বেজে চলেছে মোবাইল ফোনটা। কিছুক্ষণ পরপর। দুপুর থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্যবার সজল কল দিয়েছে। অবন্তী ফোন ধরছে না। ধরবে না। কখনো না। কোনো দিনও না। আবার ফোন বন্ধও করবে না। অবন্তী শুধু খুদে বার্তা পাঠিয়েছে—আমি আর তোমার সঙ্গে থাকব না; এটা আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এমন বার্তা পেয়েও ফোন দেয়া বন্ধ করছে না সজল। আর খুদে বার্তা তো দিয়েই চলেছে; একটার পর একটা। সে এক কথা—ফিরে এসো অবন্তী। ফিরে এসো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো এরকম বার্তা সজল পাঠানোর চেষ্টা করছে মেসেঞ্জারেও। অবন্তীর কাছে যে তা পৌঁছানো আর কিছুতে সম্ভব নয়; সকালেই সজলকে ব্লক করেছে ও।
অবন্তীর ধারণা, ভয় পেয়েছে সজল; এত অনুনয় করছে কি মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে? না, আইনি-ঝামেলার দিকে অবন্তী যাবে না। কাদা-ছোড়াছুড়ি করলে নিজের গায়েও লাগতে পারে। লোক জানাজানি করেই বা কী লাভ! অবন্তী চায় নীরবে সরে যেতে। অনেক হয়েছে। আর নয়। এবার সব ভুলের ইতি টানতে হবে। অথবা শুরু হবে নতুন ভুলের। কিন্ত ওর পক্ষে যে আর সম্ভব নয়। ধৈর্যের সব বাঁধ ইতোমধ্যে ভেঙে পড়েছে অবন্তীর।
সজলদের বাসায় ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটি অবন্তীর একার; কারো সঙ্গে আলাপ না করে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত একাই নিয়েছে ও। এমনকি ওর দিদিদের সঙ্গেও এ নিয়ে আলাপ করেনি। এখন পর্যন্ত বাবাকে ও কিছু জানায়নি। দিদিদের মাধ্যমে বাবাও কেবল জানতেন যে, সজলের পরিবারের সঙ্গে ও খাপ খাওয়াতে পারছে না। ব্যস, এটুকু। কিন্তু তা যে বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়াতে পারে, অবন্তী কাউকে বুঝতে দেয়নি।
কার কাছে ফিরবে অবন্তী? সজলের প্রতি ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ আর অবশিষ্ট নেই। ওর বেশি রাগ হচ্ছে এই জন্য যে, সজলের মানসিক বা শারীরিক কোনো সমস্যা যদি থাকে তবে সে বিয়ে করতে গেল কেন! বিয়ের আগে সজল ওকে সব কথা জানাতে পারত। অবন্তী আবার এমন ধাতুতে গড়া যে, নিজে থেকে কোনো প্রশ্নও করবে না। রাগে ওর সর্বাঙ্গ জ¦লে গেলেও ও কিছু বলতে পারে না মুখ ফুটে। এটা ওর প্রকৃতি। চাপা-স্বভাবের জন্য ছোটবেলায় মায়ের কত বকুনি খেয়েছে অবন্তী। চেষ্টা করেও পাল্টাতে পারেনি অভ্যেস। তবু প্রথম প্রথম ও আকারে-ইঙ্গিতে সজলকে এটা বুঝিয়েছিল যে, তোমার এমন কাজের প্রায়শ্চিত্ত তোমাকেই করতে হবে। কিন্তু সজলের মধ্যে এর কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না; সে সবসময় নিজের চিন্তায় বিভোর।
সজল চ্যাটার্জিকে অবন্তী বিয়ে করতে চায়নি; করার কোনো ইচ্ছেও ছিল না। শুধু অশীতিপর বাবার মনরক্ষার জন্য সাতপাকে বাঁধা পড়েছিল অবন্তী। এটা কি তার শাস্তি? চেষ্টা তো ও কম করেনি সজলের সঙ্গে মানিয়ে চলার। আর পারল কই! এই ছয়মাসে অবন্তী ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে যে, এমন মানুষের সঙ্গে জীবন পার করা অসম্ভব। প্রতিটি মুহূর্তে যে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এভাবে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। এটা মানুষের জীবন নয়। অন্তত ও এমন জীবনের কথা ভুলেও ভাবেনি কখনো।
অবন্তীর স্বপ্ন ছিল এমন একটি সংসারের যেখানে ও পাখা মেলে উড়বে। ভাবতে অবাক লাগে, সজল ওকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে হানিমুনে পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। নবদম্পতির নিভৃত দিনযাপনের অবকাশ ওকে দেয়নি সজল। পরেও এড়িয়ে গেছে বিষয়টা। এমনকি ফুলশয্যার রাতেও সজল নিজেকে ওর কাছে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করেনি। অবন্তীর ঘোরার নেশা; স্বামীর সঙ্গে দেশে-বিদেশে ঘুরে সেই শখ মেটাবে—মনে মনে ছিল এমন অভিপ্রায়। আজ সব যেন পরিণত হয়েছে প্রহসনে।
শুধু কি বাবা আর দিদিদের খুশি রাখার জন্য অবন্তী সজলের সঙ্গে বিয়েতে মত দিয়েছিল? আজ নিজেকে প্রশ্ন করে বুঝতে পারছে, ইমরানের হাত থেকে ও বাঁচতে চেয়েছিল সেই সময়। অবন্তী যে বড্ড বেশি বাঁধা পড়েছিল ইমরানের বাহুডোরে। সম্পর্কের এমন এক অবস্থায় ওরা পৌঁছে গিয়েছিল যে, সেখান থেকে ফিরে আসা রীতিমতো অসম্ভব বলে ওর মনে হতো তখন। ইমরান শাহরিয়ার ছিল ওর সহপাঠী ও বন্ধু। শুধু বন্ধু বললে কম বলা হবে। বিশেষ বন্ধু। ওদের দুজনের মধ্যে বোঝাপড়ার একটা সম্পর্ক ছিল। ক্যাম্পাসে সবার মুখে মুখে ছিল ওদের কথা। ছিল অনেক মুখরোচক গল্পও।
ভিন্নধর্মী দুটি ছেলেমেয়ের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি মেনে নেয়ার মতো এতটা উদারতা যে আমাদের সমাজের নেই—অবন্তী তা জানত; জানলেও সমাজ নিয়ে ভাবত না ও। সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও প্রথার প্রতি বিরাগ ওর মনে জন্মেছিল জ্ঞান হওয়ার পর থেকে। মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য ও খুঁজে পেত না। অবন্তী এমন হয়েছে হয়তো বিভিন্ন রকমের বই পড়ার কারণে। ছোটবেলা থেকে ওর ছিল বই পড়ার নেশা। তবে এমন মহৎ ভাবনাগুলো কারো সঙ্গে ও শেয়ার করত না। লালন করত নিজের মধ্যেই। অবন্তীর অবাক লাগত, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এত রক্ষণশীল হয় কীভাবে! সহপাঠী অনেকের চোখে ও এমন কিছু দেখত, যেন ওরা দুজন মহাপাপে নিমজ্জিত।
কেউ কেউ আবার ইমরানকে টিট্কারি দিয়ে বলত, সুযোগ যখন পেয়েছিস বেহেশত্ কনফার্ম করার সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া করিস না। ইমরান মনে মনে হাসত। অবন্তীর মতো অবিশ্বাসীর সংস্পর্শে থেকে ইমরানের মধ্যেও অবিশ্বাস ধীরে ধীরে দানা বাঁধে। তুখোড় বিতার্কিক অবন্তীর প্রতিটি যুক্তির কাছে হেরে যেত ইমরান যা ওকে সামাজিক বিধিনিষেধের দেয়াল ভাঙতে প্রলুব্ধ করত। একসময় ঠিকই পূর্বপুরুষের দেয়া বৃত্তের বাইরে চলে আসে ইমরান। খুব গোপনে। তবে এসব ব্যাপারে প্রকাশ্যে কাউকে কিছু বলত না সে।
অবন্তী জানে, ওকে ইমরান ছাড়া আর কোনো বন্ধু বুঝতে পারেনি কখনো, যদিও ওদের গ্রুপে আরো অনেকে ছিল। ইমরানের মধ্যেই ও খুঁজে পেয়েছিল নির্ভরতা আর বিশ্বাস। ইমরানও ওকে ভালোবেসেছিল। মনপ্রাণ উজাড় করে। সে ভালোবাসায় ছিল না কোনো খাদ। কিন্তু অবন্তীর বাবা আশুতোষ আচার্য তো কখনো মেনে নিত না ওদের সম্পর্ক। মুসলমান তো দূরের কথা, স্বগোত্রীয় ব্রাহ্মণ ছাড়া কোনো হিন্দু ছেলের কাছেও তিনি কন্যা সম্প্রদান করতেন না—অবন্তী তা ভালো করে জানত। জানত বলেই হার্টের রোগী বাবার মনে কোনো আঘাত দিতে চায়নি ও। নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, ভালো-লাগা মন্দ-লাগাকে ফুৎকারে উড়িয়ে ও বাবাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল তখন—বাবার পছন্দ ওর পছন্দ।
এ কথা বলার সময় ইমরানের মুখাবয়ব মনে করে ওর বুক কি একবারের জন্যও কেঁপে ওঠেনি!
বাবা ও দিদিরা বেশ প্রসন্ন হয়েছিল ওর সিদ্ধান্তে। এতদূর পড়াশোনা করেও যে ওর মাথা বিগড়ে যায়নি, তা দেখে আত্মীয়স্বজনের মুখেও ছিল অবন্তীর জয়জয়কার। ও মনে মনে হিসেব কষেছিল, এতগুলো মানুষের অনুভূতিকে অগ্রাহ্য করে কেবল নিজের ভালো-লাগাকে প্রাধান্য দিলে বাকি জীবন হয়তো কষ্ট পেতে হবে। কাউকে পাশে পাবে না দুর্দিনে। তাছাড়া প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে প্রতিকূল স্রোতে ভাসার মতো মনের জোর অবন্তীর তখন ছিল না। এখনো যে আছে তা ও বলতে পারে না। অবন্তী শুধু বুঝতে পারছে, অনেক চেষ্টা করেও নিজের সঙ্গে নিজে আর কিছুতে পেরে উঠছে না ও। ওর সমস্ত প্রাণশক্তি যে নিঃশেষ হয়ে গেছে।
আশুতোষ বাবু কট্টর ব্রাহ্মণ। ওর দুই দিদিকেও তিনি দেখে-শুনে সমর্পণ করেছেন সাচ্চা ব্রাহ্মণ ছেলের হাতে। কানা হোক, বধির হোক, খোঁড়া হোক, পেশায় যত নিচু হোক, কন্যা সম্প্রদানের জন্য পাত্রকে ব্রাহ্মণ হতেই হবে; এখানে চলবে না কোনো ছাড়। তিনি বিশ্বাস করেন রক্তের বিশুদ্ধতায়। বর্ণাশ্রম প্রথার অন্ধ সমর্থক। বর্ণে বর্ণে মিলতেই হবে।
অবন্তী ওর দিদিদের চেয়ে যোগ্যতায় বেশ এগোনো। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে বোনেরা পড়াশোনা ততটা করতে পারেনি। তারা সবাই গৃহিণী; ব্যস্ত স্বামী-সন্তান-সংসার নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দেয় অবন্তী। স্বগোত্রের মধ্যে ওর জন্য পাত্র পাওয়া তাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। এজন্য চিন্তার সীমা ছিল না ওর বাবার।
দৈনিক পত্রিকার পাতায় ব্রাহ্মণ-পাত্রের বিজ্ঞাপন দেখে অবন্তীর বিয়ের কথাবার্তা শুরু। তারপর চলে পাত্র-পাত্রীর কুষ্ঠি-ঠিকুজি-পেশা-শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই ও বাছাই। মিলেছিল সবকিছু। পুরোহিত জানিয়েছিল যে, একেবারে রাজযোটক। অনেক সুখী হবে ওরা। অবন্তীর বাবা একরকম তাড়াহুড়ো করে ঠিক করেছিলেন আশীর্বাদ ও বিয়ের দিন। অতি নিকটে ভালো একটি লগ্নও পেয়ে গেলেন সৌভাগ্যবশত। ব্রাহ্মণ ছেলের মধ্যে যোগ্য পাত্র দুর্লভ বলে তিনি ওই শুভলগ্নটি মিস করতে চাননি। আশুতোষ বাবু একরকম সজলের মা-বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করেছিলেন তখন।
সজলের মা-বাবা সময় চাইলেও আশুতোষ বাবু বেশি সময় দিতে রাজি ছিলেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এমন সুপাত্র হাতছাড়া হলে সহজে আর পাওয়া যাবে না। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অবন্তীর বয়স তো আর কম হয়নি। ওর এই বয়সে তিন সন্তানের মা হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। অবন্তীকে তিনি বুঝিয়ে বলেন, মা, এমন যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলে ব্রাহ্মণের মধ্যে খুব একটা নেই; বাংলাদেশে আমাদের সমাজটা যে বেশ ছোট। ওর দিদিরাও ওকে বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে রাজি করায় তখন। ওর দ্বিমত করার আর তেমন কোনো সুযোগ ছিল না।
অবন্তী বিয়ের আগে একবার দেখেছিল সজলকে। কথাও হয় সে একবারই। আশীর্বাদের দিন। আগে তো নয়ই, আশীর্বাদের পরও সজল ওকে ফোন করেনি কখনো। ও ফোন করতে যাবে কোন দুঃখে! অবন্তী ভেবেছিল, সজল লাজুক; বিয়ের পর সব নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে। তাই এ-নিয়ে কথা বাড়ায়নি। তবে একটি মারাত্মক আঘাত পেয়েছিল ও আশীর্বাদের ঠিক দুইদিন আগে। তখন ভেবেছিল, এ-বিয়ে ভেঙে দেবে। শুধু বাবার কথা ভেবে ও তখন সিদ্ধান্তটি নিতে পারেনি।
অবন্তীর অফিসে এসেছিল সজল ও তার বাবা। ওকে দেখতে নয় ঠিক, তারা এসেছিল ওর চরিত্রের খোঁজখবর নিতে। সহকর্মীদের কাছ থেকে ওর সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে। তখনই ও বুঝেছিল, সজলের ব্যক্তিত্ব কত তলানিতে। তার ওপর ফেসবুকে ইমরানের সঙ্গে ওর ছবি দেখে সজলের বাবা ওই রাতে ফোন করে ইমরান সম্পর্কে যখন জানতে চায়, তখন বিগড়ে যায় ওর মেজাজ; জলে ওঠে ব্রহ্মতালু। তৎক্ষণাৎ ও বড়দির কাছে ফোনে কান্নাকাটি করে বলেছিল, দিদি, এখানে বিয়ে হলে আমাকে নিশ্চিত অনেক কষ্ট পেতে হবে। ওদের সঙ্গে আমার যাবে বলে মনে হয় না। আমার ভয় করছে ভীষণ। এখনো সময় আছে। ভালো হয়—আর না এগোনো। ওদের আশীর্বাদে আসতে নিষেধ করে দাও। দিদির একই অনুরোধ—বাবাকে আঘাত দিস না। বাবার যদি কিছু হয়ে যায়! দিদির কথা শুনে চোখ দিয়ে কেবল বয়ে যায় জলের ধারা; কিছু বলতে পারে না ও।
আজ অবন্তীর মনে হচ্ছে, কেন কঠিন হতে পারল না সেদিন। তাহলে ওর জীবনে নেমে আসত না আজকের এই বিপর্যয়। বাবার জন্য সজলের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েছিল অবন্তী—একথা সবাই জানে। ও তো মেনে নেয়ার সব রকম চেষ্টাই করেছিল। বিয়ে না হয় করল, কিন্তু সংসার যাপন? মনরক্ষার জন্য কি সংসার করা সম্ভব! নারী-পুরুষের সংসার তো আর রেলগাড়ির বগি নয় যে, ইঞ্জিনের সঙ্গে জুড়ে দিলে টানতে টানতে নিয়ে যাবে।
বিয়ের পর অবন্তী চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি—স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে মানিয়ে চলতে। কিন্তু সজলের আচরণ ক্রমে ওর কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। সব সময় একটা বিরক্তির ভাব। চোখে-মুখে রাশভারী গাম্ভীর্য। রাতে এক বিছানায় ঘুমালেও সজলের কাছ থেকে ও কোনো সাড়া পেত না। খেয়াল করত, সজল ফেসবুক চ্যাটিংয়ে বা মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত। এসব নিয়ে শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করলেও কোনো ফল হয়নি। উল্টো শাশুড়ি ওকে দোষারোপ করে বলত, তুমি কেমন মেয়ে যে স্বামীকে বশে আনতে পারছ না। চাকরির চাপ, সাংসারিক জটিলতা, অসুস্থ বাবাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা, ইমরানের জন্য উদ্বেগ আর অমনোযোগী স্বামীকে নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিল অবন্তী। খুঁজছিল মুক্তির উপায়। সমাজ ও আত্মীয়পরিজনের কথা ও আর ভাবতে পারছিল না।
অবন্তী এখন টের পাচ্ছে—এবার ও নিঃশ্বাস নিতে পারবে প্রাণ খুলে। বাবাকে কি একটা ফোন দেবে! নাকি বড়দিকে ফোন দিয়ে জানাবে ওর এই সিদ্ধান্ত। দিদি এবং জামাইবাবুরা কিছু কিছু জানে। দিদিদের মারফত বাবার কানেও কথাটা তুলেছিল ও। সবাই অনুমান করছে যে, অবন্তী ডিভোর্স চায়। নিজের কাছে ও পরিষ্কার; ছাড়াছাড়ির বিষয়ে ওর কোনো সংস্কার নেই। অবন্তী জানে, আজকাল অহরহ ডিভোর্স হচ্ছে হিন্দু মেয়েদের। শাখা-সিঁদুর পরে স্বামীর মঙ্গলকামনায় জীবন পার করার ব্রত-পালনের যুগ আর নেই। শত কষ্ট বুকে নিয়ে স্বামীর ঘর ছাড়ার কথা ভাবতে না পারার দিনও শেষ। স্বাবলম্বী মেয়েরা প্রতিবাদী হয়ে উঠছে দিকে দিকে। ভেঙে দিচ্ছে এতকালের সংস্কারের দেয়াল। অথচ ওর শ্বশুর-শাশুড়ি ও বাবা-দিদিরা এখনো প্রাচীন বিশ্বাসে অটল। সবার ধারণা, ব্রাহ্মণ-মেয়েরা সংসার ভাঙে না কখনো। ব্রাহ্মণের বিয়ে ছেলেখেলা নয়।
ওর ব্যাপারে বাবার মনে অনেক কষ্ট—অবন্তী নিজেই তা উপলব্ধি করেছিল। বাবা তো বেড়াতে এসে স্বচক্ষে দেখে গেছেন তাঁর গুণধর জামাইয়ের কাণ্ডকীর্তি। দেখেছেন মা-মরা মেয়ের চোখের জল। অনুভব করেছেন ওর ভেতরে চেপে রাখা কষ্ট। আর বাবার চোখে মেয়ে দেখেছে একটা অপরাধবোধ—মেয়ের জীবনকে তাড়াহুড়োয় ছারখার করে দেয়ার অপরাধ। অবন্তী মুখে কিছু বলেনি তখন, পাছে বাবা দুশ্চিন্তা করেন।
বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে অবন্তী একবারও যোগাযোগ করেনি ইমরানের সঙ্গে। দেখা তো দূরের কথা, কথাও বলেনি আর। এমনকি মোবাইল নম্বর পর্যন্ত ও পরিবর্তন করে ফেলেছিল। অবন্তী ভালো করেই জানে, ওর পক্ষে দ্বিচারিণী হওয়া অসম্ভব। নিজের প্রতি ওর বিশ্বাস অগাধ। তবে মমর কাছ থেকে ও ইমরানের সব খবর পেতো; এমনকি না চাইলেও।
ইমরান যে বিবাগী হয়ে ঘুরছে তা শুনে ও কষ্ট পেয়েছিল ভীষণ। অবন্তীর আজও স্পষ্ট মনে আছে, ইমরান ওকে বারবার বলত, তোমার ধর্ম নিয়ে আমি কখনো প্রশ্ন তুলব না। আমার মা-বাবাকেও তা বলে দেব। তারাও এ নিয়ে কিছু বলবে না। ও হেসে বলত, ভালোবাসা জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে। আমাদের ভালোবাসা কোনো কিছুর জন্য হারিয়ে যাবে না। আর আমার কাছে ধর্ম কোনো বিষয় নয়। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি ঠাকুরদেবতার কাছে মাথা নোয়াইনি। আমার বিশ্বাস নেই ভগবানে। সত্যি বলতে কী, বাবার সব কিছু পছন্দ হলেও ধর্মীয় গোড়ামি আমি মেনে নিতে পারিনি কখনো। আমার ধর্মবিদ্বেষের সূত্রপাত হয়তো এ কারণে।
অবন্তী ভাবছে, ইমরানকে কি একটা ফোন দিয়ে সব বলবে। নম্বর তো ঠিক মনে আছে ওর। পরক্ষণে এই ভাবনা উড়িয়ে দেয় ও। না। কখনো নয়। ইমরানের কাছে ও এখন একটা প্রতারক ছাড়া আর কিছু নয়। হয়ত ইমরান এতদিনে ওকে ঘৃণা করতে শিখে গেছে। অথচ অন্তর্যামী বলছে, ইমরান ওকে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। যেমন ও কখনো ভুলতে পারবে না ইমরানকে। ওদের আত্মা যে অভিন্ন সুতোয় বাঁধা।
শীতের রাত। এখন সময় প্রায় আটটা। কী করবে অবন্তী? অনেক ভেবেচিন্তে মমকে ফোন দেয় ও। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে—আমি আসছি। আজ রাতটা তোর এখানে থাকব। মম বিস্তারিত জানতে চাইলে অবন্তী বলে, এসে তোকে সব বলব। আর শোন, আমার জন্য একটা সাবলেট বাসার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি আর সজলের সঙ্গে থাকছি না।
মম অবন্তীর দাম্পত্য-সমস্যার কথা কিছু কিছু জানত। মমকে ও নিজেই জানাত। মমর টিকাটুলির বাসা ওর অফিস থেকে বেশি দূরে নয়। বিয়ের মাস খানেক পর একদিন এসে মমকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছিল অবন্তী; তখন বলেছিল, ইমরানের মনে দুঃখ দেয়াতে আমি বোধ হয় জীবনে সুখী হব না। মম কিছু না বলে ওকে সান্ত্বনা দিয়েছিল। বলেছিল ধৈর্য ধরতে।
ইমরানের সব খবর জানার পর অবন্তী বলেছিল, আমি যদি ফিরে আসি, ইমরান কি আমাকে গ্রহণ করবে? মম তখন জানায়, ইমরানের জীবনে তুই ছাড়া আর কোনো মেয়ে আসবে না কখনো। সে তোর জন্য বাকি জীবন একা একা কাটিয়ে দেবে। কয়েকদিন আগে ইমরানের সঙ্গে কথা হয়। তখন সে বলেছিল, তার মা-বাবা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদেশে চলে যাবে। স্কলারশিপও একটা পেয়ে গেছে। একবার যেতে পারলে আর কোনোদিন নাকি সে দেশে ফিরবে না।
ওই কথাগুলো মমর মুখে শুনে অবন্তী দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল কেবল। আর ওর চেহারায় ফুটে উঠেছিল গভীর উদ্বেগ।
মমর বাসায় এসে অবন্তী নিজেকে এবারও সংবরণ করতে পারে না। বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে—আমাকে দিয়ে সংসার হবে না রে! আমি কিছুতেই পারব না! এত কষ্ট আমার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব নয়। আমার জীবনটা এমন হলো কেন? আরো কত প্রশ্ন……
মম অবন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। অবন্তী বারবার একই কথা বলে—ইমরান কেন আমাকে তখন আটকাল না। যদি সত্যিই ও আমাকে ভালোবাসত, আমাকে কেন এভাবে ছেড়ে দিল। মম সজল ও তার মা-বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেও অবন্তী ওই প্রসঙ্গে যেতে চায় না; ইমরানের কথা কেবল জানতে চায়। মম জানায়, ইমরান এখন ওদের কাছাকাছি থাকে। গতমাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করার পর সজলের পরিবার এখানে উঠেছে।
ওরা দুজন যখন ইমরানের গল্পে মশগুল তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে। মম অবন্তীকে দরজা খুলে দিতে বলে নিজে ভেতরে চলে যায়। বেডরুম থেকে ভেসে আসে মমর ছয়মাস বয়সী মেয়ের চিৎকার। দরজা খুলে অবন্তী। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না ও। স্বপ্ন দেখছে না তো! ছুঁয়ে দেখে বিশ্বাস হলো যে, ওর সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে ইমরান শাহরিয়ার। একগুচ্ছ ফুল হাতে দাঁড়িয়ে। বিমর্ষ মুখমণ্ডলে একরাশ হাসি। ভাবটা এমন, মাঝে ওদের দুজনের মধ্যে কিছু হয়নি। সব আছে আগের মতোই। বিচ্ছেদ যেন আরো শাণিত করেছে তাদের সম্পর্ককে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবন্তী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। দু’চোখ ফেটে অশ্রু ঝরে। ইমরান বাড়িয়ে দেয় তার বলিষ্ঠ দুই বাহু। সেই আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে দেয় অবন্তী; বলে, তোমাকে ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না। তুমি এভাবে আমাকে ধরে রেখো। সারা জীবন। আমি আর কিছু চাই না।
ইমরান অবন্তীকে জড়িয়ে ধরে গভীর আলিঙ্গনে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন
Khuuub bhalo laglo. Tobe sab Abanti r janyo Imran apekhha kore thake na hoyto….