১) ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, দেশভাগের প্রাক্কালে, খুলনা শহরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা নানা বাড়িতে জীবনের প্রথম কয়টি বছর কাটাবার সময়ে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা নয়, সংগীত ও আবৃত্তিতেও আগ্রহ জন্মে প্রিয়ভাষিনীর।
২) বাংলদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সম্ভ্রান্ত ঘরের নজর কাড়া সৌন্দর্য্যের অধিকারী নারীদের অন্যতম ছিলেন তিনি।
৩) শিশুকাল কেটেছে প্রকৃতির কোলে নানা বাড়িতে। ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর নানা এ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম কংগ্রেস রাজনীতি করতেন। ১৯৫২ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে ঢাকা চলে আসেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের শাসনকালে স্পীকার হয়েছিলেন তিনি।
৪) ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বাংলার আরেক পরিচিত কন্যা যাঁর পিতা কৌলীণ্য ও উচ্চমনস্কতার ঔদ্ধত্যে বা নিজ কর্মহীনতার আত্মগ্লানিতে কিংবা আত্মবিশ্বাসের অভাবে তাঁর মাকে ধরে যখন তখন পিটাতেন। সকলের সামনেই। গৃহে অশান্তি ছিল প্রচুর, এবং তার স্থায়িত্ব ছিল প্রায় সার্বক্ষনিক।
৫) তিনি একজন শিক্ষিত স্ত্রী, দুই-দু’বার বিবাহিতা, সম্ভ্রান্ত গৃহবধূ। পিতৃগৃহের দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে স্নেহের কাঙাল, অনুভবে নাজুক ষোড়শী প্রিয়ভাষিনী তাঁর জীবনে আসা প্রথম পুরুষকেই স্বাভাবিকভাবে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। প্রতারক ভালোবাসার হাত ধরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে মুক্তির খোঁজে সংসার পেতেছিলেন কিছুটা শান্তির অন্বেষায়। কিছুটা নিরন্তর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসে নিজের মত করে সুখী হয়ে বাঁচার আশায়। কিন্তু শান্তি বা সুখ কোনটাই মেলেনি। কারণ তিনি ঘর বেঁধেছিলেন একজন ভুল মানুষের সঙ্গে।
৬) সংসারে তিনি ছিলেন একজন সফল অভিভাবক ও অন্নদাতা। প্রথম স্বামীর ঘরে
তিন তিনটি সন্তানকে যোগ্য শিক্ষা ও যত্নে বড় করে তোলার ধকল মাথায় নিয়েও পূর্ণকালীন চাকরী আর টুইশনি করে ডিগ্রীহীন প্রতারক স্বামীকে পড়ালেখা শিখিয়ে উপার্জনক্ষম ও পেশাদার হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। নিজেও ডিগ্রী পাশ করেছিলেন একই সময়।
৭) তারপরেও সেই সংসার টেকেনি তাঁর। ভেঙ্গে গিয়েছিল। পিতার আলয়ের অনুকরণে মাতার মুখ বুজে অনবরত স্বামীর মার খাওয়া আর যারই হোক ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মতো তেজস্বিনী নারীর পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। ঝড়ের তান্ডবে মুখ থুবড়ে পড়া এক দৃষ্টিনন্দন টিয়া পাখির মতো ভেতরে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে গেলেও বাইরে স্মিত হাসি আর সটান দৃঢ় চেহারা নিয়ে প্রিয়ভাষিনী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সন্তানদের হাত ধরে দৃঢ় পদে অত্যাচারী স্বামীর ঘর ছেড়েছিলেন। স্বামীহীন প্রিয়ভাষিণী এরপর সন্তানদের নিয়ে স্বাবলম্বী ও স্বাধীন হয়ে বেঁচে থাকার জন্যে পাটকলে চাকরী নিয়েছিলেন। সেটা মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগের কথা।
৮) মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে যৌন নির্যাতিতা লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারীদের অন্যতম তিনি।
৯) তিনি ছিলেন একজন মা। ছয় সন্তানের জননী। দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন ১৯৭২ সালে। জনসম্মুখে প্রকাশ করার আগেই, এই অসীম সাহসী নারী তাঁর জীবনযুদ্ধ ও তাঁর ওপর সংঘটিত অমানবিক নির্যাতন সম্পর্কে যাবতীয় কথা দ্বিতীয় স্বামীকে অবহিত করিয়েছিলেন।
১০) স্বশিক্ষিত উঁচুমাপের একজন ভাস্কর ছিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। অবহেলায় ঘরের কোণে, রাস্তায়, ক্ষেতে, ড্রেনের পাশে পড়ে থাকা কিংবা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া কাঠের টুকরো, ধাতব পাত্র, চিনে মাটির ফুলদানি বা আসবাব পত্রের ভাঙ্গা কোনা, পোড়া কাঠের অংশবিশেষ, ছিন্ন রঙিন কাগজ কিংবা প্রাকৃতিক কারণে ঝরে পড়া ফুল বা শুকনো পাতা অথবা মরে যাওয়া গাছের শিকড়, কান্ড, শুকনো ডালপালা ছিল তাঁর ভাস্কর্যের উপকরণ। সাগ্রহে সেসব কুড়িয়ে এনে তাঁর সঙ্গে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করা শৈল্পিক অভিব্যক্তি যোগ করে রচনা করতেন অতুলনীয় ও নান্দনিক সব ভাস্কর্য যা সাদরে বা সসম্মানে প্রদর্শিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন গ্যালারীতে ও বিশেষ প্রদর্শনীতে। তাঁর সুচারু কাজের ভূয়শী প্রশংসা করেছেন দেশের স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীগণ। যেমন তাঁর ভাস্কর্যের অনুরাগী ছিলেন এস এম সুলতান ও হাশেম খানসহ দেশের বহু বরেণ্য শিল্পীবৃন্দ। তাঁর সেইসব অনবদ্য সৃষ্টি আজ শোভা পায় বিভিন্ন শিল্পালয়ে অথবা তারা অলংকৃত করে রাখে বহু সজ্জন ও পরিশীলিত ব্যক্তির ড্রয়িং রুম। পরিণত বয়সে তাঁর এই নবলদ্ধ শিল্পসৃষ্টি এক বিশেষ ক্ষমতার বিরল বহিঃপ্রকাশ ও বড় মাপের শৈল্পিক প্রতিভার বিস্ময়কর বিকাশ বলে সর্বজনে স্বীকৃত। নারী ভাস্করের কথা যদি ওঠেই, পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে এই পেশায় নিজ নাম উচ্চাসনে বসাতে তাঁর চেয়েও আগে এগিয়ে এসেছিলেন নভেরা। কিন্তু নভেরা পেশাগত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তাঁর শিল্প আয়ত্ত করেছিলেন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর বেলায় যেটা ঘটেনি। নিজেকে ঘষে মেজে, গাছ, পাথর আর কাঠ খুঁটে খুঁটে দিনের পর দিন অতিরিক্ত পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় দিয়ে তিনি তাঁর ধারা, তাঁর শৈল্পিক কলা আয়ত্ব করেছিলেন।
১১) মুক্তিযুদ্ধের ২৮ বছর পরে নিজের বিবেকের তাড়নায় স্বতোপ্রণোদিত হয়ে, স্বামী ও পরিণত সন্তানদের কথা মনে রেখেও, এবং বহু স্বজনের প্রচন্ড আপত্তির মুখে তিনি জনসম্মুখে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ওপর যৌন নির্যাতনের কথা সাহসের সঙ্গে সবিস্তারে খুলে বলেন। সমাজের যে স্তরে তাঁর বসবাস, সেখানকার কোন কন্যা বা বধূর যৌন নিগ্রহের কাহিনি সাধারণত শোনা যায় না। শোনা গেলেও নিগৃহিতা বা তার আত্মীয়স্বজন বরাবরই তা পুরোপুরি অস্বীকার করে বসেন বা নিজেদের ক্ষমতাবলে এর অস্তিত্ব মুছে সাফ করে দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্বতোপ্রণোদিত হয়ে নিজের ওপর অত্যাচারের কথা নিজে প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু কতৃক ঘোষিত পদবী অনুসারে প্রিয়ভাষিনী হয়ে পড়েন একজন “বীরাঙ্গনা”। আড়ালে দুষ্ট লোকেরা তাঁকে ‘বারাঙ্গনা’ বলেও ডাকতে শুরু করে।
১২) ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীদের কেবল বীরাঙ্গনা নয়, মুক্তিযোদ্ধার সম্মানের দাবী করেন। মৃত্যুর আগে তিনি নিজে তা অর্জন করলেও সকল বীরাঙ্গনার জন্যে এই সম্মান (মুক্তিযোদ্ধা) আজও প্রসারিত করা হয় নি।
১৩) ২০১০ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ সরকারী পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কা্রে ভূষিত হন।
১৪) ২০১৮ সালের ৬ মার্চ তাঁর নিরন্তর লড়াই করা জীবনের অবসান ঘটে এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।
এইতো গেল সংক্ষেপে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর জীবন ও কর্মের কথা। কিন্তু তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য কী বা কোনগুলো, এবং সমাজে তাঁর অসাধারণ অবদানের মূল ভিত্তিটা, আসল জায়গাটা কোথায়? আজকের বাংলাদেশে, বিশেষ করে নারী সমাজে, প্রিয়ভাষিণীর প্রাসঙ্গিকতা কী এবং কতখানি?
ক) প্রিয়ভাষিণী সামাজিক দায়বদ্ধতার তাড়নায়, নির্যাতিতা মেয়েদের সামাজিক ভীতি থেকে পরিত্রাণ দিতে নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন সমাজের যত অবহেলা, নিন্দা, ঘৃণা, কলুষতা, আবর্জনা ও ধিক্কারের সকল উপাদান। জীবনের এতো ক্লেদ, এতো নিষ্ঠুরতার পরেও সব ময়লা ঝেড়ে সোজা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। মানুষের কাছ থেকে এতো পাশবিক আচরণ পেয়েও মুখ ঘুরিয়ে না নিয়ে আবার ফিরে এসেছেন মানুষেরই কাছে, জীবনের কাছে। তার জীবনে সংগঠিত শত নিষ্ঠুর নির্মমতাই পরবর্তী কালে তাঁর নিজের ও অন্য নারীদের জীবনে বাঁচার রসদ যোগাবার অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর ওপর অকথ্য অত্যাচারে হতাশ হয়ে কখনো জীবন বিমুখ হয়ে পড়েননি। বরং নিপীড়িতা মেয়েদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে অন্য সকল অন্যায় বা অপরাধের মত ধর্ষনও একটি গুরুতর অপরাধ। এরকম অপরাধ সংগঠিত হলে জনসম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন হবে ধর্ষক, শাস্তি পাবে ধর্ষক, সারাজীবনের জন্যে জঘন্য অপরাধী বলে চিহ্নিত হবে ধর্ষক। ধর্ষিতা সম্পূর্ণ নিরপরাধী। সমাজ তাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি, সেটা সমাজ বা রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা, অক্ষমতা।
দুর্বৃত্তরা ছিল তৎপর। ফলে এক অবাঞ্ছনীয়, অপ্রীতিকর, অশোভন অত্যাচারের শিকার হয়েছে নারী। এটা দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। কিন্তু এর জন্যে সে কেন লজ্জা পাবে? সে কেন মুখ লুকাবে? সে কেন গোপন করবে অপরাধী পুরুষের জঘন্য কর্মের কথা? অন্য এক দুস্কৃতিকারীর মহা অপরাধী কর্মের ফলে নারীর সম্ভ্রম বা ইজ্জৎই বা কী করে লুট হতে পারে? ফলে তাঁর মতো অন্য নারীরা, বিশেষ করে সম্ভ্রান্ত ঘরের আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের নারীরা, যদি জনসম্মুখে বেরিয়ে এসে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বা অন্য সাধারণ ধর্ষকদের পাশবিকতা ও নিষ্ঠুরতার কথা খোলামেলা বলতে পারেন, আদালতে সাক্ষী দিতে পারেন, অন্যরা, সমাজে পিছিয়ে পড়া- অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাধর মেয়েরা এগিয়ে আসতে সাহস পাবেন। কেন পাবেন না? তিনি যে তাদের সামনে একজন জ্বলন্ত প্রতিবাদী ও জীবন্ত লড়াকু হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। অন্য মেয়েদের মনে সাহস যুগিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে সত্যভাষনের মধ্য দিয়ে নিজ জীবনের ওপর সংগঠিত অত্যাচারের কথা উন্মোচন করতে। তেভাগা আন্দোলনের তেজস্বিণী নেত্রী রানীমা ইলা মিত্র ও তিনি ছাড়া সমাজের শিখরে বসে আর কোন বাঙালিনারী এমন সাহসিকতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন, বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন তার ওপর পাশবিক শারীরিক অত্যাচারের কথা, এমন শোনা যায় না। এরকম অকুতোভয়ে সকলে সামনে এগিয়ে এলে বোঝা যেত অপরাধটি প্রকৃতই কত ব্যাপক ও কতখানি গভীর। সামাজিকভাবে মুখোমুখি হয়ে কোন বিশেষ সমস্যার সমাধানের চেষ্টার আগে সমস্যার রকম ও পরিধি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনার একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু তাঁর এই দৃঢ় প্রত্যয় ও প্রচন্ড সাহস প্রদর্শনের পরেও আর কেউ তেমন এগিয়ে আসেন নি, বিশেষ করে শিক্ষিতসমাজ ও সম্ভ্রান্ত ঘরের ভেতর থেকে।
একমাত্র চট্টগ্রামের বীরাঙ্গণা রমা চৌধুরী ছাড়া। রমা চৌধুরী ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ করে কক্সবাজার হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে এবং পরে বিভিন্ন কলেজে প্রভাষক হিসেবে বাংলা পড়িয়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মে মাসে পাকিস্তানী সৈন্যরা রমা চৌধুরীদের বাড়ি আক্রমণ করে রমাকে উপর্যুপরি ধর্ষন করে। তারপর গান পাউডার দিয়ে সম্পূর্ণ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। রমা তখন তিনটি শিশু পুত্রের মা। স্বাধীনতার পর তিনি লিখতে শুরু করেন এবং একটি কাগজে অবৈতনিক কাজ করতে থাকেন। পরবর্তীকালে রমা তাঁর আত্মকথা সবিস্তারে লিখে গেছেন ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে। এছাড়া গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস মিলে আরো আঠারোটি গ্রন্থ প্রকাশ করে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে নিজেই নিজের বই ফেরী করে বেড়াতেন। সেটাই ছিল তাঁর শেষ জীবনের জীবিকা অর্জনের একমাত্র পথ। সেটা করেই দীর্ঘ ৮২ বছর পর্যন্ত তাঁর সংগ্রামী জীবনকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর জীবিতাবস্থাতেই তাঁর স্বামী ভারতে চলে যায় এবং তিন পুত্রই মারা যায়। প্রথম দুই পুত্র শৈশবে এবং তৃতীয় পুত্র সাবালক অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। শেষ বয়সে চটগ্রামে তাঁকে দেখাশোনার জন্যে কেউ ছিল না।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ডাকে বা রমা চৌধুরীর বই পড়ে সাড়া দিয়ে বীরাঙ্গনাদের তেমন কেউ এগিয়ে আসেননি এটা সত্য। যদি আসতেন এই কেবল পুরুষ-কৃত জঘন্য অপরাধটির প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির একটি মৌলিক, সার্বিক ও স্থায়ী পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা ও পরিপার্শ্বের চেহারা দেখে অন্যরা হয়তো ভরসা পান নি এগিয়ে আসতে।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিতা চার লাখ নারী আজ কোথায় আছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। যারা বেঁচে আছেন, তাদের এখনও কাউন্সিলিং দরকার। তারা আজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু তাদের বোঝানো দরকার যে, তাদেরও কথা বলতে হবে। এতে তারা সম্মানিত হবেন। তাদের কোনও লজ্জা নেই। এটা কোনও লজ্জার বিষয় নয়।”
খ) ভাস্কর হয়ে তিনি অবহেলায় বা নিষ্প্রয়োজনে ফেলে দেয়া বা কুড়িয়ে পাওয়া সব মূল্যহীন উপকরণ থেকে ঘর সাজাবার, নান্দনিক পরিবেশ রচনা করার, দর্শনীয় বস্তু গড়ার আগ্রহ ও কর্মক্ষমতা অর্জন করেন। এ যেন তার বা তার মত নির্যাতিতা, নারীর শরীর থেকে বাহ্যিক সব কাদামাটি, আবর্জনা ধুয়েমুছে সংসার সরোবরে সতেজ এক পদ্ম হয়ে প্রস্ফুটিত হবার গল্প। এ গল্প যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার- বড় হবার – এগিয়ে যাবার কাহিনি। তিনি জীবন সম্পর্কে কতখানি ইতিবাচক ধারনা পোষন করতেন, কতখানি সৌন্দর্যপ্রিয়তা ছিল তাঁর, সেটা তাঁর সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্ন ও ফিটফাট থাকা, কপালে বড় টিপ, চোখে ঘন কাজল, গায়ে জড়ানো চওড়া পাড়ের তাঁতের শাড়ি ও নক্সা করা পশমী চাদর, অঙ্গে কাঠের বা মাটির বড় বড় গয়নায় ফুটে বেরুতো। নিজের ভেতরে যত জ্বালাই থাকুক, তাঁর সেই স্নিগ্ধ উজ্জ্বল চেহারার দীপ্তি, সাজপোষাক ও অভিব্যক্তি অন্য মানুষদের বিশেষ করে পোড় খাওয়া নারীদের মনে সাহস ও বেঁচে থাকার প্রত্যয় যোগাতে সক্ষম হতো।
গ) জীবনের প্রতি অবিচল বিশ্বাসী, স্বাধীন, সাহসী নারী যিনি রোজগার করে প্রথম স্বামীকে পড়ালেখা শিখিয়ে শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম করে তোলেন, সেই স্বামী যখন তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, তার গায়ে হাত তোলে, পুত্রকন্যার হাত ধরে তিনি স্বামী ও তার সংসার ছেড়ে চলে আসেন। নিজের মায়ের মতো মুখ বুজে স্বামীর পেটানো হজম করেন না। তাঁর এই দৃঢ় মনোভাব, স্বাবলম্বিতা এবং সুচিন্তিত ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা অন্য নারীদের কাছে দৃষ্টান্ত ও পথনির্দেশক হতে পারে।
ঘ) মৃত্যুর আগে চার দশক ধরে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও তাদের যথোপযুক্ত শাস্তির দাবীতে দেশব্যাপী গণসচেতনতা তৈরীর সাহসী ও দুর্নিবার এক সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। জীবনের শেষমুহুর্ত পর্যন্ত সেই লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি।
ঙ) যে মুক্তিযুদ্ধকালের অভিজ্ঞতা তার জীবনকে সম্পূর্ণ এলোমেলো ও তছনছ করে দেয়, দুঃস্বপ্নের মতো কালো অভিজ্ঞতা ঘুমে, জাগরণে স্থায়ী হয়ে যায়, সে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিন্দুমাত্র বিরাগ বা বৈরাগ্য হয়নি তার। বরং জীবনের প্রাপ্তি নিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বাংলাদেশ নামের একটা মানচিত্র আমার সামনে জন্ম নিল, এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।” এই পর্যায়ের দেশপ্রেম, নিঃশর্তভাবে এতোটা নিবেদন, এটাও শিক্ষনীয় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর কাছ থেকে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন