short-stories-antaral

অন্তরালের জীবন

কাজী রাফি

কুকুরের একটানা ডাকে অনেক ভোরে ঘুম ভাঙল দীপ্তির। মাইকে ভিন্ন ভিন্ন মসজিদ থেকে একের পর এক আজানের শ্রুতিমধুর স্বর ভেসে আসছিল। ঢাকা শহরের বৈশাখি বাতাসে কোনো ঘ্রাণ না থাকলেও ঝিরঝির বাতাস বারান্দায় দাঁড়ানো দীপ্তিকে তার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোর স্মৃতিঘোরে নিয়ে গেল। এমনি ফাগুন মাসে গ্রামের পথ-ঘাট আর প্রান্তর ভরে থাকত আম-মুকুলের ঘ্রাণে। তার ফ্ল্যাটের সামনে গুলশান লেক। আকাশে দু’একটি মিটিমিটি তারা তখনো জ্বলছিল জ্বল জ্বল। খালের পানিতে মিশে থাকা কটু গন্ধ ভোরের উঠে আসা আলো আর রাতের মিলিয়ে যাওয়া আঁধারের ভিতরে যেন চুপটি করে ঝিম মেরে আছে।
কিন্তু আজ সবকিছুই ভিন্ন। নির্মল ভোর দীপ্তিকে নিয়ে গেছে গ্রামে কাটানো শৈশব কৈশোরের আম-মুকুলের গন্ধে মাতানো দিনগুলোতে। মসজিদে-মসজিদে আজান শেষ হয়। কী এক আবেশঘোর প্রায় বেনামাজি দীপ্তিকে অনুপ্রেরণায় ধুয়ে দেয়। দাঁতব্রাশ এবং ওজু করে সে আজ এই প্রাণাকুল করা স্মৃতিভোরে নামাজের জন্য জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ে। শেষ রাকাতের ছালাম ফেরানোর পরই সে বেলিফুলের ঘ্রাণে শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোর স্মৃতিতে আরো তলিয়ে গেল।

শীতের মধ্যে দীর্ঘদিন দীপ্তির সর্দি ছিল। সে ধরেই নিল আজ সেই সর্দি পুরোপুরি চলে গেছে। দীপ্তি অবাক হয়ে ভাবল; বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি এসে কেন তার নাসারন্ধ্রের এই উন্মীলন! নাকি এটা ধর্ম-কর্মের প্রতি নতুন করে অনুরাগ? ঘটনা যাই হোক, দীপ্তি মনে মনে পণ করল এখন থেকে সে ভোরে উঠবে এবং নামাজ পড়বে। মনে মনে পণ শেষ করামাত্র দীপ্তির রাতে দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ল। একটা বেলিফুলের গাছ। কিন্তু বেলি ফুলগাছ তো এত বিশালাকৃতি নয়। কাঞ্চন গাছের মতো বিস্তৃত গাছটা সাদা ফুলে ভর্তি। সেই সাদা-সাদা ফুলভর্তি গাছে পাতা নেই বললেই চলে। তারই একটা মোটা ডালে একটা নিকষ কালো ঘোড়া। যেন আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছে। মৃত অবস্থায় ঘোড়াটার দুই পা এমন অবস্থানে ঝোলানো যে দীপ্তির মনে হচ্ছিল ঘোড়াটি এখনই বেগবান দৌড়ে মুখরিত করে তুলবে চারপাশ।

স্বপ্নটার কথা মনে পড়ামাত্র দীপ্তির গা ছমছম করে উঠল। আর সাথে সাথে তীব্র হয়ে উঠল নাকে জেগে থাকা বেলিফুলের গন্ধ। প্রায় পঞ্চাশ বছর জীবনে দীপ্তি এমন বিমূর্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়নি। প্রাণভরে সে খোদার কাছে তার নিরাপত্তার জন্য দোয়া চাইল। জায়নামাজটা গুটিয়ে নেওয়ার সময় বাইরে কাকের ডাকগুলোর ভেতরে যখন অন্য একটা পাখির চিকন গলা শুনতে পেল সেটাও দীপ্তির কাছে রহস্যময় শোনাল। ঢাকায় চিকন গলার পাখি? নিজের এমন প্রশ্নের উত্তর নিজের ভেতর খুঁজে পেল না দীপ্তি। আর মোনাজাতের সময় সবকিছু ছাপিয়ে কেন শুধু তার মুখ থেকে বের হলো এমন সব বাক্য-
‘খোদা সকল বিপদ থেকে তুমি আমাদের নিরাপদ রেখ। চোর-ডাকাত-মলমপার্টি এবং চাঁদাবাজদের খপ্পড় থেকে নিরাপদে রেখো। মামলা মোকাদ্দমার ত্রিসীমানা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখো। ভূমিকম্প হলে…’ –বলেই থেমে গেল সে। এরপর ঠিক কী বলা উচিৎ- প্রার্থনায় অনভ্যস্থ দীপ্তি ভেবো পেল না। শুধু একটু থেমে সে তার বাক্যটুকু শেষ করল, ‘ঢাকা শহরকে তুমি ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করো। ‘
কুকুরের ঘেউ-ঘেউ শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠা এবং তারপর প্রার্থনায় পুলিশ, চোর-ডাকাত এবং আদালতের সাথে ভূমিকম্প শব্দটার ঠিক মিল খুঁজে পেল না দীপ্তি। ঠিক তেমনি স্বপ্নে দেখা একটা মৃত ঘোড়ার সাথে বেলিফুলের তীব্র গন্ধের অনুভব -কিছুই যখন দীপ্তির সাদামাটা জীবনের সমীকরণে মিলছিল না তখন ভোরের আলো প্রায় ফুটছে। এরই মধ্যে লেকের সেতুর উপর দিয়ে একটা সিএনজি ঢাকার নীরবতা ভাঙছে। নীরবতা ভাঙা শুরু হওয়ামাত্র দীপ্তির মনে হলো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। কী একটা প্রশ্ন মনের কোণে উঁকি দিয়েও যেন ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। সে একটু ভয় পেয়েই তার ঘুমন্ত স্বামীকে ডাকল,
সাকেব, ওঠো। বয়স তো কম হলো না, সারাজীবন সকাল দেখলে না; নামাজও পড়লে না। ওঠো; নামাজ পড়ো। ভোঁস ভোঁস করে আর কত ঘুমাবে?
‘নামাজ’ দীপ্তির জীবনে প্রায় অচর্চিত। তাই এই শব্দটা শুনে সাকেবের ঘুমের আবেশ কেটে গেল। প্রায় সারারাত এপাশ ওপাশ করে রাত তিনটার পর সাকেবের ঘুম এসেছিল। সেই গভীর ঘুম ভাঙার বিরক্তি আর দ্বিধা নিয়ে হুতোম পেঁচার মতো পিট পিট করে সে দীপ্তির অবয়বের দিকে তাকিয়ে সন্দেহের কণ্ঠে বলল,
নামাজট! তুমি আজ নামাজ পড়েছ নাকি?
হ্যাঁ পড়েছি। বলে দীপ্তি রাতের স্বপ্ন আর সকাল থেকে নাসারন্ধ্রে জেগে থাকা বেলিফুলের ঘ্রাণ পাওয়ার বিষয়টিসহ তার অদ্ভুত সব অনুভূতির কথা বর্ণনা করল। দীপ্তির স্বরে এক ধরনের শান্ততা ছিল। সেজন্যই হয়তো সাকেবের ভেতরটা ছমছম করে উঠল। কণ্ঠনালী দ্রত শুকিয়ে এল এবং সারাজীবন ধরে যে নারীকে সে আদর-ভালোবাসায় সিক্ত করে এসেছে তাকে ভয় পেতে শু্রু করল। ঢাকা শহরের পথ-ঘাটে এবং পার্টিতে আড্ডায় সাকেব অফুরান প্রাণ-অনুপ্রেরণায় ভেসে যেত। খাঁচাসম সেই ঢাকার জন্য কোনো জড়ত্বধরা প্রাণ নিজ সত্তার উপর ‘ভর’ করেছে এমন অবশ অনুভূতি সাকেবের কণ্ঠনালী হতে একটাও শব্দ বের হতে দিল না। আপ্রাণ চেষ্টায় সে ধড়মড় উঠে খাটের একপাশে কাঁথা জড়িয়ে দীপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।


দিনের আলো ফুটলে সকালের কথা মনে পড়ে সাকেবের হাসিই পেল। নাস্তা শেষে খাল-পাশের বরান্দায় বসে চা খেতে খেতে সে দীপ্তিকে বলল,
আজ হঠাৎ তোমার সকালে ওঠার ইচ্ছা হলো কেন?
ইচ্ছে করে উঠিনি। তোমাকে তো বললাম! অনেকগুলো কুকুরের একটানা ঘেউ ঘেউ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল । মনে হচ্ছিল কোথাও কোনো খুন, চুরি-ডাকাতি অথবা দূর্ঘটনা ঘটছে।
দীপ্তির এ কথায় সাকেবের সকালের সেই গা ছমছম ভাবটা ফিরে এল। ‘এটা নির্জন কোনো গ্রামের নির্জন কোনো জঙ্গলের নিরিবিলি কোনো বাড়ি নয়, এটা ঢাকা শহর’ –কিন্তু সাকেবের নিজকে বলা নিজের কথাটুকুই নিজের সাথে ব্যঙ্গ করল। তারপর ফাল্গুনের আরো কয়েকটা দিন অতিবাহিত হলো।

এরই মাঝে দীপ্তি একদিন এক জ্যোতিষীর সাথে সাক্ষাৎ করে বিষণ্ন মনে বাসায় ফিরলো। পর পর দুইদিন দীপ্তি প্রায় কোনো কথাই বলল না। তৃতীয় দিন বিকেলে চা খেতে বসে আনমনা হয়ে সাকেবকে বলল,
জানো? জ্যোতিষী সব শুনে অদ্ভুত এক কথা বলল।
কী?
সারাক্ষণ নাকে সুঘ্রাণ লাগা ভয়াবহ খারাপ লক্ষণ।
তুমি কি গন্ধটা এখনো পাও?
হুম ; সারাক্ষণ! মাঝে মাঝে গন্ধটা বেশি স্পষ্ট হয়।
তা তোমার জ্যোতিষী কী বলল? সারাক্ষণ সুঘ্রাণ লাগা কিসের ভয়াবহ লক্ষন?
স্পষ্ট করে বলেনি ; বলা নাকি নিষেধ। তবে এর প্রতিকার হিসেবে পোখরাজ এবং মুক্তার আংটি ডান হাতের দুই অনামিকায় পড়তে বলল।
হো, হো করে হাসল সাকেব। জ্যোতিষীর ভণ্ডামি ধরা পড়াতে যেন দীপ্তিকে নিয়ে কয়েকদিন তৈরি হওয়া সাকেবের মনের অযথা ভীতি কেটে গেল। সাকেবের হাসিকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে কণ্ঠস্বরে ভয় জড়িয়ে দীপ্তি বলল,
জ্যোতিষী আমার বাসার ঠিকানা দেখে জিজ্ঞাসা করল আমাদের বাসার সীমানা প্রাচীরের গ্রিল ধরে, খাল থেকে রাতের আঁধারে কাঁকড়া উঠে কি না?
খুব অদ্ভুত প্রশ্ন। তারপর ?
আমি মধ্যরাতে পর পর দুইরাত এই বারান্দায় এসে বসে দেখার চেষ্টা করেছি, লেক থেকে সত্যিই কোনো কাঁকড়া উঠে আসে কি না!
হঠাৎই সাকেবের মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেল। তারপরের বাক্যটুকু সাকেবের কণ্ঠে খসখসে শুকনা শোনাল,
কাঁকড়া ওঠে কিনা তা দেখার জন্য তুমি রাতে একা একা এই বারান্দায় বসে থাকলে? তোমার ভয় লাগল না?
আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো? লেকের পাশে আমাদের যে ছোট্টবাগান, তার চারপাশ ঘেরা গ্রীলগুলো ধরে কাঁকড়াগুলো সত্যি সত্যিই রাতে উঠে আসে।
সাকেবের ইচ্ছা হলো একলাফে সে চেয়ার ছেড়ে দীপ্তির কোলের মধ্যে গিয়ে লুকায়; কিন্তু যার কাছে সে আশ্রয় খুঁজবে সেই এখন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। এই দীপ্তিকে তার হঠাৎই অচেনা লাগছে। সাকেবকে নিশ্চুপ এবং হা হয়ে বসে থাকতে দেখে দীপ্তি বলল,
বিশ্বাস না হলে আজ রাতে আমার সাথে তুমিও বারান্দায় বসে কাঁকড়াগুলোর উঠে আসা দেখতে পার। কী ভয়ংকর জ্যোতিষী!
দীপ্তির প্রস্তাবে সাকেবের শরীরের ভেতরের সব শিরা-উপশিরা একসাথে বিদ্রোহ করে উঠল।
কী সব আবোল-তাবোল বকছ!
আরে আবোল-তাবোল নয়, ছোট্টবেলায় বাবা বলতেন, সাগরে ভূমিকম্পের প্রধান লক্ষণ হলো ঝাঁক ঝাঁক কাঁকড়ার তীরে এসে …
সাকেব দীপ্তির কথা শেষ হতে দিল না। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
ঐ ব্যাটা জ্যোতিষী একটা বাজে লোক। তোমার স্বপ্নে দেখা মরা ঘোড়া, নাকে সারাক্ষণ লেগে থাকা বেলিফুলের গন্ধ, এসবের সাথে আরো একটা ফালতু বিষয় ছাগলটা যোগ করে দিয়েছে । কাঁকড়া! হাউ ফানি!
এই যে এখন থেকে বামবাহুতে এই তাবিজটা পড়বে। আর তাড়াতাড়ি আমার জন্য পঁয়ষট্টি হাজার টাকা যোগাড় করবে।
বলেই দীপ্তি তাবিজটা সাকেবের চোখের সামনে ধরল। নিজের বামবাহুতে পড়া তাবিজটাও দেখাল।
টাকা কি গাছের পাতা? মাত্র কয়েকদিন হলো তোমাকে দামি একটা গলার হার উপহার দিলাম ।
সত্যিই ব্যাপারটা আমার জন্য বিরাট বিস্ময়! তুমি আমাকে হিরার হার গিফট করবে -তাও এই বয়সে; ভাবতেও পারিনি।
আবেগাল্পুত হয়ে গলার চেইন ধরে হারটা উপরে তুলে পরম তৃপ্তিতে দীপ্তি সেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। আগ্রহভরে হারটার দিকে সাকেবও তাকিয়ে থাকল। হৃদয়-অঙ্কিত একটা ছোট্ট ফাঁপাকৃতির হার। দীপ্তি গলার যথাসহানে যত্ন করে হারটা রেখে দিল এবং পুনরায় তাবিজটা কোল থেকে তুলে নিয়ে সাকেবের বামবাহুতে পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
তুমি কিন্তু হারটা কেনার ক্যাশমেমো এখনো আনলে না। এত দামী জিনিস কিনে কেউ কি ক্যাশমেমো ভুলে ফেলে আসতে পারে ? তুমি যে কী!
তাবিজ বামবাহুতে পরিয়ে দেওয়া শেষ হতেই দীপ্তি বিরক্তি সহকারে ভৎর্সনা চালিয়ে গেল,
না হলে কোন দোকান থেকে হারটা কিনেছ তার নাম বলো, আমিই গিয়ে ক্যাশমেমো নিয়ে আসছি…
সাকেব পড়ল মহাফাঁপরে। হার কেনা নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক গল্পই সে শুনিয়েছে দীপ্তিকে। আর সাকেবের সেসব বানানো গল্পে বার বার দীপ্তি নতুন করে প্রেমে পড়েছে সাকেবের । আজো সাকেব মিনতীভরা গলায় আদর এনে বলল,
তোমার এসব ঝামেলায় জড়ানোর কী প্রয়োজন ? এটাও তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ হয়ে থাক না। সত্যি কথা বলতে কি, আমি চাই না হারটা কত টাকায় কেনা সেটা তুমি এত তাড়াতাড়ি জানো।
জানলে কী হবে ?
তোমার চোখ কপালে উঠবে এবং হঠাৎ এত টাকা খরচ করার জন্য আমাকে হয়তো বকাবকি করবে। ক্যাশমেমোর ব্যাপারটা থাক না দীপ্তি!
এটুকু বলেই সাকেবের মনে হল সে একের পর একটা ভুল করে চলছে। মিথ্যা কথাগুলো তার পাপের সাথে যোগ হয়ে পাপটাই আসলে বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। তখনই তার নিজেকে বোকা মনে হলো। কয়েকদিন আগে বিদেশ থেকে সে ঘুরে এসেছে। দীপ্তিকে হারটা বিদেশ থেকে আনার কথা বললেই ল্যাঠা চুকে যেত। এসব ভাবনার মাঝেই সিন্থিয়া নামের মেয়েটির মুখ সাকেবের চোখের সামনে ভেসে উঠল। অত দামি হারটা কৌশলে নিয়ে নেওয়ার পর সিন্থিয়ার সাথে দেখা হলে সে নিশ্চয়ই তাকে ফাঁসিয়ে দেবে। এতদিনে নিশ্চয়ই সে হন্যে হয়ে হিরার হারটা খুঁজছে। মধ্যপ্রাচ্যের এক শেখ খুশি হয়ে সিন্থিয়াকে হারটা নাকি উপহার দিয়েছিল। সাকেব সিন্থিয়ার মুখ থেকেই গল্পটি শুনেছিল।


সাকেব নিজকেই নিজে বলল -সিন্থিয়ার হারটা হস্তগত করা তার জীবনের ভীষণ বাজে কাজগুলির একটি। এটি নিয়ে সে বরং ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিন্থিয়ার সান্নিধ্য পাওয়া জীবনে আর সম্ভব নয়। ভাগ্যিস সিন্থিয়া তার সত্যিকার ঠিকানা অথবা মোবাইল নাম্বার জানে না। আহ! বেচারা; ভুল ঠিকানা এবং ফোন নাম্বারে কতবার যে তাকে খুঁজছে! সাকেব জানে সিন্থিয়া তার টিকিটির খোঁজ পেলে সাকেব নামের এক মানুষকে সে আস্ত গায়েব করার ক্ষমতা রাখে। আদুরে, পোষা বিড়ালের মতো আচরণ করলেও যে কোনো সিংহ-পুরুষের চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে সিন্থিয়া। তার একটা ফোন প্রশাসনের প্রভাবশালী যে কোনো কারো চেয়ে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে কম গুরত্বপূর্ণ নয়। বউকে খুশি করার জন্যও ওরকম একজন মানবীর হিরার হার চুরি করেনি সে -শুধুমাত্র মনের জেদ অথবা ক্ষোভের কারণেই হারটা নিয়ে এসে সে বরং জীবনে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা টেনে এসেছে। সাকেব চায়নি, তার সাথে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর সিন্থিয়া অন্য কারো সাথে বিছানায় যাক। সুতরাং সিন্থিয়া জৈবিক চাহিদার সাথে তার আর্থিক চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রতিমাসে সিন্থিয়ার জন্য কাড়ি-কাড়ি টাকা খরচ করেও তাকে বশে আনতে পারেনি সাকেব। সাকেবের মনে পড়ল, সিন্থিয়া ওকে একদিন বলেছিল,
তুমি যে কয় পয়সা আমার জন্য খরচ করো -তা দিয়ে আমার কয়েকদিনের হাত খরচও হয় না! দয়া করে পানসে ভালোবাসা দেখিয়ে মূল্য পরিশোধ করছ… এমন ভাব দেখিও না ।
সিন্থিয়ার মন্তব্য সে রাতে সাকেবের শরীরে যেন জ্বালা ধরাল। তারপর এক দুর্বল মুহুর্তে সাকেব সন্তর্পণে খুলে নিয়েছিল হারটা এবং বিছানার চাদরের একপ্রান্ত তুলে তার নিচে ওটা লুকিয়ে রেখেছিল। সিন্থিয়া স্নানঘরে ঢোকার মুহুর্তে হোটেলের নিচ থেকে ফল কিনে আনার কথা বলে সাকেব সেদিন কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছিল।
কী ভাবছ? বুঝতে পেরেছি পঁয়ষট্টি হাজার টাকা দেবে না এইতো? তোমার মতো হারকিপ্টের কাছ থেকে এই হারটা যে কীভাবে আমার গলায় জুটল! মাসে বাসা ভাড়া পাও দুলাখ টাকা; কী করো এত টাকা দিয়ে?
দীপ্তির কথায় যতক্ষণে তার সম্বিৎ ফিরল, ততক্ষণ দীপ্তি উঠে চলে গেছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে ঠিক তখন সাকেব তার চারপাশে বেলিফুলের গন্ধ পেল। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিল সে। নাসারন্ধ্র হয়ে সুতীক্ষ্ণ সেই ঘ্রাণ সাকেবের ফুসফুসকে বেলিফুলের সুবাসে ভরে তুলল। সিন্থিয়ার ত্বক, চুল এবং রোমকূপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকানো সেই ঘ্রাণ! সিন্থিয়ার সংস্পর্শে যে ঘ্রাণ পাগল করে তুলত সাকেবকে। হারিয়ে ফেলা মূল্যবান সম্পদের মতো সেই নারীর জন্য হৃদয় ব্যথিত হয়ে উঠলেও আবার গা ছমছম অনুভূতি পেয়ে বসল সাকেবকে। সিন্থিয়া ভীতির চেয়েও দীপ্তি-ভীতি এই মুহূর্তে অস্থির করে তুলল তাকে।মনের ভুল ভেবে সে আবার লম্বা করে শ্বাস নিল। না, গন্ধটা আগের মতো স্পষ্ট নয়। তার মানে গন্ধটা বাস্তব। কিন্তু রহস্যটা কী? ভেবে পেল না সাকেব। বারান্দা থেকে উঠে সে দীপ্তির কাছে গেল। পেছনে থেকে দীপ্তিকে জড়িয়ে ধরে আদুরে ভঙ্গিতে বলল,
আমি টাকাটা অবশ্যই তোমাকে দেবো। তবে তার জন্য আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিতে হবে।
কথা বলতে বলতেই সে দীপ্তির চুলে-গলায় গন্ধটুকু খুঁজল এবং সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, এখনো একটা চুলেও পাক না ধরা তার ঘন কেশগুচ্ছের ভিতরে নয় সেই গন্ধটুকু দীপ্তির গলার কাছে প্রবল। দীপ্তি বিরক্তি সহকারে সাকেবের প্রস্তাব প্রত্যাখান করল,
তোমার টাকার আশায় বসে থাকতে থাকতে আমার কোনো দুর্ঘটনা হোক, আমি চাই না। তোমার কী ধারণা? মাত্র পঁয়ষট্টি হাজার টাকা যোগাড় করার সামর্থ্য আমার নেই?
বিয়ের সময় সাকেবের দেওয়া কয়েক ভরি ওজনের সোনার প্রিয় হারটা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিল দীপ্তি। এই বয়সে মোটা সোনার সেকেলে হারটা পরে কোথাও যাওয়া বেমানান দেখায়। দীপ্তির কোনো মেয়েও নেই। একমাত্র সন্তান অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পেয়ে অস্ট্রেলিয়ান নারীকে বিয়ে করেছে। তাছাড়া সাকেবের দেওয়া হিরার হারটা পাওয়ার পর থেকে বিয়ের সময় উপহার পাওয়া সোনার হারকে দীপ্তির আর পরম সম্পদ বলে মনেও হয় না।
বেশ তো তোমার থেকে আপাতত খরচ করো। আগামী মাসেই আমি তোমাকে টাকাটা দিয়ে দেবো। আর বিপদ বা দুর্ঘটনা শুধু তোমার কেন একা হবে? জ্যোতিষী কি তাই বলেছে?
বিপদটা আমার একা হলে তো তুমি বেঁচে যাও তাই না? আমি মরে গেলে আরো ভালো হয়…। কিন্তু তোমাকে বলে রাখি –গন্ধটা তুমি না পেলেও; ভূমিকম্পে ভেঙে পড়া দালান শুধু আমার গায়ে একা পড়বে না; বুঝেছ ?
দীপ্তি! জানো,আজকাল আমিও গন্ধটা পাচ্ছি ?
বেলিফুলের গন্ধ?
বেলিফুল কি না জানি না – তবে গন্ধটার সাথে আমার পরিচয় তোমার চেয়ে আরো আগে ।
কবে? কোথায়? দীপ্তি প্রায় ফিসফিস করে প্রশ্নটা করল। দীপ্তির প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমতা আমতা করল সাকেব।
না, ঠিক মনে পড়ছে না –কবে এবং কোথায়? তবে…
দীপ্তি নিজের চোখের দৃষ্টিকে আরো তীক্ষ্ণ করল এবং সাকেবের একেবারে কানের কাছে প্রায় চুপিচুপি স্বরে বলল,
আমি শুধু একা নই দেখেছ! গন্ধটা এখন তুমিও পাচ্ছ এবং রাতে নিশ্চয়ই স্বপ্নও দেখছ?
হ্যাঁ দেখছি।
কী স্বপ্ন দেখেছ বলো? প্রশ্নটা করেই দীপ্তির মনে হলো সাকেবও হয়তো একই স্বপ্ন দেখছে । সে বলল
একটা বিশাল বেলিফুলের গাছ, সেই গাছটাতে…
সাকেব দীপ্তির বাকি কথাগুলো শুনতে চাইল না। দীপ্তির স্বপ্নে দেখা মরা ঘোড়াটা যেন সে নিজেই! তাড়া খেয়ে আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়েছিল ভুল জায়গায়। দীপ্তিকে থামিয়ে দিয়ে আনমনা স্বরে সাকেব বলল
না। আমার স্বপ্নগুলো ঠিক তোমার স্বপ্নের মতো নয় ।ওগুলো একটু ভিন্নরকম ।
কী রকম?
মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি, একটা লিফটের ভিতর আমি আটকা পড়েছি। কিন্তু লিফটটা কোনো দালানের নয়। সেটা একেবারে শুন্যে স্থাপিত। আকাশের নিচে কোনো ভিত্তি অথবা খুটির সমর্থন ছাড়াই লিফটটা ঝুলে আছে শূন্যে। নিচু থেকে হাজার হাজার মানুষ আমার শুন্যে স্থির লিফটটার দিকে তাকিয়ে আছে। নখ উঁচিয়ে আমাকে নির্দেশ করছে একটা মেয়ে। মেয়েটার পাশে একদল পুলিশ সদস্য। মেয়েটার মেরুণ রঙের নেইল-পলিশ করা সুন্দর নখটা একদম মাটি থেকে আমার লিফটটা পর্যন্ত লম্বা। পানিতে নখ রাখলে নখের মাথাটা যেমন মোটা দেখা যায়, মেয়েটার নেইল পলিশ করা সুন্দর নখ ঠিক তেমনি দেখায়…
দীপ্তি প্রশ্নবোধক চোখে সাকেবের দিকে তাকাল এবং সাকেবকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালোভাবে দেখে নিল,
তুমি কি নারী সংক্রান্ত কোনো ঝামেলায় জড়িয়েছ, সাকেব!
কী যে বলো না! তুমি কি তাহলে ঘোড়া সংক্রান্ত…? শুধু কি তাই ? আমি স্বপ্নে আরো দেখি, যানজটে আটকে আছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা । আমার একজনের সাথে দেখা করার কথা, কিন্তু…
একটুকু বলেই থামল সাকেব। স্বপ্নে দেখা বাঁকি অংশটুকু ওর মনে অস্থিরতা তৈরি করল । সিন্থিয়াকে নিয়ে তার কোনো এক তারকা হোটেলে ওঠার কথা। সিন্থিয়ার আসার কথা বিকেল পাঁচটায়। বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে -কিন্তু সাকেব যানজটে আটকাই পড়ে আছে। অস্থিরতা আর উদ্বেগে ওর কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সাকেব মনের অস্থিরতাকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে এনে দীপ্তিকে বলল,
অথবা কোনো সভায় আমার উপস্থিত থাকার কথা; সভার সময় হয়ে এলেও আমি যানজটে আটকাই পড়ে আছি। মাঝে মাঝে স্বপ্নে আরও দেখি –পানির ট্যাপ দিয়ে জলের বদলে রক্ত আসছে। ঢাকা শহরের নিদারুণ পানিশুন্যতা! অথচ আমার ভিতরে তখন প্রাণান্ত পিপাসা।
দীপ্তি সাকেবের চোখে স্থির তাকাল যেন সাকেব রোগী আর সে নার্স অথবা ডাক্তার । তারপর খুব মগ্নতার সাথে সে বলল,
তাহলে তুমিও আমার সাথে জ্যোতিষীর কাছে চলো।
কেন?
তোমার স্বপ্নগুলোরও একটা কারণ আছে। নিশ্চয়ই তিনি বলতে পারবেন এখন আসলে আমাদের কী করা উচিত ।
দীপ্তির প্রস্তাব শুনে আঁতকে উঠল সাকেব । যে ব্যাটা জ্যোতিষী মধ্যরাতে খাল থেকে কাঁকড়া ওঠার খবর বলতে পারে সে সাকেবকে দেখেই হয়ত সিন্থিয়ার সাথে তার সম্পর্ক ধরে ফেলবে। না, জ্যোতিষীর কাছে গেলে সিন্থিয়া রহস্য জেনে যাবে দীপ্তি ; সে ভাবল। বলল,
যারা নামাজ পড়ে তাদের তো জ্যোতিষীর কাছে যাওয়ার কথা নয় ।
তুমি তো নামাজ পড়ো না ।
আমার কথা বলছি না। নামাজটা তুমিই শুরু করেছ । আমি জ্যোতিষ-শাস্ত্রে বিশ্বাস করি না। তাছাড়া আমার মনে হয় শিক্ষিৎ মানুষ হয়ে…
ঢাকা শহরে শিক্ষার কোনো মূল্য আছে নাকি ?
মানে ?
মানে এখানে কখন ভূমিকম্প হবে অথবা সত্যি সত্যি কখন নলকা দিয়ে পানির বদলে রক্ত অথবা যাত্রাপথে সন্ত্রাসীর আগুনে গাড়ির মধ্যেই মারা পড়বে…
এগুলোর সাথে শিক্ষার কী সম্পর্ক?
শিক্ষা দিয়ে তোমার আমার তো আর চাকরি করে পেটের ভাত জোটাতে হচ্ছে না। অথচ জীবন বলো, গাড়ি-বাড়ি বলো এসব রক্ষার জন্য জ্যোতিষীর পরামর্শ নিতেই হচ্ছে ।
ওহ্!


এরপর থেকে বসন্ত পেরিয়ে বৈশাখ আসা পর্যন্ত দীপ্তি সাকেবের চা-বিকেল অথবা কোনো কোনো রাতে বেলি ফুলের সেই গন্ধটা তীব্র হয়ে উঠলেই, দুজনেই সারারাত ভয়ংকর সব এলোমেলো স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। দীপ্তি পয়ষট্টি হাজার টাকা খরচ করে মধ্যমা এবং অনামিকায় ভিন্ন রঙের আংটি উঠাল। দীর্ঘ আটাশ বছরের বিবাহিত জীবনে কোনোদিন মুহূর্তের জন্য বাগদান-আংটিটা সামান্যক্ষণের জন্য না খুললেও দীপ্তির সুন্দর হাতের সেই স্থানটি দখল করে বসল পোখরাজ, মুক্তা ইত্যাদি নামের প্রতারণার চিহ্ন। অনুপ্রেরণা আর উজ্জ্বলতায় ভরে থাকা দীপ্তি দিন দিন বিষণ্নতায় ভরা দীপ্তিহীন এক নারী- প্রতীক হয়ে উঠল ।

একুশে এপ্রিল সন্ধ্যা আটটার সময় দীপ্তি-সাকেবের বাসার খাবার-স্থানের টেবিল চেয়ারের উপরে বসানো ঝালর বাতি হঠাৎ কাঁপতে শুরু করল। দুজনেই অনুভব করল ওদের দালানটা দুলছে। এবং সাথে সাথে একসাথে অনেক মানুষের সিঁড়ি ভাঙার শব্দ শুনল তারা । ‘ভূমিকম্প’ ‘ভূমিকম্প’ বলে একজন কিশোর চিৎকার করছিল। বাঁকি সবার চোখমুখে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য লুকিয়ে ছিল আকুল আকুতি। শিশুরা বাবা-মায়ের কোলে তারস্বরে কাঁদছিল। সাকেব যখন দীপ্তিকেও তাড়াতাড়ি বাসা ছেড়ে নিচে নামার জন্য বলছে তখন ৫.৬ মাত্রার ভূ-কম্পনটি থেমে গেছে। তবু সাকেব বাঁচার আশায় দ্রুত বাড়ির দরজা খুলে অন্যান্য মানুষের সাথে সিঁড়িভাঙার শব্দে যোগ দিল। দালানের বড় বড় এক একটা অংশ ভেঙে পড়ছে তার মাথায় এবং শরীরে -এমন কাল্পনিক অস্থিরতায় এবং উদ্বিগ্নতায় সে দীপ্তির কথা ভুলেই গেল। নিচে গিয়ে যখন বুঝল তারা বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই ভূ-কম্পনটি থেমে গেছে তখন লুঙ্গি পরা লম্বা-চওড়া এক সুদর্শন যুবক জ্ঞানদীপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
আরে ভাই আমি আমার স্ত্রীকে বলছিলাম ছোট্ট একটা প্লেটের চ্যুতিমাত্র ! স্বল্প মাত্রার ভূ-কম্পনে কিছুই হবে না। কে শোনে, কার কথা…
ভদ্রলোকের স্ত্রীকেও যেন তীব্র ভাষায় প্রতিবাদের অনুপ্রেরণা পেয়ে বসল,
অ্যাই ! শুদ্ধভাবে বাজে বকবে না। তুমিই তো লুঙ্গি পরা অবস্থায় বাসা ছেড়ে সবার আগে দৌড় শুরু করলে…
আরেকজন বলল ‘এটা আর এমন কী! লস অ্যাঞ্জেলস-এ আমার বাসাটা ভূমিকম্পে একবার ডানে একবার বামে কাত হয়ে যেত। আমি হাসতে হাসতে বাসাটার ডান-বামের দোলনির তালে তালে পেণ্ডুলিয়ামের মতো নাচতে নাচতে দৌড়ে বাইরে যেতাম। তবে ভাই এই বিল্ডিংয়ের এক্সিট তো একটা সিঁড়ি আর একটামাত্র লিফ। খুবই টেনশনের ব্যাপার !’
অন্যজনের কণ্ঠ আর জনাদশকের কণ্ঠকে ছাপিয়ে গেল,
গ্লাসের পানির ভেতরে পুকুর-জলের ঢেউয়ের মতো কম্পন দেখেই আমার স্ত্রীকে বলছিলাম, ভূমিকম্প হচ্ছে। সে তো ভাই বিশ্বাসই করে না।
তার স্ত্রী তাকে ধমক দিল,
থামো। সবকিছুতে সাহিত্য ঝারার পণ্ডিতি রাখো তোমার। তুমি তো জলের মতো থর-থর কাঁপছিলে-‘দ্যাখো স্বর্ণা, দ্যাখো । এসব কী হচ্ছে ? ‘
‘স্বর্ণা ! তাহলে দীপ্তি কোথায় ?’ সাকেবের মনে প্রশ্নটা আসামাত্র সে দীপ্তিকে খুঁজল। তারপর প্রায় দৌড়ের চেষ্টা করতে করতে উপরে উঠল।

সাকেবের সাথে বাইরে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছিল দীপ্তির। সাকেব বাঁচার জন্য তাকে একা রেখেই দৌড়ে নিচে গেছে এই ভাবনায় দানাবাঁধা অভিমান দীপ্তিকে আর বাসা থেকে বের হতে দেয়নি। একটা চেয়ার টেনে সে দরজার পাশে বুকসেল্ফে হেলান দিয়ে বসেছিল। বুকসেল্ফে একপ্রান্তে যত্ন করে কোরান শরীফ রেখেছিল দীপ্তি এবং ওর মনে হয়েছিল মরে যাওয়ার জন্য এই স্থানটি উত্তম। ক্ষণিকের জন্য সাকেবের প্রতি তীব্র ঘৃণা মনে জেগে উঠলেও, জীবনের হয়তো বা এটাই শেষ মুহূর্ত ভেবে দীপ্তি সাকেবের সাথে কাটানো জীবনের প্রিয়তম মুহূর্তের কথা স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। বিয়ের লগ্ণ, লজ্জামাখা বাসর-রাত, সাকেবের চোখে চোখ রাখার প্রথম কাঁচা অনুভূতি, সাকেবের তরুণ মুখ সবকিছুকে দীপ্তির এত প্রিয় মনে হলো! সে ফিরে যেতে চাইল তার অতীতে। দুজনের একসাথে কাটানো অসংখ্য প্রিয় স্মৃতি মনের কোণে ভিড় করল। সাথে সাথে দীপ্তির চোখের সামনে লাল-লাল রঙের ফোয়ারা খেলা করল। দীপ্তি আরো কিছুক্ষণ তার স্মৃতিগুলোর ভেতরে মাত্র কৈশোরোত্তীর্ণ তারুণ্যের কাঁচা অনুভূতিকে প্রাণপণে আলিঙ্গনের চেষ্টা করল। কিন্তু তার মুখের ডানপাশটা যেন অনুভূতিশূন্য হয়ে গেল এবং মাথার বামপাশে বন্যাধারার মতো এক শীতল জলের স্রোত বয়ে গেল। তারপর সুতীক্ষ্ণ ব্যথার তীব্র ভাষায় কুঁকড়ে গেল দীপ্তি। সাকেবের জন্য একতাল মায়া উথলে উঠল তার হৃদয়ে। লুকিয়ে লুকিয়ে সারাজীবন টাকা বাঁচিয়ে সাকেব তার জন্য হিরার হার কিনেছে; এর ভেতরের সত্য আর মাধুর্য যেন মাত্র দীপ্তির কাছে স্পষ্ট হলো।
সাকেবের ভালোবাসার গভীরতা বোঝার মতো মন, খোদা তাকে কেন দিল না –সেজন্য সে নিজেকে ভৎর্সনা করে সাকেবকে দেখার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠল। সাকেবকে দেখার অনন্ত পিপাসায় দীপ্তির ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। দীপ্তি অনুভব করল মাথার ভেতরের সেই শীতল জলের স্রোত গলগল রক্তের উষ্ণ প্রবাহের তীব্র যন্ত্রনা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে তার সমগ্র অস্তিত্বে। দীপ্তির চোখের আলো যেন নিভে এলো। দীপ্তির মনে হলো দালানটা হয়তো ভেঙে পড়েছে। সে হয়তো ধ্বংসস্তুপের ভেতরে প্রাণ খুঁজে ফেরা এক পতঙ্গ। এই মুহূর্তে তার জীবনের একমাত্র প্রিয় বস্তু সাকেবের দেওয়া হিরার হারটা রক্ষা করতে পারলে তার স্বপ্ন-স্মৃতির সময়গুলো বেঁচে থাকবে –এমন ভাবনায় অনেক কষ্টে প্রায় অবশ হাতদুটো টেনে গলার কাছে আনল সে এবং আলতো করে হারটা খুলে ডানহাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। যেন শক্ত করে হারটা ধরতে পারলেই তার প্রিয় সব অনুভূতি আর সাকেবের সাথে কাটানো জীবনের প্রিয় স্মৃতিগুলো বেচেঁ যাবে। দীপ্তি ধরেই নিল দালানের বাইরে সাকেব নিরাপদ আছে এবং ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে তার গলিত লাশ বের হলে সাকেব দীপ্তির হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরা হারটা খুঁজে পাবে।
‘সাকেব যেন হারটা পায়!’ সে মনে মনে শেষবার প্রার্থনা করল। দীপ্তি মনে মনে, হিরার হার হয়ে সাকেবের কাছে বেঁচে থাকতে চাইল। তার সেই চাওয়া যত বাড়ল অজান্তেই দীপ্তির হাতের মুঠো তত শক্ত হল।
দীপ্তি… দীপ্তি !
সাকেব দ্রুত দরজা খুলেই দীপ্তিকে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখে ব্যঙ্গ করে বলতে গেল,
তোমার জ্যোতিষীকে দেওয়া পঁয়ষট্টি হাজার টাকা…
বাক্য শেষ হওয়ার আগেই কথা হারিয়ে ফেলল সে। ধীরে হাঁটুগেড়ে বসল সে দীপ্তির সামনে। একপাশে ঝুকে পড়া দীপ্তির মাথাটার সোজা করিয়ে দিতে দিতে ডাকল কয়েকবার
দীপ্তি, দীপ্তি… দুঃখিত দীপ্তি -তোমাকে একা রেখে ওভাবে দৌড়ে যাওয়া আমার মোটেও উচিত হয়নি। দীপ্তি ?

ডানহাতের মুঠির মধ্যে শক্ত করে হিরার হারটা ধরতে পারায় দীপ্তির ঠোঁটের কোণে শেষমুহূর্তে যেন সাকেবকেই কাছে পাওয়ার তৃপ্তিময় অদ্ভুত এক হাসি লুকিয়ে ছিল ।


তারপর অ্যাম্বুলেন্স…হাসপাতাল…মিথ্যা ছোটাছুটি। সময়ের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে ‘দীপ্তি’ ক্রমেই একটা শব্দ হয়ে গেল।
অনন্ত নিঃসঙ্গতার এক বিকেলে সাকেব হেঁটে হেঁটে কফি হাউজে পৌঁছাল। ইচ্ছা না করলেও আশেপাশের কন্ঠস্বরে ঝরে পড়া গল্প-হাসিগুলো সাকেবের কানে দূর থেকে ভেসে আসা অশ্রুত শব্দের মতো শোনাল। পাশের টেবিলে বসা এক ভদ্রলোক বলছেন,
ব্যাটা ভণ্ড জ্যোতিষ! আমার বাসা গুলশান লেকের পাশে শুনে আমাকে অবাক করার জন্য বলল, ‘আপনার সামনে মহাবিপদ, কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি আপনার বাসায়, পাশের লেক থেকে রাতে কাঁকড়া উঠে আসে।’
পাশের বন্ধু ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করল,
তারপর ?
আরে কাঁকড়া না ছাই। বৈশাখ মাসে গাছে ঝিনুক উঠতেই পারে। এত বড় খালের আশেপাশে কিছু ঝিনুকও থাকতে পারে। ঢাকা শহরে গাছ না থাকায় ঝিনুকগুলো দেওয়ালে অথবা গ্রিলে উঠে আসে। ছাগলটা ঝিনুকও চেনে না। ওর মতো অন্যদের গর্দভ ভেবে…


অতি মানুষের ভিড়ে মানুষ প্রকৃতির সুন্দর ব্যাপারগুলো নিয়ে অতিলৌকিকতার আড়াল তুলে ব্যবসার ফন্দি করছে । শুধু ঢাকা নয়; হয়তো সমগ্র বিশ্বজুড়ে।
সাকেবের সেখানে বসে থাকতে আর ইচ্ছা করল না। মৃত্যুর সময় দীপ্তির ঠোঁটের কোণে লুকানো মিষ্টি হাসির রেখা এসে আলতো করে যেন সাকেবকে দেখে নিল।

বাসায় এসে আনমনে বারান্দায় পায়চারী করল সে। মনে মনে চাইল দীপ্তি এসে দুষ্টুমি করে পেছন থেকে ওর চোখ দুটো ঢেকে দিক। কিছুই হলো না। দীপ্তি কোথাও নেই! তাদের কক্ষে সযত্নে রাখা হিরার হারটা হাতে তুলে নিয়ে সে নাড়াচাড়া করল কিছুক্ষণ। আবার নাকে লাগল সেই বেলিফুলের ঘ্রাণ। সাকেব যেন আর সহ্য করতে পারল না। সে হারটা ছুড়ে ফেলে দিল লেকের উদ্দেশ্যে। হারটা লোহার গ্রিলে ধাক্কা খেয়ে সজোরে পেঁচিয়ে ফেলল একটা গ্রিল।
না, সাকেব সিন্থিয়াকে মনে করতে চায় না। ঐ গন্ধটুকু পেতে থাকলে সে জানে সিন্থিয়া তাকে অমোঘ আকর্ষণে টানতেই থাকবে।সিন্থিয়াকে সে জীবন থেকে ছুড়ে ফেলতে চাইল সারাজীবনের জন্য। আজ থেকে সে দীপ্তির একান্ত মানুষ হয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাতে চাইল। হারটা ঘৃণাভরে সে পুনরায় খালের জলে ফেলে দিতে উদ্যত হলো। হাতটা গ্রিলের বাইরে নিয়ে সাকেব শেষবারে মতো হারটা খালের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিতে গিয়েও কী ভেবে নিজের মুঠোর মধ্যে আবার শক্ত করে ধরে ফেলল। বেলিফুলের গন্ধ আর সিন্থিয়ার অমোঘ আকর্ষণ সাকেবকে টানতেই থাকল। সিন্থিয়ার ঘোরে আবিষ্ট সাকেবের মনে পড়ল দীপ্তি ওকে একদিন বলেছিল,
ঢাকা শহরে শিক্ষার কোনো মূল্য আছে নাকি?
সাকেব মনে মনে হাসল। তার চারপাশে কত মানুষ ; তাদের সবার ভেতরে সাকেবের মতো ছোট্ট এক রহস্য! একটা পাপ।
একটা কফির মগ বরান্দায় বসানো টেবিলের উপর তখনো সযত্নে রাখা। দীপ্তি এই মগে কফি খেতে পছন্দ করত। দীপ্তির সুন্দর নখগুলোতে বয়স উড়ে এসে জুড়ে বসে ছিল। মগের পরতে পরতে জেগে থাকা তবুও অসাধারণ সেই নখগুলোর অস্তিত্ব বিষণ্ন সাকেবকে অস্থির করে তুললক। সাকেব প্রাণপণে দীপ্তির নখগুলোর অস্তিত্বকে অনুভব করতে চাইল। অস্থিরতা সাকেবের আবেগকে চাড়িয়ে তুলল। ঝাঁপসা অশ্রুসজল চোখে সে মগটা মুখের সামনে তুলে ধরল। যেন দীপ্তিকেই বলল,
তুমি হারিয়ে গিয়ে আরো স্পষ্ট হয়েছ। আর আমি অনেক আগেই আড়ালে চলে গিয়েছি। দীপ্তি! তোমার সাকেব যেদিন এই বাড়ির ভিত্তিতে প্রথম ইট গেঁথেছিল সেইদিন থেকে সে ইটের ফাঁকে ফাঁকে অর্থ উপার্জনের স্বপ্নের সাথে নিজেকে গেঁথে ফেলেছিল। লক্ষ-লক্ষ সাকেবের অন্তরাত্মা ঢাকা শহরের ইট সিমেন্টের ভেতরে প্রোথিত হয়ে কবেই আড়াল হয়ে গেছে! সিন্থিয়ারা আমাদের অমোঘ আকর্ষণে টানতেই থাকে।
হাতে রাখা মগ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সাকেব নির্মোহ মানুষগুলোর মতোই নির্মোহ ভঙ্গিতে খালটায় চোখ রাখল।

টুপ করে একটা শব্দ শুধু। তারপর অসীম নীরবতা। অতি মানুষ এবং তাদের অর্থ উপার্জনের ‘পদ্ধতি’র ভারে ভারাক্রান্ত ঢাকা শহর যদি তার পাপ ওমন ‘টুপ’ শব্দে তার অন্তরালের জীবনকে অদৃশ্য করে দিতে পারত!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *