ম দেখি, চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের মৃত্যু দেখি আমি। ঠিক সেসময় মধ্যবিত্তের অসংখ্য পাঁচিলে মেঘ জমে; আরও এক ঈশ্বরের অসুখ, আরও এক ধর্ম-বইয়ের বিষাদ ঢোকে ঘরে। সেই থেকে… মানুষের জ্যামিতিক অধিকার নিয়ে ফুটবল খেলে ধর্ম, আর আমি ভাঙতে ভাঙতে ভিটেমাটি বিক্রি করি। তারপর আমাদের আনন্দ-মৃত্যুর ভিতর আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রেমের কবিতা হয়ে থাকি, কবিতা ঠোঁটে পাগলামি করি পৃথিবীর আশ্চর্য গলিতে। এই মুহূর্তে কোন মিছিল নয়, হাতে পায়ে শান্তি অমরত্ব পাক, এক পরিচ্ছন্ন ঘুমের জন্য আমার শোষণ-মুক্ত শিরদাঁড়া চাই।
কুহুক্লান্ত কোকিলের আত্মকথায় নোঙর আমাদের সব পাতা-ঝরা প্রবণতার। সে আসে তবু ফাল্গুন ফিকে হয়ে যায় ধুঁকে ধুঁকে চৈত্র; আবহমান এই কুৎসিত জলসায় জ্বলে আর নেভে নেভে আর জ্বলে রূপনীল-রূপলাল হাউজ। একদিন এভাবে ঝরে যাব ঋতুহীন; স্বপ্নে সমাধির জতুগৃহ বসন্তসবুজ।
প্রেমিক ছিলে না বলে, হাত ধরে রেখেছিলে সামান্য প্রার্থনাও রাখিনি কখনও …তবু সেই ‘দেবী’ সম্বোধন জারি ছিল আজীবন। কাকে লোকে দেবী বলে? কাকে দেয় পদ্মের আসন ? আমিও জানি। রাস্তা পার করেছিলে আর সেইসব দুপুরপাগল ফুল ফুটলে, দিয়ে যেতে ঝুড়ি ভরে। তুমিও জানতে না, আমার ফুলদানী নেই এমনকী মাটির কলসীও। তাই জলও পাওনি তুমি… একে একে আলো হারিয়েছ হারিয়েছ জলসার টিকিট,পশমের সোয়েটার, রেলের পাস শেষ অব্দি শুধু নদীটুকু ছিল…আর এক নাছোড় শীত এইসব অধিকার নিয়ে লীন হয়ে যাওয়া কেবল এক কবির নিয়তি …তুমি সেই কবি…প্রেমিক ছিলে না বলে এত প্রিয় …এত বেশী প্রিয়।
এমন সন্ধে আদরে যায় ভেসে, সাক্ষী দেবদারু,ছায়াপথে পাতার কারুকাজ স্বপ্নের দীপাবলি,শহর জুড়ে আলোর মালা,মায়াপ্রদীপ দূরের বারান্দায় কথার পিঠে কথা,ফুরন্ত সময় কোলাহলের বাঁকে মাঝেসাঝে চুপ সন্ধে ছড়ায় নেশাগন্ধ নরম অন্ধকারে,পাখির উড়ান পেতে চায় চোখ দূরে উজ্জ্বল রাতের ইশারায় অচেনা বাড়ি,ওখানে পৌঁছতে হবে একদিন। নিষেধ-পরিধি পেরিয়ে কেন যাব, চেনা দূরত্বের মুগ্ধতায় টুপটাপ ঝরে কথা সিন্থেসাইজারের রিডে আঙুল ছোঁওয়া যেত যদি, লহমায় শেষ হবে সব গান এই ভালো কিছু দূরে থাকা,কাছে গেলে ভুল সুরে ছন্দ ভেঙে যায় বুঝি পাশাপাশি হেঁটে গেলে রাগ আশাবরী, আমি তার মগ্ন শ্রোতা শান্তশ্রী সন্ধে অষ্ফুটে বলে যায় বারবার এভাবেই আচ্ছন্ন থাকে যেন আশ্চর্য সকাল আর গোলাপি বিকেল সব। নিওন আলোর সন্ধে নেমেছে হৃদিজলে আজ জল জানে নিভৃত গোপন,রেখার আঁচড়ে কীভাবে নষ্টজন্ম শিল্প হতে শেখে মুগ্ধতার সীমানায় দাঁড়িয়ে থেকো সন্ধ্যাপথ,ঘুমঘোর রাত আপ্লুত কারও সুরে…
এখানে ধূসর আলো লেগে থাকে দুপুরের গায়ে ক্ষীণতোয়া নদী এক অথবা নদীর মতো মেয়ে চওড়া হয়ে এলোচুলে অবসন্ন শরীর দিয়েছে ঢেলে। হেমন্তের কমরৌদ্রে পাতাদের মৃত্যুযাত্রা আলতা মাখা পায়ে তাদের দেহের নীচে শুয়ে আছে রুদ্ধশ্বাস প্রবীণ হলদে ঘাস বুকে নিয়ে কোমল পরশ – পদচিহ্ন, তোমার হেটে যাওয়ার। ভালোবেসে ফেলেছিলে পা সময়ের অভ্যন্তরে গহীন জাফরী কাটা রোদ আর রোদের অলস ছোঁয়া তোমার চোখের পাতা বাদামি রঙিন। অযত্নে আঁকা কাঠের বেঞ্চ হাওয়াদের সরিয়ে তুমি বসলে যখন আমার শরীরমনে অপরাহ্ন এলো, অন্তরঙ্গে একলা যাপন। ওগো মেয়ে, ওগো নদী – কালির হরফে ছবি আঁকা যেতো যদি সিঁড়ির অনেক নিচে কবিদের ভিড়ে ছাপা হতো বিষাদের নীল জলছবি। দধি মঙ্গল হয়ে গেছে কবে এখন হেমন্ত এসেছে নেমে খোলাচুল নদীদের ঘরে এবার বাসর রচো ঝরে পড়া পাতাদের বিবর্ণ বিছানায় রূপকথা লেখা থাক পরিযায়ী পাখিদের আকাশি ডানায়|
না হয় উহ্য থাক এসব গোপন ভালোলাগা উপত্যকার ঢাল— বেহাগের শেষ সিঁড়ি— মোহর-কাহন! বারশিঙ্গা, ম্যকাওরা ক্ষীণ হতে হতে বিপাশার তীরে… বিতস্তার ধার ঘেঁষে —- নিদ্রাকালে অনিচ্ছুক—- বিয়েতে অনিচ্ছুক সারস-সারসী; দুই জমি ধান নেবে— কিছু আনাজপাতি, চা-পাতা, গ্রীন কফি, মৌরীর ফুল! অনভ্যস্ত সহবাসে আবারও জোয়ার… যে দেশ শীতল হয় তার প্রান্তে বনভূমি, আঙুরের থোকা তাপসী মূর্তিমতী— ঘন নীর… ঘন পাতা… অপর্ণা, অপর্ণা! বিক্ষত মরালগ্রীবা, মানবিক নয় অজস্র চাঁদ ভেঙে বেড়ে দেয় কলাইয়ের ডাল নিম ওড়ে পাড় ভেঙে— গভীর আড়াল! পদাবলি শেষ হলে অপ্রেমিকের দোষ-গুণ সব বিশীর্ণপ্রায়, মিলিয়ে যায়—- সেখানে থেকে থেকে মোচড়ায় নিষ্ঠুর মীড়…
আমার প্রতিটি স্বপ্নের ভেতর ডুব সাঁতার দেয় একটা ফিনিক্স পাখি ; তার বুকের ওমে তপ্ত হতে থাকে বুক, অতঃপর চোখে সন্ধ্যা নামে…. অগোচরে ধানের শীষে বাড়ে শরীরের বয়স, অভাবী চাঁদের আলোয় পাতকুয়োর গভীরে ঘুমন্ত জোয়ার মরণের ইঙ্গিত দেয় ; ঘোর লাগা নিয়ন জ্বলা সন্ধ্যায় কয়েকগাছা মনখারাপি পেরিয়ে পাহাড়ের অতল খাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে মন আর নিষিদ্ধ সুখের দ্বন্দ্ব, দেখি চতুর্দিকে মানববোমা বাঁধা হচ্ছে সচেতন ভাবে; তোড়ে বুকের অনুভূতি ছিটকে বেড়িয়ে আসতে চায় রক্তমাখা কবিতার মতো…. তারপর ছত্রভঙ্গ বারুদ যৌবন ফিনিক্স পাখির পালক থেকে উড়ে আসা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সন্তর্পণে উড়ান দেয় বৃক্ষশোভিত শৈশবের দিকে ; বহুদূরে প্রাচীন বৃক্ষের মতো একা একা বাঁচে আমার মা ; ফিরি তার কাছে । কারন গুনিতক হারে বেড়ে ওঠা বৃক্ষের ঋজুতা আমায় আদর শেখায় জীবনের প্রতি।