short-story-jagannath-badi

জগন্নাথবাড়ি

অদিতি ভট্টাচার্য

“ছেলেটা কে?” মানব চলে যেতেই যশ তৃণার প্রশ্নর সম্মুখীন হল। তৃণার মুখ গম্ভীর, গলার স্বর রুক্ষ।
যশ ইতস্তত করল। মানব বেরোতে না বেরোতেই তৃণা যেভাবে “ছেলেটা কে” করে চেঁচিয়ে উঠল, শুনতে পায়নি তো?
“উত্তর দিচ্ছিস না যে বড়ো? কথা কানে যাচ্ছে না?” তৃণার গলা আরো চড়ল।
“ও মানব। আমরা মহীতোষস্যারের কাছে একসঙ্গে অঙ্ক করি,” ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিল যশ। মাকে ভয় পায় ও, বিশেষ করে তৃণা রেগে গেলে তো বটেই।
“মহীতোষবাবু এই ছেলেটাকে তোদের সঙ্গে অঙ্ক করান?” তৃণার কপাল কুঁচকে গেল, কন্ঠস্বরে রুক্ষতার পাশাপাশি বিস্ময়েরও ছোঁয়া লেগেছে।
“হ্যাঁ।”
“তোর খাতা ছেলেটার কাছে গেল কী করে?” তৃণার পরবর্তী প্রশ্ন।
“আগের দিন ও পড়তে আসতে পারেনি, জ্বর হয়েছিল, তাই খাতা চেয়েছিল। কাল দিয়েছিলাম, আজ ফেরত দিয়ে গেল।”
“তুই ওকে তোর অঙ্ক খাতা দিয়েছিলি!” আগুনে যেন ঘি পড়ল, “কাকে জিজ্ঞেস করে দিয়েছিলি? তোর সাহস তো দেখছি দিন কে দিন বেড়েই যাচ্ছে! কাল কখন দিয়েছিলি খাতা?”
“বিকেলে খেলতে যাওয়ার সময়। রাতটুকুই রেখেছিল মা, সকালেই তো দিয়ে গেল।”
“কাল বিকেলে আমি বাড়ি ছিলাম না আর সেই সুযোগে তুমি খাতাটা দিয়ে দিলে! তোমার বাবাও আশ্চর্য লোক বটে! ছেলে খেলতে যাচ্ছে খাতা হাতে করে – সেটা নজরে পড়ল না! কোন স্কুলে পড়ে ছেলেটা? তোদের স্কুলে বলে তো মনে হয় না।”
“ভবেশচন্দ্রতে।”
তৃণার অনুমান নির্ভুল। যশদের নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এ ছেলে পড়ে না। পড়তেই পারে না। দেখেই বোঝা যায়।
“বাড়ি কোথায় ওর?”
“ফেরিঘাটের কাছাকাছি, ওই যেদিকে ছোটো ছটো টালির বাড়িগুলো আছে,” যশ বলল, না বলে কোনও উপায় নেই। তৃণার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া ও না বললেও তৃণা ঠিক খবর জোগাড় করে নেবে, তখন আরও মুশকিল।
“ও তো জেলেপট্টি, ওখানে তো জেলেরা থাকে। তার মানে ও জেলে!” তৃণা আঁতকে উঠল।
যশকে আবার হ্যাঁ বলতে হল। তৃণা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু যশ তার আগেই বলল, “মানব ভালো ছেলে মা। অঙ্কে তো খুব ভালো। আমাদের ব্যাচের মধ্যে বেস্ট। স্যার ওকে খুব ভালোবাসেন।”
“চুপ করো, তোমাকে আর ওর হয়ে ওকালতি করতে হবে না,” তৃণা ধমকে উঠল, “যা করেছ করেছ, আর কোনোদিন করবে না। ওকে খাতা দেওয়া তো দূরের কথা, ওর সঙ্গে মিশবেও না, বুঝেছ? আমাকে এক কথা যেন বারবার বলতে না হয়।”
যশ ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল।
“কী হল বুঝেছ?”
যশের ঘাড় এবার অল্প কাত হল। তৃণা ছেলের মুখের ওপর কড়া দৃষ্টি বুলিয়ে চলে গেল।
যশের খুব খারাপ লাগল। মা ওরকম রেগে গেল কেন? মানব কত ভালো অঙ্ক করে সে যদি জানত মা! যেসব অঙ্ক দেখে ওরা মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতেই পারে না, সেই সব অঙ্কও মানব অনায়াসে করে ফেলে। অঙ্ক বোঝাতেও পারে কী সুন্দর করে! মহীতোষস্যারই ওকে মাঝে মাঝে ভালোবেসে মাস্টার বলে ডাকেন! স্যারের হোম ওয়ার্কের অঙ্ক আটকে গেলে যশ আর ওর বন্ধুদের মানবেরই দ্বারস্থ হতে হয় অনেক সময়। তবে যশের বন্ধুরা অন্য সময় ওকে মোটে পাত্তা দেয় না। আসলে মানবের সঙ্গে ওদের ফারাকটা বেশ ভালো চোখে পড়ে যে। মানবের ওদের মতো দামি দামি জামা, জুতো নেই, ওদের মতো নিত্য নতুন পেন নিয়ে পড়তে আসে না, ওদের মতো নাম করা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে তো পড়েই না। আসলে অনেক কিছুই মানবের নেই। এই এক যশের সঙ্গেই যা একটু ভাব। তৃণা তো সব সময়েই বলে, যশটা এক নম্বরের ক্যাবলা। হয়তো সেই জন্যেই।
প্রদীপ্ত বাজার সেরে ফিরে সবে খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছে, তৃণা জলখাবারের থালাটা ঠক করে টেবিলের ওপর রেখে বলল, “নাও খাও। চা করছি।”
থালা রাখার আওয়াজ আর তৃণার গলার স্বরেই প্রদীপ্ত বুঝে গেল গতিক সুবিধের নয়। তাড়াতাড়ি মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজটা সরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল। ওতেই কাজ হল।
তৃণা গম্ভীর মুখে আর ততোধিক গম্ভীর স্বরে বলল, “ছেলেকে সামলাও। আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে তো একেবারে মাথায় তুলছ! এরপর হাতের বাইরে বেরিয়ে গেলে আমাকে বলতে এসো না যে সময় থাকতে সাবধান করিনি।”
“কেন কী হল? কী করেছে যশ? পরিষ্কার করে বলো না?” প্রদীপ্ত জানতে চাইল।
“সে তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো,” তৃণার বেজার উত্তর।
তৃণার কথা শেষ হল কী হল না, পাশের ঘর থেকে এক বয়স্ক মানুষের গলা ভেসে এল, “তৃণা, এক কাপ চা দেবে মা?”
“যাই তোমার বাবার হুকুম তামিল করি। বিয়ে হয়ে থেকে অবধিই তো এই ঝিগিরিই করছি, এই করতেই তো জগন্নাথবাড়িতে আসা। একটা মিনিট তর সয় না কারুর!” গজগজ করতে করতে উঠে গেল তৃণা।
প্রদীপ্ত যশকে ডাকল, “কী রে কী হয়েছে? মা কী বলছে?”
“মানব আমার অঙ্ক খাতা নিয়েছিল আর সেটা ফেরত দিতে বাড়িতে এসেছিল বলে মা রেগে গেছে,” যশের মুখও থমথমে।
এরপর মানব কে, সে কেন অঙ্ক খাতা নিয়েছিল, সে অঙ্ক খাতা নিলে বা বাড়িতে এলে তৃণার রাগের কারণ কী – এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রদীপ্তকে জানতে হল।
“ছেলেকে কিছু বললে না যে বড়ো?” ততক্ষণে চা হয়ে গেছে, তৃণা চা প্রদীপ্তর বাবা পরমেশকে দিয়ে এসেছে, নিজেদের জন্যেও এনেছে।
“কী বলব? মানব তো মহীতোষবাবুর কাছেই পড়ে শুনলাম, ওদেরই ব্যাচে। তাছাড়া একটা ক্লাস সেভেনের ছেলের মনে এসব জাতপাতের ব্যাপার ঢোকানোও ঠিক নয়,” প্রদীপ্ত বলল।
“চমৎকার! তোমাদের কথা যত শুনি না তত মুগ্ধ হয়ে যাই!” ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল তৃণার স্বরে, “কী করে ভাবলে তুমি যে আমি শুধু জাতপাতের কারণেই বলছি? যশদের ক্লাসে তো সবরকম ছেলেমেয়েই আছে, কিন্তু তারা এরকম নয়। তারা ভালো পরিবার থেকে এসেছে, ভদ্র পাড়ায় থাকে, তাদের বাবা মারা ভালো চাকরি বাকরি করে। আর ওই মানব থাকে জেলেপট্টিতে, ওরা জেলে। ওই পাড়ার কতগুলো ছেলে গঙ্গার ঘাটে বসে রোজ সন্ধ্যেতে নেশা করত, ক’দিন আগে পুলিশ ধরেছে। দেখো ওদের মধ্যে মানবের কোনও দাদা টাদা আছে কি না। ওদের তো আবার গুচ্ছের ভাইবোন থাকে! তা এরকম ব্যাকগ্রাউণ্ডের ছেলের সঙ্গে তোমার ছেলে মিশলে তোমার কোনও আপত্তি নেই তো? খুব ভালো কথা, যাক ছেলে উচ্ছন্নে!”
“এখনই এত কিছু ভেবে ফেলছ কেন বলো তো? যশই বা কী করবে? একসঙ্গে পড়ে, খাতা চেয়েছে, না দেওয়া যায় কখনও?” প্রদীপ্ত তৃণাকে বোঝানোর চেষ্টা করল।
“আমার ভাবতেও আশ্চর্য লাগছে যে মহীতোষবাবু এই ছেলেকে ওদের সঙ্গে পড়ান! এমনিতে তো মহীতোষবাবুর কাছে পড়তে চান্স পাওয়াই শক্ত, তার ওপর আবার কত মাইনে! ওই ছেলেটা এত টাকা মাসে মাসে দিতে পারে?”
“আজ বিকেলে তো যাব টাকা দিতে, দেখি তখন যদি পারি কায়দা করে জিজ্ঞেস করব। তবে তুমি আর যশকে বকাঝকা কোরো না। বাবাকে ওষুধ দিয়েছ?”
“না করব না বকাঝকা। বকাঝকা তো দূরের কথা, কিছুই বলব না। জগন্নাথবাড়ির লোকজন দেখছি আজকাল খুব উদার হয়ে গেছে। আমার জন্যে অবশ্য নিয়মকানুন আলাদা ছিল। আর তোমার বাবাকেও ওষুধ দিয়েছি। ওনার শুধু চোখই গেছে, স্মৃতিশক্তি ঠিকই আছে। ডেকে ডেকে আমাকে না পেলে যশকে ডাকেন। পড়া ছেড়েও ছেলেকে উঠে আসতে হয় দাদুর পরিচর্যা করতে। কোনও অযত্ন হচ্ছে না তোমার বাবার, নিশ্চিন্তে থাকো,” তৃণা ঝাঁঝিয়ে উঠল, চেয়ার ছেড়ে উঠেও গেল।
তৃণার যখন বিয়ে হয়েছিল, প্রদীপ্তরা তখন পলতায় থাকত, ওদের পৈতৃক ভিটেতে। প্রদীপ্ত বাবা, মার এক সন্তান, মা মারা গেছেন অনেক দিন আগে। বাড়িতে আরও দুই জ্যাঠা, এক কাকা আছেন। বড়ো বাড়ি, গেটের পাশে শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা জগন্নাথবাটি, লোকের মুখে মুখে যা জগন্নাথবাড়ি হয়ে গেছে। নামের কারণ বাড়িতে জগন্নাথদেবের মন্দির। সে মন্দিরে পুরীর মতই দারু বিগ্রহ। তবে শুধু জগন্নাথই, বলরাম, সুভদ্রা সেখানে অনুপস্থিত। প্রদীপ্তর মেজ জ্যাঠা নিঃসন্তান, তিনিই এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। বহু বছর আগেই নির্মাণ করিয়েছিলেন এই মন্দির, তখন তাঁর যৌবন। ছোটোবেলা থেকেই ঠাকুরদেবতার প্রতি তাঁর বিশেষ টান। পুরী থেকেই বিগ্রহ আনিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, বাড়ির নাম জগন্নাথবাটিও তখনই দেওয়া হয়। প্রতি বছর ঘটা করে স্নানযাত্রা, রথযাত্রা পালন করা হত।
জগন্নাথবাড়ির খুব সুনাম। তৃণার যখন প্রদীপ্তর সঙ্গে বিয়ে স্থির হল তখন তৃণার বাবা, মাও এই সম্বন্ধে খুব খুশী হয়েছিলেন। তৃণার অবশ্য বরাবরই মনে হয় প্রদীপ্তদের পরিবার বড়ো বেশী রক্ষণশীল। ওর তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে, ও বাড়ির এক গৃহপরিচারিকা ছিল অল্প বয়সী। তৃণা তার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই গল্পগুজব করত। একদিন প্রদীপ্তর বড়ো জেঠিমা তৃণাকে বললেন, “দেখো মা, এখন তুমি এ বাড়ির বৌ, যার তার সঙ্গে এত গল্প করা ভালো দেখায় না।”
তৃণাকে তখন মানতে হয়েছিল। তাছাড়া বাড়িতে জগন্নাথ আছেন বলে নিয়মকানুনও হাজার, সেসবেরও অন্যথা করার জো ছিল না। তবে জগন্নাথবাড়ি নামটাই যা রয়ে গেল, জগন্নাথ আর রইলেন কই? তৃণার বিয়ের কয়েক মাস পরেই নবকলেবর অনুষ্ঠিত হল। নতুন বিগ্রহ এল পুরী থেকে, পুরোনোকে বিসর্জন দেওয়ার সময় হল। পুরীর প্রথামত পুরোনো বিগ্রহকে সমাধিস্থ না করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া স্থির হল। আলো, বাজনা সহ শোভাযাত্রা করে সুসজ্জিত জগন্নাথকে নিয়ে যাওয়া হল গঙ্গার ঘাটে। শোলার তৈরি একটি আধারে জগন্নাথকে শুইয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে দেওয়া হল ফল, মিষ্টি। বিগ্রহের চোখের মণিদুটি ছিল সোনার, সেও সেরকমই রেখে দেওয়া হল। জগন্নাথ ভাসতে লাগলেন, যতক্ষণ তাঁকে দেখা গেল, সবাই ঘাটে দাঁড়িয়ে রইল। নতুন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হল। এর বছরখানেকের মধ্যেই যশের জন্ম।
সময় গড়াচ্ছিল নিজের নিয়মে। প্রদীপ্তর মেজ জ্যাঠা আর জেঠিমা দুজনে অল্প সময়ের ব্যবধানে গত হলেন। জগন্নাথদেবের নিত্য পুজোর ঝক্কি ওঠাতে কেউ আর রাজি হল না। ভাড়া করা পুরোহিত রাখলেই তো শুধু হয় না, নিজেদেরও অনেক কাজকর্ম করতে হয়। কেউ আগ্রহী নয় এসবে। জগন্নাথদেব ফিরে গেলেন যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানেই। পুরীর এক আশ্রমে ঠাঁই হল তাঁর। মন্দিরে তালা পড়ল। শুধু জগন্নাথবাড়ি নামটা আর কোনোদিন মুছে গেল না, ওটা বেশ পাকাপোক্তভাবেই টিঁকে গেছে।
তৃণা অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছিল নিজের আলাদা একটা বাড়ির। প্রদীপ্তকে বোঝাতে বোঝাতেই অনেক সময় লাগল। যা পিতৃভক্ত ছেলে! তৃণা ওর বাবা, মাকে বলে রেখেছিল ওঁদের ওদিকে ফ্ল্যাট বা ছোটো বাড়ির সন্ধান রাখতে। যশকে শ্যাওড়াফুলির একটা নামকরা স্কুলের অ্যাডমিশন টেস্টে বসাল। এর জন্যে কম খাটেনি তৃণা, নাওয়াখাওয়া ভুলে ছেলের পেছনে পড়েছিল। যশ চান্স পেয়ে গেল। অদ্ভুত সংযোগ, তৃণার বাবাও শ্যাওড়াফুলিতেই একটা বাড়ির খোঁজ পেলেন। ওঁরাও ওই শহরেরই বাসিন্দা, ভালোই হবে মেয়ে একেবারে কাছে চলে আসবে।
তাই হল। প্রদীপ্ত বাড়ি কিনল আর যশ ভর্তি হল নতুন স্কুলে। পরমেশ রয়ে গেলেন পলতার বাড়িতেই।
তৃণা খুব খুশী হয়েছিল। এত দিনে সম্পূর্ণ তার নিজের সংসার হল। কারুর কোনও বিধিনিষেধ নেই।
পরমেশ বলেছিলেন, “জগন্নাথবাড়ি থেকে এই প্রথম তোমরাই আলাদা হলে, কিন্তু তা হলেও তো তোমরা এই বাড়িরই। তাই সম্ভব হলে তোমাদের নতুন বাড়ির নামও জগন্নাথবাটিই রেখো আর বাড়িতে জগন্নাথের একখানা ছবি রেখো।”
আবার জগন্নাথবাড়ি! তৃণা পরিষ্কার না বলে দিয়েছিল। তৃণার মা মেয়েকে বোঝালেন, “এটুকুতে আপত্তি করছিস কেন? নামে কী যায় আসে? তোর বাড়ি, তোর সংসার তোরই থাকবে, বরং তোর শ্বশুর অসন্তুষ্ট হবে না। ঠাকুরের সিংহাসনে একটা ফটোও রেখে দে বাবা। মেনে নে এটুকু। তাছাড়া ঠাকুরদেবতার নাম, অমত করা ঠিক নয়।”
অতএব নতুন বাড়ির গেটের পাশেও জগন্নাথবাটি লেখা শ্বেতপাথরের ফলক বসল।
তবে পরমেশের আর বেশিদিন পলতার বাড়িতে থাকা সম্ভব হল না। প্রথম প্রথম অতটা পাত্তা দেননি বোধহয়, ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি চলেই গেল। যখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া হল তখন আর কিছু করার নেই। বাঁ চোখটার অবস্থাও ভালো নয়, দৃষ্টিশক্তি কমছে সেটারও। প্রদীপ্ত বাবাকে আর ওখানে রাখতে রাজি হল না, নিজের কাছে নিয়ে এল। তৃণার মনঃপূত হয়নি, কিন্তু এ ব্যাপারে প্রদীপ্ত কোনও কথা শুনবে না বুঝে আর তেমন কিছু বলেনি। পরমেশের অবস্থা এখন খুবই সঙ্গীন। চোখে খুব কমই দেখতে পান। চিকিৎসা চলছে, কিন্তু সুফল তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। পরমেশের বড়ো আশা, একবার পুরীতে গিয়ে জগন্নাথ দর্শন করে আসেন। এই ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়েই, জগন্নাথের কৃপা হলে কী না সম্ভব। ছেলেকে বলেওছিলেন সে কথা। তখন ওদের পুরী যাওয়ার কথা হচ্ছিল। এই তো ক’মাস আগে।
তৃণা বেঁকে বসেছিল, “পুরীর মন্দিরের ভেতরটা কীরকম অন্ধকার অন্ধকার জানো না? ভিড়ও থাকবে এ সময়। এর মধ্যে একটা অন্ধ লোককে কোথায় নিয়ে যাবে? ওনাকে না একা হোটেলে রেখে যাওয়া যাবে, না ভিড়ভাট্টায় বাইরে বের করা যাবে। সারা বছর তো তোমার বাবার খিদমত খাটছি, ক’টা দিন আমাকেও তো রেহাই দেবে, নাকি?”
এবার প্রদীপ্তও আর কিছু বলেনি। ওঁকে নিয়ে যাওয়ায় যে সমস্যা আছে সে কথা অস্বীকার করতে পারেনি। সে ক’টা দিন পরমেশ পলতাতেই ছিলেন।
সন্ধ্যেবেলা প্রদীপ্ত মহীতোষবাবুর কাছে গেল, ফিরে এসে তৃণাকে বলল, “মানব ছেলেটা খুব ভালো, অঙ্কে দারুণ মাথা। মহীতোষবাবু বলতে গেলে যেচে ওকে পড়াচ্ছেন, একটা পয়সাও নেন না। বললেন এতো ভালো ছাত্র অনেকদিন বাদে পেয়েছেন। যশেরও প্রশংসা করলেন, বললেন খুব বাধ্য ছেলে। অঙ্ক নিয়েও চিন্তার তেমন কিছু নেই, বাড়িতে আর একটু বেশি প্র্যাক্টিস করে যেন, সেটা দেখতে বললেন। কাজেই তুমি আর অনর্থক চিন্তা কোরো না।”
তৃণা কিছু বলল না, গম্ভীর মুখে শুধু শুনে গেল সব।
তৃণার মার শরীর কিছু দিন হল ভালো যাচ্ছে না, তৃণা তাই গেছে ওঁদের কাছে। সংসার তো নয়, যেন নাগপাশ! মুক্তি পাওয়া কঠিন। আজ যশের স্কুল ছুটি, ওর ভরসাতেই পরমেশকে রেখে গেছে। যশ আবার খুব দাদুভক্ত, ওঁর এতটুকু অসুবিধে হতে দেবে না। তাছাড়া পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলাকেও বলা আছে, তেমন বুঝলে যশ ওঁকে ডাকবে।
পরমেশ জানলার ধারে চেয়ারটা টেনে বসেছিলেন। যশ পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল, তারপর দাদুর কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে বলল, “জগন্নাথ দেখতে যাবে দাদান?”
পরমেশ চমকে উঠলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“সে আর কী করে হবে দাদা? কে আমাকে পুরী নিয়ে যাবে?”
“পুরীতে না, এখানেই। আমার বন্ধু মানব আছে না? ওদের বাড়িতেই জগন্নাথ আছে। কিন্তু…” যশ কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল।
“কিন্তু কী দাদা?”
“ওরা জেলে। তুমি ওদের বাড়িতে যাবে? মানব আমাদের বাড়িতে এসেছিল বলে মা খুব রেগে গেছিল। ওর সঙ্গে মিশতেও মা বারণ করেছে।”
“তাহলে আর কী করে যাব দাদা? গেলে তুমি তো খুব বকুনি খাবে।”
“কিচ্ছু হবে না। তোমাকে জগন্নাথ দেখাতে নিয়ে গেছি শুনলে বাবা বকবে না। আর বকলে বকবে। তুমি এখন ওঠো। আমার হাত কিন্তু শক্ত করে ধরে থাকবে দাদান।”
দরজায় তালা টালা সব যশই লাগাল। ওসব ও পারে। তারপর দাদুর হাত ধরে অটোতে চাপিয়ে ঠিক নিয়ে গেল মানবদের বাড়িতে। মানবের সঙ্গে বোধহয় এ নিয়ে ওর আগে কথা হয়েছিল। মানবের মা খুব যত্ন করে পরমেশকে ঠাকুর দেখাল, বিগ্রহের একেবারে সামনে নিয়ে এসে। পরমেশ খুব যে ভালো দেখতে পেলেন তা নয়, কিন্তু আনন্দে তাঁর দু চোখ সজল হয়ে উঠল। এসেছেন তো জগন্নাথের সামনে। এই অনেক। এটুকু আশাও তো ছেড়ে দিয়েছিলেন।
তৃণা আর প্রদীপ্ত প্রায় একসঙ্গেই বাড়ি ফিরল। যশ আর পরমেশের বাড়ির বাইরে যাওয়ার খবর গোপন রইল না। প্রতিবেশী ভদ্রমহিলাই তৃণাকে জানিয়েছেন। রাগে ফেটে পড়ল তৃণা, পরমেশকে ছাড়ল না।
“কী বলে আপনি ওইটুকু একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছিলেন?”
পরমেশ নিজের ঘাড়েই সব দোষ নিলেন, বললেন উনিই যশকে নিয়ে যেতে বলেছেন। এভাবে যাওয়া হাজারবার অনুচিত হয়েছে। কী যে মতিভ্রম হয়েছিল ওঁর কে জানে!
“কিন্তু বাবা জানল কী করে যে মানবদের বাড়িতে জগন্নাথ আছে? বাবার তো জানার কথা নয়। যশ, ঠিক করে বল কী হয়েছে,” প্রদীপ্ত বলল।
যশ সব সত্যি কথাই বলল। দাদানের জন্যে ওর বকুনি খেতে কোনও আপত্তি নেই। জগন্নাথ দেখে পরমেশের আনন্দ তো ও দেখেছে। নাহলে উনি তো আজকাল বেশিরভাগ সময়ই মনমরা হয়ে বসে থাকেন।
“কীরকম জগন্নাথ?” প্রদীপ্ত জিজ্ঞেস করল।
তৃণা বিরক্ত হল। জগন্নাথের নাম শুনলেই যে এদের কী হয়! এখন জিজ্ঞেস করছে কীরকম জগন্নাথ!
“জানো বাবা, এই এত্ত বড়ো মূর্তি! যেরকম টিভিতে দেখায় রথের সময় ঠিক সেরকম,” যশ উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগল, “আর জানো গোল গোল চোখের মণিতে দুটো সোনার চাকতি বসানো। সত্যি সোনার গো!”
চোখের মণিতে সোনার চাকতি বসানো! প্রদীপ্ত বাবার মুখের দিকে তাকাল।
“তুই ঠিক দেখেছিস? আমি তো অত কিছু বুঝলাম না, অবশ্য আমি আর ভালো দেখতে পাই কোথায়?”পরমেশ বললেন।
মানবরা কোথায় থাকে তা প্রদীপ্তর অজানা নয়, সে তখনই ছুটল। যতক্ষণ না সে ফিরল শ্যাওড়াফুলির জগন্নাথবাড়ির মানুষগুলো এক অদ্ভুত অবস্থায় রইল। পরমেশ রীতিমতো ছটফট করছেন, ভাবছেন, এ কী করে সম্ভব? যশ ভাবছে বাবা এত তড়িঘড়ি করে মানবদের বাড়িতে গেল কেন? কী হল? তৃণা বিরক্ত, যশকে বকতেও পারছে না, প্রদীপ্ত বারণ করে গেছে।
প্রদীপ্ত ফিরল বেশ অনেকটা সময় পার করে দিয়ে। তৃণার অবশ্য তার মধ্যে অনেকবার ফোন করা হয়ে গেছে, কিন্তু প্রদীপ্ত কিছুই বলেনি। বলল একেবারে বাড়িতে এসে।
“কত অদ্ভুত ঘটনাই যে ঘটে! কী হয়েছিল শুনবে?” বলল প্রদীপ্ত, “আজ থেকে প্রায় বারো, সাড়ে বারো বছর আগেকার ঘটনা। মানবের বাবা বন্ধুদের সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে বসেছিল, শোলার পাত্রে জগন্নাথের বিগ্রহ এসে ঘাটে লাগল। এরকম ঠাকুরের মুর্তি ভেসে আসা কেউ কোনোদিন দেখেনি বা এরকম কথাও শোনেনি। কেউ যে ইচ্ছে করে ভাসিয়ে দিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে, সঙ্গে ফল, মিষ্টিও আছে। মানবের বাবা আবার তাকে ঠেলে ভাসিয়ে দিল। জগন্নাথের বিগ্রহ কিন্তু দূরে গেল না, একটু পরে আবার ওই ঘাটে এসেই লাগল। মানবের বাবা তখন তাকে জল থেকে তুলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। ছোটো বাড়ি, তখনও মাথায় টিনের চাল, সেখানে কোথায় রাখবে জগন্নাথকে? তাই বাড়ির সামনে প্লাস্টিক দিয়ে ছাউনি করে রাখা হল। দেখতে দেখতে লোক ভেঙে পড়ল। এরকম ঘটনা আগে কেউ কখনও শোনেনি যে। ওদিককার এক কৃষ্ণ মন্দির থেকে মূর্তিটা চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু মানবের বাবা দেয়নি। মানবের জন্ম এর কিছু দিন পরেই। দেখতে দেখতে মানবদের বাড়ির ছাদ পাকা হল, বাড়িতে ছোটো একখানা মন্দিরও হল জগন্নাথের জন্যে। আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানো? ওই বাড়ির নামও জগন্নাথবাড়ি, লোকের মুখে মুখে হয়ে গেছে। অনেকগুলো ফটো তুলে এনেছি বাবা, এই নাও দেখো। এ আমাদের পুরোনো ঠাকুর, কোনও সন্দেহই নেই। এবার থেকে ছুটির দিনে তোমাকে নিয়ে যাব, আমি বলে এসেছি। সব শুনে ওরাও কী কম অবাক হয়েছে নাকি? আমাকে বারবার বলেছে যখন ইচ্ছে তখনই যেন আসি।”
“পলতা থেকে ঠাকুর ভেসে এল শ্যাওড়াফুলির ঘাটে! শুধু ভেসে আসা নয়, জগন্নাথ নিজের ব্যবস্থাও করে নিলেন সব! আমরা তো তাঁকে রাখতে পারিনি, ওরা যেন পারে, উনি যেন থাকেন ওখানে,” পরমেশ বললেন।
প্রদীপ্ত তৃণার দিকে তাকাল, বলল, “তোমার বাবা, মা মনে হয় এসব কিছুই জানেন না! জানলে তো বলতেন। সব সময় কি আর ওরকম জেলে জেলে করলে চলে? আর শোনো মানবের বাবা জাল ঘাড়ে করে মাছ ধরতে বেরোয় না, চাকরি করে। নিজের পড়াশোনার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু বেশী দূর হয়নি সংসারের চাপে, চাকরিও ছোটোখাটোই জুটেছে, নিজের দুই ছেলেমেয়েকে তাই ভালো করে পড়াশোনা করানোর ইচ্ছে। যাই হোক, আমাদের যশ কিন্তু একটা কাজের কাজ করেছে, ওর জন্যেই তো এই সব কিছু জানা গেল।”
যশের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে প্রদীপ্ত দু হাত বাড়িয়ে দিল আর যশও দৌড়ে এসে বাবার বুকে মুখ গুঁজল।

4 thoughts on “short-story-jagannath-badi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *