থমকানো আলোর মধ্যে পড়ে আছে মেয়েটা । শরীরের খোলা জায়গাগুলো জুড়ে আঘাত আর নির্মমতার স্পষ্ট চিহ্ন । বোবা মুখ, করুণ চাউনি আর ফুলে ওঠা বিকৃত ঠোঁট নিয়ে তেইশ বছরের মেয়েটা কীরকম যেন কাত হয়ে পড়ে আছে চৌকাঠের সামনে । তার লোকটা এইমাত্র ছেড়ে চলে গেছে তাকে ।
ও আমার দিদি । ওই লোকটার কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো রোমন্থন করছে । অসহ্য রাগে ফুঁসছে । আর আমি ঘরের ভেতর শুয়ে ছটফট করছি, অস্থির, অব্যক্ত একটা যন্ত্রণায় ।
গোলমালটা যে আমাকে নিয়েই, সেটা মাসখানেক যাবৎই বুঝতে পারছিলাম । দিদি যে আমাকে আড়াল করে রাখতে চায়, সেটাও আমার কাছে না বোঝার মতো কিছু ছিল না । অথচ নিজে খুঁটে খাবার কথা বলতে গেলেই দিদি এসে আমার মুখ চেপে ধরতো । কিন্তু আমার অনুভবকে দিদি চাপা দেবে কী করে ?
আসলে দিদির মায়ামমতাই আমাকে আটকে রেখেছে দিনের পর দিন । সেই যে তিন বছর আগে, যেদিন মূর্তিমান দুঃস্বপ্নের মতো একটা লরি এসে আমার পা দুটোকে গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল, তার পর থেকেই এই গোটা পৃথিবীতে দিদি ছাড়া আমার কেউ নেই । জামাইবাবু তো সামান্য একজন দিনমজুর । তবু তার ভরসাতেই দিদি আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিল । কিন্তু কতদিন ?
দিনে দিনে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল আমার কাছে । অনুভব করছিলাম এবার বাচ্চা আসছে বলে জামাইবাবুর ক্ষিপ্ততা সীমা ছাড়াবে । আজ পেটের আগুন মাথায় উঠে এল । তা থেকেই শুরু হল বাঘ-বাঘিনীর লড়াই । কিন্তু আমার যে কিচ্ছু করার ক্ষমতা নেই । তাই নীরব দর্শক হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি ।
চোখের সামনে দেখেছি প্রথমে খিদের জ্বালায় মায়ের ছটফটানি । তার কিছুদিনের মধ্যেই সে জ্বালা ছড়িয়ে পড়ল নিজের গায়ে লাগানো আগুনে । সে যে কী দৃশ্য ! ভাবলে এখনও ঘুমের মধ্যেই চমকে উঠি । শরীরের অর্ধেকের বেশি পুড়ে যাওয়া মায়ের শরীর আর ফিরে এল না তার নিজের ঘরে, নিজের সংসারে ।
কিন্তু ফিরে এল সেই ভয়, আমার জীবনে, নতুন করে । দুই-পা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সেই লরীটার ভয়াবহ শরীর এখনও আমার কাছে জাগ্রত আতঙ্ক । তিন বছর হয়ে গেল, অথচ প্রতি মুহূর্তে এখনও যেন তাড়া করে বেড়ায় সেই ভয় । আমি … আমি …
সেদিন থেকেই আমি অনাথ । শুধু দিদি ছাড়া আমার আর কেউ নেই । পা গেছে, কিন্তু পেটটা তো আছে । সেই ভয়ঙ্কর খিদে মেটানোর এই তো একটাই জায়গা আমার কাছে । তাই আমি কি পারব এই দুমুঠো ক্ষিদে মেটানো অমৃত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে …
না না, এ কী করছি ? আমাকে যে পারতেই হবে । জামাইবাবু ফিরবে দিদি । আমিই তাকে ফিরিয়ে আনব । আমার দেহের অর্ধেকটা তো নেইই, কিন্তু তোমার দেহে যে দুটো প্রাণ !
ঘষটাতে ঘষটাতে এগোলাম । নিশানা এখন সামনের ওই চৌকাঠটা, আর দুটো ব্যাকুল হাত পেরিয়ে যাওয়া ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন