সোলমেট
ভোর রাতে, টয়লেট যাবার প্রয়োজন হওয়াতে ঘুম ভেঙে গেল সোহাগের। টয়লেট থেকে ফিরে আসার পর, আর ঘুম এলনা তার। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি ক্রমাগত খোঁচাতে থাকলে শান্তিতে ঘুমানো যায় কখনো! প্রথম রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকার জন্য, কিন্তু এখন ক্লান্তিটা কেটে যাওয়া অস্বস্তিটা আবার ফিরে এসেছে। বিছানায় শুয়ে, গত রাতের ঘটনা গুলো আবার তার চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে ওঠে। সাহিলের হঠাৎ করে তাকে জড়িয়ে ধরা, আদর করার ব্যাপারগুলোতে তার মনে একটা অশান্তি কাজ করছে। ঠিক যেন হিসাবটা মিলছে না, দুইয়ে দুইয়ে বারবারই পাঁচ হচ্ছে, কখনো চার হচ্ছে না। যদিও, এমন অযাচিত ভাবে ঈশান ও একদিন তাকে জড়িয়ে ধরেছিল, আদর করেছিল, সেই এক বৃষ্টির গন্ধ মাখা সন্ধ্যায় কিন্তু তার জন্য ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। কেউই মুখে না বললেও, তারা দুজনেই জানত পরস্পরকে কত ভালোবাসে, কতটা চায় তারা! তাই ওই ঘটনাটা যে কোনো দিনই ঘটতে পারত, ভালোবাসার শরীরি বহিঃপ্রকাশ ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।কিন্তু গতকাল রাতের ঘটনার কোনো তলই খুঁজে পাচ্ছে না সে। যদিও সাহিল স্বীকার করেছে, সে সোহাগকে ভালোবাসে, কিন্তু তবুও যেন কোথাও একটা কাঁটার খচখচানি থেকেই যাচ্ছে। ভালোবাসার যাত্রা চিরদিনই মন থেকে শরীরে হয়, এমনটা দেখেই সে অভ্যস্ত, কিন্তু শরীর থেকে মনে, এমন উল্টো চলন সে কখনও দেখে নি, এমন যে হতে পারে, সেটা ভাবেও নি। তাই তার মনে বার বার সংশয় উঁকি দিচ্ছে, সাহিলকে কি তবে সে ভুল চিনেছিল? তাকে যেমন সৎ, ভালোমানুষ ভেবেছিল, সেটা কি তবে ঠিক নয়? বাড়িতে তাকে একা পাওয়ার পুরোদস্তুর ফায়দা ওঠাতে চাইছিল কি সাহিল?মনে এমন একটা ভাবনা উঁকি দিয়ে গেলেও, মন আবার সেটাকেও মানতে পারছিল না। কারণ যতটুকু সে চিনেছে সাহিলকে, তাতে তাকে এমন খারাপ মানুষ কখনো মনে হয়নি। সবচাইতে যে ব্যাপারটা তাকে বেশী ভাবাচ্ছে, সেটা হল, গোটা বিষয়টাতে, তার নিজের ইনভলভমেন্ট। সে ও যে নিজের অজান্তে ঢুকে পড়েছিল, কখন যেন ঘটনাটার মধ্যে, তার মনও জড়িয়ে গেছিল, উপভোগ করেছিল সাহিলের আদরের স্পর্শ, সে কথা তো নিজের কাছে অস্বীকার করার উপায় নেই! তা না হলে, কেন সে বাধা দিতে পারেনি সাহিলকে? সাহিল যা করেছে, তাকে অসভ্যতা মনে করে, কেন সেভাবে রিঅ্যাক্ট করতে পারেনি? এত কিছু হয়ে যাবার পর ও যত্ন করে খাইয়েছে সাহিলকে, যেন ব্যাপারটা খুবই সাধারণ, হবারই ছিল।এই সোহাগকে সে নিজেই চিনতে পারছে না, আর এটাই তার সবচেয়ে বেশী সমস্যা হচ্ছে। যদিও, কেউ তার শরীরকে স্পর্শ করলে, তার শরীর ময়লা হয়ে গেল, অপবিত্র হয়ে গেল, এই জাতীয় ভাবনায় সে কোনোদিনই বিশ্বাসী নয়। কারণ সে বিশ্বাস করে, কোনোকিছু যদি ময়লা হয়, অপবিত্র হয়, তবে সেটা হল মন। শরীরে তো কোনো কিছু লেগে থাকে না, কিন্তু মনে সব কিছুই দাগ রেখে যায়। কিন্তু কালকের ঘটনাটাকে, সে কোনো ভাবনা দিয়েই নিজের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারছে না।সাহিলকে সে পছন্দ করে ঠিকই; কিন্তু বিশেষ ভাবে ভালোবাসে কি না, সেটা কখনো ভেবে দেখেনি, ভাবার দরকার ও পড়েনি। আর সাহিল তার প্রেমে পড়েছে, এমন ঈঙ্গিত ও কখনো সে পায়নি ওর তরফ থেকে। তাহলে? যে ব্যাপারটা ঘটল, সেটা কি শুধু শরীরের টান? হঠাৎ করে চলে আসা জোয়ার? কিন্তু সেটাই বা কেন? ভেবে ভেবে কোনো কুল কিনারাই পাচ্ছিল না সোহাগ।আর ঘুম আসবে না বুঝতে পেরে, বিছানা ছাড়ল সে। খুব ইচ্ছা করছিল সাহিলের সঙ্গে একটু কথা বলতে, কথা বলে মাথার মধ্যে পাকিয়ে থাকা জটটা ছাড়িয়ে নিতে। না হলে কোনো কাজেই মন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আলো তখনও ভালো করে ফোটেনি, সবে মাত্র আকাশ ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে, এই সময়ে কাউকে ফোন করা যায় না। ফোন করার জন্য অন্ততঃ ভালো করে দিনটা শুরু হওয়া জরুরী। মাথাটা ছাড়ানোর জন্য, কিচেনে গিয়ে কড়া করে চা বানায়, তারপর চা এর কাপটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে সে।ভোরের আলো-আঁধারিতে, বাড়ির সামনের চেনা রাস্তাটাকেও কেমন অচেনা, নতুন নতুন লাগছিল তার। মনে হচ্ছিল, নিজের বাড়ি নয়, অন্য কোথাও বেড়াতে এসেছে সে। ভোরের ঠান্ডা হাওয়া চোখে মুখে লাগাতে বেশ ফ্রেশ লাগছিল, না ঘুমানোর ক্লান্তি কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎই তার মাথায় একটা ভাবনা এল ধুমকেতুর মত! যদি পরিস্থিতি প্রেক্ষাপটের সাপেক্ষে চেনা জিনিস অচেনা হয়ে যায়, তাহলে অচেনা-ই বা চেনা হবে না কেন? চেনা আর অচেনার মাঝে আছে একটা পাতলা পর্দার ব্যবধান, যেকোনো সময়েই সেই ব্যবধানটা সরে যেতে পারে! তখন চেনা হয়ে যায় অচেনা আর অচেনা হয়ে যায় চেনা।ঠিক সাতটায় ফোনটা বেজে উঠল সোহাগের। সাহিলের ফোন। ফোনটা ধরতেই ও প্রান্ত বলে উঠল, -”ম্যাডাম, রাতে ঘুম হয়েছে তো?” -”একদম ভালো হয়নি, ছেঁড়া ছেঁড়া। সেটাও ভোরের দিকে ভেঙে গেল, আর এলনা।”একটু সময় চুপ করে থাকে সাহিল। তারপরে বলে, -”আমি ভীষণ দুঃখিত। তোমার এরকম খারাপ লাগবে বুঝতে পারলে, আমি এটা করতাম না।” -”তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে সাহিল, অনেক কিছু জানার আছে।” -”বেশ তো, বলো কি জানতে চাও?” -”না এখন বলব না, সামনাসামনি বলব। কখন সময় হবে তোমার?” -”তোমার কলেজ?” -”যাব না আজ। ভালো লাগছে না শরীরটা।” -”তাহলে, বাড়ির বাজারটা করে দিয়েই আসছি। ভাইকে বলছি আজকে দোকানটা খুলতে।” -”ঠিক আছে। তাই এসো।” ফোনটা ছেড়ে দিয়ে সোহাগ ভাবে, তার মত সাহিলও তবে রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারেনি। না হলে সকাল সাতটা বাজতে না বাজতে কিভাবে ফোন করে সে? হতে পারে, সোহাগের মত সেও ভোররাতে বিছানা ছেড়েছে, আর ছটফট করেছে, কখন সকাল হবে, আর সোহাগের সঙ্গে কথা বলতে পারবে।এমনিতে সকাল সকাল স্নান সেরে নেওয়া অভ্যাস সোহাগের, কিন্তু আজ আর ভালোলাগছিল না কোনো কিছু করতে, তাই বসেই ছিল চুপচাপ। সাহিলের ফোনটা আসার পর কিছুটা উদ্যম পেল সে, তাই উঠে বাথরুমে ঢুকলো। সাহিল আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই এসে পড়বে; ও আসার আগে ফ্রেশ হয়ে নিতে হবে, পোশাক ছাড়তে হবে; রাত পোশাকে তো আর ওর সামনে বের হওয়া যাবে না।সাহিলকে যে প্রশ্নগুলো করবে, সেগুলো বাথরুমে বসেই মনে মনে সাজিয়ে নিতে থাকল সোহাগ। সমস্ত সংশয় দূর করে নিতে হবে সামনাসামনি বসে। জীবনে অনেকগুলো ভুল করে ফেলেছে সে, আর নতুন কোনো ভুলে জড়িয়ে পড়ার আগ্রহ নেই তার। যদিও হিসাব করে জীবন কাটানোর পক্ষপাতী যে কোনো দিনই ছিল না, আর এখনও নয়; জীবন তো মুদির দোকানের মাসকাবারি হিসাবের খাতা নয়, যে প্রতিটা পাই পয়সার হিসাব মেলাতে হবে! তবুও এক একটা ভুলের হিসাব তাকে অনেক অনেক চোখের জলে মেটাতে হয়েছে বলে, এবার সে একটু সতর্ক হতে চায়, সাবধানী হতে চায়! সেই জন্যই সে ডেকেছে সাহিলকে আজ, সোহাগের বিশ্বাস, সামনাসামনি কথা বললে, সাহিলকে বুঝতে সুবিধা হবে তার, সত্য গোপন করতে পারবে না সে।সাহিল যতটা তাড়াতাড়ি আসবে বলে ভেবেছিল সোহাগ, তার চাইতেও তাড়াতাড়ি এলো সে। দরজা খুলে, সাহিলকে দেখে, খুব খারাপ লাগল সোহাগের। আগের দিন রাতে যে সাদা পাঞ্জাবীটা পরে এসেছিল, সেটাই পরে রয়েছে সে তখনো, কিন্তু সেটা এমন কুঁচকে গেছে, মনে হচ্ছে, ওটা না ছেড়েই গত রাতে বিছানাতে গেছে ও। পাঞ্জাবীর থেকেও করুণ অবস্থা ওর মুখের। চোখে মুখে না ঘুমানোর ছাপ স্পষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে, ওর ওপর দিয়ে ভীষণ একটা ঝড় বয়ে গেছে। -”ভেতরে এসো” সোহাগ ডেকে নেয় ওকে। ওর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন সোহাগ না ডাকলে ভেতরে ঢুকবে না ও। ভেতরে ঢোকার পর চুপচাপ বসে পড়ে সাহিল, মাথা নিচু করে। ওর ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছিল সোহাগের, এখুনি যেন ওকে খুনের সাজা শোনানো হবে, আর সেটা শোনার জন্য সে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর অবস্থা দেখে সোহাগের কষ্ট হল খুব, নরম স্বরে সে ডাকল,-‘সাহিল!এতক্ষণে মুখ তুলে তাকায় সাহিল। তারপর কোনোরকমে ঢোঁক গিলে বলে, -”কাল রাতে আমি যা করে ফেলেছি তার জন্য তোমার যদি খারাপ লেগে থাকে, তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ!”সোহাগ কিছু বলে না। সাহিল যা বলতে চায়, ওকে আগে সেটা বলে নিতে দেয়। -”জানি না, কেন এমন করলাম। তুমি ভাবছ হয়ত, আমি এরকম স্বভাবেরই, তোমাকে বাড়িতে একা পাওয়ার সুযোগটা কাজে লাগালাম। কিন্তু বিশ্বাস কর, কোনো দিন, কোনো মেয়ের সাথে এরকম কিছু করা তো দূরে থাক, কখনও হাতটুকু ও ধরিনি কারো! কাল যে কি হয়ে গেল! আমি রাতে ঘুমোতে পারিনি সোহাগ, বিশ্বাস কর।”সাহিলের আকুতি সোহাগের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। তার মনে হল সাহিলকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণই নেই। সে লঘুস্বরে বলল, ‘বিশ্বাস করলাম’। -”কি বিশ্বাস করলে?” -”বিশ্বাস করলাম এই যে, তুমি কাল রাতে ঘুমোও নি।”। -”ঠাট্টা করছ সোহাগ?” -”না,না, ঠাট্টা কেন করব? তোমার মুখ চোখই বলে দিচ্ছে, কাল রাতে তুমি ঘুমোওনি।” -”তুমি আমাকে খারাপ ভাবছ না তো?” -”সেকথা পরে হবে। আগে তুমি আমার প্রশ্ন গুলোর উত্তর দাও।” -”হ্যাঁ, হ্যাঁ, কর তোমার প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতেই তো আসা।” -”করব। তার আগে তুমি একটু চোখমুখে জল দাও। আমি চা আনছি। চা খেয়ে নার্ভগুলোকে একটু স্ট্রং করে নাও। তারপর সওয়াল জবাব হবে।” সকালে সাহিল আসার পর, ওকে সামনাসামনি দেখে সোহাগের মনের ভার অনেকটাই কমে গেছিল। সে যে মিথ্যা কথা বলছে না, তার প্রমাণ তার মুখে চোখেই প্রকাশ পাচ্ছে। সোহাগের মনে হল, আর যাই হোক, সাহিল সুযোগ সন্ধানী নয়। গতরাতে, যদি সে সুযোগের সদ্ব্যব্যবহারই করবে, তবে তার কেন মনের ওপর চাপ পড়বে? কেনই বা সে ভালো করে ঘুমোতে পারবে না রাতে? সোহাগ যদি ওর ব্যবহারে ওকে খারাপ মনে করে, ওর সঙ্গে সম্পর্ক না রাখে আর সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তির তাতে কীই বা যায় আসে? এক সোহাগ যাবে, আর এক সোহাগ আসবে। যেখানে, ভালোবাসা বা ভালোলাগাটা শুধুমাত্র চামড়ার সঙ্গে হয়, কোনো গভীরতা থাকে না, সেখানে তো কষ্ট পাবার কোনো বালাই থাকে না! কিন্তু চামড়া, মাংস, হাড়ের পরত পেরিয়ে, ভালোবাসা যখন আরো গভীরে যায়, তখনই তার সঙ্গে আসে কষ্টের রিনরিনে একটা অনুভূতি, একটা হারিয়ে ফেলার ভয়। সাহিলের মুখে চোখে, সেই কষ্টের ছাপ প্রকট।চা বানাতে বানাতে, সোহাগ ভাবে, যেকোনো মানুষকে তার জীবনে এত বেশী জটিল মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়, কিংবা এত বেশীবার বিশ্বাস করে ঠকতে হয়, যে, যদি কোনো সহজ সরল মানুষ, খোলামেলাভাবে সবটুকু নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় কখনো, তখন তাকে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। তার সরলতা, তার সহজ স্বভাবকে তখন মনে হয় ভান, যার আড়ালে রয়েছে ছদ্মবেশী অনিষ্টকারী। মুখে চোখে জল দিয়ে, চা খেয়ে, সত্যিই সাহিল একটু ধাতস্থ হল। তাছাড়া এখানে আসার পর খানিকটা সময় পার হয়ে যাবার পরও যখন তার মুন্ডুটা ধড়ের ওপরেই থেকে গেলো, তখন সে খানিকটা স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ ফিরে পেল। সোহাগ ডাকার পর, বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে যখন এ বাড়ির দিকে রওনা দেয়, তখনও জানে না, সোহাগ কোন অস্ত্র শানিয়ে রেখেছে তার জন্য। নিজের কাজের জন্য অনুতাপ তো ছিলই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অসম্মানিত হবার ভয়, সোহাগকে চিরদিনের জন্য হারানোর ভয়। প্রথম ধাক্কায় যখন এরকম কিছুই ঘটল না, তখন সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকল।চা খাওয়া শেষ করে সাহিল জিজ্ঞাসা করল, ”এবার বল কি জানতে চাও?”সোহাগ একথার কোনো উত্তর দিল না। উল্টে তাকে প্রশ্ন করল, ”বাজার যাওনি তুমি?” -”কেন বলতো?” -”বাজারে গেলে, এত তাড়াতাড়ি তো এখানে আসতে পারতে না, তাই জিজ্ঞাসা করছি।” -”না, আজ ভাইকে পাঠালামা আসলে ভীষণ টেনশনে আছি তো, তোমার সাথে তাড়াতাড়ি দেখা করাটা আগে দরকার। বাজারে গেলে অনেকটা দেরী হয়ে যেত, তাই- -”এখন আর নেই তো?” -”কি?” -”টেনশন?”হেসে ফেলে সাহিল। বাড়িতে আসার পরে এই প্রথমবার হাসে। হাসলে ওকে দেখতে খুব ভালো লাগে। হাসি সংক্রামক, তাই সোহাগ ও হাসে। হাসির সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের শক্ত হয়ে যাওয়া পেশীগুলো যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। -”আছে তো টেনশন! এখনও প্রশ্নপত্রই হাতে পেলাম না যে। কটা উত্তর দিতে পারব, কটা পারব না, পাশ করব না ফেল করব, এখনও তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”সহজভাবে কথাগুলো বলে সাহিল। এই সহজ ব্যাপারটাই ওর আইডেনটিটি। ওকে আবার আগের মত সহজ হতে দেখে, সোহাগের ভালোলাগে। ও নিজেও সহজ হতে পারে। টেনশন থাকলে যে কোনো কাজই ভন্ডুল হয়, আলোচনা ও। -”আমার সব প্রশ্নের সত্যি উত্তর দেবে তো?” -”তোমাকে কোনো দিন কোনো মিথ্যা বলিনি সোহাগ, এখনও বলব না।” -‘তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো?” -”হ্যাঁ।” -”কবে থেকে?” -”তা ঠিক ভাবে বলতে পারব না। তবে যেদিন থেকে তোমার সাথে মিশছি, প্রতিদিনই একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছি বোধহয়, আসলে কালকের আগে, ব্যাপারটা নিয়ে কখনো আলাদা করে ভাবি নি।” -”আমাকে বল নি কেন?” -”ক্ষেপেছ! তোমাকে একথা বলা যায়? কোথায় তুমি, আর কোথায় আমি! তোমার কত পড়াশোনা, আর আমি মাধ্যমিক! তুমি পড়াও কলেজে, আর আমি ওষুধ বেচি। তোমার পরিবার কত উঁচু, আর আমার পরিবার কোথায়! আর তাছাড়া- -”তাছাড়া কি?” -”তুমি হিন্দু, আমি মুসলিম। আমাদের এত পার্থক্য। তুমি কখনোই আমাকে মানতে পারবে না। কারণ ভালোবাসা হয় সমানে সমানে।” -”বাঃ! চমৎকার বুদ্ধি তো তোমার! ভালোবাসলে, অথচ জানালে না! তাহলে, এর পরিণতি কি?” -পরিণতির কথা তো কিছু ভাবিনি আমি। তাছাড়া, দুনিয়ার সবকিছুরই কি পরিণতি থাকে? সব গল্পের কি শেষ এভাবে হয়-”আফটার দিস্, দে লিভড ইন পিস।” ছোটবেলায় আব্বা শিখিয়েছিলেন, সব কিছুর শেষ খুঁজতে নেই, মানুষের জীবনের তো নয়ই। জীবন তো আর একটা সাজানো গোছানো রূপকথার গল্প নয়, যে তার একটা সুন্দর শেষ থাকবে, যা দেখে মন ভরে যাবে! তাই যদি হতো সোহাগ তাহলে এত রক্তারক্তি করে দেশভাগ করে নেবার পরিণতিটাও তো সুন্দর হতো, তাই না? কিন্তু তা তো হয়নি! আব্বার কাছে শুনেছি, সব পেয়েছির দেশের খোয়াব দেখে যারা ঘর ছেড়েছিল, পাকিস্থানে গিয়ে তারা সবাই আমীর বনে যায়নি। বরং এদেশে তারা যেমন ছিল, তার থেকেও খারাপ অবস্থায় দিন গুজরান করছে। তারপর আমার দাদাজির কথাই ধরো! সারাটা জীবন দেশের সেবা করেছে, দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনের সবটুকু দিয়েছে, তার পরিণতি কি হয়েছে? চোখের সামনে দাদিকে, ছেলেকে মরতে দেখেছে, ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে। তাই কোনো কিছুই পরিণতি খুঁজতে যাই না আমি। যখন যা পাই, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি।”সোহাগ মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল সাহিলের কথা। কে বলবে, ও বেশী পড়াশোনা করেনি! কে বলবে সারাদিন ও ব্যবসা নিয়ে, লাভক্ষতির হিসাব নিকাশ নিয়েও ব্যস্ত থাকে! ওর ভেতরে যেন এক ত্রিকালজ্ঞ জ্ঞানী মানুষের আবাস, যাবতীয় কথা যেন তিনিই বলছেন। কই, সে তো কখনো এভাবে ভাবেনি! যদি এভাবে ভাবতে পারত,যদি সব কিছুর একটা পরিণতি খুঁজতে না চেষ্টা করত, তবে তার জীবন ও তো অনেক সহজ হতে পারত! -”কই আর কি প্রশ্ন আছে তোমার, করে ফেলো।” সোহাগকে চুপ করে থাকতে দেখে সাহিল তাড়া লাগায়। -”সাহিল, তুমি এত সুন্দর করে কথা বল যে আমার কাছে সব কেমন সহজ হয়ে যায়। তোমার কথা শুনতে শুনতে আমার আর যেসব প্রশ্ন ছিল, সেগুলো গা ঢাকা দিয়েছে; এখন যে আর কিছুই মনে পড়ছে না।” -”বেশ তো, আবার যখন মনে পড়বে, তখন করে ফেলো। আমি সব সত্যিই বলব।” -”হ্যাঁ, তুমি সত্যি বলবে, আমি জানি।” -”এবার তাহলে আমি উঠি ম্যাডাম। দোকানে যাই, ভাইকে ছাড়তে হবে তো।” -”এসো। কিন্তু তুমি তো জানতে চাইলে না, আমি তোমাকে ভালোবাসি কি না!” সাহিল হেসে ফেলে, হয়ত সোহাগের ছেলেমানুষি দেখেই। -”আমার কোনো তাড়া নেই ম্যাডাম। পরিণতি তো খুঁজি না, তাই। যদি তুমি ভালো বাসো আমাকে, বাসবে। আর যদি না বাসো, তাতেও আপত্তি নেই।”আবার হাসে সাহিল। ওর হাসির সারল্য যেন আলো ছড়িয়ে দেয়। সোহাগের হালকা লাগে খুব। সাহিল চলে যাবার পর, সোহাগ ঠিক করে, খুব করে ঘুমোবে। আগের রাতে ভালো করে ঘুম না হওয়ার জন্য, মাথাটা ভীষণ ভারী লাগছিল তার। শরীরটাও ঠিক ভালো লাগছিল না। ভালো করে কয়েকঘন্টা ঘুমিয়ে নিলে শরীরটা ঠিক হয়ে যাবে ভেবে ফোনটা সায়লেন্ট করে রেখে, সে ঘুমোতে চলে যায়।
”কি পরিণতি আমাদের এই সম্পর্কের? কেন আর টেনে নিয়ে চলব একে?” বলতে বলতে দ্রুত পায়ে এগোতে থাকে রিম্বিক। পেছন পেছন দৌঁড়য় সোহাগ, চেপে ধরে ওর হাত, বারবার অনুনয় করতে থাকে, ”যাস না রিম্বিক, আমার কথাটা আগে ভালো করে শোন।” কিন্তু কিছুই শোনেনা রিম্বিক। সোহাগের হাত ছাড়িয়ে নেয় এক ঝটকায়, আর দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে। আর শুধু বলতে থাকে বার বার, ”কেন থাকব আমি, কি পরিণতি আছে আমাদের এই সম্পর্কের?” রিম্বিকের চলে যাওয়া আটকাতে না পেরে, ওকে বোঝাতে না পেরে খুব কষ্ট হয় সোহাগের, কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসতে চায়, ছট্ফট্ করতে থাকে সে। জল পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু জল কথাটা কিছুতেই মুখ দিয়ে বার হচ্ছিল না। ছট্ফট্ করতে করতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ওর। প্রথমটাতে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না সে। চারপাশটা কেন এত চুপচাপ, কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন? কারো আওয়াজই বা পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কিন্তু এই সময়ে তার মা কোথায় গেল? মা কি তাহলে রান্নাঘরে? জল পিপাসায় মুখের ভেতরটা একদম শুকিয়ে গেছিল, একটু জল দেবার জন্য চিৎকার করে মাকে ডাকার চেষ্টা করল সোহাগ, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হল না। বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইল, কিন্তু হাত, পা শরীর একবিন্দুও নড়াতে পারল না। এ এক ভারী অদ্ভুত, অসহনীয় অবস্থা, সে ভাবছে যে জেগে রয়েছে, সব কিছু দেখতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে, কিন্তু আসলে সে জাগেনি। উঠতে পারছে না, নড়তে পারছে না। এই অবস্থায় বেশ কয়েক মিনিট চেষ্টা করার পর, সত্যি সত্যি জেগে উঠতে পারল সোহাগ, বাস্তবে ফিরতে পারল। তখন বুঝতে পারল, সাহিল যাবার পর সেই যে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঘুমের মধ্যে সে চলে গেছিল কয়েক বছর আগেকার একটি দিনে। বাবা চলে যাবার পর রিম্বিক একদিনের জন্য কলকাতায় এসেছিল। যদিও এসেছিল না বলে আনানো হয়েছিল বলাটাই ভালো। সোহাগের মায়ের ইচ্ছাতে, ওকে আসতে বলেছিল সোহাগ। কারণ, মা চাইছিলেন, ওদের মধ্যে সম্পর্কটা কি অবস্থায় আছে, সেটা নিয়ে আরো এগানো যায় কি না, সেটা সোহাগ মুখোমুখি কথা বলে বুঝে নিক। বাবা চলে যাবার পর, মায়ের মনের জোর অনেকটাই কমে গেছিল, তাই তিনি চাইছিলেন, সোহাগকে থিতু করে দিতে। ততদিনে সোহাগের ডক্টরেট ও শেষ হয়ে গেছে, কাজেই কলকাতা ছেড়ে যাবার ক্ষেত্রে ওর কোনো অসুবিধা নেই। ও চাইলে অনায়াসে বিয়ে করে কলকাতার বাইরে যেতেই পারে। নিজের ইচ্ছা কোনোদিনই তিনি মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেন নি, তাই সোহাগকে এসব কথা কিছুই বলেন নি। তবে মা যখন রিম্বিককে আসার কথা বলতে বলল, তখন মায়ের ইচ্ছাটা সোহাগ বুঝেছিল। তাছাড়া সে নিজেও বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিল, ব্যাপারাটার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। শুধু ফোনে, মেলে যোগাযোগ আছে দুজনের, কথাবার্তা যা হয় সবই মামুলি। গভীরে কেউই ঢোকে না, কিংবা বলা যায়, ঢুকতে চায়না, ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চায়। ফলে বোঝা যায় না, একসাথে জীবন কাটানোর ইচ্ছাটা ওদের মধ্যে এখনো বেঁচে আছে কি, নেই। এই ব্যাপারটা আর বেশীদিন ধোঁয়াশায় না রেখে খোলাখুলি আলোচনা হওয়াটা জরুরী, যেটা সামনা সামনি ছাড়া সম্ভব নয়। সোহাগের মনে হচ্ছে, রিম্বিক আর এগোতে চায় না সম্পর্কটা নিয়ে, তাই রিম্বিকের ভাবনা চিন্তা পরিস্কার ভাবে জানা দরকার। যদিও আইনি কোনো বন্ধন নেই তাদের তবু, এতদিন লিভ-ইন সম্পর্কে থাকার জন্য একটা দায়বদ্ধতা তো থেকেই যায় দু তরফেরই। তাই মা রিম্বিককে আসতে বলাতে সোহাগের সুবিধাই হল। যদিও, বাবার সেরিব্রাল অ্যাটাকের খবরটা পাবার পর আসতে চেয়েছিল রিম্বিক যাতে হাসপাতালে ভর্তির থাকার সময়টাতে ওদের পাশে থেকে কোনরকম সাহায্য করতে পারে। কিন্তু ছুটি পায়নি। বাবা সাতদিন ছিলেন অচেতন অবস্থায়, তারপর চলে গেলেন। সোহাগ বা তার মা, কেউই প্রচলিত অর্থে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান করেনি, কারণ বাবা চাইতেন না। শুধু বাবাকে যাতে প্রিয়জনেরা, পরিচিত জনেরা শ্রদ্ধা জানাতে পারে, সেজন্য বাড়িতেই ওরা একটা স্মরণসভার আয়োজন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে ও রিম্বিক আসতে পারেনি। ছুটি পাওয়াতে সমস্যা হচ্ছিল বলে, সোহাগই বারণ করেছিল, বলেছিল, ”অসুবিধা করে আসার দরকার নেই।” তাই এবার যখন সোহাগ নিজে থেকে ওকে আসার কথা বলল, ও একটু অবাকই হল। কলকাতা ছাড়ার প্রায় চার বছর পর আবার শহরে পা রাখল রিম্বিক। চারবছরে শহরের অনেক পরিবর্তনই চোখে পড়ল তার। শহর-একটা স্থুল জিনিস, একটা ইট কাঠ কংক্রিটের বোঝা, তারই যদি এত পরিবর্তন চোখে দেখা যায়, তবে শহরের মানুষগুলোর না জানি কত পরিবর্তন হয়েছে! শহরের মানুষ বলতে, সোহাগের মুখটাই চোখে ভাসে তার, সোহাগের টানেই ফিরে আসা। যদিও, রিম্বিক জানে না, তার প্রতি সোহাগের কোনো টান আছে কি না! কিংবা, যেটাকে সে টান বলে ভাবছে, সেটা আদৌ তার সোহাগের প্রতি টান নাকি সোহাগের প্রতি তার অধিকারবোধ এখনও কতটা বাস্তব, সেটা বুঝে নেবার চেষ্টা সেটাও সে নিজে ঠিক মত বুঝে উঠতে পারেনি। যা-ই হোক না কেন, সামনাসামনি কথা বলে, একটা জায়গায় পৌঁছনোর তাগিদ সে অনেকদিনই অনুভব করছিল, কিন্তু সোহাগের বাবার অসুস্থতা, মৃত্যু, ইত্যাদি কারণে ওর মানসিক অবস্থার কথা ভেবে, আর সে প্রসঙ্গে কথা বলতে পারেনি। তাই, এখন যখন সোহাগ নিজে থেকেই ডেকেছে ওকে, ও আর দেরী করোনি। সোহাগ কি ভাবছে তাদের সম্পর্কের পরিণতির ব্যাপারে, সেটা পরিস্কার করে জানা দরকার রিম্বিকের। সোহাগ এখন বিয়েটা সেরে ফেলতে রাজী কি না, সেটাও জানা দরকার। কারণ বাড়ি থেকে বাবা মা ক্রমাগত তাড়া দিয়ে চলছে বিয়ে করার জন্য, আর, রিম্বিক নিজেও বিয়ে করে থিতু হবার তাগিদ অনুভব করছে। হোয়াটসঅ্যাপে, পরস্পরের প্রোফাইলের সঙ্গে একটা পরিচিতি ছিলই। সেইজন্য এতদিন পর দেখা হয়েও ওদের মনে হল না অন্যজন খুব বেশী বদলে গেছে। যদিও সোহাগের ওজন কমেছে বেশ কয়েক কেজি, তার চশমার পাওয়ারও বেড়েছে। তবুও ওকে দেখলে মনে হলনা রিম্বিকের, যে সোহাগকে শেষবার দেখার পর প্রায় চার বছর সময় কেটে গেছে। কিন্তু রিম্বিকের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নিয়মিত শরীর চর্চায় চেহারা হয়েছে মেদহীন সুঠাম। চেহারায় আর চোখ মুখে যে ছাত্রসুলভ ছেলেমানুষ ভাবটা ছিল, সেটা উধাও হয়ে গিয়ে বেশ একটা ভারিক্কী ভাব এসে গেছে, যেটা ওর প্রফেশনের সঙ্গে বেশ মানানসই। ফলে, সমবয়সী হলেও, রিম্বিকের পাশে, সোহাগকে বেশ ছোট মনে হচ্ছে। রিম্বিককে দেখে সোহাগ সহজ খুশীতে বলে ওঠে, -”আরে, তুই তো দেখছি রীতিমত লোক হয়ে গেছিসরে!” -”হব না! বয়স বেড়েছে তো। কিন্তু তুই সেই খুকীটিই রয়ে গেলি কি করে?” -”তোর বিরহে, খাওয়া ঘুম ত্যাগ করে।” -”বাজে বকিস না! আমার জন্য বিরহ থাকলে এখানে পড়ে থাকতিস নাকি? আমি তো কবেই চাকরি পেয়ে গেছি।”রিম্বিকের এই কথাতে পরিবেশটা একটু ভারী হয়ে গেল। আলোচনা শুরুর আগেই যদি ওদের মধ্যে ঝামেলা বেঁধে যায়, তবে আলোচনাটাই পন্ড হয়ে যাবে, এই আশঙ্কা করে, সোহাগের মা মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসেন। -”আরে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই ঝগড়া বাধাস না তোরা। রিম্বিক, যা আগে ফ্রেশ হয়ে নে, পরে ঝগড়ার অনেক সময় পাবি। চল, চল ঘরে চল!” স্নান, খাওয়া শেষ করে, একসাথে বসল ওরা। ওদের একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দেবার জন্য, সোহাগের মা, খাওয়াদাওয়া পর কোনো একটা কাজের ছুতোয় বাড়ি ছেড়ে বাইরে গেলেন। রিম্বিক আর সোহাগের মধ্যে মধ্যে যদি সবকিছু ছাপিয়ে ভালোবাসার টানটাই বেশী থাকত, তাহলে এতদিনের ব্যবধানে দেখা হওয়ার পর, দুজনে একা হবার পর, সবচেয়ে স্বাভাবিক যেটা ছিল ওদের পক্ষে, পরস্পরকে ভীষণ রকম আদর করা, তার ধারপাশ দিয়েও গেলনা ওরা, এমন কি একটা চুমু খাওয়ার কথা ও মাথাতে এলনা দুজনের কারোরই বরং, যেন শুধুমাত্র বন্ধু ওরা, এমন একটা ভাব নিয়ে কথাবার্তা চালাতে লাগল। পরে অনেকবার ভেবেছে সোহাগ ব্যাপারটা নিয়ে, রিম্বিক ও ভেবেছে হয়ত বা, কেন সেদিন তাদের পরস্পরকে একটু আদর করতে ইচ্ছাও করেনি? তার মানে, সেদিনের অনেক আগেই নিশ্চয়ই তাদের প্রেমের মৃত্যু হয়েছিল, আর তারা কফিনবন্দী শব বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল? কিংবা হয়ত, দুজনেই চাপে ছিল, দুজনেরই মনে সংশয় ছিল অপর জনের ভালোবাসার ব্যাপারে। তাই হয়ত প্রথমে কথাবার্তা বলে নিঃসন্দেহ হতে চাইছিল। রিম্বিক সরাসরি প্রসঙ্গে চলে আসে। -”বল কি জন্য ডেকে পাঠিয়েছিস?” -”কেন ডেকেছি, কিছুটা আন্দাজ নিশ্চয়ই করেছিস, কিন্তু, আমি না ডাকলে, তোর কি এই ব্যাপারে কথা বলার প্রয়োজন ছিল না?” -”তোর না, সেই ঘুরিয়ে কথা বলার অভ্যাস আর গেল না! আমার যদি প্রয়োজন না থাকত, তবে কি আমি আসতাম।” -”নিজে থেকে তো আসিস নি! ডাকলাম, তবে আসলি।” -”ঠিক আছে বাবা। নিজে থেকে না এসে অন্যায় করে ফেলেছি।” -”কিন্তু যে কথা জানার জন্য ডেকেছিস, সেটা আমি নিজে থেকেই বলছি, এবার আমি বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই, বাড়ি থেকেও প্রচুর চাপ দিচ্ছে।”সোহাগ একটু সময় নেয়। রিম্বিক যে সরাসরি বিয়ের কথাতেই চলে আসবে, এটা ও ভাবেনি, তাই তার জন্য কি উত্তর দেবে সে ব্যাপারে কোনো মানসিক প্রস্তুতি ছিল না ওর। -”সম্পর্কটা তোর মনে এখনও আদৌ টিঁকে আছে কিনা, সেটা জানার জন্য, বোঝার জন্য তোকে ডেকেছিলাম! বিয়ের কথা পাড়ব বলে নয়।” -”ঠিক আছে, আমি নিজেই পাড়লাম না হয়। কিন্তু তোর প্রশ্নের উত্তর ও তো পেয়ে গেলি তুই, তাই না?” -”কিন্তু, আমি তো এক্ষুনি বিয়ে করতে পারব না।” -”সে তো জানি! কাকু মারা যাওয়ার এক বছর পার না হলে পারবি না। কিন্তু কথাবার্তা তো হয়ে থাকতে পারে। আমার বাবা মাও তাহলে একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারে!” -না, সেজন্য নয়। কেরিয়ার তৈরী না করে আমি বিয়ে করব না। সবে পি.এইচ.ডি হল। পুনেতে একটা প্রজেক্ট রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন হিসাবে যোগ দেবার কথা আছে সামনের মাসে। একটা পাকাপাকি চাকরি না পেয়ে, বিয়ে করব না।”সোহাগের কথাতে রিম্বিক গম্ভীর হয়ে যায়। সে এমন উত্তর আশা করেনি! কোথাও যেন তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে, পৌরুষে আঘাত লাগে। গম্ভীর ভাবেই সে বলে, ”আমি তো চাকরি করছিই। তোর তো না করলেও চলে। তুই তোর লেখাপড়া আর সমাজসেবা নিয়ে থাকবি।” -”তা হয় না রিম্বিক। চাকরি শুধু আমার কাছে পয়সা রোজগারের উপায় নয়। চাকরি আমার আত্মসম্মান, স্বাধীনতার উপায়।” -”বিয়ের পরও তো সেটা করা যায়!” -”যাবে না কেন? কম্প্রোমাইজ করতে হবে! আমি যা করতে চাইছি, যেখানে পৌঁছতে চাইছি, সেখানে পৌঁছতে পারব না। অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নিতে হবে। কারণ দ্যাখ, আজকে তোর বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। বিয়েটা হয়ে গেলে বাচ্চার জন্য চাপ আসবে। সব কিছু সামলে, আমার পড়াশোনা শেষ করা, চাকরির প্রিপারেশন নেওয়া, সম্ভব হবে? তুই-ই বল না, ব্যাপারগুলো কি এতটাই সহজ?” -”তাহলে তুই বল, আমাদের এই সম্পর্কের বাস্তব পরিণতি কি? তুই বিয়ে করে আমার কাছে যাবি না, আমার পক্ষে ও সম্ভব নয় কাজের চাপে সামলে তোর কাছে ছুটে আসা! আর সত্যি কথা বলতে কি, একটা বয়সের পর, সব কিছুরই একটা পরিণতি দরকার। অনলাইন সম্পর্কে সেটা সম্ভব নয়।” -”বেশ তো, তোকে আসতে হবে না কাজ ফেলে। আমিই যাব তোর কাছে, আমার সুযোগ সুবিধা মত, ছুটি নিয়ে।”রিম্বিক আরও রেগে যায় সোহাগের এই কথায়। -”কেন যাবি মাঝে মাঝে আমার কাছে? শারিরীক সম্পর্ক দিয়ে আমাকে ভুলিয়ে রাখতে? বিয়েটা মানুষ শুধু শারিরীক সম্পর্কের জন্য করেনা। বিয়ে মানে একটা বন্ধন, একটা নিরাপত্তা, একটা পরিবার। সেটা, ওই মাঝে মাঝে গিয়ে তৈরী করা যায়না।” সোহাগ বলতে চেয়েছিল, একসাথে কিছু সময়, কিছু ভালো সময় কাটানোর জন্য, একসাথে থাকার আনন্দ উপভোগ করার জন্যই সে মাঝে মাঝে গিয়ে থাকার কথা বলেছিল, শরীর দিয়ে রিম্বিককে ভোলানোর কথা সে একবার ও ভাবেনি। সে রিম্বিককে আরো মনে করিয়ে দিতে চাইছিল, বিয়ে করার পরও তো অনেক স্বামী স্ত্রীকে, কাজের জন্য, বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য, আলাদা থাকতে হয়, সেকথাটাই বা ভাবছে না কেন রিম্বিক? কিন্তু ওর রেগে যাওয়া দেখে এই কথাগুলোর কোনোটাই বলতে পারেনা সোহাগ।রিম্বিকের উত্তেজনা একটু কমলে সে বলে, ”বিয়ের বন্ধনটা তো বাইরের, লোক দেখানোর। মনের বন্ধনটাই তো আসল, সেটা থাকলেই তো হল!”রিম্বিক আবার রেগে যায়। -”তুই থাক্ তোর মনের বন্ধন নিয়ে! যে কোনো প্রেমের সম্পর্কেরই একটা পরিণতি দরকার বুঝেছিস! আর বিয়েটা হল সেই পরিণতি! তুই যখন সেই পরিণতিকেই স্বীকার করিস না, তাহলে, সম্পর্কটাকেও অস্বীকার কর। শুধু শুধু আমাকে ঝুলিয়ে রাখিস না।” -”কেউ কাউকে ঝুলিয়ে রাখতে পারেনা রিম্বিক। যে যার নিজের ইচ্ছায় ঝুলে থাকে। তোর ইচ্ছা না থাকলে ঝুলবি না।” -”ঝুলব তো নাই। একটা মরিচীকার মত সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি আর কত দিন কাটাব? আমার একটা ভবিষ্যৎ আছে, মা বাবার প্রতি দায়িত্ব আছে।” -”তোর যেমন বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব আছে, আমারও আছে। আমার নিজের প্রতি, মায়ের প্রতি দায়িত্ব আছে। বাবা মায়ের আমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নপূরণের তাগিদ আছে। সেটা না করে, আমি কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না।” -”এটাই কি তোর ফাইনাল ডিসিশন?” -”হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফাইনাল।” -”তাহলে এখানে আমার আর থাকার কোনো প্রয়োজনই নেই। মাকে বলেছিলাম, কাল বাড়ি যাব, কিন্তু আমি এখনই চলে যাচ্ছি নৈহাটি। রিম্বিক চলে যায়। সোহাগ বাধা দেয়না। কারণ তাকে তো যে কোনো একটা রাস্তা নিতেই হবে। হয় তার নিজের স্বপ্নপূরণ না হয় রিম্বিকের ইচ্ছাপূরণ। লোকে তাকে যতই স্বার্থপর ভাবুক না কেন, সে এক্ষেত্রে প্রথমটাকেই বেছে নিল। অন্যকে খুশী করার আগে, তার নিজেকে খুশী করাটা বেশী জরুরী বলে মনে হয়। রিম্বিক চলে যাবার ঘন্টাখানেক পরে সোহাগের মা ফিরে আসেন। সোহাগকে একা ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখে, রিম্বিক তাঁকে না বলে চলে গেছে দেখে তিনি যা বোঝার বুঝে যান, সোহাগকে রিম্বিকের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দেবার যে স্বপ্ন তিনি কদিন যাবৎ দেখছিলেন, তা যে আর সত্যি হবে না। সেটাও তিনি বেশ বুঝে যান। তাই কি নিয়ে ওদের মধ্যে মত বিরোধ হল, কেন রিম্বিক চলে গেল, এসব ঠুন্কো প্রশ্ন করে, সোহাগকে আর অযথা বিব্রত করেন না তিনি।
ক্রমশ: চেতনা স্পষ্ট হয়ে আসতে, বিছানা ছাড়ল সোহাগ। ঘামে, ঘাড়, গলা ভীষণ ভাবে ভিজে জব জবে। এই ঘাম যতটা না গরমের, তার চাইতেও বেশী দুঃস্বপ্নের। এতদিন বাদে, আবার পুরনো ফেলে আসা দিনগুলো স্বপ্নে এসে নাড়া দেওয়াতে মনটা একটু ভারী হয়ে গেছিল তার। ঘড়িতে একটা চল্লিশ, বাইরে খাঁ খাঁ করছে নির্জন দুপুর। নিঃসঙ্গ দুপুর থাবা বসিয়েছে তার মনেও। বুকের মধ্যে কেমন একটা দমচাপা কষ্টের অনুভূতি, দুপুরের রোদ, চোখে না লেগেও চোখের ভেতর একটা জ্বালা ধরানো কষ্ট, জল পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু কেউ তো নেই, যে একটু জল এনে মুখের সামনে ধরবে! মা চলে যাবার পরের দিনগুলির অনুভূতি, কষ্ট, আবার নতুন করে ফিরে এল এত বছর পরে, এই একাকী বিষন্ন দুপুরে। এত অসহায়, নিঃসঙ্গ লাগতে লাগল নিজেকে যে মনে হতে লাগল সে যেন জনবহুল মেলায় মায়ের হাত ছেড়ে হারিয়ে যাওয়া এক শিশুমাত্র; অথবা ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে সে একাকী সওয়ারি, মা অসহায় দাঁড়িয়ে প্ল্যাটফর্মে আর ট্রেন ছেড়ে দেওয়ায় ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে মা। সে যেন এক শিশু, যার জানা নেই ঘরে ফেরার ঠিকানা; একমাত্র অবলম্বন মায়ের হাতও ছেড়ে গেছে! এই বিপুল বিশ্বে, সে একাকী, নিরাশ্রয়, ঠিকানা বিহীন! যাত্রা শুরু তো করেছে, কিন্তু জানে না, কোথায় পৌঁছতে হবে তাকে! সে তখন তৃষ্ণার্ত ছিল, শরীর তার জল চাইছিল ভীষণরকম, তবুও কোথা থেকে যে এত জল এল! দুচোখ বেয়ে নামতে লাগল অবিশ্রান্ত জলের ধারা, আর সে ছোট্ট শিশুর মত কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে। কতদিনের জমানো কষ্ট ছিল, কত ভুলিয়ে রাখা ব্যথা ছিল, কত বর্ণময় প্রতিশ্রুতি ছিল হৃদয়ে তার, যে প্রতিশ্রুতিগুলো নানা আবেগ ঘন মুহূর্ত্তে ঈশান তাকে দিয়েছিল, কিন্তু পরে ব্যর্থ হয়েছে তা পূরণে, কিংবা হয়ত ভুলেই গেছে সেই সব অঙ্গীকারের কথা! সেই সমস্ত অভিমান, বিচ্ছেদের কষ্ট আজ বের হয়ে আসছে হৃদয় নিংড়ে, মায়ের জন্য কষ্টকে উপলক্ষ্য করে বিছানায় উপুড় হয়ে, বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেই চলেছে সে, শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে বাঁধভাঙ্গা কান্নার দমকে।আহারে! কাঁদুক সোহাগ! চোখের জল দুর্বলতার লক্ষণ, আর এই দুর্বলতা তাকে মানায় না, এই কথা ভেবে, কত কষ্ট, কত কান্না যে সে ঢোক গিলে ফেলেছে! সব বের হয়ে আসুক এখন! কাঁদুক সোহাগ, শৈশবে ফিরে গিয়ে কাঁদুক, মনটা হালকা হবে! মেঝেতে গড়াতে থাকা দুপুরের রোদটা যখন সরতে সরতে সোহাগের মুখে মাথায় পড়ল, তখন সম্বিত ফিরল তার। বিছানা ছেড়ে উঠে বসল সে আর তখনই চোখে পড়ল, বালিশের পাশে রাখা ফোনটাতে আলো জ্বলছে। ঘুমোতে যাবার সময় ফোনটা সায়লেন্ট করে দিয়েছিল বলে, রিং বাজেনি, কিন্তু কোনো কল আসছে বলে নীল হয়ে জ্বলে উঠছে বার বার। এই সময়ে ফোনে কথা বলার মত মনের অবস্থা নেই তার, তাই কেটেই দিতে যাচ্ছিল ফোনটা, কিন্তু স্ক্রিনে সাহিলের নাম চোখে পড়াতে ফোনটা ধরল সে। -”কি হয়েছে তোমার? ফোন ধরছ না কেন?” ভীষণ উদ্বিগ্ন শোনায় সাহিলের গলার স্বর।সোহাগ উত্তর দিতে পারে না তখুনি। কারণ কান্না বন্ধ হলে ও ফোঁপানি তখনও বন্ধ হয়নি, আর গলার স্বরও স্বাভাবিক হয়নি তখনও।তাকে নিরুত্তর শুনে সাহিল যেন বুঝে যায় সবটাই। অথবা সে অনুভব করতে পারে নিঃসঙ্গ দুপুরে একা মেয়েটির কষ্টকে। -”তুমি কাঁদছ সোহাগ? কেন কাঁদছ?” সোহাগের কষ্ট যেন তাকেও ছুঁয়ে যায়, গলার স্বরে এমনটাই বোধ হয়।কিন্তু কিভাবে সোহাগ বলবে, কেন সে কাঁদছে? এত এত জমে থাকা কষ্ট যে কান্না হয়ে বের হয়ে আসছে, তার নিষেধের পরোয়া না করে, সেই সব কষ্টকে কি আর দু একটা শব্দে ধরা যায়! না কি দুনিয়ায় এমন কোনো শব্দ আছে, যা মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের ছবি আঁকতে পারে হুবহু?তাই সোহাগ শুধু বলে, ‘ভীষণ কষ্ট হচ্ছে’।-আমি আসছি বলে ফোনটা রেখে দেয় সাহিল।ফোন রাখার পর স্ক্রীনে ভেসে ওঠে আঠাশটা মিস্ কল। যার একটা করেছে কলেজ থেকে সোনালী, আর বাকি সাতাশ টাই সাহিলের। বিগত কয়েক ঘন্টা ধরেই সোহাগকে খুঁজে চলেছে সাহিল। পড়ন্ত দুপুরের নিঃস্তব্ধ পাড়াটাকে তীব্র শব্দে দুফালা করে চিরে, সাহিলের বাইকটা এসে থামল সোহাগের ফ্ল্যাটের সামনে। দুপুরের আলস্যে রাস্তায় ঘুমন্ত কয়েকটা কুকুরের ঘুম ভেঙে গেল। অপরিচিত বাইক আরোহীকে নিজেদের চৌহদ্দিতে দেখে কর্তব্যে একনিষ্ট কুকুরের দল উচ্চস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল। কয়েকটা আবার বাইকের পেছনে পেছন তাড়া করেও এল। কুকুরের চিৎকারে ঘুমন্ত পাড়াটার অনেকেরই ঘুম গেল ছুটে। চারজন কৌতুহলী মানুষ, যারা এমনিতেই একদম একা থাকা মহিলাটিকে বিশেষ সুনজরে দেখেন না, এবং বাবা মা কিংবা স্বামী নামক অভিভাবকহীন এই মহিলাটির অভিভাবকত্ব পাড়ার গুরুজনদের ওপরই বর্তায়, এটা ধরে নিয়ে সর্বদা সোহাগের চলন বলনের যতটুকু অংশের ওপর তাদের নজরদারী করা সম্ভব, ততটুকু নজরদারী তারা বিনা ক্লান্তিতে করে থাকেন, তারা এখন দিবা নিদ্রার ব্যাঘাত জনিত অসুবিধাকে গ্রাহ্যের মধ্যে না এলে, কেউ বা পর্দার ফাঁকে, কেউ আবার সরাসরি বারান্দায় চলে এলেন, মধ্যদুপুরের অতিথিটিকে জরিপ করার জন্য। সাহিল অবশ্য এসবই কিছুই ভ্রুক্ষেপ করেনি। বাইকটিকে স্ট্যান্ড করিয়ে রেখে দ্রুত সে ভেতরে ঢোকে। দরজা খোলার পর সোহাগকে দেখে চমকে ওঠে সে, -কি হয়েছে তোমার? চোখদুটো এরকম টকটকে লাল কেন?সোহাগের ভীষণ দুর্বল লাগছিল, মাথা ঘুরছিল, সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না, পায়েও যেন জোর পাচ্ছিল না। কোনো রকমে গিয়ে সোফায় শরীরটা ছেড়ে দেয় সে।-”সোহাগ, শরীর খারাপ লাগছে? কি কষ্ট হচ্ছে আমাকে বল?”-”আমাকে একটু জল এনে দেবে?”সাহিল রান্নাঘরে গিয়ে জল ভরে আনে। জলটা এক চুমুকে খেয়ে সোহাগ বলে, -”অনেকক্ষণ ধরেই তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু উঠে গিয়ে জল খেতেও ইচ্ছা করছিল না জানো!”সাহিল যে কি বলবে এই মেয়েকে, ভেবে পায়না! অনেকক্ষণ ধরে জল তেষ্টা পেলেও যে কেউ জল না খেয়ে থাকতে পারে, জানা ছিল না ওর!-”আমি এতবার ফোন করেছি, ধরেছিলে না কেন? কি করছিলে?”-”ঘুমোচ্ছিলাম” ভীষণ ক্লান্ত স্বরে বলে সোহাগ। এই সোহাগকে কখনো দেখেনি সাহিল; এমন নির্জীব, অবসন্ন সোহাগকে সে চেনে না। এমনকি রাস্তায় জ্ঞান হারানোর পর যেদিন তার দোকানে এনে শুশ্রুষা করা হয়েছিল, সেদিন ও জ্ঞান ফিরে আসার পরই, আত্মবিশ্বাসী, স্বাবলম্বী সোহাগকেই দেখেছিল সাহিল।সাহিলের খুব অস্বাভাবিক লাগে আজ সোহাগকে। ও গিয়ে বসে সোহাগের পাশে, তারপর ওর হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয়। ভীষণ গরম লাগে সোহাগের হাতটা, তাই ওর কপালে হাত ছোঁয়ায়। কপালে হাত দিতেই হাতে ছ্যাঁকা লাগে সাহিলের, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ওর শরীর।-”তোমার তো ভীষণ জ্বর! কখন এসেছে?”-”আমার জ্বর এসেছে! কই জানি না তো!” ভীষণ আস্তে আস্তে উত্তর দেয় সোহাগ, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে ওর কথা গুলো।-”আমি না এলে জানতেই পারতাম না। কি যে করনা তুমি! চল, চল, শিগগিরি বিছানায় চল।”সোহাগকে এনে বিছানায় শোয়ায় সাহিল। এই বাড়িতে থার্মোমিটার ক্যালপল এসব আদৌ আছে কি না ওর জানা নেই, আর যদিও থাকে, তা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ওর পক্ষে। সোহাগ প্রায় অচেতন, ওকে জিজ্ঞাসা করেও কোনো লাভ হবে বলে হয় না। অগত্যা বাথরুম থেকে বালতি করে জল এনে, সোহাগের কপালে জলপটি দিতে থাকে সাহিল। কিছুক্ষণ জলপটি দেওয়ার পর সাহিল ওর ভাইকে ফোন করে থার্মোমিটার আর ক্যালপল নিয়ে আসতে বলে। জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল সোহাগ। শিশুদের মত ভুল বকছিল, মাঝে মধ্যে ‘মা’ ছাড়া আর কোনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না সাহিলের। এদিকে জ্বরও বেড়ে চলছিল ক্রমাগত কারণ সোহাগের শীত করছিল খুব, শীতে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছিল। এই গরমেও ওর গায়ে কম্বল ঢাকা দিয়ে দিয়েছিল সাহিল। থার্মোমিটার নিয়ে আসতেই তাড়াতাড়ি জ্বরটা দেখে সে। যা ভেবেছিল তাই, থার্মোমিটারের পারা একশ চার ছাড়িয়েছে তাড়াতাড়ি সোহাগকে একটা ক্যালপল সিক্স ফিফ্টি খাইয়ে দেয় সাহিল। ক্যালপল খাওয়ানোর কিছুক্ষণ বাদে ঘাম দিয়ে জ্বরটা ছাড়ল সোহাগের। সাহিলও হাফ ছাড়ল। কিন্তু এখনকার মত জ্বর ছাড়লেও, আবার যেকোন সময়েই আসতে পারে। আর বড়দের এত বেশী জ্বর উঠলে সেটা বেশ ভাবনার ব্যাপারই বটে! কাজেই ডাক্তার ডাকতেই হল; অসুস্থ সোহাগকে একা রাখা যাবে না বলে আয়া সেন্টার থেকে ফোন করে একজন আয়াও আনিয়ে নিল সাহিল। জ্বরের ধরণটা, মানে কাঁপুনি দিয়ে আসা, শীত করা আর বেশী টেম্পারেচার দেখে, ডাক্তারবাবু ম্যালেরিয়া সন্দেহ করলেন; সাহিলেরও তাই মনে হচ্ছিল! ওষুধ, ডাক্তার আর রোগী নিয়ে কারবার করতে করতে খানিকটা ডাক্তারি সেও শিখে গেছে কিনা! জ্বর আবার বাড়বে যখন, তখন ব্লাড টেস্ট করতে দিতে বলে গেলেন ডাক্তারবাবু। কাজেই সাহিল আটকে গেল। সন্ধ্যের দিকে আবার যখন জ্বরটা এল, প্যাথোলজিক্যাল সেন্টার থেকে রক্ত নিয়ে গেল এসে। সবাই এরা সাহিলের চেনা জানাই ছিল ব্যবসার সূত্রে, কাজেই কাজগুলো করতে ওর সুবিধাই হল। রক্ত নিয়ে যাবার পর, আবার ক্যালপল খাওয়ালো সে সোহাগকে। জ্বর ছাড়ার পর যখন সোহাগ একটু উঠে বসতে পারল, চা বানিয়ে এনে ওকে খাওয়ালো সাহিল আর নিজেও খেল। তখনই তার মনে পড়ল যে দুপুরে আজ তার খাওয়াও হয়নি, দোকান থেকে সরাসরি চলে এসেছিল এখানে, আর এসে তো আটকে পড়ল। ঠিক রাত আটটায় আয়াটি ঢুকলে, তাকে ওষুধ পথ্য বুঝিয়ে সাহিল বেরোল। আয়াকে সে নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে বলে গেল, কোনোরকম সমস্যা হলে খবর দিতে। ডাক্তারবাবুর সন্দেহ অমূলক ছিল না, সোহাগের ব্লাড টেস্টে ম্যালেরিয়া পজিটিভই এল। জ্বরের দাপটও রইল কয়েকদিন ধরে। যদিও দিন আর রাত দুই শিফটেই আয়ার ব্যবস্থা করেছিল সাহিল, তবুও নিজে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বার বার এসে দেখে গেছে সোহাগকে। ওষুধ খাওয়ানোর ব্যাপারটা আয়ার হাতে না ছেড়ে, নিজেই এসে এসে খাইয়ে গেছে। জ্বর বেশী বাড়লে, নিজেই মাথা ধুইয়ে দিয়েছে, জ্বর না কমা পর্যন্ত, ওকে রেখে যেতে পারেনি। ওর অসুখের প্রথম তিনটে দিন, সাহিলের সব কাজ এলোমেলো হয়ে গেছিল। যদিও আয়ার ব্যবস্থা করেছিল, তবু আয়ার ওপর পুরোটা ছাড়তে ভরসা পাচ্ছিল না। কারণ, জ্বর বাড়লে সোহাগ বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিল, আর জ্বর ছাড়লে এতটাই দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল, যে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। তাই সাহিলের বার বার আসতে হচ্ছিল ওর বাড়িতে। সাহিল চেয়েছিল, উমাকে খবর দিয়ে আনাতে, কিন্তু সোহাগের আপত্তিতে পারেনি। সোহাগ কিছুতেই চায় না, তার জন্য অন্য কেউ বিব্রত হোক, কাজ নষ্ট করুক। সাহিলকেও বারণ করেছিল, বার বার আসতে, কিন্তু সাহিল ওর কোনো কথাই শোনে নি। এমনিতে সাহিল ধর্মপ্রাণ, পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ আদায় করে। কিন্তু এই তিনটে দিন নমাজের সময় উর্ত্তীর্ণ হয়ে গেছে, ও মসজিদে যেতে পারেনি। মনে মনে মাফ্ চেয়ে নিয়েছে আল্লাতালার কাছে,”ইনসানের মধ্যে খুদা আছেন, বিপদের মধ্যে তাকে আমি যদি একা ফেলে চলে যাই, তবে কেয়ামতের দিন কি জবাব দেব?” তেড়েফুঁড়ে জ্বর আসাটা বন্ধ হল পাঁচদিন পর থেকে। কিন্তু এত দুর্বল হয়ে গেল সোহাগ, যে বিছানা থেকে নামলেই মাথা ঘোরে। ডাক্তারবাবু আরও কিছুদিন বিশ্রামের পরামর্শ দিলেন, আর দিন পনের বাদে কলেজে জয়েন করার জন্য ‘ফিট’ সার্টিফিকেট দেবেন বললেন। সারাদিন তাই শুয়ে বসেই কাটে সোহাগের। কখনও বই পড়ে, কখনও গান শোনে, কখনও বা ঘুমিয়েই কাটায় দিনটা। বিকেলের পর থেকে বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় পরিচিত জনদের ভীড় লেগেই থাকে। ওদের সঙ্গে গল্প করে কেটে যায় সন্ধ্যেটা। সবসময় যে সোহাগ গল্প করে, তা নয়, ওরা পাশে বসে গল্প করে, আর ও শোনে। কারণ বেশীক্ষণ কথা বলতে গেলেও ক্লান্ত লাগে ওর। সোহাগের বাড়িতে বন্ধুরা বরাবরই স্বচ্ছন্দ, তাই গৃহকর্ত্রীর অসুস্থতায়, ওদের কোনো রকম অসুবিধা হয়না। চা, কফি, স্ন্যাকস এর আয়োজন ওরা নিজেরাই করে নিতে পারে। বন্ধুরা যেতে যেতে রাত নটা বেজেই যায়, নটার পর আসে সাহিল। যদি ও ওষুধের দোকানে রাতের দিকে অনেক চাপ থাকে, স্টক মেলানো, পেমেন্ট দেওয়া, অর্ডার করা, এইসব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো বরাবরই ও নিজেই করে এসেছে, কিন্তু এখন সোহাগের জন্য সব হিসাবেই গণ্ডগোল হয়ে গেছে! ভাই আর কর্মচারীর ওপর ঘন্টাখানেকের জন্য দায়িত্ব ছেড়ে, প্রতিদিনই নটার পর চলে আসে সাহিল। সোহাগ ও অপেক্ষা করে থাকে, এই সময়টুকুর জন্য। সাহিলের সঙ্গ, সাহিলের যত্ন ওর খুব ভালো লাগে। ম্যালেরিয়া হয়েছে খবর পেয়ে, মাসতুতো বোন নিয়ে যেতে চেয়েছিল, উমাও এসে থাকতে চেয়েছিল ছুটি নিয়ে। কিন্তু সোহাগ রাজী হয়নি। বোনের সাথে চলে গেলে সাহিল মুখে কিছু না বললেও মনে মনে কষ্ট পাবে, এটা বোঝে সোহাগ। উমাকে আসতে বারণ করায় ও যে কষ্ট পেয়েছে, এটাও সোহাগ বুঝেছে, কিন্তু উপায় কিছু ছিল না। উমা এসে ওর সেবা যত্নের ভার নিলে, সাহিলের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হতে হবে যে! যদিও উমাকে আসতে বারণ করেছে সোহাগ শুনে সাহিল বলেছিল, -”বারণ কেন করলে? ও এসে তোমার কাছে থাকলে তো ভালোই হত! আমি নিশ্চিন্ত হতাম।” -”নিজের কাজে ফাঁকি দেওয়ার সুবিধা হত বলে?” -”আমার কাজ? কি কাজ?” -”কেন? এই যে আমাকে ওষুধ খাওয়াচ্ছো, মুখের সামনে খাবার ধরছ, এই সব কাজ! -”সোহাগ, তুমিও পারো! এগুলো কাজ? এগুলো তুমি এখন নিজেই করে নিতে পারো, আমি জানি। তবুও এটুকু তোমার জন্য করতে আমার ভালোলাগে, তাই করি।” -”কিন্তু আমাকে যে তোমার ওপর নির্ভরশীল করে ফেলছ! -”সত্যি নির্ভরশীল হচ্ছ! যাক্, তবে তো কারো ওপর নির্ভর করা শুরু করলে! শুনে ভাল লাগল। সাহিলের কথা বলার ধরণে হেসে ফেলে সোহাগ, সাহিলও যোগ দেয় সেই হাসিতে।
ঠিক ছটায় অ্যালার্ম সেট করা ছিল, কিন্তু অ্যালার্ম বাজার অনেক আগে আপনা থেকেই ঘুম ভেঙে গেল সোহাগের। মনের মধ্যেকার আনন্দ আর উত্তেজনা, ভালো করে আলো ফোটার অনেক আগেই জাগিয়ে দিয়েছে তাকে। আজ যে ঈশান আসবে। আর মাত্র কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা, তারপরেই এতদিনের ভার্চুয়াল দুনিয়ার দেখা সাক্ষাতের বদলে, সত্যিকারের দেখা হবে, সামনে এসে দাঁড়াবে রক্তমাংসের আসল মানুষটা। সেই যে, পঞ্চগনি থেকে ফেরার পথে, মুম্বইতে হাত ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল, তারপর থেকে, এতগুলো বছরের অপেক্ষা শেষ হবে আজ। মাসখানেক আগে, খবরটা জানিয়েছিল ঈশান, ক্যালিফোর্নিয়ার পাট চুকিয়ে, পাকাপাকি ভাবে দেশে ফিরছে এবার। যদিও কলকাতা নয়, বেঙ্গালুরুতেই আপাতত সেট্ল করছে চাকরির কারণে, তবুও ভীষণ খুশী হয়েছিল সোহাগ। কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু কতটুকুই বা দূরত্ব! ইচ্ছার টান প্রবল হলে, এটুকু দূরত্ব, অনতিক্রম্য তো নয় অন্ততঃ! ঈশানের দেশের বাইরে থাকাটার সঙ্গে, এতগুলো বছর এমনভাবে মানিয়ে নিতে হয়েছিল যে, ও দেশের মধ্যে যেকোন জায়গায় থাকলেই, সোহাগের মনে হবে, যে ঈশান কাছাকাছিই আছে। ঈশানকে নিয়ে কল্পনা বিলাস বন্ধ রেখে, বিছানা ছাড়ে সোহাগ। এয়ারপোর্টে যাবার জন্য তৈরী হতে হবে, আর তার আগে টুকিটাকি কয়েকটা কাজ সেরে রাখতে হবে। ঈশান এসে যাবার পর, এক সেকেন্ড সময়ও সে অন্য কাজ করে নষ্ট করতে চায়না। রান্না বান্না সবই গত রাতে করিয়ে রেখেছে, আর রান্নার লোক, ঠিকে কাজের লোক, দুজনকেই ছুটি দিয়ে রেখেছে আজকের জন্য। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দিল্লী ছুঁয়ে কলকাতা আসবে ঈশান। দিল্লী থেকে কলকাতার উড়ানে ওঠার সময়, ফোন করেছিল সে, আর ওই ফোনটা পাওয়ার পরই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল সোহাগ। সোহাগের এয়ারপোর্টে পৌঁছনো আর বিমানের মাটি ছোঁওয়ার মধ্যে সময়ের পার্থক্য কতটুকুই বা ছিল? বড় জোর আধঘন্টা কি চল্লিশ মিনিট। কিন্তু সোহাগের মন যেহেতু আলোর বেগে ছুটছে ঈশানের দিকে, তাই আপেক্ষিকতাবাদের নিয়ম অনুযায়ী ওর কাছে সময়ের গতি হয়ে গেছে অত্যন্ত শ্লথ, আধঘন্টা তাই ওর কাছে এখন অনন্তকাল। অবশেষে, অবসান হল প্রতীক্ষার। ‘প্রস্থান দ্বার’ প্রান্তে দেখা দিল সহাস্য ঈশান, সোহাগকে দেখে হাত নাড়ল সে। এই ক’বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে ঈশানের চেহারার, অনেকটা বুড়িয়ে গেছে যেন সে। ছিপছিপে শরীরে মেদের বাহুল্য, মাথার ঘনচুল অনেকটাই পাতলা, কাঁচাপাকায় মেশানো, চুল উঠে যাওয়ায় কপাল ও চওড়া হয়ে গেছে অনেকটা। গায়ের রং আগের চেয়ে অনেকটা বেশী ফরসা হয়ে গেলেও কেমন যেন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাতে বেশ গুরুগম্ভীর, ভারিক্কী দেখাচ্ছে ঈশানকে! -”তুমি তো একদম পাল্টে গেছ, ফোটোতে ভালো বোঝা যেতনা, এখন দেখছি, পুরো অধ্যাপক মশাই” হেসে ফেলে সোহাগ। -”তা তো হবই, বয়স বাড়ছে না! কিন্তু, তুই এরকম কলেজ ছাত্রী রয়ে গেলি কি করে?”সোহাগ কি জবাব দেবে এর! নিজের চেহারার দিকে কোনোদিনই খুব একটা নজর দেয়নি সে, এখনও দেয়না, তাই শুধু হাসে; তারপর বলে, ”ক্যাব ডাকি একটা, চল বাড়িতে গিয়ে বাকি কথা হবে।” -”নারে, তোর বাড়ি যাওয়া হবে না আজ। আর আড়াই ঘন্টা পরই আমার বেঙ্গালুরুর ফ্লাইট। কাছাকাছি একটা কফিশপে বসি চল্।”ঈশান অত্যন্ত সহজ এবং সাধারণভাবে কথাটা বলল বটে, কিন্তু সেটা সোহাগের বুকে তীরের ফলার মত বিঁধল, এত বছর পর ঈশান এসেছে তার কাছে মাত্র দুঘন্টা সময় নিয়ে! ঈশানের কাছে তার জন্য বরাদ্দ মাত্র ঐ মাপা দুঘন্টা সময়! সোহাগের প্রয়োজনীয়তা ঈশানের জীবনে এখন তাহলে মাত্র এতটুকুই! অভিমানে, কষ্টে চোখ ফেটে জল আসতে চায় তার, কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করে না। কফিশপে বসার পর, মামুলি, এলোমেলো কথাবার্তা হল কিছুক্ষণ। এইসব মামুলি কথাবার্তা হল সেইসব সিঁড়ির ধাপ, যেগুলো না পেরলে, পৌঁছনো যায় না সেই ঘরে, যেখানে লুকনো থাকে, মনের বন্ধ দরজা খোলার চাবি। কিন্তু সেখানে পৌঁছতে গেলে প্রয়োজন সময়; কিন্তু ঈশানের কাছে যে চামচ মাপা সময় ছিল, সেই সময়ে, এতদিন পরে কোনোমতেই সম্ভব ছিল না পরস্পরের বুকের দরজায় পৌঁছনো; কি ঐশ্বর্য লুকনো আছে পরস্পরের জন্য, তাদের মনের গভীরে, তা-ও জানা সম্ভব ছিল না। এসব কথা ভেবে সোহাগ অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল বার বার। অবশেষে, সে দ্বিধা, সংকোচ ঝেড়ে ফেলে, বলেই ফেলে-”সেবার তুমি আমার মুম্বই থেকে কলকাতা ফেরার টিকিট ক্যানসেল করিয়েছিলে, আজ যদি আমি ঐ রিকোয়েস্টটা তোমাকে করি, রাখবে?” ঈশান চুপ করে থাকে একটু সময়। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, -”সেটা সম্ভব হবে না রে। পর্ণা বাচ্চাদের নিয়ে পনের দিন আগেই চলে গেছে বেঙ্গালুরুতে, ওর বাবা-মাও গেছেন। আমি আজ না পৌঁছলে তুলকালাম হবে।”এবার সোহাগের চুপ থাকার পালা। চিরটাকাল পর্ণার জুজুবুড়ি দেখিয়ে, ঈশান, তুমি আমার সমস্ত ইচ্ছের ডাল পালা নির্মম ভাবে ভেঙে দিয়েছ। যদি সেই ভয়কে অতিক্রমই না করতে পারবে, তবে দুঃসাহস দেখিয়ে কেন ভালোবাসতে গেলে আমাকে! মনে মনে ভাবে সে। মুখে শুধু বলে, -”কোনো একটা প্রয়োজনে আটকে গেছ, বলা যায় না?” -”সেই প্রয়োজনটা যে কি, পর্ণা ঠিক বুঝতে পারবে, আর তারপরই শুরু হয়ে যাবে অশান্তি! এই চাপটা আমি আর নিতে পারি না রে।” ঈশানের প্রত্যাখ্যানে, সোহাগের কষ্ট হয় খুব, অভিমান ও হয়। কিন্তু ঈশানকে সেটা বুঝতে দিতে চায় না সে। সুতরাং প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য জিজ্ঞাসা করে, -”এতদিন পর ফিরছ, তোমার বাবা মায়ের কাছে যাবে না?” -”পর্নার বাবা-মা-ই এখন আমার বাবা মা। আর আমার জন্মদাতা-দাত্রী ই ‘ইন-ল’ হয়ে গেছে, বুঝলি কিছু? সুতরাং আগে তাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে, তারপর তো শ্বশুর-বাবা শাশুড়ি-মা। দাঁড়া আগে হেড কোয়ার্টারে জয়েন তো করি, তারপর বাড়ি গিয়ে বুড়োবুড়ির কাছে দুদিন থেকে আসবো।” সোহাগ বাক্যহারা। নিজের বাবা মায়ের প্রতি ঈশানের এরকম ব্যবহার ভালো লাগে না তার। আবার ওর অসহায়তাটাও উপলব্ধি করে। অশান্তি এড়ানোর জন্য কত কীই না করতে হচ্ছে ঈশানকে, কত কিছু মেনে নিতে হচ্ছে! কিন্তু কতটা দূর পর্যন্ত মেনে নেবে? কোথাও তো থামতে হবে! নাহলে মানতে মানতে তো আর নিজেকেই খুঁজে পাবে না মানুষটা একদিন।সোহাগকে চুপ করে যেতে দেখে ঈশান বলে, -”কিরে কি ভাবছিস? বাইরে বিপ্লব করে আসা ঈশান এখন নিজের ঘরেই কেঁচো হয়ে গেছে, তাই তো? বয়স হয়ে গেছে তো, আর পারি না রে!” পর্ণা এবং সেই সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে বরাবরই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সোহাগ। সেই সব অনভিপ্রেত বিষয়গুলো আলোচনাতে উঠে আসায়, ছন্দপতন ঘটে ওর, চুপ করে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে সে। সোহাগের এই ভাবান্তর, ঈশানের নজর এড়িয়ে যায় সম্ভবত। তাই সে দুম করে বলে বসে, ”রিম্বিককে বিয়েটা করলেই পারতিস কিন্তু।”বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে আনে সোহাগ, সরাসরি ঈশানের দিকে তাকিয়ে বলে, ”ও আর সে সুযোগ দেয়নি।” -”মানে? তুই-ই তো রিফিউজ করেছিলি জানতাম!” -”হ্যাঁ, করেছিলাম, কারণ আমি তখন বিয়ের জন্য তৈরী ছিলাম না আর সেটাই বলেছিলাম ওকে, কিন্তু ওকে বিয়ে করব না একথা বলিনি। ও যখন রাগ করে চলে গেল, তারপর ভাবলাম, বিয়েটা না হয় করেই পড়াটা চালাই। ওকে ফোনও করেছিলাম এই কথাটা বলব বলে, কিন্তু ও আমার ফোন রিসিভই করেনি একবারও। তখন ভেবেছিলাম, রাগ পড়ে গেলে, কদিন পর, নিশ্চয়ই ও ফোন করবে।” -”করেছিল?” -”করেছিল, মাসখানেক বাদে।” -”বললি তখন?” -”চান্সই পেলাম না! রিম্বিক ফোন করেছিল, ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার কথা জানানোর জন্য।” -”যাক গে! যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে! ওসব এখন ছাড়। এবার একটা বিয়ে করে ফ্যাল! কতদিন আর এরকম উড়ে উড়ে বেড়াবি!”ঈশানের মুখে এমন জ্যাঠাইমা মার্কা কথা শুনে, একটু অবাক-ই হয় সোহাগ। এরকম কথা ঈশানের কাছে সে আশা করেনি। ”বিয়ে করতে হবে বলে, যাকে তাকে করা যায়? তুমি না আমার সোলমেট! তুমি কিভাবে বলতে পারো এমন কথা?” মনে মনে বলে সোহাগ, মুখে কিছুই বলে না, শুধু একটু হাসে। সেই হাসিতে যে বিষণ্ণতা, হতাশা লেগে ছিল, তা ঈশানের নজর এড়িয়ে যায়।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, মানুষের চিন্তাভাবনা তো বদলায়ই, মানুষটাও আমূল বদলে যায় কখনো কখনো। আসলে পরিবর্তন-ই তো জীবন, যতক্ষণ জীবন থাকবে, পরিবর্তন ও চলতে থাকবে।কোনো ছেড়ে আসা জায়গায় দশ বছর পর গেলে, মনের মধ্যে থাকা স্মৃতির সঙ্গে জায়গাটাকে যেমন মেলানো যায় না, তেমনই কোনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন মানুষের সঙ্গে ও অনেক দিন পর দেখা হলে, সেই মানুষটাকে মেলানো যায় না, মনের মধ্যে সযত্নে রেখে দেওয়া তার ছবিটার সঙ্গে। সে যত প্রিয় মানুষ, কাছের মানুষই হোক না কেন! একমাত্র প্রতিদিন যদি তার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলা যায়, প্রতিদিনের ভাবনা, দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, বেদনা ভাগ করে নেওয়া যায়, যদি প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত্তে তার একটু একটু করে বদলে যাবার সঙ্গী হয়ে থাকা যায়, তবেই কাছের মানুষটি কাছের থাকে; নতুবা, অনেকদিন পর তাকে কাছে পেলে, মন আর একসুরে সুর বাঁধতে পারে না। তখন তাকে বুঝতে, খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। ঈশান রওনা হয়ে গেলে, সোহাগ এই সব কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরে। বহুদিন ধরে, বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা কিছু ছবি, কিছু কথা, যা সে ভাবত কখনো না কখনো ভাগ করে নেবে ঈশানের সঙ্গে, তা যে আর কোনোদিনই সম্ভব হবে না, সেটা আজ সে ভালো করে বুঝে গেছে। প্রতিদিনের একটু একটু করে বাড়তে থাকা মানসিক দূরত্ব, প্রতিদিনের না বলা জমতে থাকা কথা, তাদের মধ্যেকার ফাঁক এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে যে, বর্তমান কালের সামান্য সময়ের দেখা, সামান্য কিছু কথা দিয়ে, সেই ফাঁক আর ভরাট করা যাবে না। তারা আর কোনোদিনই ফিরতে পারবে না সেই স্থান-কালে, যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের, পরস্পরের চোখে দেখতে পেয়েছিল আশ্রম আর ঐশ্বর্য্য, ভুলে যেতে চেয়েছিল দুনিয়াদারীর নিয়মটা কেই।ম্যয় ভুল যাউঁ তুঝে, অব এহি মুনাসিব হ্যায়মগর ভুলানা ভি চাহুঁ তো, কিস্ তর্হা ভুলুকে তুম তো ফির হকিকৎ হো, কোই খোয়াব নেহী।গাড়িতে বসে, চোখ বুজে ভাবতে থাকে সোহাগ, আর তার বন্ধ দুচোখের পাতা ছাপিয়ে নামে বৃষ্টিধারা, যা অতিকষ্টে সে গোপন রেখেছিল ঈশানের সামনে।
ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারটা ছুঁইছুই, এসময়ে কাউকে ফোন করাটা উচিৎ কি না, এ নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিল সোহাগ; করব কি করব না ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত করেই ফেলল কোনটা। একবার রিং হতেই সাহিল রিসিভ করল, -”কি ব্যাপার, তুমি এত রাতে? -”অসময়ে ডিস্টার্ব করলাম! ঘুমিয়ে পড়েছিলে?” -”আরে না না, আমার ঘুমাতে এখনও অনেক দেরী, কিন্তু তুমি এত পর্যন্ত জেগে আছ কেন?” -”ঘুম আসছেনা।” -”সে কি! তুমি এখনও সুস্থ হও নি, ডাক্তার তোমাকে কমপ্লিট রেস্ট নিতে বলেছে। এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে কি করে চলবে।” -”কিছুতেই ঘুম আসছে না! কতক্ষণ ধরে এপাশ ও পাশ করছি বিছানায়। সেই জন্যেই তো এতরাতে তোমাকে বিরক্ত করছি, আমাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে যাবে প্লিজ?” -”আমি এক্ষুনি আসছি।” দশ মিনিটের মধ্যে সাহিল এসে গেল। -”সরি, তোমাকে কষ্ট দিলাম।” -”আমার সাথে আর ফর্মালিটি করতে হবে না। কিন্তু তোমার ঘুম আসছে না কেন বলতো, শরীর এখনও যেমন দুর্বল, বালিশে মাথা দিলেই তো ঘুমিয়ে পড়ার কথা।” -”আমিও তো তাই ভাবছি। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই, এই অন্ধকার ঘর, ফাঁকা বাড়িটা যেন গিলতে আসছে আমায়! ভীষণ একটা অস্বস্তি হচ্ছে!” -”সোহাগ, একটা কথা বলব? অনধিকার চর্চা ভাববে না তো?” -”ছিঃ ছিঃ, তা কেন ভাবব? বলনা কি বলবে?” -”এরকম একা একা তুমি কতদিন থাকবে? একা কি কেউ বাঁচতে পারে?” সোহাগ সাহিলের মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ; তারপর বলে, ”আসলে, তুমি তো আমার অতীত সম্পর্কে কিছু জানো না। আমার এমন কিছু সম্পর্কে ছিল, আমার জীবনে এমন কিছু ব্যাপার ঘটেছে যে”-সোহাগকে কথা শেষ করতে দেয় না সাহিল, বলে, -”স্পষ্ট করে না জানলেও, কিছুটা আন্দাজ করতে পারি বৈকি!” -”মানে? কি আন্দাজ করতে পারো?” সোহাগ অবাকই হয়। -”তুমি জ্বরের ঘোরে অনেক কথা বলছিলে তো! তার কিছু বোঝা যাচ্ছিল, কিছু যাচ্ছিল না, কিন্তু তোমার কথার মধ্যে ঈশান আর রিম্বিক নাম দুটো অনেক বারই শুনেছি।” -”ও, তাই নাকি! আমি অনেক ভুল বকেছি? তা, নাম দুটো শুনে কি বুঝেছ?” -”আর কিছু না বুঝলেও, এটুকু বুঝেছি যে, ঈশান বা রিম্বিক যেই হোকনা কেন, আর তোমার সাথে তাদের যে সম্পর্ক আগে থাকুক না কেন, ওরা এখন তোমাকে একলা করে রেখে চলে গেছে।”সাহিলের কথায়, সোহাগের চোখ ভিজে ওঠে। সাহিলের নজর এড়ায় না তা। সে সোহাগের পাশে এসে বসে, নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নেয় সোহাগের হাত। -”সোহাগ, ঈশান বা রিম্বিক সম্পর্কে আমি কিছুই জানতে চাই না, তুমিও ওদের নিয়ে ভেবনা, আর। ওসব তো এখন অতীত। আমরা যখন অতীতে ফিরতে পারি না, তখন অতীতে কেন বাঁচব বলতো? বাঁচাটা যখন বর্তমানে, তখন বর্তমানকে নিয়েই বাঁচতে হবে, তাই না?” সোহাগ বলে না কিছু। শুধু নিজের অন্য হাতটা রাখে, সাহিলের হাতের ওপর। -”অনেক রাত হয়ে গেছে কিন্তু। চল এবারে ঘুমিয়ে পড়বে চল। আর জেগে থাকা তোমার ঠিক না!” সাহিল তাড়া দেয়। -”হ্যাঁ, তোমাকেও তো ফিরতে হবে! দাও, ওষুধটা দাও, আমি খেয়ে শুয়ে পড়ছি।” -ওষুধ তো আমি আনিনি। ওষুধ তোমার লাগবেও না। তুমি শুয়ে পড়, আমি তোমার কাছে বসে আছি, দেখ, তুমি এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়বে।” সোহাগ শুয়ে পড়ে বাধ্য মেয়ের মত। সাহিল ওর মাথার কাছে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কপালের ওপর থেকে সরিয়ে দেয় এলোমেলো চুলের গুছি, স্বগতোক্তির মত বলে, ”ঘুমোও সোহাগ…, ঘুমিয়ে পড়…, আমি বসে আছি, অনেকদিন ভালো করে ঘুমোও নি তুমি, এবার ঘুমোও…, শান্তিতে ঘুমোও…। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসতে থাকে সোহাগের, ভারী নিশ্চিন্ত লাগতে থাকে তার। নিঃশ্বাস, প্রশ্বাসের গতি ক্রমশঃ ধীর হয়ে আসতে থাকে। মায়ের শাড়ির আঁচলের একটা কোন চেপে ধরে যেমন ঘুমোত সে ছোট্ট বেলায়, অনেক অনে-ক বছর পর, পরম শান্তিতে যখন সোহাগ ঘুমিয়ে পড়ল, সাহিলের হাতের একটা আঙুল তখন ওর মুঠিতে ধরা।